জগতে যা কিছু আছে, যা কিছু জাগতিক, তা আসলে সবার। আকাশ থেকে নেমে আসা তারাখসা, দিকবিদিক ভাসানো চাঁদের আলো, এই গনগনে উত্তপ্ত সূর্য, বৃষ্টি-বাদলা-খরা-বন্যা সব সব সব। আরো যা কিছু আছে নাগালে বা নজরের বাইরে, সব। যা কিছু ঘটছে চারপাশে, যতটুকু জানা-শোনা গেল, যতটা ভাবালো বা বুঁদ করে রাখলো, সবই আসলে সবার। তাতে দল-মত নেই, জাত-ধর্মের আরোপ নেই। অবাক হওয়া বা বিষাদের মাঝে স্রেফ খোঁজ আছে নিজস্ব ভাষার। আছে অজস্র রঙে মাখামাখি দুনিয়ায় - মনের রং খুঁজে নেবার প্রবণতা। কৃষ্ণজিৎ ওটুকুই পারেন। ছবিতে ধরে রাখেন দিনের নির্যাস। না বলা কথার রং খোঁজেন, রেখা খোঁজেন।
'মা বলতেন, আড়াই বছর বয়স থেকে এক মনে আঁকে ছেলেটা।' সে অর্থে কৃষ্ণজিৎ সেনগুপ্তের কোনও প্রথাগত শিক্ষা নেই।
বহরমপুর কমার্স কলেজের প্রাক্তনী কৃষ্ণজিৎ এখন বছর উনপঞ্চাশের পরিপূর্ণ শিল্পী। ২৭ বছর আগে ঠিক করলেন, 'ছবি আঁকাই হোক পেশা'। নিজের মতো আঁকতে আঁকতে ততদিনে ছবিতেই পান জীবনের মানে। রোজ আঁকেন। রোজ কথা বলেন নিজের সঙ্গে, চারপাশের সঙ্গে। আজকাল, রাতের ফেসবুক পোস্টে থাকে দিনের নির্যাস।
দল নেই তাঁর। নানারকম বড় হওয়ার পথে সমাজ-রাজনীতির নানা ওঠা-নামা দেখেছেন। 'প্রাত্যহিক প্রশ্ন, আরো সুচিন্তিত প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে মন নাজেহাল হলে, ওই ক্যানভাসটুকুই ভরসা। গত তিন দশক এমনই চলছে!'
গত, ২৩ অগাস্ট। ভারতের বিজ্ঞানীরা চাঁদ ছুঁতেই, আনন্দে কৃষ্ণজিতের ক্যানভাস রং ছুঁড়লো চাঁদে।
আপামর ভারতের উচ্চাস! আনন্দের জয়চিহ্ন এঁকে দিলেন চিত্রকর!
দিন কয়েকের মধ্যে বদলে গেল ছবিটা। অন্ধবিশ্বাসের রাজনীতি, কুসংস্কারের বাজার আর আসন্ন ভোটের আগাম প্রচার যেন দখল করলো বিজ্ঞানের জয়যাত্র। প্রবাহমান জগতের কৌতুহল ও প্রশ্ন হয়ে উঠল অন্ধবিশ্বাসের বিচরণভূমি। যেন হোঁচট খেলেন চিত্রকর স্বয়ং। "চাঁদে হিন্দুরাষ্ট্র ঘোষণা করতে হবে।" হিন্দুত্ববাদীদের এই দাবিতে আসলে 'বিজ্ঞান-বিরোধী, শিক্ষা-বিরোধী, চেতনা-বিরোধী ভোটের সমীকরণ মাপা!' মুর্শিদাবাদের চিত্রকর কৃষ্ণজিৎ সেনগুপ্তের কার্টুন পেল সহজ ভাষা। সরল ইন্টারপ্রিটেশন। সজোর প্রতিবাদ।
ইতিমধ্যে কৃষ্ণজিৎবাবুর অপবিজ্ঞান ও বিজ্ঞানমনস্কতার দ্বন্দ্বের এই রূপকটিই ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিরও সহজ বর্ণনা। 'ভারতের চন্দ্রজয়ের মত ঘটনায় তৃতীয় বিশ্বের দেশের মানুষকে নানান কুসংস্কার থেকে বের না করে এনে, বিজ্ঞানের সাফল্যে তাগা-আংটি জুড়লো যারা, তারা আসলেই - ভোট আর দখল চান।'
কৃষ্ণজিৎবাবুর ছবিটি ফেসবুকে আসা মাত্রই শেয়ার করেছেন চিত্রকর হিরণ মিত্র, সাহিত্যিক কিন্নর রায়রা। কিন্নরবাবু বলেন, -'বহুকাল ধরে কৃষ্ণজিতের ছবি তাকে ভাবায়। সময়কে নিয়ে তাঁর কাটাছেঁড়া ও রসবোধ আসলে প্রকৃত কার্টুনিস্টের চলন।'
সমাজ, রাজনীতি, কুসংস্কার, বৈজ্ঞানিক অ্যাচিভমেন্ট - সবকিছু সঙ্গী করে সময়টা চলছে। লড়াই চলছে মিছিলে, ট্রামে-বাসে, কাব্যে, ক্যানভাসে। আপাতত, কৃষ্ণজিতের আলোচ্য ছবিটি - অন্ধবিশ্বাসহীন সব মানুষের মনের কথা। প্রকৃত শিল্পী যা খুঁজে পান মাত্র।
তথাকথিত কোনও রাজনৈতিক দল ও মতের সঙ্গে থাকেননি কখনও। আজও থাকতে চান না। তবে, সময় ও সমাজের সঙ্গে কথা বলেন। তাঁর নিরলস কথা বলার অস্ত্র তাঁর রংতুলি।
ভারতের চন্দ্র-অভিযান আপ্লুত যেমন করেছিল, চাঁদে হিন্দুরাষ্ট্র ঘোষণার দাবি কেউকেউ তোলার পর, - বিরক্ত কৃষ্ণজিৎ। বললেন, চাঁদ সবার। বিজ্ঞানের অসীম অনন্তকে কয় করা বিজ্ঞানীদের সাফল্যকে গ্রাস করে দখল নিতে চাইছে অন্ধবিশ্বাসের ব্যাপারীরা। সরল ও বিশ্বাসী মনের শিক্ষা, যুক্তি ও শিল্পকলা শেখানোর সেরা সময়ে অন্ধবিশ্বাস দিয়ে তাকে দখল করা হচ্ছে। চিত্র করের মতে, - 'এ বড় অন্যায়!'
কৃষ্ণজিতের 'হিন্দুচাঁদ' ছবিটি নিয়ে সাহিত্যিক কিন্নর রায় বলেছেন, 'শক্তিশালী ইন্টারপ্রিটেশন।' তাঁর মতে, কৃষ্ণজিৎ আসলে রসিকতা, যুক্তিবোধ ও তির্যক চিন্তা দিয়ে - অনেক গভীর কথা সহজে বলেন। একজন কার্টুনিস্ট এমনই হন।
কৃষ্ণজিৎ নিজে অবশ্য কথা কম বলেন, ছবি আঁকেন বেশি। প্রতিদিন সময়ের সঙ্গে কথা বলে তাঁর সৃষ্টি।