সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ লিখেছেন ষাট একষট্টি সালের আগেই আলকাপ হারিয়ে গেছে। সুতরাং আলকাপ সম্পর্কে তথ্যাদি জানতে আমার বাবার(সৈয়দ আনোয়ার আলম) সাহায্য নিয়েছি। উনি আলকাপ দেখেছেন। আলকাপের মানুষজনদের অত্যন্ত কাছ থেকে দেখেছেন ।
এছাড়া সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ‘মায়ামৃদঙ্গ’ উপন্যাসটির সাহায্য নিয়েছি।
আলকাপ দর্শকদের মাঝে হত, কোন স্টেজ ছিল না। একটা ছোট্ট বিষয় থাকত। সেটিকেই লতিয়ে লতিয়ে ব্যাখা করে দুই তিন ঘন্টা ধরে চলত। লিখিত ডায়ালগ ছিল না। থাকত তাৎক্ষনিক সংলাপ। সেই মুহূর্তে বানানো।
দর্শকরা অনেক সময় ইনভলভড হয়ে যেত। তাদের মধ্যে থেকে একজন উঠে আসত। সেও তখন একজন অভিনেতা। অসাধারণ স্বাধীনতা। সকলে মিলে অভিনয় শুরু হত।
আসলে শুরুটাতেই তো স্বাধীনতার বীজ লুকোন রয়েছে। কেউ পাপেট নয় এখানে।মূল সুর অক্ষুন্ন রেখে তাৎক্ষনিক সংলাপ সৃষ্টি করে অপরূপ গল্পের ভিতর ঢুকে যাওয়া। এটাও একটা ‘বিরল মায়া’।
ছেলেদের মেয়ে তৈরি করা হত। একেবারে তেরো বছর বয়স থেকেই শুরু হত এই তৈরি করা।তাদের নমনীয় করে তোলা হত। বিকৃতির ভয়ে তাদের খাটতে দেওয়া হতনা । ‘চলনে বলনে শয়নে স্বপনে তুমি নারী’। সেই ছোকরা যখন আসরে নামত তখন তাকে দেখে বিভ্রম জাগত। মনে হত সে একজন ‘কিন্নরী’।
আলকাপ আসলে সম্পূর্ণ অন্য জগৎ। এক মায়াময় জগৎ। যে মায়া ফুরোতে চায় না।
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ সাত বছর এই মায়াময় জগতে ছিলেন।
সিরাজকে আলকাপে যোগদান দেওয়ার জন্য মুর্শিদাবাদ জেলা গণনাট্যের প্রতিষ্ঠাতা সুধীন সেন অনুরোধ করেছিলেন। তিনিও আলকাপে গান গেয়েছেন, অনুষ্ঠান করেছেন। সুধীন সেন বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন মানুষ ছিলেন।
আলকাপ ষাট দশকের একেবারের গোড়ার দিকে ‘বিরল মায়া’ হয়ে গেছে। বাস্তবে যেটা রয়েছে সেটা আসলে পঞ্চরস। আসলে ‘নাচিয়ে ছোকরার’ বদলে মেয়েদের আলকাপে ঢোকানো হয়েছিল, কিন্তু মেয়েরা ওস্তাদ-কথিত বিরল মায়া ফোটাতে ব্যর্থ হয়। ওখানেই আলকাপের পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটে।
এখন যেটা আপনারা দেখেন সেটা আসলে পঞ্চরস। যা সম্পূর্ণ আলকাপের বিপরীত।
আলকাপের সঙ্গে মিথ হয়ে গেছেন ধনঞ্জয় মণ্ডল বা ওস্তাদ ঝাঁকসু। তিনি আলকাপকে অন্য মাত্রা দিয়েছিলেন।ঝাঁকসু সাধু ভাষায় ছন্দ মিলিয়ে কথা বলতেন। আধুনিক ঢঙে একটা দার্শনিক ছোঁয়া দিয়েছিলেন। জীবন একটা মায়া এমন একটা ভাবধারা আলকাপে এনেছিলেন।
সিরাজ তাঁকে ‘মায়ামৃদঙ্গ’ উপন্যাসে বিশিষ্টতা দান করেছেন ।
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ আলকাপে আধুনিকতা এনেছিলেন। ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’-এর নাট্যরূপ দিয়েছিলেন। নাটকের মাঝে মাঝে আবহ সঙ্গীত থাকত। গানের মাঝে মাঝে সুর যাকে ইন্টারলিউড বলে।বিচিত্র সুরের সমাহারে পরিবেশ সৃষ্টি করতেন।
একটা গান হতে হতে ইন্টারলিউডে এসে বিলম্বিত লয়ে পনের বা কুড়ি মিনিট ধরে সুরের তালে নাচটা হত।তারপরে যখন মূল গানে ফিরে আসা হল, তখন সেই গানটা ধরে নিয়ে দোহার্কিরা উচ্চস্বরে খোল তবলা সহযোগে মূল গানটা দ্রুত তালে গাইত।
এটাই হচ্ছে আলকাপের গল্প...