গত লোকসভা নির্বাচনের ফল বেরোনোর পর থেকে গুলশনকে ফোন করলেই আমি বুঝতে পারছিলাম একটা তীব্র হতাশা-বোধ রিসিভার এন্ড চুঁইয়ে আমার কাছ অবধি এসে পড়ছে।গুলশন যাকে বলে কিনা হাড়ে-মজ্জায় কোলকাত্তাইয়া।যেমন সে নাটককে ভালবাসে, তেমনি শহর কলকাতাকে সে জড়িয়ে-জাপ্টে ভালবাসে।আমি আবার উল্টো।মফস্বলে বড় হওয়া এই আমি বহুদিন শিকড় ছেঁড়া। বৃহত্তর কলকাতাতে থাকলেও তার সঙ্গে আমার অন্তরের যোগ নেই। কোলকাতা শহর আজও আমার কাছে বেশ দূরের। এই শহর আমাকে প্রায়শই ক্লান্ত করে। কিন্তু এর বিচিত্রতা একই সঙ্গে আমাকে অবাক করে। এ শহর আমার কাছে অনেকটা উমদা জিবেগজার মতো।পরতের পর পরত – আর প্রতিটি পরতে জীবন রস টই-টুম্বুর করছে। কলকাতা আমার কাছে একা ধারে বিরক্তি ও বিস্ময়। তবুও আমি আর গুলশন মনে করতাম এই শহর বিপরীত স্রোতে চলে। এর পাগলামি আর জিভে প্রেম একে ব্যতিক্রমী করে রেখেছে। বুঝতাম না আসলে আমরা দু-জনেই মুর্খের স্বর্গে বাস করছিলাম।আমাদের চোখের সামনেই শহরটা প্রাণপণে বদলাচ্ছিল। ঠিকঠাক ভাবে নিজেকে বিশ্বায়ন ও জাতীয়তাবাদের ককটেলের গগন-বিদারী চিৎকারে সামিল করে নিতে গিয়ে, শহর তার মানবিক মুখটাকে গাঁইয়া ভেবে কুলোর বাতাস দিয়ে বিদায় করছিল। বাইরে আমেরিকান আর অন্তরে ভক্ত হয়ে উঠতে গিয়ে, এ শহরটা তার চারণ পরিসরকে সংকীর্ণ করে তুলছিল ধীরে ধীরে।
অবিশ্যি আমি- এই মফস্বলি জানতাম এ শহরের খরগোশের চরিত্র। নারসিসিস্ট এই শহরের পুরো ভাগবাসীরা জানেনা ‘কত ধানে কত হয় চাল’! বাম জমানায় এরাই অস্বস্তিকর প্রশ্নকে কার্পেটের তলায় চালান করে দিয়ে নিজেদের মনে করত প্রগতিবাদী এবং সবজান্তা।আর এখন ভক্তির ঝ্যাঁটা দিয়ে কার্পেটের আরও ভেতরে প্রশ্নগুলিকে ঢুকিয়ে দিয়ে চোখ-কান বুজিয়ে বলে চলেছেন- ওদিকে ভয়ানক জুজু আছে। সেই জুজুকে কতটা হিংস্র অত্যাচার করে কী করে বঙ্গোপসাগর বা আরবসাগরের হুইপারে পাঠানো যায়, তার বিষদ বয়ান দিচ্ছে সোশাল মিডিয়ায় বা বঁধুয়াদের আড্ডায়। তা এমন পরিবর্তনের সময়ে, গুলশনের বন্ধু-তালিকাটি ভয়ানক ভাবে ছোট হয়ে আসছিল আর আমার-ও। আর যারা ছিল তারা গো-মাংসভক্ষণের সঙ্গে আম্বানি-আদানির বিত্তের সম্পর্ক সমানুপাতিক না ব্যস্তানুপাতিক -এই চিন্তায়ও আলোচনায় জিওর ডাটা প্রায় ডাঁটা চিবোনোর মতো ছিবড়ে করে দিচ্ছিল। গুলশন আর আমি কলকাতায় বসে ভাবছিলাম হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক, হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি।ইতিহাস, সাহিত্য, দর্শন ইত্যাদির কূটকাচালি থেকে খুঁজে বার করতে চাইছিলাম ভিত্তি-প্রস্তরেরজমি।
ঠিক এমন সময় আমার সঙ্গে বীরভূমের এক ছোট্ট বাজারে দেখা হল ফুলমণি বাউরির।ফুলমণি পিসির আঁচলের ফাঁক দিয়ে আমাকে অবাক চোখে দেখছিল তাঁর বারো বছরের নাতনি।ঠাকুমা- নাতনিতে মিলে এসেছেন হাটে বাজার করতে।দিন-মজুরি করে সংসার চলে তাঁদের।একশো দিনের কাজ নেই, বৃষ্টি পিছিয়ে গেছে বলে ধান পোঁতার কাজেও মন্দা।আর জমিও তো নেই নিজেদের। বাজারের ব্যাগটা দেখিয়ে বললেন দুশোটাকাতে ও ব্যাগ ভরলনা ।মশলার দোকানে যেতে যেতে বলে গেলেন, কী খাবব লতে পার? সব জায়গাতেই টাকার খেলা। গরিবের কথা কেউ ভাবেনা গো। বলে চলে গেলেন আরেকটা দোকানে। পেছনে পেছনে তাঁর নাতনি। এমনিতেও তার উজ্জ্বল ভবিসষ্যত নিয়ে ভাবার সময় কলকাতার কোনদিন ছিল না। তার ভবিতব্য বাবু বাড়িতে খাটার। নয়তো দিন-মজুরি তো আছেই। আর যদি সে তার মেধা দিয়ে ডিম-মাছ-দুধ খাওয়া বাবুদের ছেলেমেয়েকে চিতপটাং করতে পারে, তবেই মিডিয়া তার ইন্টারভিউ নেবে। অতএব, উন্নতি, হিন্দু-মুসলমান, চন্দ্রযানে ভারতের সাফল্য, ফুলমণি বাউরির বাড়ির রাস্তায় ঢোকেনা।তার চুলোতে সত্যি হয় খাবার, খিদে, রোজগার আর মাসে তিন হাজারে সংসার চালানোর অর্থনৈতিক ভাবে দক্ষ মস্তিষ্ক।তার কাছে জমি নেই, দেশি বীজ নেই, পূর্ব-পুরুষদের চাষের জ্ঞান নেই, সেচের জল নেই, শিক্ষা বা স্বাস্থের সুবিধা নেই, কাজের সুরক্ষা নেই, নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা বা ক্ষমতা নেই। তার জন্য যা উন্নতি-কল্প নেওয়া হয়, তাতে তার কোনো ভূমিকা থাকে না। বর্ণ-শ্রেণি দ্বারা বিভাজিত ভারতবর্ষে কোনকালে তার মানুষের অধিকার ছিল ও না।
আবার আমি আর গুলশন বসি।এবার পাশাপাশি নয়, মুখোমুখি। গুলশন আজকাল আবার ভালোবাসার কথা বলছে। তবে তার ভালবাসার মধ্যে আজকাল শাক-ভাতের গন্ধ পাই আমি। ফুলমণি বাঊরির চুলা আমাদের কাছে এখন সম্প্রীতির প্রতীক। কারণ সেটি খিদের কথা বলে- যা জাত দেখে না, ধর্ম দেখে না।যাকে মিটিং-মিছিল করে বোঝাতে হয়না, ডাটা- কার্ডও লাগে না।।