পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

প্রাতিষ্ঠানিক ‘স্বাধিকার’: ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও মূল্যবোধ

  • 01 January, 1970
  • 0 Comment(s)
  • 201 view(s)
  • লিখেছেন : অশোক অধিকারী
আচার্য ত্রিগুণা সেন স্মারক বক্তৃতায় বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও পার্লামেন্টারিয়ান হীরেন মুখার্জি এক জায়গায় বলছেন,“….নিজের বিশ্বাস, নিজের মতবাদ থেকে কখনো তাঁকে বিচ্যুত হতে দেখা যায়নি।এ লোকটি তো অসম্ভব লোক।” এরকম অসম্ভব মানুষেরাই পারে অতি মূল্যবান ‘না’ শব্দটি উচ্চারণ করতে। সেটা একটা চর্চার বিষয়।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় উপাচার্য (প্রথম বাঙালি উপাচার্য স্যর গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়) স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের একটি কথা দিয়ে বিষয়ের নান্দীমুখ করা যেতে পারে, যেখানে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে তাঁর মূল্যবান দীক্ষান্ত ভাষণে বলছেন, “The University is thus the instrument of the state for the Conservation of knowledge, for the application of knowledge, and above all for the creation of knowledge makers।” আমরা যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃত্তাকার পবিত্র লোগোর দিকে তাকাই যেখানে উজ্জ্বলিত প্রভায় দীপ্যমান  ‘Advancement of Learning ’-র বিজ্ঞান সঞ্জাত অভ্যুদয় তারই অন্তর্গত সত্যে স্যর আশুতোষের ‘শিক্ষার সংরক্ষণ’, অধিত জ্ঞানের ‘প্রয়োগ’ও সর্বোপরি ‘জ্ঞান সৃষ্টিকারীদের স্রষ্টা’-র ত্রিবিধ উপাত্তের সাদর আমন্ত্রণ ও অনুশীলন উপ্ত থাকে। স্যর আশুতোষের  বিচারবোধ, প্রজ্ঞা ও অন্বেষায় যে উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান সেখানে শুধু শিক্ষা গ্রহণ নয়, তার উপযুক্ত প্রয়োগের বিজ্ঞানও যেন শিক্ষার্থীরা গ্রহণ করে যথার্থ মূল্যবোধ সম্পন্ন মানবিক দৃষ্টান্ত হয়ে সমাজে অবস্থান করতে পারে তারই প্রত্যয়ী বার্তা ছিল। সেই অভিমুখেই তিনি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করতেন ও যে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এই প্রতিজ্ঞা নিয়েই পরিচালিত হওয়া উচিত বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। আশুতোষের এই ইচ্ছা ও প্রত্যয়ের সঙ্গেই যুক্ত শিক্ষালয়ের ‘স্বাধিকার’। স্বাধিকার হল ব্যক্তির নিজস্ব ওজস্বিতা যার প্রভাবে সালঙ্কৃত হয় শিক্ষাঙ্গন এবং সেই সঙ্গে মূল্যবোধ সংগঠনের একটি উপাদান যেখানে সুস্থ চিন্তা, ভাবনা, অন্বেষা এবং উদ্ভাবন বিচারবুদ্ধির আলোয় আলোকিত হতে পারে; যেখানে নিরন্তর চর্চা হাতে কলমে শিক্ষার মতো জারি থাকে। স্বাধিকার একটি সমূহ সংগঠন-যে অভিমুখে শিক্ষা প্রণালী, প্রতিষ্ঠান, পরিকাঠামো ও সামগ্রিক উন্নয়ন বাধাহীন ভাবে মুক্ত পরিবেশে গড়ে উঠতে পারে। তাঁর মৃত্যুর পরে (১৯২৪) অবন ঠাকুর যথার্থ ভাবেই লিখেছিলেন, “আকাশের মতো বৃহৎ এবং উদার সেই মহাপুরুষের অভাবে আমাদের শিক্ষার রাজত্বে কতখানি অন্ধকারের সৃষ্টি হল,কত ভয়ের লক্ষ্মণ সমস্ত দেখা গেল, তা এই শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে যাঁরা আজ নাড়া-চাড়া করছেন তাঁরাই জানেন।” তখন ভারত পরাধীন; ‘অন্ধকার’ ও ‘ভয়’ বলতে সে সময়কার ব্রিটিশ শাসনের শিক্ষার উপর নানা অবরোধ যে আরও পোক্ত হবে তার কথাই তিনি বলেছেন।

বিগত কয়েকদিন ধরে সেই ঐতিহ্যবাহী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা হওয়া না হওয়া নিয়ে যে দ্বৈরথ তৈরি হয়েছিল তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের তথাকথিত বহু মূল্যবান স্বাধিকার রক্ষার বিষয়টি সামনে এসেছে। একদিকে রাজ্যের শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের প্রতিষ্ঠা দিবস (২৮ আগস্ট) অন্যদিকে তিনমাস আগে স্থির করা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যালেন্ডার নির্ধারিত বাণিজ্য বিভাগ (বি কম) ও আইন বিভাগ (বিএ/এলএলবি)-র পরীক্ষা একই দিনে পড়ায় উচ্চশিক্ষা দপ্তরের পরীক্ষা সূচী বদলানোর চিঠি নিয়ে বিতর্কটি সামনে এসেছে। মুখ্যমন্ত্রী উপস্থিত থেকে যে সভা প্রতি বছর সংগঠিত হয় সেখানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কিভাবে পরীক্ষা নিতে পারে তাই নিয়ে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ, সর্বোপরি দল হিসাবে তৃণমূল কংগ্রেস তাদের অবস্থান জানানো শুধু নয়, দায়িত্বে থাকা অন্তর্বর্তী উপাচার্য শান্তা দে’কে পরীক্ষার্থীদের অসুবিধের কথা তুলে তারিখ বদলের অনুরোধ করেছে। আর একটু এগিয়ে ছাত্র দলের প্রধান নেতা অন্তর্বর্তী উপাচার্য রাজনৈতিক স্বার্থে যে এ কাজ করছেন তাও বলতে দ্বিধা করেনি। শিক্ষা মহলে এভাবে পরীক্ষার দিন বদলের নিদান বা অনুরোধ উচ্চশিক্ষা দপ্তর দিতে পারে কিনা তা নিয়ে বিতর্ক সমানে সামনে এসেছে। একটি দলের শাখা সংগঠনের প্রতিষ্ঠা দিবস তার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা এই দুই বিষয়কে দাঁড়িপাল্লায় বসালে যে তুমুল ভারসাম্যের ঘাটতি লক্ষিত হয় এবং পাল্লা যথার্থভাবেই ছাত্র স্বার্থে সংঘটিত হতে চলা পরীক্ষার দিকেই সর্বোচ্চ ভাবে ঝুলে পড়বে তা নিয়ে উচ্চশিক্ষা দপ্তর ব্যতিরেকে সমস্ত শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ ও প্রতিষ্ঠানের মান্যতা পাবে এবং পেয়েছে তাতে কোনো দ্বিমত থাকে না। এখানেই অবনীন্দ্রনাথের ‘ভয়’ও ‘অন্ধকার’-র সহাবস্থান প্রত্যক্ষিত হয়ে ওঠে। সেই সঙ্গে বেশ কিছু প্রশ্নেরও জন্ম দেয় এই বিতর্ক:

১) বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকারে একটি সংস্থা কি এভাবে হস্তক্ষেপ করতে পারে।

২) সাকুল্যে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা যখন হাজার তিরিশেক বা তারও কিছু বেশি এবং তাদের এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা (৪র্থ সেমিস্টার) সেখানে কেন পরীক্ষা অগ্রাধিকার পাবে না।

৩) প্রশাসন কেন পরীক্ষার্থীদের নির্বিঘ্নে পরীক্ষা দিতে আসার যাবতীয় উদ্যোগ নেবে না।

৪) শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের মধ্যে পরীক্ষাকে গুরুত্ব দেবার সাংগঠনিক বোধ কেন থাকবে না।

৫) কেন ছাত্র দলের নেতা উপাচার্যের এই পরীক্ষা সংঘটিত করার পেছনে তাঁর পুরস্কার প্রাপ্তির বিষয় সামনে আনবেন।

৬) সর্বোপরি এই অনভিপ্রেত ও ব্যতিক্রমী ঘটনা যার অতীতে কোনো নজির নেই তার পত্তন ঘটিয়ে এই বিরল ছাত্র সংগঠনটি কোন অভিমুখে শিক্ষা ব্যবস্থাকে পরিচালিত করতে চাইছে।

৭) ক্যাম্পাসে ঢুকে উপাচার্যকে ঘেরাও, বামহাত-ডানহাত বলে সিপিএম বিজেপির দাগা দেওয়া, সোসাল মিডিয়ায় গালমন্দ করা, নিরাপত্তাকর্মীদের ঠেলাগোঁজা করার মধ্যে ছাত্র সংগঠনের কোন ভাবমূর্তি প্রকাশ পেল।

৮) উচ্চশিক্ষা দপ্তরের চিঠিতে ‘ডাইরেক্টেড ও রিকোয়েস্ট’ বলে যে শব্দবন্ধ ব্যবহার করা হয়েছে তাতে একই সঙ্গে ‘ডাইরেক্ট’ করা ও ‘রিকোয়েস্ট’ করার মধ্যে প্রচ্ছন্ন আধিপত্যই কি প্রকাশ পায় না!

অন্যদিকে শিক্ষামন্ত্রী যখন বলেন, “রাজ্যের সর্বোচ্চ পদাধিকারী অনুরোধ করেছিলেন, মুখ্যমন্ত্রী যখন সব বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেন না তাই সেটা মানতে পারতেন উপাচার্য”; তখন সবটাই জলের মতো পরিস্কার হয়ে যায়। অনৈতিক আবদার রাখতে রাজ্যের ছাত্রসংগঠনের পক্ষে বার বার দাঁড়ানোর ফল যে শিক্ষাক্ষেত্রকে কোন অবক্ষয়ের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তা সাম্প্রতিক ল্য কলেজের ঘটনায় প্রমাণ হয়ে গেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য শান্তা দত্ত দে, তিনি অন্তর্বর্তী উপাচার্য হয়েও প্রথমাবধি যেভাবে এই অসুস্থ নির্দেশের বিরোধিতায় সরব থেকে সপাটে ছক্কা হাঁকিয়ে চলেছেন তাতে এই অন্ধকারেও আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে।এমনিতেই রাজ্যের অর্ধেকের বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পুরো সময়ের উপাচার্য এখন নেই। রাজ্যপাল ও সরকারের দ্বন্দ্বে শিক্ষার সর্বোচ্চ পদগুলি কবে পূরণ হবে কারও জানা নেই। এদিকে পরীক্ষা, ফলপ্রকাশ সহ যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে চলেছে। সে সব দিকে গুরুত্ব দেওয়া যখন সরকারের অগ্রাধিকারের মধ্যে পড়ে এবং তা না দিয়ে ছাত্র সংগঠনের প্রতিষ্ঠা দিবস পালনের জন্য উপাচার্যকে পরীক্ষার দিন বদলের চিঠি ধরানো হয় তখন শিক্ষার হদ্দমুদ্দ অবস্থাই নজরে আসে। এ সময় মাননীয়া শান্তা দত্ত দে তাঁর মতাদর্শ যাই থাক তিনি যে একটি ব্যতিক্রমী কাজ করলেন ও শিক্ষা দপ্তরকে সমঝে দিলেন তাতে তিনি আমাদের শ্রদ্ধাভাজন হয়ে উঠলেন। সিন্ডিকেটের উত্তপ্ত বৈঠক সেরে (যে বৈঠকে শিক্ষা দপ্তরের কর্তা সহ সরকারের নমিনেটেড মানুষজনের উপস্থিতি) সাংবাদিক বৈঠকে তিনি যখন বলেন,“পরীক্ষা হবে পরীক্ষার মতোই,কোনও দিন বদল হবে না। বরং রাজ্য সরকার ও প্রশাসনকে বিশ্ববিদ্যালয় অনুরোধ করছে পরীক্ষার দিন যান চলাচল ও সার্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার ব্যবস্থা করতে যাতে পরীক্ষার্থীদের কোনও অসুবিধা না হয়”; প্রতিষ্ঠানের এই বহু মূল্যবান বহু চর্চিত স্বাধিকার যা নিয়ে প্রতিনিয়ত রাজ্যের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলিতে তর্ক বিতর্ক চলছে তাতে উপাচার্যের এই বয়ান অবশিষ্ট উপাচার্যদের সাহস জোগাতে পারে! একদিকে ভয় অন্যদিকে সাহস দুটোই যখন ছোঁয়াচে তখন প্রাজ্ঞ উপাচার্যেরা কবে শান্তা দত্ত দে হয়ে উঠবেন তার অপেক্ষায় গোটা আচার্য সমাজ। আচার্য ত্রিগুণা সেন স্মারক বক্তৃতায় বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও পার্লামেন্টারিয়ান হীরেন মুখার্জি এক জায়গায় বলছেন,“….নিজের বিশ্বাস, নিজের মতবাদ থেকে কখনো তাঁকে বিচ্যুত হতে দেখা যায়নি।এ লোকটি তো অসম্ভব লোক।” এরকম অসম্ভব মানুষেরাই পারে অতি মূল্যবান ‘না’ শব্দটি উচ্চারণ করতে। সেটা একটা চর্চার বিষয়। এখন তো মেধা ও মনন কম্প্রোমাইজড হয়ে যাচ্ছে। তাই স্যর গুরুদাস, স্যর আশুতোষ বা ত্রিগুণা সেনেরা ইতিহাসের এমসিকিউ হয়েই রয়ে গেছেন। তাই বোধহয় বিজ্ঞানী বিকাশ সিংহ তাঁর ‘সৃষ্টি ও কৃষ্টি:বন্ধনহীন গ্রন্থি’ বইতে লেখেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষ্টি সুইচ টিপলেই হয় না। শিক্ষার সঙ্গে কৃষ্টি না থাকলে বিদ্যালয়ের আলোর জোগান দেবে কে? জ্ঞানের জ্যোতিই বা কোথা থেকে আসবে? শিক্ষার কৃষ্টিই বিদ্যালয়ের সাফল্যের মাপকাঠি।” শিক্ষায় অন্তর্হিত সেই সত্তার অনুসন্ধান ও অনুশীলন আজ জরুরি।

 

 

 

  

  

 

 

 

 

 

 

 

 

 

0 Comments

Post Comment