পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

উন্নয়নের পথ না ঋণের জাল?

  • 16 April, 2025
  • 0 Comment(s)
  • 401 view(s)
  • লিখেছেন : শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২০২৫ সালে ভারতের সরকারি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩.৫৮ ট্রিলিয়ন ডলার, যা আমাদের টাকায় প্রায় ২৯৫ লক্ষ কোটি। পশ্চিমবঙ্গের ঋণ এখন ৬.৯৩ লক্ষ কোটি টাকা। এই বিশাল ঋণ নিয়ে একটা বড় প্রশ্ন উঠছে—এটা কি আমাদের উন্নতির পথ দেখাচ্ছে, নাকি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সমস্যা বাড়াচ্ছে? এই ঋণের পরিমাণ, এর ভালো-মন্দ দিক, সমস্যা আর সমাধান নিয়ে আলোচনা করলে বুঝতে পারি কি পরিস্থিতির মধ্যে আমরা আছি।

সরকারি ঋণ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। তবে, এর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। ঋণের পরিমাণ যেন নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকে, এবং তা যেন উৎপাদনশীল কাজে ব্যবহার করা হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আমাদের দেশ, আমাদের রাজ্য এই মুহূর্তে ঋণের ভারে জর্জরিত। ২০২৫ সালে ভারতের সরকারি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩.৫৮ ট্রিলিয়ন ডলার, যা আমাদের টাকায় প্রায় ২৯৫ লক্ষ কোটি। পশ্চিমবঙ্গের ঋণ এখন ৬.৯৩ লক্ষ কোটি টাকা। এই বিশাল ঋণ নিয়ে একটা বড় প্রশ্ন উঠছে—এটা কি আমাদের উন্নতির পথ দেখাচ্ছে, নাকি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সমস্যা বাড়াচ্ছে? এই ঋণের পরিমাণ, এর ভালো-মন্দ দিক, সমস্যা আর সমাধান নিয়ে আলোচনা করলে বুঝতে পারি কি পরিস্থিতির মধ্যে আমরা আছি। 

২০২৫-২০২৬ সালের শেষে ভারত সরকারের অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক ঋণ এবং অন্যান্য দায়বদ্ধতা আনুমানিক ১৯6,৭৮,৭৭২.৬৮ কোটি টাকা, যেখানে ২০২৪-২০২৫ সালের শেষে (সংশোধিত হিসেবে) ছিল ১,৮১,৭৪,২৮৪.৩৬ কোটি টাকা। ভারতের ঋণ এত বড় যে এটা দেশের ২.৫ বছরের রপ্তানি থেকে যা আয় হয় তার সমান। এই টাকায় ৭৫ কোটি মানুষকে এক বছর বিনামূল্যে খাবার দেওয়া যায়। এই মুহূর্তে ভারতের বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডারে রয়েছে ৬৫৮ বিলিয়ন ডলার। ২০২৪ অর্থবর্ষে ভারতের মোট আমদানির পরিমাণ প্রায় ৭২০ বিনিয়ন ডলারের, অর্থাৎ কিনা এগারো মাসে আমদানির গড় ব্যয় প্রায় ৬৬০ বিলিয়ন ডলার। সুতরাং, দেশের ভান্ডারে এখন যত বিদেশি মুদ্রা রয়েছে, তা দিয়ে আগামী মাত্র এগারো মাসের আমদানির খরচ মেটানো সম্ভব। অন্যদিকে, পশ্চিমবঙ্গে ২০১১ সালে ঋণ ছিল ১.৯৩ লক্ষ কোটি, এখন তা ৩.৫৯ গুণ বেড়ে ৬.৯৩ লক্ষ কোটি হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে মাথাপিছু ঋণ বেড়ে ৬০,০০০ টাকা হয়েছে, যা আগে ছিল ২০,৩০০ টাকা। ভারতের আয়ের ২৭ শতাংশ এখন ঋণের সুদে চলে যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে এটা আরও বেশি, ৫৮ শতাংশ, যার ফলে শিক্ষা আর স্বাস্থ্যের জন্য মাত্র ১২ শতাংশ টাকা থাকছে।

সরকার বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ নেয়, যেমন বন্ড বিক্রি করে বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ধার করে। এই ঋণ সাধারণত সরকারি ব্যয় নির্বাহের জন্য ব্যবহৃত হয়, যেমন পরিকাঠামো নির্মাণ, সামাজিক কল্যাণ প্রকল্প, বা জরুরি পরিস্থিতিতে। অর্থনীতির যুক্তিতে সরকারি ঋণের পরিমাণ, সুদের হার, এবং অর্থনৈতিক প্রভাব বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, এই ঋণেরও ভালো-মন্দ দুইদিকই আছে। সরকার অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যরাস্তাঘাট, সেতু, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, এবং অন্যান্য পরিকাঠামো নির্মাণের জন্য ঋণ নিতে পারে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, এবং সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে বিনিয়োগের জন্যও ঋণ নেওয়া যায়, যা মানব উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে। মন্দার সময় বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো জরুরি পরিস্থিতিতে, সরকার ঋণ নিয়ে অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে পারে। সমাজের দুর্বল অংশের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে, বিভিন্ন সামাজিক কল্যাণমূলক প্রকল্প, যেমন পেনশন, ভর্তুকি, এবং অনুদানের জন্যও সরকার ঋণ নিতে পারে। 

কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে, অতিরিক্ত ঋণ ভবিষ্যতের প্রজন্মের জন্য একটি বড় বোঝা হয়ে না দাঁড়ায়। ঋণের সুদ পরিশোধ করতে সরকারের আয়ের একটি বড় অংশ যদি খরচ হয়ে যায়, তবে তা উন্নয়নমূলক কাজের জন্য অর্থের অভাব সৃষ্টি করবে। সরকার বেশি ঋণ নিলে বাজারে অর্থের যোগান বাড়ে, যা মুদ্রাস্ফীতি ঘটাতে পারে; তা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার খরচ বাড়াবে। এক্ষেত্রে, অতিরিক্ত ঋণ দেশের ও রাজ্যের অর্থনীতিকে ঝুঁকির সামনে ফেলে দিতে পারে। আন্তর্জাতিক বাজারে দেশের ঋণমান কমে গেলে, বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করতে দ্বিধা বোধ করে। ঋণ পরিশোধ করার জন্য তখন সরকার করের পরিমাণ বাড়াতে পারে, আর এই অতিরিক্ত কর সাধারণ মানুষের উপর আরো চাপ সৃষ্টি করবে।  মনে রাখতে হবে, সরকারের আয়ের বড় অংশ যদি ঋণের সুদ মেটাতেই চলে যায়, তাহলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিকাঠামোর মতো ক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য কম টাকা থাকে। 

১৯৯১ সালে যখন আমাদের দেশের অর্থনীতি যখন দেউলিয়া হওয়ার মুখে ছিল, ঋণই আমাদের বাঁচিয়েছিল। ২০০৮ সালে যখন সারাবিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা এসেছিল, তখনও এই ঋণ আমাদের সাহায্য করেছিল। COVID-এর সময় ৮০ কোটি মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করতে ভারত সরকারকে ঋণ নিতে হয়েছিল। কিন্তু শ্রীলঙ্কা আর গ্রিসের মতো দেশ, সাম্প্রতিক অতীতে, ঋণের দায়ে বহু সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। প্রত্যেক ভারতবাসীর মাথায় এখন ২১,০০০ টাকা ঋণ। ভবিষ্যতে, এই ঋণ শোধ করতে কর কাঠামোর সম্পূর্ন সংস্কার করতে হতে পারে, আর করের পরিমাণ ১৫-২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে।

পশ্চিমবঙ্গে সমস্যা আরও গভীর। এই মুহূর্তে, প্রত্যেক পশ্চিমবঙ্গবাসীর মাথায়, কেন্দ্র - রাজ্য মিলিয়ে, মোট ঋণের বোঝা প্রায় ৮১,০০০ টাকা। পশ্চিমবঙ্গ বাজেট ২০২৪-২৫ থেকে জানা যায়, ২০২৪-২৫ সালে পশ্চিম বঙ্গের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ১৮.৮ লক্ষ কোটি টাকা, যা ২০২৩-২৪ সালের তুলনায় ১০.৫% বেশি।  ঋণ পরিশোধ ছাড়া মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩,০৪,৬৮৯ কোটি টাকা, যা ২০২৩-২৪ সালের সংশোধিত হিসাবের তুলনায় ১৩% বেশি। এর সাথে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ৬১,৪২৭ কোটি টাকার ঋণ পরিশোধ করবে।  ঋণ ব্যতীত ২০২৪-২৫ সালে মোট প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ২,৩৬,৪৩৮ কোটি টাকা, যা ২০২৩-২৪ সালের সংশোধিত হিসাবের তুলনায় ১৩% বেশি।  ২০২৪-২৫ সালে রাজস্ব ঘাটতি জিএসডিপির ১.৭% (৩১,৯৫২ কোটি টাকা) ধরা হয়েছে, যা ২০২৩-২৪ সালের সংশোধিত হিসাবের মতোই (জিএসডিপির ১.৭%)। ২০২৪-২৫ সালে রাজকোষ ঘাটতি জিএসডিপির ৩.৬% (৬৮,২৫০ কোটি টাকা) ধরা হয়েছে। তার উপর, এখানে শিল্প থেকে সরকারি উপার্জন বেশ কম; রাজ্য সরকারের মোট আয়ের মাত্র ১৮ শতাংশ শিল্প থেকে আসে। পশ্চিমবঙ্গে বেকারত্বের হারও বেশি (৮.২ শতাংশ) যা দেশের গড় বেকারত্ব হারের তুলনায় (৬.১ শতাংশ) অনেক বেশি। রাজ্যের আয় মোট উৎপাদনের মাত্র ৬.৫ শতাংশ, যেখানে দেশের গড় আয় ১০.২ শতাংশ। ফলে ঋণে, আর ঋণের সুদে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আয়ের একটা বড় অংশ চলে যাচ্ছে, যা ভবিষ্যতের জন্য যথেষ্ঠ দুশ্চিন্তার কারণ।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারকে এত ঋণ নিতে কেন হচ্ছে? নিশ্চয়ই আপাতকালীন অবস্থা, একটা বড় কারণ। COVID-এর সময় খাবার আর স্বাস্থ্যের জন্য ১.৫ থেকে ১.৭ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে। আরেকটা কারণ তবে নিশ্চয়ই উন্নয়ন। প্রতি বছর, রাস্তা আর বিদ্যুতের মতো পরিকাঠামো উন্নয়নে  সরকারের ২.৪ থেকে ২.৫ লক্ষ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। তবে নিশ্চিত করেই, সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এক্ষেত্রে একটা বড় ভূমিকা নিচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার বিভিন্ন জনকল্যাণ প্রকল্পে প্রতি বছর ৩২,০০০ কোটি টাকা খরচ করছে, লক্ষ্মীর ভাণ্ডারে প্রতি বছর খরচ প্রায় ১২,০০০ কোটি ।

আসলে সমস্যাটা হচ্ছে, ঋণের ঝুঁকিও তো বড়ো কম নয়। ভারত সরকারের শুধু সুদের খরচ প্রতিদিন ৯,৮৬৩ কোটি টাকা, যা শিক্ষার বাজেটের ৩২ গুণ। ব্যাংক থেকে ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা ঋণ পাচ্ছে কম, কারণ সরকার নিজেই অনেক টাকা ধার করছে। একটা ছোট কারখানার জন্য ঋণের সুদ এখন ১৩ শতাংশ, আগে ছিল ৯ শতাংশ। জিনিসের দাম বাড়ছে—খাবারে ৭.৩ শতাংশ, পেট্রোলে ৪২ শতাংশ। ভবিষ্যতে কর বাড়বে, পেনশন কমবে, রাস্তা-সেতুর খরচের টাকাও থাকবে না। তাহলে, এই সমস্যার সমাধান কী? ভারত সরকারকে ঋণের ভার কমিয়ে ৬০ শতাংশের নিচে আনতে হবে। রাস্তা, শিল্প আর বিদ্যুতের মতো ক্ষেত্রে প্রয়োজনে আরো টাকা খরচ করতে হবে, কিন্তু বহু অপ্রয়োজনীয় খরচ কমাতে হবে। তাই একদিকে সরকারি খরচ কমানোও যেমন জরুরী, অন্যদিকে আয় বাড়ানোর ব্যাপারেও একই রকম উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজনীয়। 

আশার কথা এটাই যে যদিও ভারতের সরকারি ঋণ বর্তমানে উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে, তবুও আমাদের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ খুব অনুজ্জ্বল নয়। তার পেছনে রয়েছে অসীম বৃদ্ধির সম্ভাবনা, একটি তরুণ ও উৎপাদনশীল জনশক্তি এবং প্রযুক্তি ও পরিকাঠামো খাতে অভূতপূর্ব অগ্রগতি। ভারতের অর্থনীতি ২০২৫ সালেও ৬.৫%-৭% হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা বিশ্বের দ্রুততম গতিশীল অর্থনীতিগুলির মধ্যে একটি। তরুণ জনসংখ্যা—যেখানে ৬৫% মানুষের বয়স ৩৫ বছরের নিচে— ভারতকে একটি বিশাল জনমিতির সুবিধা (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড) প্রদান করছে, যা উদ্ভাবন ও উৎপাদনশীলতাকে ত্বরান্বিত করছে। আইটি, ফিনটেক এবং ব্যবসায়িক সেবা খাতের দ্রুত প্রসার ভারতকে ডিজিটাল অর্থনীতির একটি প্রধান খেলোয়াড়ে পরিণত করেছে। একইভাবে, মুম্বাই-আহমেদাবাদ বুলেট ট্রেন, ভারতমালা প্রকল্প এবং স্মার্ট সিটি মিশনের মতো মেগাপ্রকল্পগুলি দেশের যোগাযোগ ও পরিকাঠামোকে শক্তিশালী করছে। সরকারের আর্থিক সংস্কার যেমন জিএসটি, ফিসক্যাল রেসপনসিবিলিটি অ্যাক্ট (FRBM) এবং জন-ধন যোজনার মতো আর্থিক অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রকল্পগুলি রাজস্ব বৃদ্ধি ও দারিদ্র্য হ্রাসে ভূমিকা রাখছে। এছাড়াও, 'মেক ইন ইন্ডিয়া' এবং স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমের প্রসার বেসরকারি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিকে উৎসাহিত করছে। পরিবেশগত দিক থেকে, ভারত ২০৩০ সালের মধ্যে ৫০০ গিগাওয়াট নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় অগ্রণী ভূমিকা নিচ্ছে। সুতরাং, উচ্চ ঋণের চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, ভারতের গতিশীল অর্থনীতি, তরুণ জনশক্তি এবং প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন দেশটিকে একটি স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে সাহায্য করবে, যদি সঠিক নীতি ও বিনিয়োগ অব্যাহত থাকে। সরকারকে মনে রাখতে হবে, ঋণ উন্নয়নের সহায়ক হতে পারে বটে, কিন্তু এই সময়ে ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি আর সম্ভাবনা অনেক বেশি। 

 
0 Comments

Post Comment