শঙ্খদীপ ভট্টাচার্যের লিখিত ‘অযান্ত্রিকের কড়চাঃ কৃত্রিম বৃত্তে মানুষের আজ ও আগামী’ পড়তে গিয়ে প্রথমেই মনে হয়েছে, কৃত্রিম বুদ্ধি কি? এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা অনুযায়ী, কৃত্রিম বুদ্ধি হল কম্পিউটার চালিত রোবটের সেই ক্ষমতা যার দ্বারা সেই সব কাজগুলো করা যায় যা সাধারণ ভাবে বুদ্ধিমান প্রাণীর দ্বারাই সম্ভব। এই বিজ্ঞানের অন্যতম জনক জন ম্যাকার্থি ১৯৫৫ সালে বলেছিলেন, ‘যন্ত্রকে দিয়ে যদি এমন কাজ করান যায় যা মানুষের সদৃশ মনে হয়, তবে তাকে বুদ্ধিমত্তা বলা যেতে পারে।’ কিন্তু মানুষের বুদ্ধির সংজ্ঞা কী বা কীভাবে তা মাপা যাবে? লেখক শঙ্খদীপ বুদ্ধি কী তা নিয়ে আলোচনা করছেন, প্রশ্ন করছেন, বুদ্ধির সারবস্তু আসলে কী, বুদ্ধির উদ্দেশ্য কী? তিনি বুদ্ধির সামাজিক চরিত্রর ওপর জোর দিচ্ছেন। তিনি লিখছেনঃ ‘মানুষের বুদ্ধি সহজাত স্বতন্ত্র কোনও বৈশিষ্ট্য নয়। সমাজ এবং সামাজিক সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন করে মানুষের বুদ্ধিকে বুঝতে চাওয়া একেবারেই ভুল দৃষ্টিভঙ্গি।’ এই বুদ্ধি যখন যন্ত্রে প্রতিস্থাপন করা হয় তখন তা কৃত্তিম বুদ্ধি হয়ে দাঁড়ায়।
এই কৃত্রিমবুদ্ধি নিয়ে মহা শোরগোল। অনেকে বলছেন যে কোনও নতুন প্রযুক্তি এলেই সেটা নিয়ে গেল গেল রব ওঠে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অন্য যে কোনও প্রযুক্তি নয়। এটা অতীতের প্রযুক্তি থেকে গুণগত ভাবে আলাদা। লেখক প্রথমেই ফাদার অফ কম্পিউটিং সায়েন্স অ্যালেন টিউরিং ১৯৪৭ সালে যা বলেছিলেন তা আমাদের স্মরণ করাচ্ছেনঃ ‘আমরা চাই এমন একটা যন্ত্র যা অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে পারে।’ এই কথাই কিন্তু আজকে সমাজবিজ্ঞানী য়ুভাল নোয়া হারারি বলছেন। তাঁর কথায়, এ আই মানব সভ্যতার অপারেটিং সিস্টেম হাইজ্যাক করে নিয়েছে। আমরা যোগাযোগ করি ভাষার মাধ্যমে, ভাষা হল সভ্যতার প্রাণভোমরা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রাকৃতিক ভাষা বুঝতে পারছে, সে নিজেকে নিজে উন্নত করতে পারে। তাই লেখক বলছেন, ‘কৃত্রিম বুদ্ধির কাজ ভাষাকে ঘিরেই, ভাষাকে আরও গভীরে বোঝার মধ্যে দিয়েই।’
‘অযান্ত্রিকের কড়চা’ একটি গল্প, এগারোটি অধ্যায়ের মধ্যে দিয়ে লেখক কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার কাহিনীটা বলেছেন। মনে প্রশ্ন জাগে এই ধরণের একটা প্রযুক্তির প্রয়োজন হল কেন। হঠাৎ করে তো এটার আবির্ভাব হয়নি! মার্গারেট থ্যাচারের অর্থনীতি যা ‘থাচ্যারিজম’ নামে কুখ্যাত সেটার মূল মন্ত্র ছিল, সমাজকল্যাণে রাষ্ট্রের কোনও দায় থাকবে না। বাজারই শেষ কথা, সরকার বাজারের কথা মেনে চলবে। আমরা জানি পুঁজিবাদের উদ্দেশ্য হল যেভাবে হোক মুনাফা বাড়াও। অতি অল্প সময়ে বিপুল পরিমাণ নির্দেশ মেনে চলা এটাই হল কম্পিউটারের মূল দক্ষতা। দেখা গেছে মানুষ যদি ২৪ ঘণ্টা লাগাতার কাজ করে এবং প্রতি দশ সেকেন্ডে একটি নির্দেশ পালন করে তাহলেও সেক্ষেত্রে একটা কাজ পুরো শেষ করতে তার লেগে যাবে পুরো ৩৭০০ বছর, কম্পিউটারের ক্ষেত্রে যেটা লাগবে মাত্র এক সেকেন্ড! অভাবনীয়! কম্পিউটার প্রযুক্তির ফলে এই সময় রাশি রাশি ডেটা, ইন্টারনেট থেকে পাওয়া তথ্য, এসে জড়ো হয়। অতি দ্রুত এই ডেটার বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন হয়ে পড়ে, কারণ বিশ্বের কোন প্রান্তে মানুষের কোন ধরণের পণ্য প্রয়োজন তা তাঁদের বহুবিচিত্র পোস্টগুলি কাটাছেঁড়া করলেই শুধুমাত্র বোঝা যাবে। এটা মানুষের কম্মো নয়! এই বিশেষ দ্বন্দের অবশ্যম্ভাবী সমাধান হিসাবেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আবির্ভাব।
১৯৯৪য়ে আমেরিকায় ইন্টারনেট ব্যক্তিগত মালিকানার হাতে চলে গেল। ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউবের আবির্ভাব হল। অতিকায় টেকনো কোম্পানিগুলির উদ্ভব শুরু হল, এই নতুন শিল্পে GAFAM এর রাজ শুরু হল। GAFAM অর্থে, গুগল, অ্যাপেল, ফেসবুক, অ্যামাজন, মাইক্রোসফট। লেখক একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমাদের জানাচ্ছেন। ২০০৫ থেকে ২০১৮র মধ্যে GAFAM কংগ্রেসের পিছনে ৫০০০ কোটি টাকা খরচ করেছে শুধুমাত্র এটা নিশ্চিত করতে যাতে রাষ্ট্র তাদের কাজকর্মে নাক না গলায়। ভারতও পিছিয়ে রইলো না। রাতারাতি ঝাঁ চকচকে আইটি কোম্পানি গজিয়ে উঠল। মধ্যবিত্ত সমাজ পুঁজিবাদের এই মনোমোহিনী রূপে রীতিমত মজে গেল।
কম্পিউটিং এবং মেশিন লার্নিংয়ের অভুতপূর্ব উন্নতির ফলে প্রযুক্তির আরও একটি উল্লম্ফন হল, ওপেন-এ-আই কোম্পানির চ্যাটজিপিটি বাজারে এল এবং অবিশ্বাস্য ভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠল। মাত্র পাঁচ দিনে এটির ইউজার সংখ্যা হয় ১০ লক্ষ, দু মাসে যা হয়ে দাঁড়ায় ১০ কোটি। ফেসবুক, টিকটক এত দ্রুত এত জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি। চ্যাটজিপিটি গুগলের সার্চ ইঞ্জিনের চেয়ে বহু বহু গুণ উন্নত। বিশ্বের সেরা সব পরীক্ষায় ৭২% নম্বর পেয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছে। এটা মুহূর্তের মধ্যে নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে, যেমন কমিউনিজম কি মানুষের জন্য ভালো, জলবায়ুর সংকট কী ভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে মোকাবিলা করা যায় ইত্যাদি। লেখক এখানে চ্যাটজিপিটির ভাষা জ্ঞান সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার জন্য যন্ত্রের উত্তর ইংরাজিতেই রেখেছেন, অনুবাদ করার চেষ্টা করেননি। যদি চ্যাটজিপিটিকে বলা হয় তোমার উত্তর ঠিকঠাক নয়, তাহলে সে বিনীত ভাবে ক্ষমা চাইবে এবং বলবে আমার উত্তর কখনোই সম্পূর্ণ ঠিক নয়, আমাকে সেপ্টেম্বর, ২০২১ অবধি তৈরি করা হয়েছে।
চ্যাটজিপিটি কি নিরপেক্ষ, এর কি শ্রেণী সচেতনা আছে? যন্ত্র স্বীকার করে তার চেতনা বা ব্যক্তিগত বিশ্বাস নেই, আমি শুধু কৃত্রিম বুদ্ধির ভাষার মডেল। তথ্য প্রদান করা ও বিভিন্ন কাজে সাহায্য করার জন্য আমাকে ডিজাইন করা হয়েছে, সে জানায়। যন্ত্র দাবী করে সে রাজনৈতিক ভাবে নিরপেক্ষ, বলে তার প্রতিক্রিয়াগুলি অবজেক্টিভ ও নিরপেক্ষ। অথচ সে কিন্তু মনে করে পুঁজিবাদ সহিংস বা অনৈতিক নয়, কম্যুনিজমে মানবাধিকার লংঘন হয়েছে। চীন বা রাশিয়ার লেবার ক্যাম্পের উল্লেখ করে। বোঝাই যায় চ্যাটজিপিটি তার প্রভুদের শিখিয়ে দেওয়া বুলি আওরায়। মার্ক্সের সময় কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা ছিল না, কিন্তু টেলিগ্রাফ সিস্টেমকে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করে তিনি প্রযুক্তির অগ্রগতি আঁচ করতে পেরেছিলেন। গ্রুনড্রিস্সে অধ্যয়ন করে শঙ্খদীপ মেশিন সম্পর্কে মার্ক্সের মতামতের আভাস দিয়েছেন। তিনি লিখছেন, ‘মার্ক্স কল্পনা করেছিলেন, সামাজিকভাবে উৎপাদিত তথ্য মেশিনে আস্তে আস্তে অঙ্গীভূত হয়ে উঠছে। তিনি আরও কল্পনা করেছিলেন, এখান থেকে এক নতুন গতিশীল উৎপাদন ব্যবস্থার জন্ম নেয় যা মূল্য ও মুনাফা তৈরির সেকেলে ব্যবস্থাটাকে নাকচ করে।’
এই প্রযুক্তির দোষ গুণ নিয়ে লেখক বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করেছেন। তিনি সতর্ক করেছেন এই প্রযুক্তি নিয়ে উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই, আতঙ্কিত হওয়ারও কিছু নেই। রোবট সেটা যত নিখুঁতই হোক, সেটা রোবটই, চেতনা, আবেগহীন একটা যন্ত্র। বিশ্ব টার্মিনেটারে ভরে যাবে এরকম আশঙ্কা করার কিছু নেই। যন্ত্রদানব সে মানুষের ক্রীতদাস মাত্র। সবার ওপরে মানুষ সত্য……..