পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

মাধ্যমিকের শেষ দিন: এক ছাত্রের খোলা চিঠি

  • 01 March, 2025
  • 0 Comment(s)
  • 2510 view(s)
  • লিখেছেন : সীমান্ত গুহ ঠাকুরতা
মাধ্যমিক পরীক্ষার পরে বেশ কিছু জায়গায় ছাত্রদের দেখা গেল বইপত্র ছিঁড়ে ফেলতে, কিন্তু কী কারণে ছাত্ররা এই আচরণ করছে, তা কি আমরা কোনও সময়ে ভেবে দেখেছি ? এক ছাত্রের খোলা চিঠি, সেই কথাগুলোকেই আবার সামনে আনলো। ছাত্ররা কি তবে মুক্তি চাইছে, এই পড়াশুনা থেকে ? আসুন ভাবি, ভাবা প্র্যাক্টিস করি।

বেশ করেছি বই ছিঁড়ে কুচি কুচি করে উড়িয়ে দিয়েছি। আমার বই, আমার খাতা, আমার পরীক্ষা, আমার নম্বর, আমার ইচ্ছা। কথায় কথায় ব্যক্তিস্বাধীনতার গল্প আওড়ান আপনারা। আজ তবে এত গায়ে লাগছে কেন আপনাদের?

কাগজে  দেখলাম, কোন এক স্কুলের একজন মাস্টারমশাই বলেছেন, ‘এ আসলে  আমাদেরই ব্যর্থতা’। দেখে তবু একটু ভাল লাগল। যাক, একজন কেউ অন্তত আছে, যিনি সবসময় অন্যের দিকের বদলে নিজের দিকেও আঙুল তুলতে পারেন। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর পড়াশুনার নামে  আপনারা শুধু আমাদের ভয় দেখিয়েছেন। পড়া না পারলে মারের ভয়, বন্ধুর কাছে হেরে যাবার  ভয়, পরীক্ষায় ফেল করার ভয়, পিছিয়ে পড়ার ভয়, চাকরি না পাবার ভয়, বিয়ের সময় ভাল পাত্রী না পাবার ভয় --- শুধু ভয়, ভয় আর ভয়। মোটের ওপর  ব্যাপারটাই এমন দাঁড়িয়ে গিয়েছিল যে -- পড়াশুনা ইজ ইকুয়্যাল টু ভয়। তা সেই ভয় থেকে মুক্তির দিনটাকে একটু সেলিব্রেট করব না?

কী-ই বা করেছি আমরা? স্কুলবাড়িতে আগুন ধরাইনি, মা সরস্বতীর মূর্তি ভাঙিনি, রাস্তা অবরোধ করিনি, কারোর কোনো ক্ষতি করিনি, শুধু যে বইখাতাগুলো দিনের পর দিন শুধু ভয় দেখিয়েছে, যন্ত্রণা দিয়েছে, সেগুলোকে ছিঁড়ে কুচিকুচি করে উড়িয়ে দিয়েছি। আবারও বলছি, বেশ করেছি।

ভেবে দেখুন তো, কোনওদিন, কোনও ক্লাসে পড়াবার সময় আপনারা একবারও বলেছেন, ‘আজ আমরা একটা দারুন জিনিস শিখব’ অথবা ‘আয়, আজ একটা খুব মজার অঙ্ক করব?’  গোটা সিস্টেমটাই কেমন যেন নুন ছাড়া, তেল ছাড়া  রুগীর পথ্যের মত বিস্বাদ বানিয়ে রেখেছেন আপনারা। শুধু কি পড়াশুনা? আমাদের জন্য যখন যা বরাদ্দ করেছেন, সবই তো ওই কোয়ালিটির। ক্লাস এইট পর্যন্ত মিড ডে মিল খেয়েছি। আমাদের যাতে যথেষ্ট পুষ্টি হয়, তার জন্য নাকি সরকার মিড ডে মিল চালু করেছে। তা ভাল কথা, কিন্তু পুষ্টির পাশাপাশি স্বাদ বলেও তো একটা জিনিস আছে, নাকি? দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর হয় ভাত-ডাল-সোয়াবিনের তরকারি, নইলে ট্যালটেলে খিচুড়ি। আপনারা নিজেরা খেতে পারবেন? প্রতি বার গার্জিয়ানস মিটিং-এ বলেন, আমরা নাকি আপনাদের সন্তানের সমান। ভাল লাগত আপনাদের, যদি আপনাদের নিজেদের ঘরের বাচ্চাগুলো দিনের পর দিন দুপুরবেলা এই খাবার খেতে হত? অথচ কই, এ নিয়ে কোনোদিন কোনো অন্দোলন করেছেন বলে তো মনে পড়ে না। আপনাদের আন্দোলন মানেই তো ডি এ দাও, মাইনে বাড়াও, বোনাস দাও…।  মানে আমাদের ছেলেরা ভাল-মন্দ খাক, বাকিগুলো মায়ের ভোগে যাক।

আপনাদের দেওয়া শিক্ষাও আমাদের কাছে হয়ে গেছে ওই মিড ডে মিলের মতই --- একঘেয়ে…, বিস্বাদ…., বিরক্তিকর…। ভূগোল পড়াবার সময় শেষ কবে একটা ম্যাপ ঝুলিয়েছিলেন দেওয়ালে, মনে পড়ে? অথবা যে জায়গাটার ভূগোল পড়াচ্ছেন, কোনোদিন সেটা গুগল ম্যাপে বার করে দেখিয়েছেন? বিজ্ঞান পড়িয়েছেন, অথচ তার কোনো কিছু হাতে কলমে করে দেখানোর প্রয়োজন বোধ করেননি। আর অঙ্ক? সেই ছোটবেলা থেকে বাবা-মা থেকে শুরু করে এই মাধ্যমিক পর্যন্ত আপনারা তো অঙ্ককে শুধু  ভয়ই পেতে শিখিয়ে গেলেন। অঙ্ক পরীক্ষার দিন সকাল থেকে বাবা-মা, পাড়া প্রতিবেশী থেকে শুরু করে আপনারা সবাই কেবল একটা কথাই বলতে থাকে, ‘টেনশন করবি না’। আরে বাবা, এতবার যদি একটা ছেলে বা মেয়ের কানের সামনে এই একই কথা আওড়ানো হয়, সে তো অটোমেটিক টেনশনে পড়ে যাবে।  একটা মজার কেস বলি শুনুন।  বারবার অঙ্কে ফেল করত বলে আমার এক বন্ধু পড়াশুনাই ছেড়ে দিয়েছিল।  সেই বন্ধুটা এখন বাজারে সবজি বেচে আর ফটাফট মুখে মুখে যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ করে। খদ্দেরদের থেকে টাকা নিতে বা ফেরত দিতে ওর একটুও ভুল হয় না। অথচ ওই অঙ্কগুলোই আপনারা ওকে খাতায় করতে দিন, সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আপনাদের মুখগুলো দেখে ভয়েই বোধহয় সব ভুল করে ফেলবে। এই তো আপনাদের দেওয়া শিক্ষার আসল চেহারা।

কী ছিল ওইসব বইগুলোতে, যেগুলো আমরা ছিঁড়েছি? কিছু কঠিন কঠিন কথা, যার মধ্যে কোনোদিন কোনো রস পাইনি আমরা। আর কিছু জ্যালজেলে ছবি, যা নড়েও না চড়েও না। চ্যালেঞ্জ করবেন? যেকোনো বইয়ের যেকোনো চ্যাপ্টার বার করে দিন, ইউটিউব খুলে দেখিয়ে দেব সেই বিষয়টাই কত সুন্দর করে বোঝানো যায়। কত লোক বুঝিয়েও দিচ্ছে।  সেসব না দেখে আমরা কেন শুনতে যাব আপনাদের একঘেয়ে বোরিং লেকচার?

জানি, এক্ষুণি বলবেন, ‘তা বাপু ইউটিউব দেখেই বা পড়োনি কেন? কেনই বা সারাদিন শুধু গেম খেলেছ আর ফেসবুকে রিলস দেখে সময় নষ্ট করেছ?’  কারণ এই পড়াশুনায় আখেরে কোনো লাভ বা ফিউচার দেখতে পাই না আমরা। বুকে হাত রেখে বলুন তো স্যর, আপনারা পান? কটা বই ছিঁড়েছি বলে এত যে গাল দিচ্ছেন, তা আমরা যদি  পালটা পড়াশুনার শেষে একটা চাকরির বা অন্তত একটা ভদ্রস্থ পেশার (আপনারা যাকে বলেন হোয়াইট কলার জব) গ্যারান্টি চাই,  দিতে পারবেন? জানেন, আমার দিদি আপনাদের কথা শুনে খুব কষে পড়াশুনা করেছিল। ওর খুব ইচ্ছে ছিল আপনাদের মত স্কুল-টিচার হবে। বলত, চাকরি না পেলে বিয়ে করবে না। এম এ পাস করার পর এখন ঘরে বসে টিউশন করে। তিনবার স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা দিয়েছে, পায়নি। কেন পায়নি তা কি ব্যাখ্যা করে বলতে হবে? এখন বাড়ি থেকে ওর পাত্র দেখা চলছে।  

আর আমার যে সব বন্ধু পড়াশুনা ছেড়ে ‘কাজে’ চলে গিয়েছিল তামিলনাড়ু বা গুজরাট বা দুবাই --- সবাই দিব্যি ভাল খেয়ে পরে আছে। বিশ্বাস না হয় খোঁজ নিয়ে দেখুন। ছ’মাস অন্তর যখন কদিনের জন্য বাড়ি ফেরে, পকেটে আই ফোন, চুলে জেল, চোখে সানগ্লাস দিয়ে কায়দার বাইক হাঁকিয়ে পাড়ায় ঘুরে বেড়ায়। ওদেরই মত কারো সাথে হয়তো আমার দিদিটার বিয়ে হয়ে যাবে। পড়াশুনা করে তো এই ঘোড়ার ডিম হয় আজকের দিনে। স্কুলে, হেডস্যরের ঘরের বাইরে বড় বড় লেখা আছে স্বামীজির বাণী। কী সব অন্তর্নিহিত পূর্ণতা-ফূর্ণতা --- মানে বুঝিনি কোনোদিন। কেউ বুঝিয়েও দেয়নি। কিন্তু বাংলার স্যর ক্লাসে একদিন বেদ না উপনিষদ কী থেকে যেন শ্বেতকেতু আর অরণি-উদ্দালকের গল্প শুনিয়েছিলেন। উদ্দালক তার শিষ্য অরণিকে পনেরোদিন উপোস করে তারপর তার সামনে আসতে বলেছিল। সেই মত উদ্দালক উপোস করে এসে দাঁড়ালে অরণি তাকে বেদের একটা অংশ মুখস্থ বলতে বলেছিল। বিশ্বাস করুন, অরণি একটা লাইনও বলতে পারেনি। উদ্দালক তখন  বলেছিল, তাহলে বুঝলে তো, খালিপেটে বিদ্যে হয় না।

এই গল্পটা আমার হেব্বি লেগেছিল। আমার মনে হয়েছিল এর সঙ্গে আমি আরও কয়েকটা পয়েন্ট যোগ করতে পারি। যেমন--- আনন্দ না থাকলে বিদ্যে হয় না, ভালবাসা না থাকলে বিদ্যে হয় না, মারের ভয়ে কোনোদিন বিদ্যে হয় না, আর লাস্ট বাট নট না লীস্ট --- পড়াশুনার শেষে ভাল আর ভদ্র রোজগারের গ্যারান্টি না থাকলেও বিদ্যে হয় না।

আপনাদের প্রবলেম কী জানেন স্যর? আপনাদের কাছে পড়ানো মানে লেকচার দেওয়া, শাসন মানে পেটানো, বোঝানো মানে জ্ঞান দেওয়া, পড়া তৈরি করা মানে মুখস্থ করা, সাফল্য মানে একগাদা নম্বর আর মানুষ হওয়া মানে ভাল চাকরি করা। সত্যি করে বলুন তো, ভুল বলেছি?

শ্রদ্ধা!!! শ্রদ্ধা মানে কী --- তা আপনারা কোনোদিন আমাদের বুঝিয়েছেন? জ্ঞান দিয়ে নয়, আচরণ দিয়ে? শ্রদ্ধা জিনিসটা জোর করে আদায় করা যায় না স্যর। ওটা অর্জন করতে হয়। যে স্যর বা ম্যাডাম একটু ভালবেসে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন, একটু পরিবারের খোঁজ নেন, দুপুরে পেট ভরে খেয়েছি কিনা জিজ্ঞেস করেন, অন্যায় করলে পাশে বসিয়ে বুঝিয়ে দেন কেন আমার কাজটা ঠিক হয়নি --- তাঁদের আমরা শ্রদ্ধা করি। আর বাকিদের শ্রদ্ধা দেখাই, কিন্তু করি না। সেই ‘দেখানো’-টুকুরওর দরকার হবে না আর বেশিদিন। কারণ আপনাদের প্রয়োজন ফুরোচ্ছে। হাইফাই প্রযুক্তি এসে যাচ্ছে, ঘরে  বসেই সব্বাই সব কিছু শিখে নিচ্ছে আজকাল।শুধু আপনারাই আটকে আছেন মান্ধাতার আমলে। আপনাদের ব্যবস্থায় পরীক্ষা মানে তো শুধু কার ব্রেনে কতটা ইনফরমেশন জমা আছে তা মেপে দেখা। কেবল এম সি কিউ-তে টিক মেরে ওর থেকে বেশি কী-ই বা প্রমান করা যায়? ও ছাতার পরীক্ষা আমাদের আর না দিলেও চলবে। সারা পৃথিবীর সমস্ত ইনফরমেশন আমরা এখন পকেটে নিয়ে ঘুরি।  দরকার পড়লে দু-সেকেন্ডের মধ্যে বার করে দেব।

জ্ঞান সম্পূর্ণ অন্য জিনিস স্যর। সেটা যে কী তা আপনারাও ভুলে গেছেন। কাজেই ও-কথা বাদ দিন। এখন বলুন তো, ইনফরমেশন ব্যাপারটা আমাদের ঠিক কোন কাজে লাগে? আর কাজ ফুরোলেই বা তার কী গতি হয়? ধরুন আপনি ট্রেনে ওঠার আগে একটা টিকিট কাটলেন, তাতে কতদূর যাবেন, কত ভাড়া দিয়েছেন, কটার সময় টিকিট কেটেছেন  ---  এসব ইনফরমেশন লেখা থাকে। তা এই ইনফরমেশনগুলো কতক্ষণ আপনার কাজে লাগে? যতক্ষণ আপনি ট্রেনে চড়ছেন ততক্ষনই, তাই তো? তারপর সেই টিকিটটা আপনি কী করেন? পরীক্ষা ব্যাপারটাকেও আপনারা অবিকল একই জিনিস বানিয়ে দিয়েছেন। কিছু শুকনো ইনফমেশনের চেকিং মাত্র। তা পরীক্ষা মিটে গেলে সেই টিকিট, থুড়ি বইগুলো আর কোন কাজে লাগবে? তাই ওগুলো কুচি কুচি করে উড়িয়ে দিয়েছি। পুরনো খবরের কাগজগুলো কী করেন আপনারা? ঠাকুরের আসনে বসিয়ে পুজো করেন?

তাই তো বলছিলাম, বেশ করেছি মাধ্যমিক মিটে যাবার পর সব বই ছিঁড়ে ফেলেছি। এটাকে আপনাদের ব্যবস্থার প্রতি অশ্রদ্ধা নয়, বরং অনাস্থা হিসেবেই দেখুন স্যর-ম্যাডামরা। গুপি গায়েন বাঘা বায়েনের শেষ সিনটা মনে আছে? সেই যে, দুষ্টু মন্ত্রীর হাত থেকে মুক্তি পেয়ে  'ছুটি ছুটি' বলে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে ছুট দিচ্ছিলেন হাল্লা রাজা, আমাদের মানসিক অবস্থাও সেদিন ওই রকমই ছিল। আপনাদের জোর করে মুখে গুঁজে দেওয়া ভয়ের ওষুধ আর আমাদের গিলতে হবে না।

0 Comments

Post Comment