‘ক’ অক্ষরের গোমাংস ?একেবারে চেনা শব্দ । অশিক্ষিত বোঝাতে এর ব্যবহার। কিন্তু সেই অশিক্ষিতও ‘ক’ চেনে। একটু আধটু জানে, ক বাংলা বর্ণমালার প্রথম ব্যঞ্জনবর্ণ । তাই ক অনুভূতি তীব্র। প্যারাডক্স এই যে ওরাও জানে না ক এর ত্রিভুজে বন্দী আজ কাশ্মীর। ক এর নাকের মত যে হ্যান্ডেল, সেটা গর্বের সঙ্গে অপারেট করছে ভারত। তাই ক এখন আমাদের ‘মন কি বাত’ জুড়ে। মুকুট হয়ে মাথায় চড়ে। ক জুড়ে অফুরাণ গুপ্তধন। খুঁড়ে তোলার অপেক্ষা। চন্দ্রযানের পাঠানো ছবি ? দূর ছাই! আমাজনের আগুন?? ধূর বাবা! এখন ওই ৩৭০ এর দৌড়। ওটা কি ছিল ? আর কেনই বা তুলে দিল? এই নিয়ে তর্জা তারা চায় না। মিডিয়ায় বলেছে ভালো হয়েছে। পাড়ার দাদাও বলেছে, দখলে এসেছে কাশ্মীরের মা, মাটি মানুষ। ডালের হাউসবোটে চড়ে পদ্ম দেখা, ফোয়ারার সামনে প্রাতরাশ তারপর সারাদিন সুন্দরী কাশ্মীরিদের খোয়াব দেখা! ভূস্বর্গ জুড়ে এন্তার নেচে বেড়ানো। আর ‘কাশ্মীর কি কলির’ শাম্মি কাপুর তো স্মৃতিতে জ্বলজ্বল এখনও। হাউসবোটে চড়া শর্মিলা কে দেখে বিনা অ্যানাস্থেসিয়ায় প্রায় অজ্ঞান নায়ক । অন্য একটি হাউসবোট ধরে ছুটে যাচ্ছে কাশ্মীরি নায়িকার পেছনে । কাশ্মীরি সুন্দরী দেখে ‘দিল কিউ না বনে পাগল’ মর্দোওয়ালি বাত। কিন্তু মেয়ের গলায় তাবিজের মত সেই আস্ফপা লেখাটা সচরাচর কারও চোখে পড়েনা। দেখা যায় না সুন্দরীদের মেরুদন্ডের পাশে লুকিয়ে থাকা আতঙ্কের হিমঘর। কাশ্মীরি মেয়েদের সততার গালিচা আতিথেয়তা জানে। নিজের মাটির নিয়ে নেই কোনোও অবিশ্বাস,দ্রোহ। নীরবে মাথা নামিয়ে দেখে চারপাশে হরিণের চামড়া গায়ে নেকড়ে কিভাবে শিকার খোঁজে।
আসলে মর্দাঙ্গির কাজ করছে তো ওখানকার মেয়েরা।
গুলি,কার্ফিউ,বিচ্ছিন্নিতাবাদীদের ছড়ানো আতঙ্কের সঙ্গে লড়াই প্রতিনিয়ত। আয়নায় এরা নিজেদের মুখ নয়,ওদেরই দ্যাখে। ভয় ও অনিশ্চয়তার সভ্য জীবন ওখানাকার মেয়েদের। আবার অসহায়ত্ব মাঝে মাঝে প্রবল স্পর্ধা এনে দেয়। তার প্রমাণ মেলে সদ্য বিমানে বসা কাশ্মীর সফররত রাহুল গান্ধীকে ঝড়ের বেগে অভিযোগ জানাতে থাকা এক মহিলার ভাইরাল হওয়া ভিডিও। অভিযোগ মানুষকে অস্থির করে। অবদমন আর এক ধাপ এগিয়ে। এটি মানুষকে ভেতর ভেতর মজবুত করে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রতিরোধ গড়ে দেয়। কিন্তু প্রতিরোধ যদি কৃতজ্ঞতা ও কর্তব্যে আত্মসমর্পণ করে, তবে? কাশ্মীরি মেয়েদের সেই আত্মগর্বের ইতিহাসে কতখানি জাতীয় লজ্জা লুকিয়ে আছে? সেই সমানুপাতিক হারের হিসেব কষে কি ইতিহাস কোনোদিন ঘোষনা দেবে? নাকি ‘মেঘে ঢাকা তারা’ আসলে কাশ্মীরের আকাশের নিয়তি। কাশ্মীরি মেয়েদের আসলে অভিযোগ কী? অকাল বৈধব্য বা হাফ উইডোত্ব ? নাকি বন্দুকের নলের সামনে কুমারিত্ব বিসর্জন? শিক্ষার সুযোগ না পাওয়া? নিরাপত্তার অভাব? অকালে স্বামী হারানো? বৈধব্যের প্রতিকূলতায় ঘর চালানো ও সন্তানদের উপযুক্ত শিক্ষা দান? ইতিহাস খুঁজলে কাশ্মীরি নারীদের ভূমিকা নজর কাড়ে।এ এক অনন্য বিবর্তনের ইতিহাস।
কাশ্মীরে দেশ বিভাগ ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের পরবর্তী বছরগুলিতে মেয়েরা ছিল উজ্জ্বল ভূমিকায়। রাজনৈতিক জগতে ছিলেন আকবর জাহান । একজন সংসদ সদস্য । জয়নব জিয়া ছিলেন একজন শিক্ষাবিদ। এবং একজন সমাজকর্মী। আবার একজন প্রগতিশীল বামপন্থী এবং সরকারী মহিলা কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ মাহমুদা আলী শাহ। জুনার মতো সাধারণ মহিলারা আন্দোলনে সক্রিয় থাকার জন্য যথেষ্ট সাহস ও সামাজিক শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন। সংঘর্ষ ও নিপীড়নমূলক প্রশাসন কর্তৃত্ব কাশ্মীরি সমাজে এনেছিল অফুরান যন্ত্রণা ও বিপর্যয়। তারপরেও সব প্রতিকূলতাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে কলা ও সাহিত্য, আইন, পুলিশ, সাংবাদিকতা, প্রশাসন সব ক্ষেত্রেই মেয়েদের ক্রমবর্ধমান প্রতিনিধিত্ব দেখা গেছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে পেশাগত ক্ষেত্রে মহিলাদের দৃশ্যমানতা অনেক বেড়েছে। পাশাপাশি তাদের প্রচলিত ভূমিকার ক্ষেত্রে দ্রুত পরিবর্তন এসেছে। কাশ্মীরি মহিলাদের উপর রাষ্ট্রীয় সংঘাত তাদের পরিবারের পুরুষতান্ত্রিক চৌহদ্দি ও রক্ষণশীলতা থেকে মুক্তি দিয়েছে। মেয়েরা বেছে নিয়েছে ‘হোয়াইট কলার’ জব। বাড়ির পুরুষের অনুপস্থিতিতে আর্থিক দায় দায়িত্ব পালনের ভার এসেছে তাদের উপর। তাই গোঁড়া ও অন্দরমহলকেন্দ্রিক জীবনে এসেছে ব্যতিক্রম। পশমিনা ,জরির কাজ,গালিচা বোনায় সক্রিয়তা বাড়ার সঙ্গে ধান চাষ, গবাদি পশু পালন ও সব্জি বিক্রীর কাজ চলতে থাকে।
কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক রিপোর্ট বলছে যে "এমনকি ইসলামে পুনর্বিবাহের বিধান থাকা সত্ত্বেও বেশিরভাগ কাশ্মীরি যুদ্ধ-বিধবা তাদের সন্তানদের সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পুনরায় বিবাহ করেন না। গবেষণার প্রতিবেদন অনুসারে যুদ্ধ-বিধবাদের অনুমান সংখ্যার মাত্র ৮ শতাংশই পুনরায় বিবাহ করেছেন বা পুনরায় বিবাহের ইচ্ছা পোষণ করেছেন। ৯১ শতাংশ পুনরায় বিবাহ করেনি । এবং বিবাহ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পুনরায় বিবাহিত ৫ শতাংশ মহিলারা তাদের সন্তানদের নিজের কাছে রেখেছিলেন। এবং তাদের নতুন স্বামীরা আপত্তি করেননি। ” কাশ্মীরি মহিলাদের শরীর ও মন কাশ্মীরের মাটির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। রক্তাক্ত হলেও কাশ্মীরের মাটি প্রিয় মেয়েদের। ঐ মাটি থেকেই ফসল তোলা ,বিক্রির অপেক্ষা,পরিবারের মুখে হাসি ফোটানোর কথা। ক্ষতবিক্ষত হয়েও হারিয়ে যাওয়া লাশের হিসেব ভুলতে থাকার অভ্যাস করে। যুদ্ধক্ষেত্র এবং শৃঙ্খলার মধ্যেও জীবনের উদযাপন ফিকে হয় না! শুধু অপেক্ষার প্রহরে বুক বেঁধে লড়াই জারি। ফিরবে একদিন হারানো স্বামী ,হারানো ছেলে। কাশ্মীরি মেয়েদের মাতৃভূমির প্রতি অগাধ দায়বোধ। তাই তাদের সহন ক্ষমতার ধার অনেক বেশি। সামাজিক জীবনের প্রতি সম্মানবোধ একদম অক্ষত। সন্দেহ নেই যে তাদের শারীরিক এবং মানসিক দুর্বলতা তাদের সহজাত। কিন্তু তাদের মাতৃভূমিতে প্রচলিত চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবিলা করতে এবং কাটিয়ে উঠতে কাশ্মীরি মেয়েদের জুড়ি নেই। তাই যে ভয়াবহ দীর্ঘ রাস্তাগুলি ভ্রমণ করেছে ওরা এবং যে অন্ধকার অবিরত পার করেছে তা নিজের আঁচলে গুছিয়ে নিয়ে নীরব হয়েছে। বিনয়ের চাদর তুলে যা দেখা যায় তা খুব পীড়াদায়ক। ৩১% মহিলা মাদকাসক্ত। জটিল মানসিক অসুখে ভুগছে প্রায় ৬৬ শতাংশের বেশি মহিলা। ১০-৬০ বছরের মহিলারা একরকমের দৈহিক নির্যাতনের শিকার। এদের নিরাময়ের জন্য কাশ্মীরের স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও হাসপাতাল সব কম পড়ার কথা।
কাশ্মিরী মেয়েদের এই কীটদগ্ধ ও অসম্পুর্ণ জীবনের দায় কার? ঘরের বাইরে গুলির আতঙ্ক, ভেতরে স্বামী উধাও। বাড়ির দরজা ও হাসপাতালের মধ্যে সমান্তরাল রেখা টানা। পথে মৃত্যুকে বেছে নেওয়া নইলে বন্দুকের নলের সামনে নিজেকে বিছিয়ে দেওয়া। শরীর তো মাটিতেই মিশে যাবে। এই মাতৃভূমি কাশ্মীরেই থেকে যাবে। তবে আর কিসের অমর্যাদা? আফসোস এই যে অপরাধী কে? কার সাজা কার কাছে চাওয়া ন্যায়ত মানবিক? এ প্রশ্ন তিরের ফলার মত বিঁধছে অনেককেই। কিন্তু আখেরে এই যন্ত্রণার ও অপমানের দায় কার? ইতিহাস নিরুত্তর। দেশপ্রেম কাঠগড়ায়। ইতিহাস সাক্ষী করে দখল হল মাটি। কাশ্মীরি মেয়েদের মন জয় করতে চাই এবার ভালোবাসা। চাই দ্বিপাক্ষিক বিশ্বাস। চাই অটুট মানবিকতার আশ্বাস।