পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

ইস্যু থাকলেও ইন্ডিয়া জোট ঐক্যবদ্ধভাবে তা নিয়ে মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারছে না

  • 09 April, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 541 view(s)
  • লিখেছেন : আশিস গুপ্ত
ভোট গ্রহণের দিন যত এগিয়ে আসছে, রাজনৈতিক দলগুলির প্রচার যত তীব্র হচ্ছে, একটাই প্রশ্ন সমগ্র দেশজুড়ে, কর্তৃত্ববাদী দক্ষিণপন্থী শক্তিকে কি পরাস্ত করতে পারবে অসংলগ্নতা এবং খণ্ডিত হওয়ার ঝুঁকি বহনকারি বিরোধীজোট ?
আগামী দিন দশেকের মধ্যে, বিশ্বের বৃহত্তম সংসদীয় ব্যবস্থার অধীনে ১৮ তম লোকসভা গঠনের জন্য নির্বাচনের ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাবে।দীর্ঘ দেড় মাস ধরে চলতে থাকবে ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়া। ইতিমধ্যে প্রায় সব রাজনৈতিক দল তাদের  প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করে ফেলেছে। চলছে নির্বাচনী প্রচার।প্রচারে মূলত দুটি ধারার মধ্যে একটি কে বেছে নেওয়ার আহ্বান জানানো হচ্ছে।একটি ধারা কর্পোরেট লুট দ্বারা আবদ্ধ স্থিতিশীলতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্যতা এবং ‘বিকাশের’ প্রতিশ্রুতি দেয়। অন্যটি বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের  জন্য সংবেদনশীলতা, সহানুভূতি এবং জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের অপূর্ন আকাঙ্খা পূরণের প্রতিশ্রুতি দেয়।
এই পর্যায়ে আরএসএস সদর দফতরের নেতৃত্বে 'এক দেশ-এক জাতি-এক নেতা'র প্রবক্তারা মানুষকে ভুল জিনিস গ্রহণ করার জন্য মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে।তারা চায় মানুষ বিশ্বাস করুক যে দেশের বিচারক ও বিচার বিভাগ খারাপ এবং উন্নয়ন বিরোধী।তারা চায় নাগরিকরা বিশ্বাস করুক যে সমস্ত বিরোধী রাজনীতিবিদ দুর্নীতিগ্রস্ত এবং কোনো প্রশ্ন না করে এই অভিযোগ মেনে নেওয়াটাই বিচক্ষণতার কাজ।এই প্রচার অব্যাহত রেখে তারা এটাও প্রতিষ্ঠিত করতে চায় যে, জনগণ মেনে নিতে চায় স্বাধীনতা এবং মুক্ত চিন্তা একটি জাতির জন্য ভালো নয়।এরা নাগরিকদের মেনে নিতে উদ্বুদ্ধ করে যে, বানরের পালের মতো কেবল একজন নেতা থাকা উচিত এবং একাধিক গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব বর্জনীয়, কারণ তা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে উন্নয়নের গতিরোধ করে।দক্ষিণপন্থী শাসকদলের এই প্রচারের বিপরীতে বিরোধী দলের আখ্যান অসংলগ্নতা এবং খণ্ডিত হওয়ার ঝুঁকি বহন করে। যেখানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একটি পরিচিত কর্তৃত্ববাদী সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
 
ভোট গ্রহণের দিন যত এগিয়ে আসছে, রাজনৈতিক দলগুলির প্রচার যত তীব্র হচ্ছে, একটাই প্রশ্ন সমগ্র দেশজুড়ে, কর্তৃত্ববাদী দক্ষিণপন্থী শক্তিকে কি পরাস্ত করতে পারবে অসংলগ্নতা এবং খণ্ডিত হওয়ার ঝুঁকি বহনকারি বিরোধীজোট ? যদিও বিরোধী দলগুলোর প্রতিটি ইস্যুই সমাজ জীবনের কঠিন বাস্তব। নির্বাচনী বন্ড কেলেঙ্কারি, বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাগুলির অভিযান এবং তাদের গ্রেপ্তার, বিরোধী দলগুলোতে ভাঙ্গন ধরানো এবং তাদের নেতাদের দলে টেনে রাজ্য সরকারগুলির পতন ঘটানো, জনমানসে চাঞ্চল্য অথবা অস্বস্তির অনুভূতি তৈরি করলেও, সেই অস্বস্তিকে সংগঠিত করে ভোটবাক্সে নিয়ে যেতে পারবে বিরোধীজোট ? ভোটারদের তো বিশ্বাস করাতে হবে, গণতন্ত্রের মৃত্যু নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার বাইরে, বিজেপি-র বিরুদ্ধে তারা যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবিচারের সমস্যাগুলো উত্থাপন করছে- তা মোকাবেলা করার জন্য একমাত্র তাদের কাছে সমাধান রয়েছে।কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে ঘটছে বিপরীতটাই। নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার সাথে সাথে, ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠনে রেকর্ড করার চেষ্টা করছে। অন্যদিকে বিরোধীদের দৃঢ় প্রত্যয়ের অভাব দেখা যাচ্ছে। এমন সময়ে যখন ঐক্য তাদের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত, তখন তারা অসংগঠিত বলে মনে হয়। ক্ষমতাসীন দলকে জবাবদিহি করতে সমন্বিত প্রচেষ্টার পরিবর্তে, বিরোধীরা বিশৃঙ্খলার মধ্যে রয়েছে, একটি সাধারণ কৌশলের অভাব রয়েছে।প্রায় দশ মাস সময় লাগলো দিল্লিতে বিরোধী দলগুলির শীর্ষ নেতাদের এক মঞ্চে একত্রিত করতে। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী এবং আম আদমি পার্টির (আপ) জাতীয় আহ্বায়ক অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে গ্রেপ্তার এর বিরোধিতা করে সংহতি প্রদর্শনের জন্য একত্রিত হয়ে 'ইন্ডিয়া' জোট গঠনকারী ২৭টি দলের প্রতিনিধিত্বকারী নেতারা সমবেত হন রামলীলা ময়দানে। সেই সমাবেশে মানুষের উপস্থিতি বিরোধী নেতাদের উৎসাহিত করার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু তারপর ? সমাবেশের সাফল্যকে হাতিয়ার করে বিরোধী জোটের যে আগ্রাসী ভূমিকা নিয়ে প্রচারের ময়দানে অবতীর্ন হওয়াটা সময়ের ডাক ছিল, তাতে সাড়া দিতে ব্যর্থ হয়েছে 'ইন্ডিয়া' জোট। বিজেপির নির্বাচনী রণকৌশল নির্ধারকদের একজন সিনিয়র নেতা একান্ত আলাপচারিতায় বলেছিলেন, অরবিন্দ কেজরিওয়াল গ্রেপ্তার হওয়ার আগে দলের অভ্যন্তরীণ মূল্যায়নে দিল্লির ৭ টি লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপির জয়লাভের সম্ভাবনা ছিল ৫৫ শতাংশ। কেজরিওয়াল গ্রেপ্তার হওয়ার পর সেই সম্ভাবনা কমে এসেছে ৪৫ শতাংশে। অর্থাৎ, এই মুহূর্তে যা অবস্থা আম আদমি পার্টি ও কংগ্রেস যদি ঐক্যবদ্ধভাবে দিল্লিতে প্রচারে ঝড় তুলতে পারে মজবুত সংগঠন নিয়ে, তবে ধাক্কা খাবে বিজেপি। কিন্তু এখনো পর্যন্ত বিরোধীদের যৌথ প্রচার নিয়ে কোনো প্রস্তুতির খবর পাওয়া যায়নি। 
 

২০২৩ এর মাঝামাঝি সময়ে বিহারে মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমারের উদ্যোগে বিরোধী দলগুলির কনক্লেভ থেকে নরেন্দ্র মোদী সরকারের বিরুদ্ধে জোট গঠনের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়, তা বেঙ্গালুরু এবং মুম্বাইয়ের বৈঠকগুলিতেও আশা জাগিয়েছিল। অনেকেই মনে করেছিলেন যে ২০২৪ সালের লড়াই বিজেপির জন্য কঠিন হবে। সে সময় রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মধ্যেও আলোচনা হচ্ছিলো, বিরোধীরা যদি অন্তত ৪০০ টি লোকসভা আসনে জাতীয়ভাবে বিজেপির বিরুদ্ধে একক প্রার্থী দাঁড় করাতে পারে তবে বিজেপি গুরুতর সমস্যায় পড়বে।কিন্তু অবস্থাটা পাল্টে যায় উত্তর ভারতের তিনটি রাজ্য মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও ছত্তিশগড়ে বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের পরাজয়ের পর।বিধানসভা নির্বাচনের পর ডিসেম্বরে চতুর্থ কনক্লেভ অনুষ্ঠিত হয় দিল্লিতে। আর সেখানেই ফাটল দেখা দেয় বিরোধী জোটে, বিশেষ করে নীতিশ কুমারের উচ্চাশার কারণে। তারপর নানা চাপান-উতর চলেছে বিরোধী জোটের মধ্যে। বিরোধীতা ছেড়ে সরকারি জোটে শামিল হয়েছে নীতিশ কুমারের জেডিইউ আর জয়ন্ত চৌধুরীর রাষ্ট্রীয় লোকদল। অনেক টানাপোড়েনের পর অরবিন্দ কেজরিওয়াল, হেমন্ত সোরেনদের গ্রেপ্তার, কংগ্রেসকে আয়কর বিভাগের তিনহাজার কোটি টাকার বেশি কর দেওয়ার নোটিশ কার্যত বিরোধীদের একত্রিত করেছিল রামলীলা ময়দানে। সিপিআইএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরি ছিলেন সেই সমাবেশে। কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্বের উপস্থিতিতে ইয়েচুরি নরেন্দ্র মোদির সরকারকে গদিচ্যুত করতে বিরোধী ঐক্যের পক্ষে জোরালো সওয়াল করেছিলেন। সেই সমাবেশের পরে এক সপ্তাহ পার হতে না হতে সিপিআইএমের পলিট ব্যুরো সদস্য ও কেরল শাখার সম্পাদক এম ভি গোবিন্দন "মাস্টার" ৭ এপ্রিল 'ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস' এর সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, "কংগ্রেসের উচিত ছিল বিজেপি-বিরোধী ভোটকে একত্রিত করতে নেতৃত্ব দেওয়া। দুর্ভাগ্যবশত, তারা দায়িত্ব কাঁধে রাখার অবস্থানে নেই। তাদের নেই কোনো নেতৃত্ব বা স্পষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান।কোন নেতারা এর নেতৃত্ব তৈরি করে? দল কি সিএএ নিয়ে তার অবস্থান স্পষ্ট করেছে? কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে কি দলের অবস্থান তুলে ধরেছেন?" রামলীলা ময়দানের সমাবেশে মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের ডেরেক ও' ব্রায়ান। পশ্চিমবঙ্গে ৪২ টি আসনেই প্রার্থী দিয়েছে তৃণমূল এবং তাদের শীর্ষ নেত্রী কংগ্রেস সম্পর্কে মাঠে ময়দানে কি বলছেন বাঙালি পাঠকরা তা ভালো করেই জানেন। 

 
উপরে উল্লেখিত বিষয়গুলি আলোচনায় নিয়ে আসার কারণ, এটা বলার জন্য যে ভোটারদের কাছে বিরোধীজোটের গ্রহণযোগ্যতা তলানিতে ঠেকবে শরিকদলের কারণেই। নরেন্দ্র মোদির মতোই ইন্ডিয়া জোটের কোনো কোনো শরিকদল কংগ্রেসকে আক্রমণ করে চলেছে। অথচ দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিরোধীজোট গড়ে উঠতে পারে কংগ্রেসকে কেন্দ্র করেই। কারণ বিরোধী দলগুলির মধ্যে একমাত্র কংগ্রেসেরই আছে গোটা দেশজুড়ে উপস্থিতি। এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করা রাজনৈতিক মুর্খামির লক্ষণ। কংগ্রেসকেও বিরোধীজোটের শক্তিশালী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে দ্রুত এবং দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। ইন্ডিয়া জোট কে সঙ্গে নিয়ে নরেন্দ্র মোদির বিকল্প হিসেবে নিজেকে একটি ঐক্যবদ্ধ সত্তা হিসেবে উপস্থাপন করতে হবে। বিজেপির প্রচারকে মোকাবেলা করার জন্য বিরোধীদের একটি সমন্বিত যোগাযোগ কৌশল তৈরি করা উচিত ছিল এবং অসামঞ্জস্যপূর্ণ কণ্ঠে কথা বলা এড়ানো উচিত ছিল।অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলছেন, বিরোধী জোটের উচিত ছিল, জাতির জন্য একটি বিকল্প ভিশন ডকুমেন্ট তৈরি করা , যা কেবল মোদী সরকারের দুর্বলতাগুলিই তুলে ধরে না বরং দেশের সমস্যার সমাধানও দেয়।বিজেপি প্রার্থীদের তালিকা চূড়ান্ত করার আগে বিরোধীদের নিজেদের মধ্যে আসন বণ্টন নিয়ে ভালোভাবে সমাধান করা উচিত ছিল।এসব কিছুই হয়নি। প্রত্যেক দলই নিজ নিজ নির্বাচনী ইশতেহার, প্রতিশ্রুতি নিয়ে নির্বাচনী প্রচার অভিযানে শামিল। ইন্ডিয়া জোটের কোনো ভিশন ডকুমেন্ট নেই।ইলেক্ট্রোরাল বন্ডের দুর্নীতি, ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি, সাম্প্রদায়িক বিভাজন তৈরির মতো ইস্যু থাকলেও ইন্ডিয়া জোট ঐক্যবদ্ধভাবে তা নিয়ে মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারছেনা। বেশিরভাগ বিরোধী দলের নেতাদের প্রদর্শন করার মতো পারফরম্যান্সের রেকর্ড নেই। ফলে কয়েকটি আঞ্চলিক দল ছাড়া, সামগ্রিকভাবে ইন্ডিয়া জোট স্থিতিশীল শাসনের প্রতিশ্রুতি ছাড়াই ভোটারদের দরজায় কড়া নাড়ছে, এটা ভোটারদের মনে কতটা প্রভাব ফেলবে ? বিরোধী দলকে ভোটারদের আশ্বস্ত করতে হবে যে কার্যকর শাসন সম্ভবপর এবং এমনকি একটি সম্মিলিত জোট ব্যবস্থায়ও সম্ভব। বিরোধী দলের নেতাদের, ব্যক্তিগতভাবে এবং সমষ্টিগতভাবে, বুঝতে হবে যে শেষ পর্যন্ত, চূড়ান্ত লড়াই নরেন্দ্র মোদীর কর্পোরেট সমর্থক এবং ভারতের জনগণের মধ্যে। আর এই বিশ্বাসের সমর্থকরা মনে করেন বিরোধী নেতারা ভোটারদের উদ্বেগ ও ভয়কে সরকার পরিবর্তনের কাজে লাগাতে ব্যর্থ হলেও, নির্বাচকমণ্ডলী তার সহজাত প্রজ্ঞায় প্রজাতন্ত্রের হারানো ভারসাম্য পুনরুদ্ধার করবে।
0 Comments

Post Comment