পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

কর্মচঞ্চল বিজ্ঞান সাধক এক মানব; সমর বাগচী

  • 31 July, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 1030 view(s)
  • লিখেছেন : অসিত রায়
যখন চন্দ্রায়ন ছাড়ার সময়ে, দেশের বিজ্ঞানীরা তিরুপতির মন্দিরে গিয়ে বা এক ভন্ড বাবা, সদগুরুর পায়ে নিজেদের সমর্পণ করেন, তখন মনে হয়, সমর বাগচীর মতো মানুষদের আরও প্রয়োজন ছিল এই সময়ে। যখন আজকের সময়ে পরিবেশ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে, তখন তাঁর ফোনের হোয়াটসঅ্যাপ স্ট্যাটাস দিয়েই তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে হয় সদা হাস্যময় এই মানুষটিকে। Climate Justice - Act Now, Right Now!


অরুণ মিত্রের কবিতা অনর্গল আওড়াতে,কিংবা শেক্সপিয়ার এর হ্যাম লেটের থেকে হোয়াট এ পিস অফ ওয়ার্ক ইজ ম্যান বলতে আর কোন বিজ্ঞান সাধক কে এরকম  আমি দেখি নি। কোথা থেকে শুরু করব ভেবে পাই না।
এত অজস্র মানুষ তাঁর চলে যাবার পর অশ্রু সজল কলমে  তাঁকে প্রণতি জানিয়েছেন তার লেখাজোখা হয় না। সত্যিই আক্ষরিক  অর্থেই তিনি কতশত বিষয়ে তাঁর স্বাক্ষর রেখে গেছেন এই ছোট পরিসরে তা ধরার ক্ষমতাই এই প্রতিবেদকের নেই।প্রায় একানব্বই বছরের এই যুবক এই সেদিনও ৬ই ডিসেম্বর,বাবরি ধংসের কালো দিনটিতে মেধা পাটকরের আহবানে হাজরা পার্কের সামনে শাসকদের প্রতি দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের  সাথে গলা মিলিয়ে স্লোগান দিয়েছেন, দেশ বাঁচাও, সংবিধান বাচাও,গণতন্ত্র বাঁচাও ।আবার তিনিই গ্রেটা থুনবার্গের ডাকে সাড়া দিয়ে ছাত্র ছাত্রীদের বিশাল মিছিলে পা মিলিয়েছেন জলঙ্গী নদী বাঁচাতে কলকাতায়।প্রয়াত এই অক্লান্ত উদ্যমী নানা রঙের মানুষটি অন্ধকার সময়ে আমাদের বাতিঘর।তিনি আর কেউ নন। তিনি সমর বাগচী , বিহারের মুঙ্গেরে জন্মানো প্রতিবেশী সতীনাথ ভাদুড়ীর ঢোড়াই চরিত মানসের এক চরিত্র। যার প্রয়াণে চোখের জলে ভাসছে শহর কলকাতা। কী প্রখর ছিল তাঁর স্মৃতি শক্তিঃ এনএপিএম এর পুরী সম্মেলন শেষ করে যখন ফিরে এলাম তখন তিনি জানতে চাইলেন কিরকম হোল? আমাদের এক সাথী পুরনো আমলের একটা গান গেয়ে উত্তর দিলেন ওয়াক্ত কি আওয়াজ হ্যায় মিল কে চলো ।সঙ্গে সঙ্গে গানের গীতিকারের নাম বলে দিলেন।তাঁর অনেক কবিতা  মুখস্ত শুনেছি। কবি অরুণ মিত্রের কবিতা ভালবাসতেন। উদাত্ত কন্ঠে তিনি ধরলেন, বৃক্ষমূলে আমার গভীরতম কথা আমি রেখে দিয়েছি।
  আরও পুরনো একটা গল্প বললে সমর বাগচীর চরিত্রের একটা দিক উন্মোচিত হবে।যখন তিনি বিড়লা মিউজিয়ামের অধিকর্তা ছিলেন ,তখন একটা পেট লাইব্রেরী করেছিলেন.এক কিংবদন্তি বহুমাত্রিক বিজ্ঞান সাধক মানবতাবাদীর কথা
এত অজস্র মানুষ তাঁর চলে যাবার পর অশ্রু সজল কলমে  তাঁকে প্রণতি জানিয়েছেন তার লেখাজোখা হয় না। সত্যিই আক্ষরিক  অর্থেই তিনি কতশত বিষয়ে তাঁর স্বাক্ষর রেখে গেছেন এই ছোট পরিসরে তা ধরার ক্ষমতাই এই প্রতিবেদকের নেই।প্রায় একানব্বই বছরের এই যুবক এই সেদিনও ৬ই ডিসেম্বর,বাবরি ধংসের কালো দিনটিতে মেধা পাটকরের আহবানে হাজরা পার্কের সামনে শাসকদের প্রতি দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের  সাথে গলা মিলিয়ে স্লোগান দিয়েছেন, দেশ বাঁচাও, সংবিধান বাচাও,গণতন্ত্র বাঁচাও ।আবার তিনিই গ্রেটা থুনবার্গের ডাকে সাড়া দিয়ে ছাত্র ছাত্রীদের বিশাল মিছিলে পা মিলিয়েছেন জলঙ্গী নদী বাঁচাতে কলকাতায়।প্রয়াত এই অক্লান্ত উদ্যমী নানা রঙের মানুষটি অন্ধকার সময়ে আমাদের বাতিঘর।তিনি আর কেউ নন। তিনি সমর বাগচী , বিহারের মুঙ্গেরে জন্মানো প্রতিবেশী সতীনাথ ভাদুড়ীর ঢোড়াই চরিত মানসের এক চরিত্র। যার প্রয়াণে চোখের জলে ভাসছে শহর কলকাতা। কী প্রখর ছিল তাঁর স্মৃতি শক্তিঃ এনএপিএম এর পুরী সম্মেলন শেষ করে যখন ফিরে এলাম তখন তিনি জানতে চাইলেন কিরকম হোল? আমাদের এক সাথী পুরনো আমলের একটা গান গেয়ে উত্তর দিলেন ওয়াক্ত কি আওয়াজ হ্যায় মিল কে চলো ।সঙ্গে সঙ্গে গানের গীতিকারের নাম বলে দিলেন।তাঁর অনেক কবিতা  মুখস্ত শুনেছি। কবি অরুণ মিত্রের কবিতা ভালবাসতেন। উদাত্ত কন্ঠে তিনি ধরলেন, বৃক্ষমূলে আমার গভীরতম কথা আমি রেখে দিয়েছি।
আরও পুরনো একটা গল্প বললে সমর বাগচীর চরিত্রের একটা দিক উন্মোচিত হবে।যখন তিনি বিড়লা মিউজিয়ামের অধিকর্তা ছিলেন ,তখন একটা পেট লাইব্রেরী করেছিলেন ছোটরা সেখান থেকে কিছু দিনের পোষ্য পশু পাখি বাড়ি নিয়ে যেতে পারত। আবার মেয়াদ ফুরোলে ফেরৎ দিতে হতো। একবার এভাবে নেওয়া একটি বিরল প্রজাতির পাখি এক সদস্যের খাঁচা থেকে উড়ে যায়। বাচ্চাটির মা ও বাবা সারা কলকাতা চষে ফেলেও তেমন পাখি কিনতে না পেরে সমরবাবুর কাছে গিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে জানতে চান কত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। সমরবাবু বাচ্চা টিকে জিজ্ঞেস করেন - ও কি উড়ে গেছে না তুমি উড়িয়ে দিয়েছো? ছেলেটি নিশ্চুপ হয়ে আছে দেখে উনি ওকে পাশের ঘরে নিয়ে গিয়ে জানতে চান, তুমি এ কাজ কেন করলে? ছেলেটি বলে, ওর তো খাঁচায় খুব কষ্ট
হতো! এই উত্তর শুনে সমরবাবু ওর মা বাবাকে এসে জানান, আপনাদের ক্ষতিপূরণ তো দিতে হবেই না, বরং এতোদিনে আমার এই প্রজেক্ট সফল হলো। ছোটদের মধ্যে পশু পাখিদের সম্পর্কে ভালোবাসা জাগিয়ে তুলতেই তো এই লাইব্রেরী চালু করা!
এইরকম মানসিকতার একজন প্রাকৃতিক মানুষ যখন এই দুনিয়ার খাঁচা ছেড়ে উড়ে যান তখন কষ্ট হয় বৈকি!
ডঃ সমর বাগচী বিজ্ঞান জনপ্রিয় করার বিষয়ে যত পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন তার বেশির ভাগ তিনি শুরু করেছিলেন মিউজিয়ামে থাকাকালিন।১৯৬২ সালে তিনি যোগ দেন, ১৯৮৪ সালে অধিকর্তা হন এবং ১৯৯১ সালে অবসর গ্রহণ করেন সেখান থেকে ।অবসর  নেবার পর তাঁর কর্মকাণ্ড তীব্র গতি নেয়।বিজ্ঞান কে পড়ুয়াদের মধ্যে জনপ্রিয় করার জন্য রাজ্য জুড়ে বিজ্ঞান মডেল প্রতিযোগিতা, অগুনতি সেমিনার ও বিজ্ঞান মেলায় তিনি সক্রিয় অংশ নিতেন।সারা রাজ্যের বিভিন্ন গ্রামে গঞ্জে তিনি ছুটে বেরিয়েছেন।হাতে কলমে  বিজ্ঞান নিয়ে ছাত্র  ছাত্রীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে গেছেন। দূরদর্শনে কোয়েস্ট বলে অভিনব বিজ্ঞান প্রশিক্ষণ তিনি সুত্রপাত করেন ।তাঁর অনুরাগীরা এখনো এই প্রকল্প গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করেন।  একবার তাঁর সঙ্গে হঠাৎ দেখা শান্তিনিকেতনের অদূরে খঞ্জনপুর গ্রামে যেটা কোড়া বলে আদিবাসীদের গ্রাম। তাদের সঙ্গে কাজ করতেন রাহুল নামে এক উৎসাহী যুবক এবং তাঁর ইংরেজ স্ত্রী কার্স্টি । এখন এই কোড়ারা প্রায় সাঁওতালদের মত একই ভাষায় কথা বলে। উভয় সম্প্রদায় পরস্পরের সঙ্গে প্রায় একই ভাষায় কথা বলে। সাঁওতালদের কাছাকাছি আরও অনেক ভাষা গোষ্ঠী আছে যেমন হো ,বীরহড়, মুন্ডা ইত্যাদি। এই সাদৃশ্যের বিষয়ে তিনি অপার আগ্রহ নিয়ে শুনছিলেন ।রাহুল কার্ষর্টি দম্পতি ডঃ বাগচীর পরামর্শে স্থানীয়দের সাহায্যে অনেক পাঠ্য বই প্রকাশ করতেন।নিজেদের ভাষায় পাঠদান ও করা হত। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য মৈত্রেয়ী দেবীর প্রতিষ্ঠিত সাঁওতাল মেয়েদের নিয়ে শিক্ষা সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠান খেলাঘর, কলকাতার অদূরে বাদুতে, এর কথা মনে পড়ে গেল। সেখান ডঃ বাগচী  ছিলেন প্রধান উপদেস্টা।কি অপূর্ব দক্ষতায় তারা রবীন্দ্রনাথের কবিতা, নাচ,গান, নাটক তারা পরিবেশন করে। যখন তাদের ভাষা নিয়ে কেন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয় না বলা হয়েছিল, মনে আছে ডঃ বাগচী গভীর মনোযোগের সঙ্গে বিতর্কটি নিয়ে ভেবেছিলেন।পরে প্রতিবেদক কে জানান। আগ্রহী পাঠক ইউটিউবে তাঁর অনেক হাতে কলমে কঠিন বিজ্ঞান শিক্ষার  দেখতে পাবেন। অনেক লেখক বিখ্যাত কিছু গানের স্তবক সামনে রেখে তাঁকে স্মরণ করেছেন।২৩ জুলাই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগেও মানব জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন,আশঙ্কিত ছিলেন মূর্খদের রাজত্ব নিয়ে।আরেকটা উল্লেখ করতে ভুলে গেছি।কলকাতা দূরদর্শনে তিনি নিয়মিত একটা প্রোগ্রাম করতেন কোয়েষ্ট নামে।পরে সেইসব আলোচনা তিন খন্ডে বই আকারে বেরোয় ।আকর গ্রন্থের মত। গাছপালা বনাঞ্চল,সবুজের আচ্ছাদন ধংস হতে দেখলে তিনি পাগলের মত হয়ে উঠতেন ।

তিনি ছাত্র জীবনে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সাথে ছিলেন।জীবনভোর মার্ক্সবাদ ও গান্ধিবাদে আস্থা ছিল।আমার আক্ষেপ ছিল আম্বেদকর নিয়ে তাঁকে উৎসাহিত করতে পারি নি।তিনি পদার্থবিজ্ঞানী বরিস হেসেনের বই বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। সাহিত্য ও সঙ্গীতেও সমান দখল ছিল।একেবারে রনেইসান্স  মানুষের মত।ধ্রুপদী গান ও যন্ত্রসঙ্গীতের আসর বসাতেন চারু মার্কেটের পুরনো বাড়িতে।ক্যান্সার ধরা পড়েছে ২০১৮ সালে কিন্তু দৌড়াদৌড়ি থামে নি। রাধানগর,শান্তিপুর,ব্রহ্মপুর কোথায় তিনি নেই?

এবার দর্শনে আসা যাক। মার্ক্স, রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধী ছিল তাঁর বিচরণ ভূমি। ফলে তিনি প্রগতি শিবিরেই ছিলেন। মানবাধিকারের পক্ষেই সবসময় কথা বলেছেন।নর্মদা আন্দোলন থেকেই তিনি তাঁর অনেক প্রেরণার সঞ্চার পেয়েছেন। ফলে সমাজ কর্মী  মেধা পাটকর এবং তাঁর সাথীরা  ছিলেন তাঁর ন্যাচারাল মিত্র। বাংলার এনএপিএম এর তিনি উপদেষ্টা ছিলেন।  এখানেও সংগঠন যথেষ্ট মজবুত ছিল মূলত তাদের মত মানুষেরা।ভবিষ্যতের ইতিহাস তাঁকে শুধু অপবিজ্ঞানের আবহে গণবিজ্ঞানের চেতনাবসেরাএকনিবেদিত প্রাণ মানুষ বলেই মনে রাখবে তাই নয়। তিনি একটা যুগের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তাঁর মধ্যে এক পথসেনাকে আমরা খুঁজে পাই যিনি জীবনের কর্মচাঞ্চল্যে বলিয়ান হয়ে আমাদের হাল না ছেড়ে কণ্ঠ ছাড়তে শিখিয়েছেন।তিনি বাংলার মাঠঘাট, পথ প্রান্তরে এক অশান্ত যুবকের মত পদচারণা করেই চলবেন তাঁর  জীবন ও কাজ চর্চার মধ্য দিয়ে।আপনার ভাঙ্গা পাঁজরে যত দুঃখ জমে আছে তার নিরাময় করবে আগামী সময়।আগামী প্রজন্ম।

0 Comments

Post Comment