পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

জংলি মাংস

  • 27 April, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 1467 view(s)
  • লিখেছেন : শামিম আহমেদ
শুকনো লাল। লঙ্কার নাম কেন ‘লঙ্কা’ তা নিয়ে বহু তত্ত্ব খাড়া করা যায়। উবশ্যই অস্তিত্বের সঙ্কটকে বাঁচিয়ে। সোনার লঙ্কার নাম এ দেশের বহু প্রাচীন সাহিত্যে পাওয়া যায়। কিন্তু যে লঙ্কা ঝাল, যা মানুষকে দু বার জ্বালায়—এক বার খাওয়ার সময় আর অন্যটা মলত্যাগের কালে, সেই লঙ্কা হল ঝাল বা কটু।

ওমলেট নয়, মাংস রান্নার এক প্রণালী বলব। অস্তিত্বের যে অর্থহীনতা, তা ক্ষণকালের জন্য ভুলে যাওয়া যাক। চিজের বদলে নেব ঘি। খাঁটি গব্য ঘৃত। তবে এই রান্নার সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ মশলা হল লঙ্কা।। শুকনো লাল। লঙ্কার নাম কেন ‘লঙ্কা’ তা নিয়ে বহু তত্ত্ব খাড়া করা যায়। উবশ্যই অস্তিত্বের সঙ্কটকে বাঁচিয়ে। সোনার লঙ্কার নাম এ দেশের বহু প্রাচীন সাহিত্যে পাওয়া যায়। কিন্তু যে লঙ্কা ঝাল, যা মানুষকে দু বার জ্বালায়—এক বার খাওয়ার সময় আর অন্যটা মলত্যাগের কালে, সেই লঙ্কা হল ঝাল বা কটু।

October 4

Still working on the omelet. There have been stumbling blocks. I keep creating omelets one after another, like soldiers marching into the sea, but each one seems empty, hollow, like stone. I want to create an omelet that expresses the meaninglessness of existence, and instead they taste like cheese. I look at them on the plate, but they do not look back. Tried eating them with the lights off. It did not help. Malraux suggested paprika.

---জাঁ পল সার্ত্র

রান্নার প্রধান চার মশলাকে ‘শিষ্ট চতুষ্টয়’ বলা যেতে পারে।

হলুদ/হলদি, লঙ্কা/মরিচ (চিলি), জিরে/জিরকা ও ধনে/ধনিয়া।

এ যেন অনেকটা ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য-শূদ্রের মতো ব্যাপার। হলুদ ব্রাহ্মণ, সাত্ত্বিক মশলা—ব্যঞ্জনের মস্তিষ্ক সচল রাখেন। লঙ্কা রাজসিক ক্ষত্রিয়, তিনি মাইনাস বিশ ডিগ্রি ঠান্ডায় রাষ্ট্র নামক ব্যঞ্জনকে পাহারা দেন, তাঁর উগ্রতা ও Hot-তা বিভিন্ন ডিগ্রির। জিরকা হলেন বৈশ্য মানুষ, তরকারিতে ভাল মতো তাঁর প্রভাব-প্রতিপত্তি টের পাওয়া যায়। আর ধনিয়ার কাজ ওই তিন মশলাকে সেবা করা। ওই তিন মশলাকে সেবা মানেই ব্যঞ্জন-রাষ্ট্রের সেবা। শিষ্ট চতুষ্টয়ের বাইরে যারা বাস করেন, যেমন কলৌঞ্জি, এলাচ, জায়ফল, গোলমরিচ, লবঙ্গ, জয়িত্রী, দারুচিনি, তেজপাতা প্রমুখ সব হয় ম্লেচ্ছ, নয়তো বহিরাগত কিংবা তা ধিন-ধিনা।

ওমলেট নয়, মাংস রান্নার এক প্রণালী বলব। অস্তিত্বের যে অর্থহীনতা, তা ক্ষণকালের জন্য ভুলে যাওয়া যাক। চিজের বদলে নেব ঘি। খাঁটি গব্য ঘৃত।

তবে এই রান্নার সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ মশলা হল লঙ্কা।। শুকনো লাল। লঙ্কার নাম কেন ‘লঙ্কা’ তা নিয়ে বহু তত্ত্ব খাড়া করা যায়। উবশ্যই অস্তিত্বের সঙ্কটকে বাঁচিয়ে। সোনার লঙ্কার নাম এ দেশের বহু প্রাচীন সাহিত্যে পাওয়া যায়। কিন্তু যে লঙ্কা ঝাল, যা মানুষকে দু বার জ্বালায়—এক বার খাওয়ার সময় আর অন্যটা মলত্যাগের কালে, সেই লঙ্কা হল ঝাল বা কটু।

সেই থেকে কাঁদায় এ ভারতকে লঙ্কাচাষ

ছ মাস জিভকে আর অন্যটাকে মিহি ছয় মাস।

ধর্মসাহিত্যে ‘লঙ্কা’ শব্দ থাকলেও ‘চিলি’ ছিল না। শাস্ত্রের বাইরে ছিল লঙ্কা ধান; বহু পুরনো। তবে সেটি ধানই, ‘ধানি লঙ্কা’ নয়। ‘লঙ্কা’ শব্দের ধাতু যে ‘রম’ তার অর্থ হল আসক্তি। আসক্তির দহন হল লঙ্কাদহন। তবে লঙ্কাকে ‘মরিচ’ও বলে থাকেন বহু মানুষ। মির্চ মসালা। লাল মরিচ, হারা মরিচ। মরিশাস দ্বীপ থেকে এই নাম কিনা, সেই প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। মরিচের ঝোলের কথা পাওয়া যায় বহু লেখায়। চৈতন্য চরিতামৃতে চই-মরীচের কথা আছে। চই/ চৈ হল লতাবিশেষ ও তার মূল। চৈতন্য-চরিতামৃতের লেখক চই-মরীচ সুক্তার কথা বলেছেন। চই বা চৈ ছিল তরকারিতে ঝাল দেওয়ার অন্যতম উপকরণ। অন্তত অবিভক্ত বাংলায়। কটু বা ঝাল ছাড়া রান্নার কথা তো ইদানীং কালে ভাবাই যায় না! লঙ্কা মানে চিলি এক কালে ছিল না ভারতে, অথচ এ দেশে এখন লঙ্কা ছাড়া ব্যঞ্জন তৈরি হয় না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের যে কোনও দশ জন পর্যটককে ভারতীয় খাবার সম্পর্কে জিগ্যেস করলে ন’জন বলবেন একটিই শব্দ chillies। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ভারতীয় খাবার ও লঙ্কার বিয়ে হয়েছে এই সে দ্দিন, মানে গত হপ্তায়। তাহলে ঝাল-স্বাদের জন্য কী ব্যবহার করা হত? একটি তো চৈ। আরও বহু কিছু ছিল, আছে—গোলমরিচ, পিপ্পল/পিপ্পলি ইত্যাদি।

পৃথিবীতে লঙ্কার ব্যবহার বেশ পুরনো। খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ হাজার সালে মেক্সিকোতে লঙ্কাবাবুর জন্ম বলে পণ্ডিতরা জানিয়েছেন। ভারতে এসেছে এই সেই দিন, এখন থেকে মাত্র ৪৫০ বছর পূর্বে। না, ইউরোপ থেকে আসেনি। গোয়ায় প্রথম লঙ্কা এনেছিলেন পর্তুগিজরা। সেই ভারতে এখন সবথেকে বেশি লঙ্কা উৎপাদন হয়। ভারতীয়রা সবচেয়ে বেশি লঙ্কা খান। লঙ্কা-রপ্তানিকারক দেশ হিসাবে ভারত এখন শীর্ষস্থান দখল করেছে। দেশের মোট লঙ্কার ৭৫ ভাগ হয় অন্ধ্রে। ভারতীয় লঙ্কার ২০০ রকম প্রজাতি আছে, তার মধ্যে ৩৬-টি প্রজাতি হয় অন্ধ্রপ্রদেশে। সব যে খুব ঝাল বা ঝালহীন, এমন নয়। ঝালের মাত্রাভেদ আছে। ধানি লঙ্কা যেমন বেশ ঝাল তেমনি কাশ্মীরি লঙ্কায় ঝাল প্রায় নেই। অন্ধ্রপ্রদেশের গুন্টুরকে লঙ্কার পীঠস্থান বলা হয়। যাঁরা লঙ্কা ভালবাসেন তাঁদের তীর্থক্ষেত্র হতে পারে গুন্টুর। কালো তুলোট মাটিতে স্বর্গীয় লঙ্কা ফলান অন্ধ্রের চাষীরা। সোনার লঙ্কা।

ব্যঙজনে দেওয়া ছাড়াও লঙ্কার নানা রকমের পদ হয়, হয় আচার। ভূত ঝালোকিয়া বোধ হয় লঙ্কার রণতুঙ্গে। বিশ্বকাপজয়ী ক্যাপ্টেন। অন্যান্য খেলোয়াড়দের নানা রকম নাম আছে, সে সব পরে বলা যাবে কখনও।

যে কথাটা বলছিলাম, পর্তুগিজরা ভারতে লঙ্কা এনেছিলেন ব্রাজিল থেকে। সবই কিন্তু কালো মানুষদের দেশ। বর্ণবিদ্বেষী বলে না দাগালেই হল। প্রাচীন নথি বলছে, ভাস্কো ডা গামা গোয়ায় অন্তত তিন ধরনের ‘মরিচ’ (চিলি নয়) দেখেছিলেন—পেরনামবুকো মরিচ, কালো গোলমরিচ এবং লম্বা ‘পিপলি’ মরিচ। পিপ্পলি বা পিপ্পলের কথা মহাভারতে পাওয়া যায়। নলের পাকদর্পণে এই মশলা দিয়ে মাংস রান্নার কথা আছে। লঙ্কা দিয়ে মাংস--এই রকম একটা রেসিপি বর্তমান লেখার লক্ষ্য। রান্নাটা বেশ সহজ ও সরল। মেলা ঝামেলা নেই, উপকরণও খুব কম লাগে। তবে ‘শুকনো লাল লঙ্কা’ লাগবেই। পর্তুগিজরা ভারতে লঙ্কা আনার পরে উত্তর ভারতে লঙ্কা প্রচার হতে প্রায় ২৫০ বছর সময় লেগে গেছে। মারাঠাদের হাত ধরে দিল্লি ও আগ্রায় লঙ্কার ব্যবহার হয় এই সেদিন, মুঘল যুগের শেষ দিকে। ততদিন লঙ্কাহীন ছিল উত্তর ভারত অর্থাৎ হিন্দুস্তান। তবে দক্ষিণে ছিল তার রমরমা। লঙ্কার ধাতু হল ‘রম’ যার অর্থ রতি, রমণ, আসক্তি। রাম লঙ্কা জয় করেছলেন। তখন তিনি বনবাসে ছিলেন।

বুনো মাংস কিংবা ‘জংলি মাস’ বা জংলি মাংস আজকের রেসিপি। লাগবে মাংস (লাল), ঘি, নুন ও লঙ্কা।

নুন-মরিচ কথাটা কাঁচা আম খাওয়াতে খুব কাজে লাগে, মরিচ এখানে শুকনো বা কাঁচা লঙ্কা, গোল মরিচ নয়। শোনা যায়, এই লঙ্কার আঁতুড়ঘর নাকি বলিভিয়ায়। একটা ছোটো লঙ্কাতে অজস্র বীজ থেকে অবাক লাগে। কেন এত বীজ থাকে? অবশ্যই প্রজননেন জন্য। তাই বলে এত? খেয়ে হজম করতে পারা যায় না। লঙ্কার এই বীজসমূহ পাখিরা দূর দেশে ছড়িয়ে দিত, লঙ্কা ছড়িয়ে পড়ত দূর দেশে। বীজেও ঝাল থাকে, তবে এই বীজ ঝাল বলে কীট পতঙ্গরা নষ্ট করতে সাহস পায় না। তাতে প্রজননে সুবিধা। না, সবটা ইকো ফ্যান্টাসি নয়; প্রকৃতির লীলা তো আছেই। আল্লাহ কে বোঝে তোমার অপার লীলে! লালন লিখেছিলেন, তিনি শেষের বহু দিন বন জঙ্গলে বাস করেছেন।

বনে জঙ্গলে শিকারে যেতেন রাজা বাদশারা। রাজপুতরাও যেতেন। শিকারে গেলে হরেক রকম মশলা বেঁধে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই ‘জংলি মাস’ তৈরি হত খুব কম মশলা দিয়ে। কিন্তু এই পদ একবার খেলে ভোলা যাবে না। যাঁরা খেয়েছেন, তাঁদের দু একজনকে এই লেখায় ট্যাগ করে দিলাম।

আধ কেজি ছাগলের মাংস নিন। ‘মাটন’ বলবেন না, ওটা ভেড়ার মাংস; ‘গোট মিট’ বলতে পারেন। চার চামচ ঘি (বড়, টেবিল চামচ), ১৫-২০ টা শুকনো লাল লঙ্কা, আধ কাপ জল, পাহাড়ি নুন বা রক সল্ট (স্বাদ মতো)।

আজকাল বাজারে পাহাড়ি নুন পাওয়া বেশ শক্ত। মল-টলে গুঁড়ো করে রক সল্টের নামে যা সব বিক্রি হয় তার সঙ্গে সাদা নুন মেশানো থাকে। সাদা চিনি ও সাদা নুন বেশ বিস্বাদের ও বিষাদের। পাড়ার মুদির দোকানে রক সল্ট (বিট নুন)-এর ডেলা কিনে শিলে পিষে নিন। ভাল ঘি না পেলে মাখন ব্যবহার করুন।

এই বার রান্না। প্রথমে ঘি গরম করুন। তপ্ত ঘিয়ে মাংস দিন, ১০ থেকে ১৫ মিনিট সাঁতলান। যখন লাল-মাংস বাদামি হয়ে আসবে, তখন নুন ও লঙ্কা মিশিয়ে দিন। তার পর রান্নার পাত্র ঢেকে দিন, অল্প আঁচে রাখুন আধ ঘন্টা মতো। তার পর ঢাকনা খুলে অল্প অল্প করে জল দিন। সেদ্ধ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। মাংস ভুনা বা ভাজা হবে না, আবার কারিও নয়। মাংসের গায়ে-গায়ে নুন-ঘি লেগে থাকবে, লঙ্কা থাকবে তার নিজের মতো। হনুমানের মতো লঙ্কা দহন করতে যাবেন না, তাতে মুখ পুড়বে।

ঝাল স্বাদ মানে কটু স্বাদ। ঝাল হল জ্বালাকর। অগ্নির উত্তাপকেও ঝাল বলে, তাই ইংরেজিতে ঝালকে ডাক হয় hot নামে। তাঁদের কাছে ভারতীয় রান্নার অপর নাম hot–নামা। কারণ ঝাল বা কটু স্বাদ কন্ঠ আবৃত করে, সে হল Pungency। ঝাল কটু হল ষড় রসের অন্যতম—যাকে ভালো মতো আস্বাদন করা যায় তাই হল রস। মহাভারতের অন্যতম পাচক বা সূদ নল জানাচ্ছেন, কটু হল পিপ্পলি। সামুদ্রিক নুন ও পাহাড়ি নুন হল লবণাক্ত। ঘি মধুর রস। কষায় আর তিক্ত স্বাদ খুব অল্প পরিমাণে লাল মাংসে থাকে। ছ রকম রসের মধ্যে বাকি রইল অম্ল বা টক। গন্ধরাজ লেবু রাখতে পারেন খাওয়ার সময়। ঘিয়ের সঙ্গে লেবুর সম্পর্ক অম্লমধুর হলেও তা না যোগ করাই ভাল। তাল কেটে যাবে। পঞ্চরসই জংলি মাংসের ইউএসপি।

রস্যতে আস্বাদ্যতে ইতি রসঃ।

(শামিম আহমেদ)

(মূল লেখার লিঙ্ক কমেন্ট বাক্সে)

লি মাংস

শামিম আহমেদ

ওমলেট নয়, মাংস রান্নার এক প্রণালী বলব। অস্তিত্বের যে অর্থহীনতা, তা ক্ষণকালের জন্য ভুলে যাওয়া যাক। চিজের বদলে নেব ঘি। খাঁটি গব্য ঘৃত। তবে এই রান্নার সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ মশলা হল লঙ্কা।। শুকনো লাল। লঙ্কার নাম কেন ‘লঙ্কা’ তা নিয়ে বহু তত্ত্ব খাড়া করা যায়। উবশ্যই অস্তিত্বের সঙ্কটকে বাঁচিয়ে। সোনার লঙ্কার নাম এ দেশের বহু প্রাচীন সাহিত্যে পাওয়া যায়। কিন্তু যে লঙ্কা ঝাল, যা মানুষকে দু বার জ্বালায়—এক বার খাওয়ার সময় আর অন্যটা মলত্যাগের কালে, সেই লঙ্কা হল ঝাল বা কটু।

October 4

Still working on the omelet. There have been stumbling blocks. I keep creating omelets one after another, like soldiers marching into the sea, but each one seems empty, hollow, like stone. I want to create an omelet that expresses the meaninglessness of existence, and instead they taste like cheese. I look at them on the plate, but they do not look back. Tried eating them with the lights off. It did not help. Malraux suggested paprika.

---জাঁ পল সার্ত্র

রান্নার প্রধান চার মশলাকে ‘শিষ্ট চতুষ্টয়’ বলা যেতে পারে।

হলুদ/হলদি, লঙ্কা/মরিচ (চিলি), জিরে/জিরকা ও ধনে/ধনিয়া।

এ যেন অনেকটা ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য-শূদ্রের মতো ব্যাপার। হলুদ ব্রাহ্মণ, সাত্ত্বিক মশলা—ব্যঞ্জনের মস্তিষ্ক সচল রাখেন। লঙ্কা রাজসিক ক্ষত্রিয়, তিনি মাইনাস বিশ ডিগ্রি ঠান্ডায় রাষ্ট্র নামক ব্যঞ্জনকে পাহারা দেন, তাঁর উগ্রতা ও Hot-তা বিভিন্ন ডিগ্রির। জিরকা হলেন বৈশ্য মানুষ, তরকারিতে ভাল মতো তাঁর প্রভাব-প্রতিপত্তি টের পাওয়া যায়। আর ধনিয়ার কাজ ওই তিন মশলাকে সেবা করা। ওই তিন মশলাকে সেবা মানেই ব্যঞ্জন-রাষ্ট্রের সেবা। শিষ্ট চতুষ্টয়ের বাইরে যারা বাস করেন, যেমন কলৌঞ্জি, এলাচ, জায়ফল, গোলমরিচ, লবঙ্গ, জয়িত্রী, দারুচিনি, তেজপাতা প্রমুখ সব হয় ম্লেচ্ছ, নয়তো বহিরাগত কিংবা তা ধিন-ধিনা।

ওমলেট নয়, মাংস রান্নার এক প্রণালী বলব। অস্তিত্বের যে অর্থহীনতা, তা ক্ষণকালের জন্য ভুলে যাওয়া যাক। চিজের বদলে নেব ঘি। খাঁটি গব্য ঘৃত।

তবে এই রান্নার সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ মশলা হল লঙ্কা।। শুকনো লাল। লঙ্কার নাম কেন ‘লঙ্কা’ তা নিয়ে বহু তত্ত্ব খাড়া করা যায়। উবশ্যই অস্তিত্বের সঙ্কটকে বাঁচিয়ে। সোনার লঙ্কার নাম এ দেশের বহু প্রাচীন সাহিত্যে পাওয়া যায়। কিন্তু যে লঙ্কা ঝাল, যা মানুষকে দু বার জ্বালায়—এক বার খাওয়ার সময় আর অন্যটা মলত্যাগের কালে, সেই লঙ্কা হল ঝাল বা কটু।

সেই থেকে কাঁদায় এ ভারতকে লঙ্কাচাষ

ছ মাস জিভকে আর অন্যটাকে মিহি ছয় মাস।

ধর্মসাহিত্যে ‘লঙ্কা’ শব্দ থাকলেও ‘চিলি’ ছিল না। শাস্ত্রের বাইরে ছিল লঙ্কা ধান; বহু পুরনো। তবে সেটি ধানই, ‘ধানি লঙ্কা’ নয়। ‘লঙ্কা’ শব্দের ধাতু যে ‘রম’ তার অর্থ হল আসক্তি। আসক্তির দহন হল লঙ্কাদহন। তবে লঙ্কাকে ‘মরিচ’ও বলে থাকেন বহু মানুষ। মির্চ মসালা। লাল মরিচ, হারা মরিচ। মরিশাস দ্বীপ থেকে এই নাম কিনা, সেই প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। মরিচের ঝোলের কথা পাওয়া যায় বহু লেখায়। চৈতন্য চরিতামৃতে চই-মরীচের কথা আছে। চই/ চৈ হল লতাবিশেষ ও তার মূল। চৈতন্য-চরিতামৃতের লেখক চই-মরীচ সুক্তার কথা বলেছেন। চই বা চৈ ছিল তরকারিতে ঝাল দেওয়ার অন্যতম উপকরণ। অন্তত অবিভক্ত বাংলায়। কটু বা ঝাল ছাড়া রান্নার কথা তো ইদানীং কালে ভাবাই যায় না! লঙ্কা মানে চিলি এক কালে ছিল না ভারতে, অথচ এ দেশে এখন লঙ্কা ছাড়া ব্যঞ্জন তৈরি হয় না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের যে কোনও দশ জন পর্যটককে ভারতীয় খাবার সম্পর্কে জিগ্যেস করলে ন’জন বলবেন একটিই শব্দ chillies। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ভারতীয় খাবার ও লঙ্কার বিয়ে হয়েছে এই সে দ্দিন, মানে গত হপ্তায়। তাহলে ঝাল-স্বাদের জন্য কী ব্যবহার করা হত? একটি তো চৈ। আরও বহু কিছু ছিল, আছে—গোলমরিচ, পিপ্পল/পিপ্পলি ইত্যাদি।

পৃথিবীতে লঙ্কার ব্যবহার বেশ পুরনো। খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ হাজার সালে মেক্সিকোতে লঙ্কাবাবুর জন্ম বলে পণ্ডিতরা জানিয়েছেন। ভারতে এসেছে এই সেই দিন, এখন থেকে মাত্র ৪৫০ বছর পূর্বে। না, ইউরোপ থেকে আসেনি। গোয়ায় প্রথম লঙ্কা এনেছিলেন পর্তুগিজরা। সেই ভারতে এখন সবথেকে বেশি লঙ্কা উৎপাদন হয়। ভারতীয়রা সবচেয়ে বেশি লঙ্কা খান। লঙ্কা-রপ্তানিকারক দেশ হিসাবে ভারত এখন শীর্ষস্থান দখল করেছে। দেশের মোট লঙ্কার ৭৫ ভাগ হয় অন্ধ্রে। ভারতীয় লঙ্কার ২০০ রকম প্রজাতি আছে, তার মধ্যে ৩৬-টি প্রজাতি হয় অন্ধ্রপ্রদেশে। সব যে খুব ঝাল বা ঝালহীন, এমন নয়। ঝালের মাত্রাভেদ আছে। ধানি লঙ্কা যেমন বেশ ঝাল তেমনি কাশ্মীরি লঙ্কায় ঝাল প্রায় নেই। অন্ধ্রপ্রদেশের গুন্টুরকে লঙ্কার পীঠস্থান বলা হয়। যাঁরা লঙ্কা ভালবাসেন তাঁদের তীর্থক্ষেত্র হতে পারে গুন্টুর। কালো তুলোট মাটিতে স্বর্গীয় লঙ্কা ফলান অন্ধ্রের চাষীরা। সোনার লঙ্কা।

ব্যঙজনে দেওয়া ছাড়াও লঙ্কার নানা রকমের পদ হয়, হয় আচার। ভূত ঝালোকিয়া বোধ হয় লঙ্কার রণতুঙ্গে। বিশ্বকাপজয়ী ক্যাপ্টেন। অন্যান্য খেলোয়াড়দের নানা রকম নাম আছে, সে সব পরে বলা যাবে কখনও।

যে কথাটা বলছিলাম, পর্তুগিজরা ভারতে লঙ্কা এনেছিলেন ব্রাজিল থেকে। সবই কিন্তু কালো মানুষদের দেশ। বর্ণবিদ্বেষী বলে না দাগালেই হল। প্রাচীন নথি বলছে, ভাস্কো ডা গামা গোয়ায় অন্তত তিন ধরনের ‘মরিচ’ (চিলি নয়) দেখেছিলেন—পেরনামবুকো মরিচ, কালো গোলমরিচ এবং লম্বা ‘পিপলি’ মরিচ। পিপ্পলি বা পিপ্পলের কথা মহাভারতে পাওয়া যায়। নলের পাকদর্পণে এই মশলা দিয়ে মাংস রান্নার কথা আছে। লঙ্কা দিয়ে মাংস--এই রকম একটা রেসিপি বর্তমান লেখার লক্ষ্য। রান্নাটা বেশ সহজ ও সরল। মেলা ঝামেলা নেই, উপকরণও খুব কম লাগে। তবে ‘শুকনো লাল লঙ্কা’ লাগবেই। পর্তুগিজরা ভারতে লঙ্কা আনার পরে উত্তর ভারতে লঙ্কা প্রচার হতে প্রায় ২৫০ বছর সময় লেগে গেছে। মারাঠাদের হাত ধরে দিল্লি ও আগ্রায় লঙ্কার ব্যবহার হয় এই সেদিন, মুঘল যুগের শেষ দিকে। ততদিন লঙ্কাহীন ছিল উত্তর ভারত অর্থাৎ হিন্দুস্তান। তবে দক্ষিণে ছিল তার রমরমা। লঙ্কার ধাতু হল ‘রম’ যার অর্থ রতি, রমণ, আসক্তি। রাম লঙ্কা জয় করেছলেন। তখন তিনি বনবাসে ছিলেন।

বুনো মাংস কিংবা ‘জংলি মাস’ বা জংলি মাংস আজকের রেসিপি। লাগবে মাংস (লাল), ঘি, নুন ও লঙ্কা।

নুন-মরিচ কথাটা কাঁচা আম খাওয়াতে খুব কাজে লাগে, মরিচ এখানে শুকনো বা কাঁচা লঙ্কা, গোল মরিচ নয়। শোনা যায়, এই লঙ্কার আঁতুড়ঘর নাকি বলিভিয়ায়। একটা ছোটো লঙ্কাতে অজস্র বীজ থেকে অবাক লাগে। কেন এত বীজ থাকে? অবশ্যই প্রজননেন জন্য। তাই বলে এত? খেয়ে হজম করতে পারা যায় না। লঙ্কার এই বীজসমূহ পাখিরা দূর দেশে ছড়িয়ে দিত, লঙ্কা ছড়িয়ে পড়ত দূর দেশে। বীজেও ঝাল থাকে, তবে এই বীজ ঝাল বলে কীট পতঙ্গরা নষ্ট করতে সাহস পায় না। তাতে প্রজননে সুবিধা। না, সবটা ইকো ফ্যান্টাসি নয়; প্রকৃতির লীলা তো আছেই। আল্লাহ কে বোঝে তোমার অপার লীলে! লালন লিখেছিলেন, তিনি শেষের বহু দিন বন জঙ্গলে বাস করেছেন।

বনে জঙ্গলে শিকারে যেতেন রাজা বাদশারা। রাজপুতরাও যেতেন। শিকারে গেলে হরেক রকম মশলা বেঁধে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই ‘জংলি মাস’ তৈরি হত খুব কম মশলা দিয়ে। কিন্তু এই পদ একবার খেলে ভোলা যাবে না। যাঁরা খেয়েছেন, তাঁদের দু একজনকে এই লেখায় ট্যাগ করে দিলাম।

আধ কেজি ছাগলের মাংস নিন। ‘মাটন’ বলবেন না, ওটা ভেড়ার মাংস; ‘গোট মিট’ বলতে পারেন। চার চামচ ঘি (বড়, টেবিল চামচ), ১৫-২০ টা শুকনো লাল লঙ্কা, আধ কাপ জল, পাহাড়ি নুন বা রক সল্ট (স্বাদ মতো)।

আজকাল বাজারে পাহাড়ি নুন পাওয়া বেশ শক্ত। মল-টলে গুঁড়ো করে রক সল্টের নামে যা সব বিক্রি হয় তার সঙ্গে সাদা নুন মেশানো থাকে। সাদা চিনি ও সাদা নুন বেশ বিস্বাদের ও বিষাদের। পাড়ার মুদির দোকানে রক সল্ট (বিট নুন)-এর ডেলা কিনে শিলে পিষে নিন। ভাল ঘি না পেলে মাখন ব্যবহার করুন।

এই বার রান্না। প্রথমে ঘি গরম করুন। তপ্ত ঘিয়ে মাংস দিন, ১০ থেকে ১৫ মিনিট সাঁতলান। যখন লাল-মাংস বাদামি হয়ে আসবে, তখন নুন ও লঙ্কা মিশিয়ে দিন। তার পর রান্নার পাত্র ঢেকে দিন, অল্প আঁচে রাখুন আধ ঘন্টা মতো। তার পর ঢাকনা খুলে অল্প অল্প করে জল দিন। সেদ্ধ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। মাংস ভুনা বা ভাজা হবে না, আবার কারিও নয়। মাংসের গায়ে-গায়ে নুন-ঘি লেগে থাকবে, লঙ্কা থাকবে তার নিজের মতো। হনুমানের মতো লঙ্কা দহন করতে যাবেন না, তাতে মুখ পুড়বে।

ঝাল স্বাদ মানে কটু স্বাদ। ঝাল হল জ্বালাকর। অগ্নির উত্তাপকেও ঝাল বলে, তাই ইংরেজিতে ঝালকে ডাক হয় hot নামে। তাঁদের কাছে ভারতীয় রান্নার অপর নাম hot–নামা। কারণ ঝাল বা কটু স্বাদ কন্ঠ আবৃত করে, সে হল Pungency। ঝাল কটু হল ষড় রসের অন্যতম—যাকে ভালো মতো আস্বাদন করা যায় তাই হল রস। মহাভারতের অন্যতম পাচক বা সূদ নল জানাচ্ছেন, কটু হল পিপ্পলি। সামুদ্রিক নুন ও পাহাড়ি নুন হল লবণাক্ত। ঘি মধুর রস। কষায় আর তিক্ত স্বাদ খুব অল্প পরিমাণে লাল মাংসে থাকে। ছ রকম রসের মধ্যে বাকি রইল অম্ল বা টক। গন্ধরাজ লেবু রাখতে পারেন খাওয়ার সময়। ঘিয়ের সঙ্গে লেবুর সম্পর্ক অম্লমধুর হলেও তা না যোগ করাই ভাল। তাল কেটে যাবে। পঞ্চরসই জংলি মাংসের ইউএসপি।

রস্যতে আস্বাদ্যতে ইতি রসঃ।

(শামিম আহমেদ)

(মূল লেখার লিঙ্ক কমেন্ট বাক্সে)

0 Comments

Post Comment