প্রথমে নির্বাচনী সংখ্যাতত্ত্বের আলোকে বিজেপির উত্থানের বিষয়টিকে আলোচনা করা যেতে পারে।এ রাজ্যে বিজেপি ৭৭ টি আসনে জয়লাভ করেছে এবং ২০০ টি আসনে তারা দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। ২১৩ টি আসনে জয়লাভ করা তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছে ২,৮৭,৩৫,৪২০ টি ভোট যা মোট ভোটের ৪৭.৯৫%।বিজেপি পেয়েছে ২,২৮,৫০,৭১০ টি ভোট যা মোট ভোটের ৩৮.১৩%।আসন সংখ্যার বিচারে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে বিজেপির পার্থক্য যতটা বেশি মনে হচ্ছে, মোট ভোটের বিচারে পার্থক্যটা তত বেশি নয়,মাত্র ৫৮,৮৪,৭১০।যারা ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে বিজেপির ফলাফল বিশ্লেষণ করতে চান তাদের উদ্দেশ্য জানানো যেতে পারে বিজেপির মোট ভোট কমেছে মাত্র ২%( ১.৭৭লক্ষ)।আমরা যদি জেলাওয়ারি ফলের দিকে নজর রাখি তা হলে দেখব কলকাতা,হাওড়া,ঝাড়গ্রাম, পূর্ব বর্ধমান বাদে রাজ্যের সব জেলাতেই তাদের আসন রয়েছে এবং আলিপুরদুয়ার ও দার্জিলিঙে তারা সবকটি আসন দখল করেছে।চা বাগানের শ্রমিক হোক বা সীমান্ত জেলা,হিন্দিভাষী অধ্যুষিত এলাকা বা তপশিলি জাতি ও উপজাতি প্রধান এলাকা --- বিজেপি সব জায়গাতেই আছে।এককথায় বলা যেতে পারে ৯০' পরবর্তী সময় থেকে হিন্দুত্ববাদ,মুসলিম বিদ্বেষ ও অনুপ্রবেশের ইসুকে সামনে রেখে বিজেপি তথা সংঘপরিবার যে রাজনৈতিক ন্যারেটিভকে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের সামনে রেখেছিল তাকে আজ রাজ্যের এক বৃহৎ জনসমষ্টি সমর্থন করছে এবং বিজেপি আজ রাজ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত না হতে পারলেও মেরুকরণের রাজনীতি আজ বাংলার রাজনৈতিক সংলাপের অনিবার্য উপাদান।
সংসদীয় গনতন্ত্রের যে বিধিব্যবস্থা আমাদের দেশে লাগু রয়েছে তাতে বিরোধী দলের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।আর এদেশের সংসদীয় গনতন্ত্রের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতায় যদি আমরা চোখ ফেরাই তবে দেখব ' ধ্বংসাত্মক ' বিরোধীর ভূমিকা পালন করতে বিজেপির জুড়ি মেলা ভার।২০ জন সাংসদ ও ৭৫ জন বিধায়ক ( দুজন বিধায়ক শপথ নেন নি কারণ তারা সাংসদ থাকতে মনস্থ করেছেন) নিয়ে তারা এরাজ্যের সংসদীয় বিরোধী রাজনীতির পরিসরটা দখল করেছেন। আত্মঘাতী রাজনীতির অনিবার্য পরিণাম স্বরূপ বামপন্থী ও কংগ্রেসীদের শূন্য হয়ে যাওয়ার ফলে বিজেপি তাদের ' হিন্দি - হিন্দু - হিন্দুস্তানের ' অ্যাজেন্ডা সংসদীয় রাজনীতিকে ব্যবহার করে আরো উচ্চগ্রামে নিয়ে যেতে পারবে।এক্ষেত্রে আরেকটা বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ ও বিজেপির নেতৃত্ব আগে ঠারেঠোরে ও নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পরে প্রকাশ্যে সংবিধান বদলে দেওয়ার যে কর্মসূচি হাজির করেছে তার একটা বড়ো বিষয় হল যেটুকু যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো এখনো সংবিধানে আছে তাকে ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে বদলে দিয়ে এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন ব্যবস্থা চালু করা।সম্প্রতি দিল্লি রাজ্যের ক্ষমতার বিন্যাসকে যে ভাবে পাল্টানো হয়েছে তাতে মুখ্যমন্ত্রী প্রায় নখ-দন্ত হীন শাসকে রূপান্তরিত হয়েছেন।জিএসটি চালু হওয়ার পর অঙ্গরাজ্যগুলির আর্থিক ক্ষমতাও বহুলাংশে দুর্বল হয়েছে।ভারতীয় প্রজাতন্ত্র চালু হওয়ার পর থেকেই রাজ্যগুলির কাজকর্মের উপর কেন্দ্রীয় সরকারের খবরদারি নিশ্চিত করার জন্য রাজ্যপাল পদটি তৈরি করা হয় যা আজও একইভাবে বর্তমান। এর সঙ্গে কেন্দ্রীয় এজেন্সি ও কমিশন গুলিকে ব্যবহার করে কোন একটি অঙ্গরাজ্যের প্রশাসন তথা সরকারকে নিয়ত চাপে রাখা খুব একটা কঠিন কাজ নয়।এরাজ্যে নতুন সরকার প্রতিষ্ঠার পরেই যেভাবে আইন শৃঙ্খলা অবনতির প্রশ্নে একের পর এক কেন্দ্রীয় টিম রাজ্যে আসতে লাগলো এবং মাননীয় রাজ্যপাল তাতে যথাযথ সঙ্গত করতে লাগলেন তা আসলে এক ট্রেলার মাত্র। এছাড়া বিজেপির জয়ী বিধায়কদের নিরাপত্তার জন্য কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের প্রস্তাব আরো কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপের পথ প্রশস্ত করবে।বলার কথা হল সংসদীয় বিধি ও সাংবিধানিক রক্ষাকবচগুলিকে ব্যবহার করেই বিজেপি আগামীদিনে তাদের বিভেদকামী রাজনীতিকে আরো বেশি মাত্রায় এরাজ্যে প্রচার করতে সমর্থ হবে।
ফ্যাসিবাদ সংক্রান্ত যে কোন আলোচনায় গোয়েবলসের একই মিথ্যা বারবার প্রচার করলে তা জনগণ সত্য বলে বিশ্বাস করতে শুরু করবে -- তত্ত্বটির উল্লেখ বারবার করা হয়।বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তিগত ব্যাপক পরিবর্তন ও সহজলভ্যতার কারণে সংঘ পরিবারের পক্ষ থেকে আইটি সেলের মাধ্যমে তাদের সাম্প্রদায়িক, বিভেদকামী, ফ্যাসিবাদী প্রকল্পের প্রচার আরো বেশি সুবিধাজনক। সমস্ত সমাজতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকাররা প্রায় সর্বসম্মতিক্রমে একথা মেনে নিয়েছেন যে বিজেপির সর্বভারতীয় উত্থানে তাদের আইটি সেলের ধারাবাহিক বিষাক্ত প্রচারের এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। যেহেতু বিজেপির এই রাজনৈতিক কর্মসূচী নয়া উদারবাদী অর্থনীতির মদদপুষ্ট তাই কর্পোরেট পুঁজি চালিত সোসাল মিডিয়ার ( ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটার) নৈতিক ও অনৈতিক সমর্থন তারা পায়।এই প্রচারের সবচেয়ে বড়ে বৈশিষ্ট্য হল মূল ন্যারেটিভকে ( হিন্দু বিপন্ন/ মুসলমানরা অবাঞ্ছিত / শক্তিশালী রাষ্ট্রনায়কের প্রয়োজনীয়তা/ভারত সুপারপাওয়ার হতে চলেছে /কমুনিস্ট ও মুক্তমনা বুদ্ধিজীবিরা দেশদ্রোহী) অক্ষুণ্ণ রেখে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের জন্য আলাদা আলাদা প্রচারের ব্যবস্থা করা।বিষয়টা ইতিপূর্বে বহু আলোচিত তবু একথা উল্লেখ করা যেতেই পারে যে নির্বাচনী ফলপ্রকাশ পরবর্তী হিংসাকে ( যা অতীব নিন্দাযোগ্য এবং মূলদায় শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসকেই বহন করতে হবে) ব্যবহার করে আইটি সেলের দ্বারা যে ভাবে রাজ্যে হিন্দুরা আক্রান্ত -- এই প্রচারকে তুঙ্গে নিয়ে যাওয়া হল তা অবশ্যই চোখ খুলে দেওয়ার মত ব্যাপার।
পশ্চিমবঙ্গে ফ্যাসিবাদের বিপদ উপলব্ধি করতে হলে সংঘ পরিবারের সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের মডেলটিকে আমাদের অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে।একথা আজ আমাদের স্বীকার করতেই হবে যে ' হিন্দি - হিন্দু - হিন্দুস্তান ' প্রকল্পের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে বাঙালিরা গ্রহন করতে পারে এমন একটা সাংস্কৃতিক প্রকল্প দেরিতে হলেও সংঘ পরিবার এরাজ্যের মানুষের কাছে উপস্থিত করতে পেরেছে। এই মডেল শ্রীচৈতন্য, বাউল-ফকিরদের সমন্বয়বাদী বাংলার পরিবর্তে গোবলয় সংস্কৃতি জাত সামরিক নায়ক রামকে ধর্মীয় আইকন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। বাঙালিদের একটা বড়ো অংশ আজ ধর্মীয় প্রার্থনা হিসাবে হনুমান চালিশা পাঠ করে।দুই বাংলার ঐক্যবদ্ধ সাংস্কৃতিক চেতনা সম্পন্ন বাঙালির পরিবর্তে তারা ' হিন্দু ' বাঙালির পরিচিতি নির্মাণ করে যেখানে বাংলাদেশের বাঙালিরা পৃথক ও ভিন্ন পরিচিতি সত্তা।বাঙালি মননে রবীন্দ্রনাথ - নজরুল - সুকান্তের যে প্রভাব ( এলিট বাঙালিরা তাকে যতই রসুন সংস্কৃতি বলে ব্যঙ্গ করুক না কেন) তাকে এরা সরাসরি চ্যালেঞ্জ করতে চায়।সাম্প্রদায়িক ও ব্রিটিশ অনুগত শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে বাঙালির নতুন নায়ক হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা এই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত। শুধু শ্যামাপ্রসাদ নন,গোপাল পাঁঠার মত কলকাতা দাঙ্গার বিতর্কিত চরিত্রকে নতুন ভাবে আলোকিত করার চেষ্টা হয়েছে। সংঘপরিবারের এই সাংস্কৃতিক প্রকল্পকে প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা জোগাতে কেন্দ্রীয় সরকার বদ্ধ পরিকর।বিশ্বভারতী ও শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এর মত দুটি কেন্দ্রীয় সরকার পোষিত প্রতিষ্ঠানের গত তিন বছরের কার্যকলাপ যার আদর্শ উদাহরণ। সবচেয়ে চিন্তার কথা এই সাম্প্রদায়িক, বিভেদকামী সাংস্কৃতিক মতাদর্শ মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বাঙালির চিন্তাধারায় জায়গা করে নিতে পেরেছে এবং তারাই হয়ে উঠেছে এই নতুন সংস্কৃতির পদাতিক বাহিনী।এর শেকড় আজ এতটাই গভীর যে রাজ্যের অধিকাংশ আবাসনে মুসলিমদের বাড়ি ভাড়া দেওয়া হয় না,বাঙালি শিক্ষিত সম্প্রদায়ের কাছে মুসলমানরা আজও ' ওরা ',।এই বারের নির্বাচনের সময় সোসাল মিডিয়ায় এই শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের একটা বড়ো অংশ মুসলিমদের বিরুদ্ধে যে কদর্য প্রচার চালিয়েছে তা আগামী সময়ের জন্য অবশ্যই এক বিপদ সঙ্কেত।
একথা অস্বীকার করার কোন কারণ দেখি না যে, যারা এই নির্বাচনে সংঘ পরিবার তথা বিজেপির আগ্রাসী রাজনীতিকে রুখতে চেয়েছেন তারা তৃণমূল কংগ্রেসকেই একমাত্র ভরসা বলে মেনে নিয়েছেন। নির্বাচনে বিপুল সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন সেই ভরসারই প্রতীক।কিন্তু একই সঙ্গে এই প্রশ্নটাও থাকছে যে এক রাজনৈতিক দল হিসাবে তৃণমূল কংগ্রেস ফ্যাসিবাদ মোকাবিলায় কতখানি সক্ষম!সাধারণভাবে সংঘ পরিবারের প্রচারে সংখ্যা গরিষ্ঠ হিন্দু জনগণের মেরুকরণের প্রশ্নটা এতটাই তীব্র যে বিজেপি বিরোধী অবামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি সেই অভিঘাত থেকে বাঁচতে নরম হিন্দুত্বের রাজনীতির আশ্রয় নেয়।দিল্লি নির্বাচনের সময় আমরা দেখেছি যে অরবিন্দ কেজরিওয়াল নিয়মিত হনুমান মন্দিরে পূজাপাঠ করছেন,আদালতের নির্দেশে জয়ী হবার পর সরকারি পরিচালনায় যখন রামমন্দিরের শিলান্যাস হল তখন প্রিয়াঙ্কা গান্ধী সমস্ত দেশবাসীকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন।এবারে পশ্চিমবঙ্গের হাই ভোল্টেজ ' তোষণের রাজনীতির ' অভিযোগের জবাব দিতে তৃণমূল সুপ্রিমো যেভাবে চন্ডীপাঠ করেছেন বা জয়ের পর কালিঘাটে পূজো দিতে গেছেন তা বিজেপির রাজনীতির প্রতিক্রিয়া। ভারতে অবাম সংসদীয় রাজনৈতিক দলগুলোর যেহেতু ফ্যাসিবাদ বিরোধী কোন আদর্শগত অবস্থান নেই তাই নেতা ও কর্মীবৃন্দ তাদের নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য অনায়াসে বিজেপি ও অন্যান্য দলগুলোর মধ্যে শিবির বদল করে।নির্বাচন পূর্ববর্তী সময়ে তৃণমূল থেকে দলে দলে বিজেপিতে যোগদান এই পর্যবেক্ষণকেই সত্য বলে প্রমাণ করে।এমনকি সংসদীয় ভোট সর্বস্ব বামেদের অনেকেই গত ৫ বছরে অনায়াসে হিন্দুত্বের রাজনীতির ধ্বজাধারী বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। অপরদিকে বিজেপি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি তাদের ক্ষমতায় থাকার সময় যে রাজনীতির অনুশীলন করেছেন তাতে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও দায়বদ্ধতার পরিবর্তে বিরুদ্ধ কণ্ঠস্বরকে মান্যতা না দেওয়া,গণতান্ত্রিক পরিসরকে সংকুচিত করা,গণআন্দোলনকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের সাহায্যে দমন করা,কালা কানুনগুলির যথেচ্ছ প্রয়োগের অজস্র উদাহরণ আছে যা আদতে ফ্যাসিবাদের আগমনের পথ প্রশস্ত করে।সম্প্রতি তেলেঙ্গানা সরকার যেভাবে ১১ টি গণতান্ত্রিক সংগঠনকে নিষিদ্ধ করেছেন তা এই চরম স্বৈরতান্ত্রিক রাজনীতির হাতে গরম নমুনা।এরাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের ১০ বছরের শাসনে যে ভাবে প্রতিপদে গণতান্ত্রিক পরিসরকে সংকুচিত করা হয়েছে, প্রশাসনে কর্তৃত্ববাদী মনোভাব দেখা গিয়েছে, তা আগামী দিনে রাতারাতি পাল্টে যাবে এমনটা মনে করার কারণ নেই তাই তৃণমূল কংগ্রেস ফ্যাসিবাদ লড়াইয়ের মুখ হবে এমন চিন্তা কষ্টকল্পনা।
ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইয়ে যাদের নেতৃত্ব দেওয়ার কথা সেই বামপন্থীদের বিপন্নতার প্রশ্নটিও গুরুত্বপূর্ণ। এই বিপন্নতা বহুমাত্রিক ও প্রকৃতিগত ভাবে জটিল। বাম ক্যানভাসের একদিকে আছে সিপিআই( এম) এর নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট যারা ভোট সর্বস্ব রাজনীতির বহু পুরানো খেলোয়াড় এবং ৩৪ বছর নিরবিচ্ছিন্ন ক্ষমতা ভোগের পর দীর্ঘ সময় ধরে এ রাজ্যে ক্ষমতা বৃত্তের বাইরে অবস্থান করছে।কোন দ্বিধা - দ্বন্দ্ব না রেখেই বলা যায় সিপিএম ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইয়ে অংশ নেওয়ার যোগ্যতা হারিয়েছে। যে কোন মূল্যে ক্ষমতায় ফিরে আসার তাড়নায় ফ্যাসিবাদী বিজেপি যে রাজ্যের প্রধান বিপদ, একথা তারা মেনে নেয় নি বরং বিজেপি ও তৃণমূল একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ -- এই তত্ত্বায়নে ব্যস্ত থেকেছে। ' বিজেমূল' নামে এক আজগুবি তত্ত্বের আমদানি করে মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে। প্রায়োগিক ক্ষেত্রে ২১'রাম ও ২৬' এ বাম নামক এক চরম প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থান নিয়েছে।বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক আগে আব্বাস সিদ্দিকির নেতৃত্বাধীন আই এস এফ ( বাস্তবে এই নামে কোন দলই নেই) এর সঙ্গে জোট বেঁধে সংখ্যালঘু ভোট বিভাজন করে বিজেপির জয় নিশ্চিত করতে চেয়েছে। এই ভুল রাজনীতির কারণে ফ্যাসিবাদ বিরোধী অবস্থান নেওয়াতো দূরের কথা, তারা হয়ে উঠেছে বিজেপির বন্ধু। পশ্চিমবঙ্গের সচেতন মানুষ এই আত্মঘাতী রাজনীতির ফাঁদে পা দেন নি বরং বামফ্রন্টকে সজোরে প্রত্যাখান করেছেন।এই বামফ্রন্ট, বিশেষ করে সিপিএম তাদের রাজনৈতিক লাইন পরিবর্তন না করলে ( যার কোন সম্ভাবনা আপাতত দৃশ্যমান নয়) ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইয়ে তারা শুধু বিভ্রান্তি তৈরি করবে।ক্যানভাসের অপরপ্রান্তে রয়েছে ' সংগ্রামী বাম'।এই শব্দবন্ধের মধ্যে পড়ে সংসদীয় ও অসংসদীয় পথে অনুশীলনকারী বিভিন্ন নকশালপন্থী দল,ট্রেড ইউনিয়ন, ছাত্র - যুব- মহিলা সংগঠন, অধিকার আন্দোলনের ফোরাম,গণতান্ত্রিক মঞ্চ, এমনকি লিটিল ম্যাগাজিন,নাটকের দল প্রভৃতি। ফ্যাসিবাদের বিপদকে চিহ্নিত করা,তাদের স্বরূপ উন্মোচিত করা,সর্বোপরি নির্বাচনী ও রাস্তার লড়াইয়ে ফ্যাসিবাদকে পরাস্ত করার ডাক দিয়ে তারা সাম্প্রতিক সময়ে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সমর্থ হয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও সত্য যে এইসব নকশালপন্থী দল এখনো এরাজ্যে অত্যন্ত প্রান্তিক শক্তি। এবারের নির্বাচনে সঠিক রাজনৈতিক লাইন নেওয়া সত্বেও যে সমস্ত নকশালপন্থী দল নির্বাচনে লড়েছিল তাদের সবারই জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। আবার বিগত সময়ে নন্দীগ্রাম ও লালগড় আন্দোলনের সময় যে সংগ্রামী বামশক্তির বিকাশ হয়েছিল তারাও আজ হীনবল।যদিও তাতে সংগ্রামী বামশক্তির ফ্যাসিবাদ বিরোধী সঠিক রাজনৈতিক অবস্থানের গুরুত্ব কোনভাবেই খাটো হচ্ছে না কিন্তু আগামী লড়াইয়ের স্বার্থে এই সংগ্রামী বাম ও বিভিন্ন গণতান্ত্রিক শক্তির মধ্যে ঐক্যের বিষয়টি জরুরি প্রশ্ন হিসাবে উঠে আসছে।সে ব্যাপারে পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে সংগ্রামী বাম শক্তিগুলি যত তাড়াতাড়ি ফ্যাসিবাদ বিরোধী যৌথ কার্যক্রম নিতে পারবে ততই মঙ্গল। ফ্যাসিবাদের পরাজয় ঘটাতে পারে বামপন্থা তাই বিকল্প মতাদর্শ ও কর্মসূচি জনগনের মধ্যে না নিয়ে যেতে পারলে সংগ্রামী বামপন্থীরা ইতিহাসের পাতায় ফুটনোট হিসাবেই থেকে যাবে -- এই সত্যটা আমাদের দ্রুত উপলব্ধি করতে হবে।