কবি জীবনানন্দ “সুচেতনা”র রূপকল্পে দূরের দ্বীপকে দেখেছিলেন। দ্বীপ থেকে সুদূরে “বিকেলের নক্ষত্রের” মতো আমাদের জীবন। “রণ-রক্ত-সফলতা” নিয়ে আমাদের সমাজ। সফলতায় সেরা “কল্লোলিনী তিলোত্তমা” কলকাতা, কিংবা বেঙ্গালুরু, অথবা তিরুবনন্তপুরম। সেখান থেকে দূরে প্রশান্তির শামিয়ানার নীচে দ্বীপ-যাপন একদল মানুষের। দ্বীপপুঞ্জের নাম লাক্ষাদ্বীপ।
লাক্ষাদ্বীপ সাগরে মালাবার উপকূলে ভারতের কেন্দ্রশাশিত অঞ্চল লাক্ষাদ্বীপ। প্রাকৃতিক রূপ-ঐশর্য্যের ভূমি এই প্রবাল দ্বীপপুঞ্জ। সেই আকর্ষণে ভ্রমণ-পিপাসু মানুষের যাতায়াত এখানে। লাক্ষাদ্বীপ সম্পর্কে এর বেশি বিশেষ কিছু আমরা অনেকেই জানি না। জানলেও বোধহয় আমাদের অভ্যাসের দৃষ্টিতে দ্বীপবাসীদের ঠিক বুঝতে পারি না। তবু জানা যাক। বোঝাবুঝি যা-ই হোক, জানা ভীষণ দরকার। লাক্ষাদ্বীপ এখন বর্গিহানার শিকার। লাক্ষাদ্বীপবাসী সাহায্যপ্রার্থী। এদের পাশে দাঁড়ানো জরুরি।
নির্ঝঞ্ঝাট এই প্রবাল দ্বীপপুঞ্জে নিরবচ্ছিন্নভাবে নিরাপদ ছিল চৌষট্টি সহস্রাধিক মানুষের জীবনযাত্রা। ইকো-ফ্রেণ্ডলি লাইফ ট্যুর যেন। আদিম পরম্পরা নয়, আধুনিক জীবনপ্রণালিতে এরা সম্পৃক্ত। সাক্ষরতায় ৮৭.৫২ শতাংশ-- ভারতে স্থান তৃতীয়। সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ, কৃষি ও পশুপালনকে প্রধান জীবিকা করে দ্বীপপুঞ্জের বাসিন্দাদের দিন গুজরান ভালোই চলছিল। মদ্যপান কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত ছিল। খাদ্যে-পানীয়ে মিলে সুস্বাস্থ্যের নিশ্চয়তায় এরা নিশ্চিন্ত ছিল। এখানে অপরাধের খতিয়ান আজও নগণ্য; দেশের মধ্যে অগ্রগণ্য। সুস্বাস্থ্য ও সু-অভ্যাস সুচিন্তার ধাত্রী। সেরকমই এক সুকুমার সাংস্কৃতিক জীবনধারা রপ্ত করে নিয়েছে এরা।
লাক্ষাদ্বীপে বিধানসভা নেই। জনপ্রতিনিধিত্ব বলতে একজন এমপি নির্বাচিত হন ও পঞ্চায়েত ব্যবস্থা আছে। কেন্দ্র সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীনে প্রশাসনের মাথায় থাকেন একজন প্রশাসক, যিনি যথারীতি একজন সিনিয়র আইএএস বা আইপিএস অফিসার। কিন্তু ২০২০’র ডিসেম্বরে মোদি সরকার এই রীতি ভেঙে এখানে আপাদমস্তক রাজনীতির রঙ চড়ানো প্রফুল খোডা প্যাটেলকে প্রশাসক বানিয়েছে। তিনি মোদি-ঘনিষ্ঠ ও আরএসএস’এর স্বয়ংসেবকও বটে। ফলাফল যা হ’বার হচ্ছে। আগাগোড়া একনায়কতান্ত্রিক ও সাম্প্রদায়িক শত্রুভাবাপন্ন কার্যকলাপ শুরু করেছেন তিনি।
লাক্ষাদ্বীপে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মৎস্য আহরণ, কৃষি ও পশুপালন বিভাগের ক্ষমতা ন্যস্ত পঞ্চায়েতগুলির এক্তিয়ারে। সেখানে খসড়া পঞ্চায়েত বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে, যাতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মৎস্য আহরণ ও পশুপালন বিভাগের সমস্ত ক্ষমতা প্রশাসকের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। এই বিজ্ঞপ্তিতে আরও আছে যে, দুইয়ের অধিক সন্তানের পিতা-মাতারা পঞ্চায়েতের প্রতিনিধি হতে পারবেন না। এমন তুঘলকি হুকুমজারি দেশে আর কোথাও দেখা যায়নি। অনেক জায়গায় মৎস্যজীবিদের ব্যবহৃত শেড ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে। বহু চুক্তিভিত্তিক ও অস্থায়ী সরকারি কর্মীকে ছাঁটাই করা হয়েছে। মদ্যপানের ওপর বিধিনিষেধ রদ করা হয়েছে। অথচ এখানে ৯৬.৫৮ শতাংশ মানুষ ধর্মবিশ্বাসে মুসলমান, যাদের ধর্মীয় নৈতিকতায় মদ্যপান নিষিদ্ধ। এত মুসলমানের বাস সত্ত্বেও গোমাংস খাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
এখানকার শিক্ষার পরিবেশকে সঙ্কুচিত করতে একগুচ্ছ পদক্ষেপ নিয়েছেন প্রফুল প্যাটেল। অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র ও স্কুলে সমস্ত রকম আমিষ খাবার দেওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যা অমানবিক ও সারা দেশে নজিরবিহীন। ৩৮টি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। স্কুলের শারীরশিক্ষার শিক্ষকদের ও মিড ডে মিল কর্মীদের বসিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এখানকার মানুষ সমাজ-জীবনে রপ্ত করেছে সামাজিক নৈতিকতা ও সুবিন্যস্ত জীবনশৈলীকে। প্রশাসনিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের সুযোগে মানবসম্পদের বিকাশ ও বৈষয়িক প্রয়োজনকে সমাজ-জীবনে মিলিয়ে নিয়েছে। এখন প্রফুল প্যাটেল ঔদ্ধত্যের সঙ্গে সাধারণ মানুষের হাতে থাকা প্রশাসনিক ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়ে মানুষের যৌথ প্রজ্ঞাকে সঙ্কুচিত করা ও সম্প্রদায়গত অস্থিরতা সৃষ্টি করেএখানকার সাংস্কৃতিক জীবনধারাকে বিপর্যস্ত করার তৎপরতা শুরু করেছেন।
প্রফুল প্যাটেলের দূরবীনে কর্পোরেট হাঙরদের শ্যেন দৃষ্টি পড়েছে এই প্রবাল দ্বীপের সারিতে। এখানে ‘লাক্ষাদ্বীপ ডেভেলপমেন্ট অথরিটি রেজলিউশন, ২০২১’ (LDAR)’এর খসড়া আনা হয়েছে । LDAR’এর ক্ষমতায় লাক্ষাদ্বীপ ডেভেলপমেন্ট অথরিটি নগরায়ণ বা অন্য যেকোনো উন্নয়নের নামে বিনা নোটিশে, বিনা কৈফিয়তে ও বিনা ক্ষতিপূরণে যথেচ্ছভাবে সাধারণ মানুষের জমি হস্তগত করতে পারবে। জমি অধিগ্রহণের দৃষ্টান্তে পরিষ্কার, এইসব জমির সিংহভাগই চলে যাবে কর্পোরেট কোম্পানিগুলির হাতে। লাক্ষাদ্বীপে ট্যুরিজমের আধুনিকায়নে এই ব্যবসায় প্রচুর সম্ভাবনা। এই সুযোগে যথেচ্ছ ট্যুরিজম ব্যবসা জমে উঠবে। কর্পোরেট মুনাফার খেয়ালে ভোগ-বিলাসে মাতানো, অপার্থিব দৃশ্যপটে সাজানো ট্যুরিজমের ক্লেদে ও কর্পোরেট-বিলাসী বাণিজ্যের ক্লেশে সমগ্র দ্বীপপুঞ্জের জৈব বৈচিত্র্য ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ও পার্থিব সৌন্দর্য নি:শেষ হয়ে যাবে। কালক্রমে দ্বীপপুঞ্জের প্রাকৃতিক ভারসাম্য ধ্বংস হয়ে যাবে।
এহেন কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ হবেই। প্রতিবাদ দমন করার অব্যর্থ অস্ত্র হিসেবে এই বছরের জানুয়ারিতে ‘প্রিভেনশন অফ অ্যান্টি-সোশ্যাল অ্যাক্টিভিটিজ অ্যাক্ট, ২০২১’ (PASA) আনা হয়েছে। PASA’তে পুলিশ প্রশাসন যে কাউকে ইচ্ছেমতো গ্রেফতার করে এক বছর পর্যন্ত আটক রাখতে পারবে। এই এক বছর গ্রেফতারি সংক্রান্ত কোনো তথ্য গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তির পরিবার বা অন্য আউকে জানানো হবে না ও তার পক্ষে কোনো আইনি সুরক্ষার ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না।
দমন-পীড়নের প্রশ্নে আরও এক আশঙ্কার বিষয় হল, এবছর মার্চ মাসের প্রথম দিকে সমুদ্র-পথে একটি বড় ধরনের ড্রাগ ও অস্ত্র স্মাগলিংয়ের ঘটনায় লাক্ষাদ্বীপের নাম জড়ানো হয়েছিল। ভারতের কোস্ট গার্ড ও প্রফুল প্যাটেল প্রশাসন দাবি করেছিল, স্মাগলিংয়ে যুক্ত তিনটি বোট লাক্ষাদ্বীপ থেকে কেরল যাচ্ছিল। পরে ফাঁস হয়ে যায় যে, বোট তিনটি পাকিস্তান হয়ে শ্রীলঙ্কা যাচ্ছিল। বোট তিনটি ধরাও পড়েছিল লাক্ষাদ্বীপ থেকে ৪০০ নটিক্যাল মাইল (প্রায় ৭৪১ কিমি) দূরে। এ নিয়ে শুধু সরকারি কর্মকর্তারা নয়, আরএসএস’এর মুখপত্র আর্গানাইজারও মাঠে নেমেছে। মুখপত্রে এই মিথ্যাচারে বাতাস দেওয়ার পাশাপাশি ২০১৯’এ শ্রীলঙ্কা থেকে লাক্ষাদ্বীপে ১৫ জন আইসিস জঙ্গি ঢুকেছিল বলে দাবি তোলা হয়েছে, যার কোনো সরকারি বা বেসরকারি প্রমাণ নেই। আশঙ্কা হয়, এই রকম স্মাগলিংয়ের বিষয়কে কখনে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের অভিযোগে ঘুরিয়ে দেওয়া হতে পারে।
লাক্ষাদ্বীপে প্রফুল প্যাটেলের এইসব কর্মকাণ্ডের পিছনে প্রবল এক যৌথ উৎসাহ আছে। তা হল হিন্দুত্বের নাফা ও কর্পোরেটের মুনাফা। হিন্দুত্বের কর্পোরেটকে লাগে অর্থবল-বাহুবলের ধান্দায় ও ‘সবকা বিকাশ’এর মতো ধাঁধায়। কর্পোরেটের হিন্দুত্ববাদী হওয়া লাগে না। কর্পোরেট মুনাফার স্বার্থে হিন্দুত্বের মদতদাতা । এই দ্বৈত স্বার্থ প্রখরভাবে ছায়াপাত করেছে লাক্ষাদ্বীপে।
নিশ্চয় এখানকার প্রকৃতি ও মানুষের ওতপ্রোত সম্পর্কে নিহিত আছে লড়বার তাগিদ। কিন্তু হানাদাররা ঝাঁপিয়েছে সর্বতোভাবে। ইতিমধ্যে সরকারের পলিসি ও পদক্ষেপের প্রতিবাদ করায় ৩০০ জন সরকারি কর্মীকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। আরও অনেক প্রতিবাদীকে নানাভাবে শাস্তির মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। লাক্ষাদ্বীপবাসীর অসম লড়াইয়ে আরও আরও মানুষের মদত চাই।
মানুষের আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নের ভিতর আর এক স্বপ্ন থাকে-- অস্ফুট অথবা অবচেতনে।
“এ বাতাস কী পরম সূর্যকরোজ্জ্বল !
প্রায় ততদূর ভালো মানব সমাজ”-
এর স্বপ্ন। সেদিন কতদিনে আসবে জানা নেই। এই সকল দ্বীপবাসীদের জানলে-বুঝলে সেই দিনের আভাস একটা মেলে। এদের সূর্যস্নান, প্রকৃতির কোলে মাথা রেখে প্রশান্তির যাপনের মধ্যে এরা বাঁচলে কাঙ্ক্ষিত মানব সমাজের সুপ্ত স্বপ্নের বেঁচে থাকার অর্থ থাকে।