সারা বিশ্বের সঙ্গে করোনা আক্রান্ত আমাদের দেশও । লকডাউন আনুষ্ঠানিক ভাবে ওঠানো হলেও এখনও সব কিছু স্বাভাবিক হয়নি। এর পাশাপাশি ‘মহামারী আইন’কে সামনে রেখে দমনমূলক কাজকর্মও চালিয়ে যাচ্ছে আমাদের সরকার। কোথাও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে সমাজকর্মীদের, কোথাও ছাত্রদের। কোনও রকম প্রতিবাদ প্রতিরোধ সংগঠিত করা সম্ভব হচ্ছে না, সমাবেশ করা যাচ্ছে না। কোনও মানুষই সংগঠিত হতে পারছেন না, ফলত ক্ষোভ আছড়ে পড়ছে সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন হ্যাশ ট্যাগ সামনে আসছে। গণ-আন্দোলনের কর্মীদের মুক্তির দাবি থেকে শুরু করে করোনা সংক্রান্ত চিকিৎসা কেন পাওয়া যাচ্ছে না, সেই সংক্রান্ত লেখা ও অভিজ্ঞতাও পাওয়া যাচ্ছে বিস্তর। সমস্ত কিছু দেখেও সর্বোচ্চ আদালত না দেখার ভান করছে, আর তা নিয়ে কোনও আইনজীবী কিংবা সাধারণ নাগরিক যদি সোশ্যাল মিডিয়াতে তাঁদের ন্যায়সঙ্গত ক্ষোভ উগড়ে দেন ফেসবুক বা টুইটারে, তখন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আদালত অবমাননার মামলা করে তাঁকেই দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে, এই উদাহরণ আজ আর নতুন নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও, বিজেপির ঘৃণা ও বিদ্বেষের রাজনীতির বিরুদ্ধে অনবরত কথা চলছে, এবং তা চলছে এই ফেসবুকেই।
আমরা যারা ফেসবুকে বিভিন্ন সময়ে লেখালিখি করি, তাঁরা ভুলে যাই যে এই সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম আসলে একটি কর্পোরেট কোম্পানি, যারা নিজেদের ব্যবসা ছাড়া কিছু বোঝে না। দেখা গেছে যে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন লেখার ক্ষেত্রে ফেসবুক বলে এই লেখাটি বা ছবিটি তাঁদের ‘কমিঊনিটি স্ট্যান্ডার্ড’ বিরোধী, তাই তাঁরা ওই পোস্ট বা ছবিটিকে ফেসবুকে থাকতে দিতে পারে না, তাই সরিয়ে নিতে হবে, না হলে ব্যবহারকারীর অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া হবে বা ব্লক করে দেওয়া হবে। কখনও দেখা যায় যে কেউ কেউ বলছেন তাঁদের লেখা ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না। এর পিছনে কারণটা কী সেটা এতদিনে পরিষ্কার হচ্ছে।
আমেরিকার নামি পত্রিকা ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল সম্প্রতি একটি খবর করেছে যে ফেসবুকের যে নিজস্ব নিয়ামাবলি আছে যা দিয়ে তাঁরা কোনও একটি লেখা বা ছবিকে বলে যে এটি তাঁদের ‘কমিঊনিটি স্ট্যান্ডার্ড’ বিরোধী, সেটা বিজেপি কিংবা আরও দক্ষিণপন্থী সংগঠনের ক্ষেত্রে মানা হয়নি। যদিও তাঁরা নিজেরা জানতেন যে এই লেখা কিংবা ছবিগুলো ফেসবুকে থাকলে তা কোনও গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় বিরোধী বলে প্রমাণিত হবে, তা সত্ত্বেও তাঁরা নিজেদের নিয়মই মানেননি। শুধু তাই নয়, যে সময়ে করোনা ছড়ানোর দায় তবলিগ জামাত তথা পুরো মুসলমান সম্প্রদায়ের উপর দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল, সেই সংক্রান্ত পোস্টও তাঁরা সরায়নি, উল্টে নিরন্তর শেয়ার হতে দিয়েছে। খবরে প্রকাশ যে ফেসবুকের ভারতের যিনি অন্যতম দায়িত্ব প্রাপ্ত, সেই আঁখি দাস, নিজে বলেছেন যদি ভারতের ক্ষমতাসীন দলকে চটানো হয়, তাহলে এদেশে ফেসবুকের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এখনকার যারা ফেসবুকে চাকরি করেন তাঁদেরই মধ্যে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন জানিয়েছেন যে আঁখি দাস, নিজে চাননি, যাতে বিজেপির বিরুদ্ধে এবং বিজেপির সমর্থকদের করা কোনও পোস্টের বিরুদ্ধে কোনওরকম পদক্ষেপ করা হয়। ভারতের বিগত সাধারণ নির্বাচনে ফেসবুক কী করে শাসক দলের সুবিধা করে দিয়েছে, সেটা হয়তো অনেকেরই জানা। বিরোধী কোনও পোস্টের শেয়ার বা লাইক কমে যাওয়া থেকে শুরু করে, হোয়াটস্যাপে পেগাসাস ভাইরাস ঢুকিয়ে নজরদারির মতো ঘটনাও বিরল নয়। তেলেঙ্গানার বিজেপি বিধায়ক বা আরেকজন বিজেপি সাংসদ অনন্ত কুমার হেগডে দিনের পর দিন মুসলমানবিরোধী প্রচার চালিয়ে গেলেও তা নিয়ে ফেসবুক কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকি কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া দিল্লির দাঙ্গার ঘটনা নিয়েও যে কপিল মিশ্রর বিভিন্ন উস্কানিমূলক কথা ফেসবুক জুড়ে প্রচার হয়েছে তা নিয়েও এই আঁখি দাস কোনও রকম কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে দেয়নি ফেসবুককে।
এবার আসা যাক কেন আঁখি দাস এটা করেছেন? এইটা জানার জন্য একটা পুরনো ঘটনা উল্লেখ করা জরুরি। আঁখি দাসের বোন রেশমী দাস বিজেপির জেএনইউ-এর মাথা ছিলেন, এবং বরখা দত্তকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে জেএনইউতে এবিভিপি যে বিরোধী ছাত্রছাত্রীদের মেরেছিল, সেই ঘটনাকে সমর্থন করেছিলেন। এবার ফেসবুক আর জিওর যে চুক্তি হয়েছে সেখানেও রেশমী দাস আছেন। শুধু তাই নয় এই যে ফেসবুকে এতো নোংরা গালিগালাজ করা হয়, সেটাকে অনুমোদন করেন কে? এই আঁখি দাস।
২০১৪ র আগে মুম্বাই এর এক প্রযুক্তিবিদ রাজেশ জৈন, যিনি নরেন্দ্র মোদীর হয়ে কাজ করেছিলেন তিনি একটি তথ্যভাণ্ডার তৈরি করেছিলেন, পোলিং বুথের তথ্য, এবং ভোটার লিস্ট দিয়ে, যা দিয়ে হোয়াটস্যাপ এবং ফেসবুকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে প্রচার চালানো যায়। কোনটা বিজেপির পক্ষে ভালো সিট, কোনটাতে মুসলমান বেশি, কোনটাতে দলিত বেশি, এই সবরকমের তথ্য সংশ্লেষণ করা হয়, যাতে সেইরকম ভাবে প্রচার করা যায়। এই কাজটা শুরু হয়েছিল মোটামুটি ২০১০ সাল থেকে। তারপরে সেই তথ্য বিজেপির ‘মিসড কল’ মেম্বারশিপের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়। যারা মোদীকে সমর্থন করেন, তাঁদের কাছে মেসেজ যায় যে তাঁদের ভোটার কার্ডের তথ্যও যেন জানানো হয়, ব্যস খেলা শেষ। এই রাজেশ জৈনকে পরে আধারের বোর্ড মেম্বার করা হয় পুরস্কার হিসেবে।
ফেসবুক আসলে প্রচুর টাকা রোজগার করে, সাধারণ মানুষের মনস্তত্ব নিয়ে কাজ করে, সাধারণ মানুষ যেভাবে ফেসবুককে বিশ্বাস করে, সেই বিশ্বাসের জায়গাকে নিয়েই ওরা নাড়াচাড়া করে, ওরা বলতে চায় যে মানুষ ওঁদের মতো করে ভাবে, ওঁরাই নিয়ন্ত্রণ করে সমস্ত কিছু, মানুষের আবেগ থেকে শুরু করে হাসি, কান্না সব কিছু। ওঁরাই ঘৃণার চাষ করে, সারাক্ষণ মুসলমান বিরোধী লেখাকে এমন ভাবে সামনে নিয়ে আসে যে সরলমতি মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে, মুসলমান মাত্রেই সন্ত্রাসবাদী, মুসলমান মানেই ৮-১০ টা সন্তানের পিতা… ধীরে ধীরে মানুষের মনে ঘৃণার সঞ্চার হতে থাকে, আর ওঁরা আরও লাভবান হতেই থাকে। ওঁদের এখন দরকার হোয়াটস্যাপ পে, সেই কারণেই ফেসবুক এখন বিজেপিকে চটাবে না, আর আমরা ভেবেই চলবো, আমরা ফেসবুকে লিখে মানুষকে সচেতন করবো! কিন্তু তা কি কখনও সম্ভব? ওঁদের মাঠে নেমে, ওঁদেরই বল নিয়ে, ওঁদেরই রেফারি, এবং দর্শকের সামনে ওঁদের কি হারানো সম্ভব ?