পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

নরেন্দ্র মোদির বেলুড় মঠ সফর

  • 12 January, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 3179 view(s)
  • লিখেছেন : উত্তম মিত্র
একদা স্বামী আত্মস্থানন্দ মোদিকে বলেছিলেন, তুমি রামকৃষ্ণ মিশনের যোগ্য নও, দেশের অন্য কাজ করো। রামকৃষ্ণ মিশন প্রকৃত দেশসেবা করে। মোদি মঠের উপযুক্ত নন। এখন মোদি দেশের শাসক হয়ে রামকৃষ্ণ মিশনের যোগ্য হয়ে উঠলেন। তাঁর জন্য গর্বিত মঠের সম্পাদক। হিন্দুত্ব ও রামকৃষ্ণ মিশনের বিবর্তন নিয়ে লিখলেন উত্তম মিত্র


কলকাতা এলেন মোদি। জনরোষের ভয়ে উড়ে গেলেন রেস কোর্স। তার পর সড়ক পথ ত্যাগ করে জলপথে গেলেন বেলুড় মঠ। মমতার সঙ্গে সমঝোতা সম্পন্ন করে রাতে থাকলেন বেলুড় মঠে বিদেশিদের জন্য বরাদ্দ অতিথিশালায়। সকালে স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিনে আদ্যন্ত ‘রাজনৈতিক’ বক্তৃতা করলেন মঠচত্বরে। রাজনৈতিক বললে ভুল হবে। ঘৃণার চাষ করলেন রামকৃষ্ণ মিশনের উর্বর জমিতে। মিশনের সাধারণ সম্পাদক স্বামী সুবীরানন্দ বললেন, মোদিজি রামকৃষ্ণ মিশনের প্রডাক্ট। নরেন্দ্রভাই দামোদর দেশের অন্যতম সেরা প্রধানমন্ত্রী। মোদির জন্য মিশন গর্বিত।

যত মত তত পথের কথা বাদ দিন। ঠাকুরকে তো বহুকাল আগেই বিসর্জন দিয়েছেন। মনে করুন, নিবেদিতা স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেওয়ায়, প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে সংস্রব থাকার অভিযোগে মঠ তঁর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। সেও কি ব্রিটিশ প্রভুদের ভয়ে বা তাদের খুশি করার উদ্দেশ্যে ছিল? নাকি সত্যিই রাজনীতি পছন্দ করেন না আপনারা?

কী পছন্দ করেন তবে? মোদির মুসলমানবিদ্বেষ? মোদির দাঙ্গাপ্রীতি? মোদির কোন কাজের জন্য মিশন গর্বিত? কালা ধন ফেরত দেওয়ার জন্য, নাকি নোটবন্দি করে গরিব মানুষদের নাজেহাল করার জন্য? নাকি দেশের জিডিপি হ্রাস করার জন্য, না বেকারত্বকে রেকর্ড জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য?

মহাত্মা গান্ধী ১৯০১ সালের ২৭ ডিসেম্বর কলকাতা এসেছিলেন। বেলুড় মঠে গিয়েছিলেন। স্বামীজি দেখা করেননি। এক গুরুভাইকে দিয়ে বলে পাঠান, উনি কলকাতার বাড়িতে আছেন, দেখা করতে সক্ষম নন। ভুলে গেলেন সে সব কথা? সারা দেশ জুড়ে মোদির বিভেদনীতির জন্য গণআন্দোলন চলছে, সেই মোদিকে বিভেদের চাষ করার জন্য ছেড়ে দিলেন মিশনের জমি?

এর পূর্বে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও নিয়ে আপনাদের অনেক আদিখ্যেতা ছিল। সে সব কথাও আমরা কেউ ভুলে যাইনি।

‘সিএএ’ নামক একটি অসাংবিধানিক আইন নিয়ে মোদি মঠ থেকে ঘৃণার প্রচার চালালেন। সেই আইন আমরা পড়েছি। মোদির চেয়ে বেশি পড়াশুনা জানা লোক, কম পড়াশুনা করা লোকজনেরা পড়ে দেখেছেন, কীভাবে সেখানে তামিল হিন্দু, তিব্বতি বৌদ্ধ, পাকিস্তানি ইহুদিদের বাদ দেওয়া হয়েছে। এবং ঘৃণার প্রধান বর্শামুখ হল মুসলমান। মোদি মঠে বলে গেলেন, সিএএ নাকি কেউ বুঝতে পারছে না; এটি নাগরিকত্ব দেওয়ার আইন, কেড়ে নেওয়ার নয়। আমরা তো সকলে নাগরিক। নতুন করে নাগরিকত্ব দেবেন কী করে? এনআরসি হলে সব মানুষকে প্রথমে বে-নাগরিক ঘোষণা করে ছাঁকনির মধ্য দিয়ে নতুন নাগরিকত্ব দেওয়া হবে বলেছেন এনআরআইসি-তে। কে দেবে সেই নাগরিকত্ব? প্রধানমন্ত্রী? তিনিও তো তখন বে-নাগরিক। বে-নাগরিক কি করে দেশের মানুষকে নাগরিকত্ব দেবে? সিএএ, এনপিআর, এনআরসি শুধু মুসলমানবিরোধী নয়, গরিব মানুষ বিরোধী, শিশু-নারী-তৃতীয় লিঙ্গের মানুষও হবেন বেশি ক্ষতিগ্রস্থ। কোটি কোটি লোককে নাকি দেশ থেকে বের করে দেবেন, এই হুমকি রোজ দিচ্ছে শাসক দলের নেতারা। হিন্দু ধর্ম আত্তীকরণের ধর্ম, তা কি ভুলে গেলেন?

হে মহারাজধীরাজ সুবীরানন্দ, বিবেকানন্দের হিন্দুত্বের উপাসক হয়ে সাভারকরের হিন্দুত্বকে বরণ করে নিলেন আপনারা? সাভারকর প্রচার করেছিলেন, ভারত কেবলমাত্র হিন্দুদের দেশ। গোলওয়ালকর হয়ে মোদি—সেই হিন্দুত্বের দীর্ঘ যাত্রাপথে তাই এল সিএএ, এনআরসি। একের পর এক আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছেন ভারতীয় দলিত ও মুসলমানেরা।

হে বেলুড় মঠের কাণ্ডারী, আপনি বিভেদকামী হিন্দুত্বের পোস্টার বয় মোদির জন্য গর্বিত হলেন? আপনার পূর্বসুরিদের আরাধ্য বিবেকানন্দ ঘোষণা করেছিলেন, “যে ধর্ম জগতকে পরমতসহিষ্ণুতা ও সর্ববিধ মত স্বীকার করার শিক্ষা দিয়ে আসছে, আমি সেই ধর্মভুক্ত বলে নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করি।” মোদি ও তার দল যে অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে, সে কি আপনি জানেন না? মোদি ২০০২ সালে গুজরাতে যে গণহত্যা সংঘটিত করেছিলেন, তাতে অটলবিহারীও সামান্য লজ্জা পেয়েছিলেন।

হে সুবীরানন্দ মহারাজ, স্বামীজির সান ফ্রান্সিসকো বে এরিয়াতে দেওয়া দেওয়া “মোহম্মদ” শীর্ষক বক্তৃতা কি রচনাবলি থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছেন? নাকি সরফরাজ হোসেনকে লেখা বিবেকানন্দের চিঠির উপরেও কলম চালাচ্ছেন? বলা তো যায় না! কারণ আমরা জেনেছি, ভারতের অনেক প্রদেশে আপনাদের বইয়ে ঠাকুর রামকৃষ্ণের মাছ মাংস খাওয়ার ব্যাপারটি বাদ দিয়েছেন আপনারা। আপনারা ঠিক কোন পথে হাঁটছেন তা বিলক্ষণ বুঝতে পারছেন সাধারণ মানুষ।

রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দকে মানুষ চেনে সমন্বয়ের প্রতীক হিসাবে। মোদিকে চেনে বিভাজনের কারিগর রূপে। যে বিভাজনের রাজনীতি করেন নরেন্দ্র মোদি, সেই বিভাজনের খেলা মঠের ময়দানে খেলে গেলেন তিনি। আপনারা হাততালি দিলেন। বললেন, মোদির জন্য আপনারা গর্বিত। তাহলে বলুন, স্বামীজির জন্য আপনারা লজ্জিত। ঠাকুর, মা সর্বধর্মের যে সাধনা করে গেছেন তার জন্য আপনারা ক্ষমাপ্রার্থী করুন। আপনারা রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের ভক্তদের আড়াআড়ি বিভাজন করে দিলেন। দেশ পুড়লে যে দেবালয় রক্ষা পায় না, তা আমরা দেখলাম।

স্বামীজির জন্মদিনে প্রধানমন্ত্রী যে শ্রদ্ধা জানালেন তাও হৃদয়ে রেখে দিন। বিবেকানন্দের পবিত্র আবির্ভাব দিবসে কলকাতা বন্দরের নাম হল শ্যামাপ্রসাদের নামে। ঘৃণার পুরনো চাষী। কেন স্বামীজির নামে রাখা যেত না? কে শ্যামাপ্রসাদ হরিদাস? স্বামীজির জন্মদিনে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানানোটা কি বিবেকানন্দকে হেয় করা নয়?

রামকৃষ্ণের পবিত্র জন্মতিথিতে দেখবেন মোদি এসে আর কে মিশন পালটে এস কে (সাভারকর) মিশন করে দিয়েছে। যার হিন্দুত্বে আপনারা সম্প্রতি শিফট করলেন।

0 Comments

Post Comment