বহুকাল হল নকশালপন্থীদের ছন্নছাড়া দশা এবং সিপিএমেরও এই বারবার হার —- কোনোভাবেই পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে সুবিধা করতে না পারা আজকাল প্রায় সকল বামপন্থী মানুষের মধ্যেই এই প্রশ্নটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, কখনও লুকিয়ে কখনও খোলামেলাভাবে, কখনও গোপনে কখনও প্রকাশ্যে সমানে আসছে সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। প্রশ্নটি হল বামপন্থার পুনর্জীবন আদৌ কি সম্ভব? এই প্রশ্নের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আরও একটি প্রশ্ন। সেটি হল বামপন্থীদের মধ্যে ঐক্যের প্রশ্ন। অর্থাৎ, সিপিএম-সিপিআই জাতীয় মূলধারার বাম পার্টিগুলির সঙ্গে নকশালপন্থী পার্টিগুলি এবং এসইউসিআই ইত্যাদি সবাই মিলিতভাবে কোনো নির্বাচনী অথবা বৃহত্তর কোনো জোট নির্মাণ করতে পারবে কি না, সেই প্রশ্ন। সম্প্রতি হয়ে যাওয়া উপনির্বাচনে নৈহাটি কেন্দ্রে সিপিআই(এম-এল) লিবারেশনের প্রার্থীকে সিপিএম সমর্থন করায় এই নিয়ে আলোচনা আরও গতিপ্রাপ্ত হয়েছে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। অনেকেই মনে করছেন যে, একটিকে বাদ দিতে অন্যটি হবে না, বিশেষ করে বামপন্থীদের মধ্যে ঐক্য ব্যাতিরেকে বামপন্থার পুনর্জীবন সম্ভব নয়।
এখানে একটা কথা প্রথমেই বলা দরকার যে, বামপন্থীরা যতদিন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের কথা বলবে, তাঁদের সুখ-দুঃখ নিয়ে ভাববে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে, লড়বে এবং গড়বে ততদিন বামপন্থা মরবে না, শত পরাজয় সত্ত্বেও, শত বিপর্যয় সত্ত্বেও ফিনিক্স পাখির মত বারেবারে সে তার ভস্মস্তুপ থেকে আকাশে ডানা মেলে উড়ে যাবে। অর্থাৎ, বামপন্থীদের ভাবতে হবে মানুষকে নিয়ে, নিজেদের নিয়ে নয়। এই ভাবনায় কোনো খাদ থাকা চলে না, কোনো অভিনয় বা ভনিতা থাকা চলে না, এটি কোনো কৌশল নয়, এ প্রাথমিক নীতিগত প্রশ্ন। তবেই মানুষ ভাববে বামপন্থীদের নিয়ে। অর্থাৎ, বামপন্থীরা ভাববে মানুষকে নিয়ে, মানুষ ভাববে বামপন্থীদের নিয়ে। এর কোনোরকম অন্যথা চলতে পারে না। চললেই বুঝতে হবে বামপথীরা বামপন্থা থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। এর ফলই হল বিচ্ছিন্নতা। মানুষের থেকে বিছিন্নতা, যা দক্ষিণপন্থী শক্তিকে সুযোগ করে দেয় বামপন্থীদের মানুষের শত্রুতে পরিণত করতে৷ এই অবস্থা বামপন্থার পুনর্জাগরণে বাধাস্বরূপ। ভারতের কমিউনিষ্ট আন্দোলন সম্পর্কে যার কিছুমাত্র ধারণা আছে তারাই জানেন যে পার্টি বারেবারেই বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে, কিন্তু ততবারই সে কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ১৯৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশগ্রহণ না করাটা ছিল একটা বড় ভুল যা পার্টিকে বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলেছিল। কিন্তু তার তিন বছরের মধ্যেই নৌবিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়ে পার্টি আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। ১৯৬২-র চীন-ভারত যুদ্ধের সময়ে উগ্র জাতীয়তাবাদী স্রোত পার্টিকে গণবিচ্ছিন করে দিয়েছিল। কিন্তু তার কয়েক বছরের মধ্যেই (১৯৬৭) পার্টি কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে সরকারে আসীন হয়েছিল। এগুলো ঘটতে পেরেছিল কেন? কারণ পার্টি নিজেকে নিয়ে ভাবে নি। সে মানুষকে নিয়ে ভেবেছিল। সেই ভাবাতে কোনো খাদ ছিল না, অভিনয় ছিল না। তাই মানুষ বারেবারেই পার্টিকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিল।
এখন কী হচ্ছে?
এখন সব ধরণের বামপন্থীরাই নিজেদের কথা ভাবছেন। আর মানুষের কথা ভাবার অভিনয় করছেন। নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার একটা সিঁড়ি হিসাবে মানুষের সুখদুঃখ নিয়ে নাড়াঘাঁটা করার ভান করছেন। এর ফলেই বামপন্থার পুনর্জীবন সম্ভব হচ্ছে না। সিপিএমের কথা ধরা যাক। ১৯৭৭-এ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তাঁরা সর্বদাই চেয়েছেন যে কোনো মূল্যে সরকারে থাকতে। “বামফ্রন্ট সরকার সংগ্রামের হাতিয়ার” শ্লোগান ধীরে ধীরে “বামফ্রন্ট সরকারকে চোখের মণির মত রক্ষা করুন” শ্লোগানে পরিবর্তিত হয়ে গেছে। সরকার রক্ষা করার কাজ বামপন্থীদের ছিল না। সেটি মানুষই করত, যদি বুঝত এই সরকার তাঁদের সরকার। মানুষের যা করণীয় সেটি নিজের হাতে তুলে নিয়ে পার্টি ক্রমশ মানুষেরই শত্রুতে পরিণত হয়েছে। নিজের কাজ ভুলে গেছে। বামফ্রন্ট সরকার যে রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে আসীন হয়েছে সেই ব্যবস্থাটার সাথেই মানুষের একটা মৌলিক শত্রুতা আছে তা তাঁরা ভুলে গেলেন। ফলে যে কোনো মূল্যে সরকার রক্ষা করার তাগিস তাঁদের মানুষের শত্রুতে পরিণত করল। মুশকিলের ব্যাপার হল এই যে, এখনও তাঁরা এই মৌলিক গলদটা ধরতে পারছেন না। ফলে একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। অন্যদিকে, নকশালপন্থীরা মজে আছেন তাঁদের নিজস্ব কিছু স্বরাপিত ফর্মুলা নিয়ে। তাঁদের কাছে মানুষের স্বার্থের থেকেও ঐ ফর্মুলাগুলি মূল্যবান। বামফ্রন্ট তথা সিপিএম যদি যে কোনো মূল্যে সরকার রক্ষার জন্যে মানুষের শত্রু হয়ে থাকে তবে নকশালপন্থীরা যে কোনো মূল্যে কতকগুলি শিলীভূত ফর্মুলা রক্ষার জন্যে মানুষের স্বার্থের পক্ষে দাঁড়াতে পারছেন না। তাঁরা হয়ত মানুষের শত্রুতে পরিণত হন নি, কিন্তু বাস্তব রাজনীতিতে অপাংক্তেয় হয়ে গেছেন। এই পরিস্থিতি দক্ষিণপন্থী এবং উগ্র দক্ষিণপন্থী শক্তির বাড়াবাড়ির রাস্তা খুলে দিয়েছে।
তাহলে কী করতে হবে?
প্রথমেই এ কথা বুঝতে হবে যে, সারা দেশের বর্তমানে যা পরিস্থিতি, দক্ষিণপন্থা আর ফ্যাসিবাদের বাড়াবাড়ির এই যুগে বামপন্থীদের মধ্যে এক ধরণের ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের জায়গা গড়ে তুলতে হবে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, বর্তমানে বামপন্থীদের মধ্যে কোনো ঐক্য নেই, কিন্তু আলাদা আলাদা করে বাম-ডান ঐক্য গড়ে উঠছে। আমি আপাতত আলোচনার সুবিধার জন্যে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকব। এখানে সিপিএম সব কিছুতেই চলেছে কংগ্রেসের সাথে। আর নকশালপন্থীদের একটা অংশ বিজেপিকে আটকানোর গুরুত্ব উপলব্ধি করে তৃণমূলের প্রতি নরম মনোভাব নিচ্ছেন। এগুলি একটি বিশেষ সময়ের বিশেষ খন্ডযুদ্ধের কৌশল হিসাবেই যে বিবেচিত হচ্ছে এমন নয়। তা হলে অত কিছু বলার থাকত না। এগুলি যেন ফ্যাসিবাদের সমগ্র পর্যায়জুড়ে একটি সাধারণ রণনীতিতে পর্যবসিত হচ্ছে। সমস্যা এইখানে। এতে প্রধান যে সমস্যা তৈরি হচ্ছে তা হল বামপন্থীদের কোনো বিকল্প নীতি, বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি মানুষের কাছে উপস্থিত হচ্ছে না। যেটা ভুলে যাওয়া হচ্ছে যে, ফ্যাসিবিরোধী সংগ্রামে বাম নেতৃত্ব জরুরী। এই নেতৃত্ব তখনই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে যখন দেশের তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠা সমস্যাগুলির একটা বিশ্বাসযোগ্য সমাধান বামপন্থীরা হাজির করবেন এবং তা রূপায়নের জন্যে শক্তিশালী রাজনৈতিক হাতিয়ার গড়ে তুলবেন। বর্তমানে বামেদের না আছে নির্দিষ্ট সমাধানসূত্র, না আছে তা রূপায়নের হাতিয়ার। তাঁরা কেবল দক্ষিণপন্থীদের পেছন পেছন ছুটে আর সরকারকে সমালোচনা করেই ভাবছেন এগিয়ে যেতে পারবেন।
ভাবনাচিন্তার সুবিধার জন্যে আমি গ্রিসের উদাহরণটির দিকে একবার তাকাতে বলব। এর অর্থ এই নয় যে, আমাদের অন্ধভাবে তা অনুসরণ করতে হবে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে ইউরোপে বামপন্থীদের একটি উল্লেখযোগ্য সফল পদক্ষেপ হিসাবে যদি আমরা তা পর্যালোচনায় রাখি তাহলে বর্তমান ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গে আমাদের করণীয় কাজ বুঝতে আমাদের সুবিধা হতে পারে। গ্রিসে বামপন্থীরা ২০০১ সাল থেকেই ঐক্যবদ্ধ কাজকর্ম চালানোর জন্যে কথাবার্তা চালাচ্ছিলেন। ২০০৮-এর বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দায় সবথেকে বেশি আক্রান্ত হয় আমেরিকা এবং ইউরোপ। এর ফল ফলতে শুরু করে অতিদ্রুত। দেশে দেশে ব্যয় সংকোচন শুরু হয়, শ্রমিকশ্রেণির অর্জিত অধিকাররের যে ছিঁটেফোঁটা রয়ে গেছিল সেগুলিও কেড়ে নেওয়া শুরু হয়। নয়া উদারবাদী সংস্কার ব্যাপক আকার ধারণ করে। এর প্রতিরোধে গ্রিসে ২০১০ সালের পর থেকে আরও ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওঠে। ২০০৪ সালেই গঠিত হয়েছিল গ্রিসের র্যাডিকেল বামপন্থীদের একটি মঞ্চ, যার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘'সাইরিজা”! প্রকৃত নামটি অনেক বড়, যার সংক্ষেপিত রূপ ছিল ‘'সাইরিজা”। এটি একটি কথার খেলাও বটে। গ্রিসে ‘সাইরিজা’ শব্দের অর্থ ‘মূল থেকে’ (from the roots)। প্রাথমিকভাবে এই মঞ্চটিকে একটি ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের মঞ্চ বলেই ভাবা হচ্ছিল, কিন্তু গ্রিসের রাজনীতিতে ভয়াবহ শূন্যতাকে লক্ষ্য করে মঞ্চের বড় শরিক ‘'সাইনাসপিসমস” এটিকে নির্বাচনী জোট হিসাবেও প্রসারিত করার প্রস্তাব করেছিল য সবাই মেনে নিয়েছিল। ২০০৪-এর নির্বাচনে সাইরিজা সাড়ে তিন শতাংশের মত ভোট পেয়েছিল এবং তাঁদের চারজন সদস্য নির্বাচনে জিতে পার্লামেন্টে যায়। ২০০৮ সালের সংকটের পর যতই সংকটের ফল ফলতে শুরু করেছে সাইরিজার কড়া নয়া উদারবাদী বক্তব্য শ্রমিক ও খেটেখাওয়া মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় হতে শুরু করে। ২০১২ সালে তারা দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়। পার্লামেন্টে তাঁদের সদস্য সংখ্যা পঞ্চাশ ছাড়িয়ে যায়। ২০১৩ সালে সাইরিজা একটি ঘোষণাপত্র প্রকাশ করে। সেখানে তারা কী বলেছিল সেটা একটু মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করুন:
"The body we are establishing is a pluralistic body, open to the existence of different ideological, historical and value sensitivities and currents of thought. It is anchored by class in the labor and wider popular movement, but also with explicit feminist and ecological goals. It is already gathering forces and currents of the communist, radical, renewalist, anti-capitalist, revolutionary and libertarian Left of all shades, left-wing socialists, democrats, forces of left-wing feminism and radical ecology. Because it respects and considers differences like the above to be its wealth, it recognizes the possibility of different political considerations and provides ground for both these sensitivities and these considerations to be cultivated seamlessly and represented in the internal democracy, always aiming at promotional compositions. The organization we are establishing is an organization that systematically takes care of the theoretical understanding of social and historical development and the theoretical education of its members. It draws on Marxist and more broadly emancipatory thought and its history and tries to elaborate it further, making use of every important theoretical contribution."
এর পরেই সাইরিজা গ্রিসের রাজনীতিতে বুর্জোয়া নিউ ডেমোক্রাটিক পার্টির শাসনের একটি গ্রহণযোগ্য বিকল্প হয়ে ওঠে। ২০১৪ সালে গ্রিসের ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচনে নিউ ডেমোক্রাটিক পার্টির থেকে এগিয়ে যায়। এই বছরেরই সেপ্টেম্বর মাসে সাইরিজা গ্রিসের সরকারে আসলে কী ধরণের নীতিপদ্ধতি অনুসরণ করে কাজ করবে তার সবিস্তার বর্ণনা লিপিবদ্ধ করে। এই কর্মসূচিটি থেসালোনিকি কর্মসূচি বলে পরিচিত। এই কর্মসূচিতে ব্যাপকভাবে নয়া উদারবাদের বিরোধিতা করা হয়। সরকারের ব্যয় সংকোচনের মধ্যে দিয়ে মেহনতী মানুষের ওপর আক্রমণের তীব্র বিরোধিতা করা হয়। এর পালটা অর্থনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। বিখ্যাত গ্রিক কমিউনিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পার্টিনেতা ভারুফাকিস ছিলেন অর্থনৈতিক বিকল্প নির্মাণের প্রধান কারিগর। ২০১৫ সালের শুরুতেই নির্বাচনে বুর্জোয়া নিউ ডেমোক্রাটিক পার্টিকে পরাজিত করে সাইরিজা গ্রিসের সরকারে চলে আসে। আলেক্সিস সিপ্রাস প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। অর্থমন্ত্রী হন ওয়াইনিস ভারুফাকিস।
আমি গ্রিসের উদাহরণ দিলাম এটা দেখানোর জন্যে যে যদি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় তাহলে আপাত অসম্ভবকেও সম্ভব করা যায়। গ্রিসে দশ বছরের মধ্যে একটা শক্তি একেবারে ভূমি থেকে উঠে এসে সরকার গঠন করে ফেলেছিল। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এইরকম উদাহরণ অনেক আছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে অন্তত পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে আমাদেরও একটা সাইরিজা চাই। রাজ্যের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সেই কথাই বলে। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে যে, পশ্চিমবঙ্গে কিছু অতিরিক্ত চ্যালেঞ্জও আছে যার সঠিক সমাধানের ওপরই বাম-র্যাডিক্যাল বাম রাজনৈতিক জোটের রাজনৈতিক সফলতা নির্ভর করছে। প্রথম চ্যালেঞ্জ হল এখানে বামফ্রন্টের ৩৪ বছরের শাসনের একটি অভিজ্ঞতা মানুষের আছে। প্রথম দিককার কয়েক বছর বাদ দিলে (অবশ্য তার মধ্যেও মরিঝাঁপির মত অভিজ্ঞতা আছে) যার অভিজ্ঞতা মানুষের কাছে সুখের নয়। বর্তমানে নতুন করে কোনো ধরণের বাম সরকারের কথা পাড়লেই মানুষের সেই অভিজ্ঞতা মনে আসতে বাধ্য। আবার বামফ্রন্ট তথা সিপিএমকে বাদ রেখেও পশ্চিমবঙ্গে কোনো কার্যকরী বাম রাজনৈতিক বিকল্প গড়ে তোলার মত জায়গায় র্যাডিক্যাল বামেরা নেই। এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে গেলে বামফ্রন্টীয় পার্টিগুলিকে, বিশেষ করে সিপিএমকে, অতীতের ভুল পদক্ষেপগুলিকে প্রকাশ্যে চিহ্নিত করে আত্মসমালোচনা করতে হবে। নতুন করে পলিসি নির্ধারণ করতে হবে। প্রকৃত গণতন্ত্রকে সম্মান করতে হবে, আপোষহীনভাবে নয়া উদারবাদকে বিরোধিতা করতে হবে, সরকারকে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের সংগ্রামের হাতিয়ার হিসাবে দেখতে হবে। বিরোধীদের নিকেশ করা, দমন করার রাস্তা পরিত্যাগ করতে হবে। তীব্রভাবে প্রকৃতিবান্ধব নীতি গ্রহণ করতে হবে। এক ধরণের ইকো-সোশ্যালিশমের রাস্তা নিতে হবে। পাশাপাশি লিঙ্গ প্রশ্নেও তাকে সর্বাধুনিক মতাদর্শ গ্রহণ করতে হবে। তথাকথিত নিম্নজাত, নিপীড়িত লিঙ্গ, মার্জিনাল শ্রেণি, শ্রমিক-কৃষক খেতমজুরদের স্বার্থে তাকে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে হবে। থেসালোনিকি কর্মসূচির মত বিস্তারিত কর্মসূচি হাজির করতে হবে। পুরনো বস্তাপচা চিন্তা-ভাবনা, স্লোগান, অনুশীলন ও মনস্তত্ত্ব থেকে নির্ধারকভাবে বেরিয়ে আসতে হবে।
অন্যদিকে দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হল নকশালপন্থীদের একাংশ বামপন্থীদের দ্বারা যে কোনো সরকার গঠনেরই বিরোধী। এঁদের কাছে সরকারের কাজকম্ম বিবেচ্য নয়। সরকার গঠন করাই এঁদের কাছে সংশোধনবাদ। এঁদের বস্তাপচা এবং অমার্কসীয় অবস্থানকে তীব্রভাবে তাত্ত্বিক সংগ্রামের সামানে দাঁড় করাতে হবে। এই ভ্রান্ত অবস্থানই এক শ্রেণির নকশালপন্থীদের সর্বদাই কোনো না কোনো বুর্জোয়া সরকারের লেজুড়বৃত্তি করতে বাধ্য করেছে। অথবা, রাজনীতি থেকেই একপ্রকারের অবসর নেওয়ার দিকে ঠেলে দিয়েছে। এর বিরোধিতা করতে হবে।
কাজগুলো কঠিন সন্দেহ নেই। কিন্তু অসম্ভব নয়। ইতিহাস সব সময়ে সহজ কাজ বিপ্লবীদের জন্যে সংরক্ষিত করে রাখে না। যেটা চাই সেটা হল সাহস। স্বপ্ন দেখার সাহস। নতুন পথে হাঁটার সাহস। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় যাবার সাহস। তবেই বামপন্থার পুনর্জীবন সম্ভব। নচেৎ নয়।