কিংবদন্তী নায়ক অনেকেই হন, কিন্তু সম্রাট হন একজনই। বিশ্বফুটবলে ফুটবল সম্রাট উপাধি একজনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য আর তিনি হলেন ব্রাজিলের পেলে। ব্রাজিলের ফুটবলকে বিশ্বফুটবলের মানচিত্রে নতুন পরিচয় দিয়েছিলেন পেলে। পেলে আসার আগে ব্রাজিলের ফুটবল শুধুই একটা খেলা ছিল, অবশ্যই তার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল আবেগ, কিন্তু পেলে সেই ফুটবলকেই বানিয়েছিলেন ব্রাজিলের পরিচয়, ব্রাজিলের সাংস্কৃতিক জীবনযাপনের প্রধান ভিত্তি। বিশ্বফুটবলে ব্রাজিলকে দিয়েছিলেন জোগো বোনিতোর পরিচয়। সুন্দর ফুটবলের প্রথম সংজ্ঞায় ব্রাজিলকে যাঁরা ভূষিত করেছিলেন তাদের অন্যতম পথপ্রদর্শক তিনি এডসন এরান্টেস ওরফে পেলে। আট থেকে আশি সকলের কাছে ফুটবলের একটাই মানবীয় স্বরূপ-‘ব্রাজিলের পেলে’। তিনি অবিসংবাদী ফুটবল কিংবদন্তী, ফুটবল সম্রাট ‘ব্রাজিলের পেলে’। জন্মনাম এডসন আরান্টেস ডু নাসিমেন্টো, কিন্তু বিশ্বফুটবলে তিনি একডাকে পরিচিত পেলে নামেই। সেই ফুটবল সম্রাট পেলে চলে গেলেন চিরনিদ্রার দেশে। বছরের একদম অন্তিম লগ্নে ২৯ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে ব্রাজিলের সাও পাওলোর আলবার্ট আইনস্টাইন হাসপাতালে মাল্টিপল অর্গান ফেলিওর জড়িত কারণে জীবন প্রদীপ নিভে গেল ফুটবল সম্রাটের। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল বিরাশি নছর (জন্ম ২৩ অক্টোবর ১৯৪০ সালে)। বেশ কিছু সময় ধরেই গুরুতর অসুস্থ ছিলেন তিনি। কাতার বিশ্বকাপ চলার মাঝেও একবার কঠিন অবস্থা হয়েছিল তাঁর শরীরের, কিন্তু সেযাত্রা জীবনীশক্তি দিয়ে লড়াই করে ফিরে এলেও এবারে আর পারলেন না, বিশ্বকে চিরবিদায় জানিয়ে অনন্ত নিদ্রার দেশে চলে গেলেন তিনি।
অত্যন্ত দরিদ্র পরিবার থেকে পেলের উত্থান রূপকথার চেয়েও আকর্ষক আবার চরম বাস্তবের ওপর অধ্যাবস্যায় আর প্রতিভার ভিত্তিতে জীবন সংগ্রামের লড়াইয়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত। পেলের মা ডোনা সেলেস্তে আর পিতা ডনডিনহো। ডনডিনহো একজন ফুটবলার ছিলেন, খেলতেন ব্রাজিলের ফ্লুমিনেস ক্লাবে। একটা গুরুতর চোট তার ফুটবল জীবনের সমাপ্তি ঘটিয়ে দেয়। কিন্তু নিজে ফুটবল খেলা ছাড়ার পরও ফুটবল নিয়ে মাতোয়ারা থাকতেন তিনি। পেলে ফুটবলকে ভালোবাসতে শেখেন তার বাবার কাছ থেকেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৫০ সালে আবার ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজিত হয় এবং আয়োজক দেশ ছিল ব্রাজিল। সমগ্র ব্রাজিলের জনতা উৎসাহী ছিল যে ব্রাজিলই ফুটবল বিশ্বকাপ জিতবে। চূড়ান্ত ম্যাচ উরুগুয়ের সঙ্গে ড্র রাখতে পারলেই বিশ্বকাপ প্রথমবারের জন্য জিতে নিত ব্রাজিল (সেই বিশ্বকাপে আলাদা করে নক আউট পর্ব ছিল না)। কিন্তু উরুগুয়ের ঘিজিয়ার গোল সব হিসেব পাল্টে দেয়। উরুগুয়ে বিশ্বকাপ জিতে নিলে গোটা ব্রাজিল শোকস্তব্ধ হয়ে যায়। বাকি সবার সঙ্গে নিজের বাবাকেও প্রচন্ড রকম ভেঙে পড়তে দেখেন পেলে। তখনই তিনি প্রতিজ্ঞা করেন যে ফুটবলার হয়ে বিশ্বকাপ তিনি স্বদেশে আনবেনই। দশ বছরের বালক এডসনের সেই প্রতিজ্ঞাই হয়ে তার জীবনের লক্ষ্য। ফুটবল হয়ে ওঠে তাঁর জীবন। বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে তিনি পেলে নামে খ্যাত হন। এই পেলের পায়ের ওপর ভর করেই ১৯৫৮-র বিশ্বকাপে নতুন সূর্যোদয় হয়েছিল ব্রাজিলের। ১৯৫৪ সালের বাটেল অফ বার্নের ধ্বংসাত্মক ফুটবল (এই ম্যাচে কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিল ২-৪ গোলে হেরে গিয়েছিল হাঙ্গেরির কাছে এবং ম্যাচের পর চলেছিল দুই দলের মধ্যে হিংসাত্মক ধ্বংসকারী হাতাহাতি লড়াই) থেকে ব্রাজিলের ফুটবলকে পরিচয় দিয়েছিল জোগো বোনিতোর সৌন্দর্যে। ১৯৫৭ সালে তৎকালীন সময়ের সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসাবে আন্তর্জাতিক ফুটবলে অভিষেক হয় পেলের আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে, ম্যাচটি ব্রাজিল হেরে গেলেও নিজের প্রথম আবির্ভাবেই আন্তর্জাতিক গোল করেন পেলে সেলেকাও জার্সিতে। তারপরেই তার ডাক আসে ১৯৫৮ সালের ফুটবল বিশ্বকাপের দলে। দুই তরুণ পেলে আর গ্যারিঞ্চাকে দলে নেন ব্রাজিল ফুটবলে বিপ্লব (৪-২-৪ সিস্টেম) উদ্ভাবনকারী কোচ ভিসেন্তে ফিওলা। সোভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধে সেই বিশ্বকাপে গ্রুপের খেলায় ফিফা বিশ্বকাপের মঞ্চে আবির্ভাব ঘটে পেলের, তখন তাঁর বয়স ১৬ বছর ২৩৯ দিন। বিশ্বকাপের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসাবে পেলে তাঁর প্রথম গোল পান কোয়ার্টার ফাইনালে ওয়েলসের বিরুদ্ধে। তাঁর গোলেই ব্রাজিল সেমিফাইনালে পৌছায়। আর ১৯৫৮ সালের সুইডেন বিশ্বকাপের ফাইনাল তো ইতিহাস। আয়োজক দেশকে ৫-২ গোলে হারিয়ে প্রথমবারের জন্য বিশ্বকাপ জিতে নেয় ব্রাজিল, শুরু হয় জোগো বোনিতোর সোনালী অধ্যায়। ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবলের ইতিহাসে আর কোনও বিশ্বকাপের ফাইনালে মোট ৭ গোল হয়নি আর কোনও দলও বিশ্বকাপ ফাইনালে ৫ গোল দিতে পারেনি। ব্রাজিলের ৫ গোলের মধ্যে ম্যাচের ৫৫ আর ৭০ মিনিটে গোল দুটি করেছিলেন পেলে, দুটি গোলই অনন্য দর্শনীয় গোল। নিজের বাবার সঙ্গে সঙ্গে সারা ব্রাজিলের অতৃপ্ত স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করে দেশের নায়কে পরিণত হয়েছিলেন পেলে।
এরপর ১৯৬২ সালের চিলি বিশ্বকাপও জেতে ব্রাজিল, ছুঁয়ে ফেলে ১৯৩৪ আর ১৯৩৮-এ পরপর দু’বার ইতালির বিশ্বকাপ জয়ের রেকর্ড, কিন্তু ১৯৬২-র বিশ্বকাপ ছিল গ্যারিঞ্চার বিশ্বকাপ, পেলে দলে থাকলেও চোট-আঘাতের সমস্যায় জর্জরিত ছিলেন। ১৯৬৬-র ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে বুলগেরিয়ার বিরুদ্ধে গ্রুপের প্রথম ম্যাচেই গুরুতর চোট পান পেলে। হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে তিনি খেলতে পারেননি, হেরে যায় ব্রাজিলও। গ্রুপের শেষ ম্যাচে পর্তুগালের বিরুদ্ধে নেমে আবারও চোট পান পেলে আর সেই ম্যাচ হেরে পেলের সঙ্গে ব্রাজিলও বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেয়। কিন্তু নিজের শেষ বিশ্বকাপ ১৯৭০ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপকে স্মরণীয় করে রাখেন পেলে। অনবদ্য ফুটবল খেলে অপরাজিত অপরাজেয় থেকে বিশ্বকাপ জিতে নেয় ব্রাজিল। এই বিশ্বকাপে মোট চারটে গোল করেন পেলে। ব্রাজিলের অধিনায়ক ছিলেন এই বিশ্বকাপে কার্লোস আলবার্তো কিন্তু ১৯৭০-এর বিশ্বকাপ পেলের বিশ্বকাপ নামেই খ্যাত। জাইরজিনহো এই বিশ্বকাপে প্রতি ম্যাচে গোল করেন কিন্তু আক্রমণভাগকে দারুণ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন পেলে। ফাইনালে ইতালিকে ৪-১ গোলে গুঁড়িয়ে দেয় ব্রাজিল। ব্রাজিলের চার গোলের প্রথমটি করেন পেলে ম্যাচের ১৮ মিনিটে। এই বিশ্বকাপের পর তিনটি বিশ্বকাপ জিতে বিশ্বকাপের সোনার পরী নাইকির ট্রফি চিরকালের মত নিজেদের দেশে নিয়ে যায় ব্রাজিল আর পেলে হয়ে ওঠেন বিশ্ব ফুটবলের মহানায়ক। পেলের জীবন সংগ্রাম বিভিন্ন সময়ে অনুপ্রাণিত করেছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের তথা কথিত পিছিয়ে পড়া মানুষকে লড়াইয়ের মাধ্যমে এগোনোর পথ নিজের অধিকারের পথ অর্জন করতে।
নিজের ফুটবল কেরিয়ারের শ্রেষ্ঠ সময় ব্রাজিলের সান্তোস ক্লাবের হয়েই খেলেছেন পেলে। ক্লাব ফুটবলে কোনওদিনই তিনি ইউরোপের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকেননি। এখানেই পেলের সঙ্গে মারাদোনার বড় পার্থক্য। আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসর নেওয়ার পর ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত খেলেছেন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক কসমস ক্লাবের হয়ে। ১৯৬০-এর দশকে থেকেই পেলের জীবনী ও অসম্পূর্ণ আত্মজীবনী, তার ফুটবল জীবনের ইতিবৃতান্ত, গরিব পরিবার থেকে উঠে এসে ফুটবল মহানায়কে পরিণত হওয়া এসব বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। পেলের কাহিনী বাংলার মানুষকেও আন্তর্জাতিক ফুটবলে ব্রাজিল প্রেমী, ব্রাজিল-সমর্থক করে তোলে। ১৯৭১ সালের বাংলা সিনেমা ‘জয়-জয়ন্তী’-র একটি গানেও ‘ব্রাজিলের পেলে’-র উল্লেখ পাওয়া যায় আর ওই দশকেই স্বয়ং ফুটবল সম্রাট এসে হাজির হন কলকাতায়। ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭৭ সালে কলকাতায় আসেন পেলে কসমস ক্লাবের সঙ্গে, পরদিন ২৫ সেপ্টেম্বর একটি প্রীতি ম্যাচে তিনি কসমসের জার্সিতে নামেন মোহনবাগানের বিরুদ্ধে খেলতে। ম্যাচ ২-২ গোলে অমীমাংসিত থাকে কিন্তু কলকাতার ফুটবলপ্রেমী মানুষ এবং বিপক্ষ মোহনবাগানের প্রত্যেক খেলোয়াড়ের মন জয় করে নিয়ে যান পেলে। আর্জেন্টিনার জার্সিতে ১৯৮৬-র বিশ্বকাপে মারাদোনা ম্যাজিকের আগে পর্যন্ত কলকাতার ফুটবল প্রেম ছিল ব্রাজিলের প্রতি একমুখী, যার প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায় দিব্যেন্দু পালিতের লেখা ‘ব্রাজিল’ ছোটগল্পে।
পেলে ব্রাজিলের সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলস্কোরার। ১৩৬৩ ম্যাচে ১২৭৯ গোল করে (প্রদর্শনী ম্যাচ সহ) পেলে নিজের নাম নথিবদ্ধ করিয়েছিলেন গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে। খেলা ছাড়ার পরও ব্রাজিলের ফুটবলের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন পেলে। ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব সামলেছেন ব্রাজিলের ক্রীড়ামন্ত্রকের। ফিফা আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড এম্বেসেডার ছিলেন বেশ কয়েকবছর। বিগত বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ ফুটবলার হিসাবে মারাদোনার সঙ্গে যৌথভাবে পেয়েছেন ফিফার স্বীকৃতি। ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ ফুটবল হিস্টরি এন্ড স্ট্যাটিসটিকসের বিচারে ২০০০ সালে পেয়েছেন বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ ফুটবলারের সম্মান। ২০০০ সালেই টাইম পত্রিকা তাকে বিশ শতকের সেরা একশো জন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বের মধ্যে স্থান দিয়েছিল। ১৯৯৯ সালে ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটি তাকে বিশ শতকের সেরা আথলিটের খেতাব দিয়েছিল। ফুটবলবিশ্বের একমেবাদ্বিতীয়ম সম্রাট ছিলেন তিনি। পেলে বিশ্বফুটবলের সম্রাটের খেতাব পেয়ে থাকলে মারাদোনা পেয়েছিলেন ফুটবল রাজপুত্রের খেতাব। পেলে খেলা ছাড়ার প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় পরে আন্তর্জাতিক ফুটবলে নিজের মহিমা প্রসারিত করেছিলেন আর্জেন্টিনার মারাদোনা। কিন্তু দুজনের মধ্যে তুলনা হয়েছে বারেবারে। তাদের নিজ নিজ সমর্থকদের তাদের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত, কিন্তু বিশ্বফুটবলকে দুই ঘরানায় মাতিয়ে দিয়ে সমৃদ্ধ করে গেছেন দুই জনেই। সমৃদ্ধ হয়েছে লাতিন আমেরিকীয় ফুটবল ঘরানা। ইউরোপের ফুটবল শ্রেষ্ঠত্বকে লাতিন আমেরিকীয় রীতিতে চরম চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন এই দুইজনই। দুই বছর আগে ফুটবল রাজপুত্র মারাদোনা পাড়ি দিয়েছিলেন চিরঘুমের দেশে, এবার তাঁর সঙ্গে সেখানে মিলিত হতে চললেন আরেক মহিমান্বিত ১০ নম্বর জার্সি, আদ্যন্ত ঈশ্বরভক্ত ক্যাথলিক ফুটবল সম্রাট এডসন আরান্টেস ডু নাসিমেণ্টো ওরফে একমেবাদ্বিতীয়ম ‘পেলে’। খালি পড়ে রইল সম্রাটের সিংহাসন আর মুকুট, চিরনিদ্রার দেশে পাড়ি দিলেন ফুটবল সম্রাট, কিন্তু ফুটবলপ্রেমী মানুষের হৃদয়ে চিরস্থায়ী হয়ে রয়ে গেল ফুটবল সম্রাটের উপস্থিতি, তিনি একজনই একমেবাদ্বিতীয়ম, ফুটবল হৃদয়ের দুর্লভতম হীরে, কালোমানিক ‘ব্রাজিলের পেলে’।