পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

আচার্য বিনয়কুমার সরকার: কিছু কথা

  • 01 January, 1970
  • 0 Comment(s)
  • 419 view(s)
  • লিখেছেন : ঋষি ঘোষ
জাতীয়তা-আন্তর্জাতিকতা পেরিয়ে স্মৃতি-বিস্মৃতির নেপথ্যে:আচার্য বিনয়কুমার সরকার। আলোচনা করলেন . ঋষি ঘোষ

নিজভূমে পরবাসী'-এ ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না তাঁর সম্পর্কে। অথচ মালদা জেলার অন‍্যতম শ্রেষ্ঠ ভূমিপুত্র সম্ভবত তিনিই-আচার্য বিনয়কুমার সরকার। তাঁর নামাঙ্কিত রাস্তা(বি.এস রোড),তাঁর মূর্তি,তাঁর নামের অতিথিনিবাস(বিনয় সরকার অতিথি আবাস) বা বিশ্ববিদ‍্যালয় ভবনের বাইরে তাঁর ১৩৭তম জন্মদিবসে তাঁকে নিয়ে কোনো স্মরণের উদ‍্যোগ তাঁর জন্মভূমি মালদাতেই দেখা গেল না। বাকি পশ্চিমবঙ্গের কথা বলাই বাহুল্য। অথচ তাঁর প্রাণের প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশন,বর্তমান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েই একসময় নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়েছে বিনয় সরকার স্মারক বক্তৃতা। বঙ্গীয় জাতীয় শিক্ষা পরিষৎ থেকে প্রকাশিত সেই বক্তৃতামালার মুদ্রিত সংস্করণ এখনো খুঁজলে পাওয়া যেতে পারে।তাঁর কালজয়ী গ্রন্থ 'বিনয় সরকারের বৈঠকে' একসময় বাঙালিকে মাতিয়ে রেখেছে। সহজ সরল মাটিঘেঁষা গদ্যভাষার আড়ালে তিনি সযত্নে ঢেকে দিয়েছেন অর্থনীতি সমাজনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে তার পাণ্ডিত্যপূর্ণ গবেষণাকে। তার নিজের ভাষাতেই জ্ঞানচর্চার আস্ফালনকে তিনি বলতেন-"শুকনো পন্ডিতি"; বরাবর তিনি তার বিরোধিতাই করে এসেছেন।

 উল্টোদিকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে এই আন্তর্জাতিক বাঙালিকে নিয়ে গবেষণা ও চর্চার অন্ত নেই-আমেরিকার নিউইয়র্কে বিশ্ববিদ‍্যালয়ের অধ‍্যাপক শতদ্রু সেনের গবেষণাগ্রন্থ যেমন প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থা  রাওলাজ থেকে;তেমনই কৃতী গবেষক ড.তুষারকান্তি ঘোষের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে দুই খণ্ড বিনয় সরকার রচনাবলী। বিনয় সরকারের গভীর মননচর্চা নিয়ে গবেষণা চলছে দেশ ও দেশের বাইরে একাধিক বিশ্ববিদ‍্যালয়ে।তিনি এমনই একজন বাঙালি যিনি আঞ্চলিক হয়েও আন্তর্জাতিক- তাঁর জন্ম প্রাচীন বঙ্গের রাজধানীতে(গৌড়ভূমি তথা মালদা),কর্ম ব্রিটিশ ভারতের রাজধানীতে(কলকাতা) আর মৃত‍্যু আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানীতে(ওয়াশিংটন ডি সি)-এমনই মত প্রকাশ করেন বিনয় গবেষকদের একটা বড়ো অংশ।তাঁদের মতে,সমাজতাত্ত্বিক ছাড়াও মালদার লোকসংস্কৃতিকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার ব্যাপারেও তাঁর অবদান বিরাট।
     

বিনয় সরকারের কাছে যাওয়া মানে নিজের শিকড়ের অনুসন্ধান।‌নিজের অস্তিত্ব,নিজের মাটি সম্বন্ধে সচেতন না হলে ভবিষ‍্যৎ প্রজন্ম অন্ধকারে থেকে যাবে।তাই এগিয়ে আসতে হবে আমপাঠককে, জঙ্গি জাতীয়তাবাদের এই রাক্ষসবেলায় আরো বেশি করে প্রয়োজন বিনয় সরকার পাঠ। কেননা,বিনয় সরকার নিবিড়তম আঞ্চলিকতা থেকে ইতিবাচক অর্থে জাতীয়তার ধারণা বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর জাতীয়তাবাদের তাত্ত্বিক ধারণা,যা 'সরকারইজম' নামে পরিচিত-তা জাতীয়তা থেকে আন্তর্জাতিকতার পথে এক অন্যরকম আলোর দিশারী হয়ে উঠতে পারে।
      

মালদা কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ‍্যাপক ও কলকাতা বিশ্ববিদ‍্যালয়ের সেন্টার ফর আর্বান ইকোনমিক স্টাডিজ-এর সাম্মানিক গবেষক ড.অনিশ মুখোপাধ‍্যায়ও তাঁর বক্তব‍্যে জোর দেন বিনয় সরকার নিয়ে বহুধাবিস্তৃত চর্চার দিকটিতে,তাঁর মতে-বিনয় সরকার সমাজতত্ত্ব চর্চার এক দার্শনিক ভিত্তিভূমি রচনা করেছিলেন,যা স্বদেশের থেকেও বিদেশে সমাদৃত হয়েছে বেশি।বিনয় সরকার চর্চা ও মালদা চর্চা অনেকাংশেই পরস্পরের পরিপূরক হয়ে উঠতে পারে বলেও মত প্রকাশ করেন তিনি।
       

যে বর্তমান প্রজন্মের কথা ভাবছেন এই বিশিষ্টজনেরা,বিনয়কুমার সরকারকে নিয়ে কি ভাবছে সেই নতুন প্রজন্ম? গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় ও মালদা কলেজের স্নাতকোত্তর ইতিহাস বিভাগের ছাত্র-গবেষকদের মধ্যে বিনয় সরকারকে নিয়ে সাড়া বড়ো করুণ। সামান্য ভিন্নমত প্রকাশ করেন মালদা কলেজের স্নাতকোত্তর বাংলা বিভাগের অধ্যাপিকা ড.দীপাঞ্জনা শর্মা-তাঁর মতে,মালদায় বিনয় সরকার চর্চা কম হলেও একেবারেই হয় না,এমনটি নয়। মালদা কলেজেই বিনয় সরকারের ১৩০তম জন্মদিন উপলক্ষে ২০১৮ সালে তৎকালীন অধ্যক্ষ অধ্যাপক প্রভাস চৌধুরীর উদ্যোগে একটি জাতীয় আলোচনাচক্রের মাধ্যমে এই মণীষীকে স্মরণ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিলো। প্রকাশিত হয়েছিলো স্মারকগ্রন্থ-"রিভিজিটিং প্রফেসর বিনয় কুমার সরকার।"ইতিহাসবিদ ড.অসীমকুমার সরকার জোরের সঙ্গে বলেন,বিনয় সরকারকে নিয়ে কাজ করার সম্ভাবনা প্রচুর এবং জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা প্রায় অনালোকিতই থেকে গেছে...রয়ে গেছে এমন অনেক নথি,যা নিয়ে তরুণ প্রজন্মের গবেষণা এখনো নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে।
    

তবে অন্ধকারের পাশাপাশি আলোও রয়েছে;তা সে যতই ক্ষীণ হোক না কেন। টোকিও এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বিনয় সরকারের রাষ্ট্রচিন্তা এবং রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি তার মননচর্চার দিগন্ত নিয়ে মালদা কলেজের তরুণ অধ্যাপক শুভদীপ চক্রবর্তী এই মাসেই তাঁর পিএইচ ডি থিসিস জমা দিলেন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে।পরিসংখ্যান বলছে,ভারতবর্ষের মাটিতে হওয়া বিনয় সরকার সংক্রান্ত পিএইচ ডি গবেষণায় শুভদীপের কাজটি চতুর্থ সংযোজন।তাঁর গবেষণার শিরোনাম-"দ্য ইন্টালেকচুয়াল বায়োগ্রাফি অফ আচার্য বিনয় কুমার সরকার"।এর পাশাপাশি গত বছরই প্রকাশিত হয়েছে দমদম জংশন পত্রিকার বিনয় সরকারকে বিষয়ক বিশেষ সংখ্যা।যেখানে বিনয় সরকারের অপ্রকাশিত লেখার পুনমুদ্রণ চোখে পড়ার মতো।গবেষক এবং সম্পাদকরা প্রায় একমত-জাতীয়তাবাদের একপেশে ধারণাকে প্রশ্ন করার জন্য বিনয় সরকারের সমন্বয়বাদী আন্তর্জাতিকতার ধারণা এক বিশেষ অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে।কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন নিবিড় চর্চা এবং অধ্যাবসায়।কার্নিভাল লাঞ্ছিত পশ্চিমবঙ্গে যে শব্দদুটি ফিরিয়ে আনা-জীবনানন্দের ভাষায়,"...অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ"।
    

বিনয়কুমারই লিখেছিলেন,"...এ আমার জামতল্লীর দিগ্বিজয়,এ আমার পুড়াটুলীর দিগ্বিজয়,এ আমার চুনিয়া-নুনিয়া ভাইদের দিগ্বিজয়"-আঞ্চলিকতাকে অস্বীকার করে নয়,বরং অঙ্গীকার করে আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠা এই বাঙালি মণীষা বিস্মৃতির আঁধার পেরিয়ে ডিসেম্বরের শীতার্ত রোদে আবার নতুনভাবে উজ্জীবিত হয়ে উঠুন-এই দুরূহ প্রত্যাশাটুকুই আজ শুধু বেঁচে থাকে।

0 Comments

Post Comment