পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

অ্যাকট্রেস

  • 20 February, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 1267 view(s)
  • লিখেছেন : শ্যামলী আচার্য
নাম বলুন আপনার। নাম? আমার নাম অর্চনা। অর্চনা মণ্ডল। আপনার বাড়ি কি এখানেই? মানে এই বীরভূমেই? না না। আমার বাড়ি অন্য জায়গায়। এখেনে তো আছি... এই বছর ছয়-সাত হল। আপনি তো বহুদিন যুক্ত রয়েছেন অভিনয়ের সঙ্গে... এই কাজ সম্পর্কে বলুন না দু’চার কথা... আপনার অভিজ্ঞতা... আমাদের শ্রোতারা শুনবেন।

অর্চনা একটু চুপ করে রইলেন। তাঁর মুখের সামনে একটা বড় ঢাউস টেপরেকর্ডার। কালো। তার মধ্যে ঘরঘর করে ক্যাসেটের ফিতে ঘুরে চলেছে। সামনে বসা দুজন ব্যাটাছেলে। অল্পবয়স। কলকাতা থেকে এসেছে। রেডিওর জন্য কীসব টেপ করে নিয়ে যাবে। মেয়েদের কথা। মেয়েদের জীবনযুদ্ধ। গত দুদিন ধরে বীরভূম শহরে এসে রয়েছে। রতন মান্নার কাছেও ওরা গিয়েছিল। রতন ড্রেসার। বোলপুর বাজারের কাছে ওর গুঁড়ো মশলার দোকান। ভেতরে আরেকটা খুপরি ঘর। নাটকে যাত্রায় ড্রেস ভাড়া দেয়। রতনই অর্চনার ঠিকানা দিয়েছে।

আজ ওরা এসেছে অর্চনার ইন্টারভিউ নিতে।

  • কথা তো অনেক। কোত্থিকে শুরু করি বলো দিকি...
  • আগে বলুন, এই পেশায় আপনি এলেন কেন? আপনি কি ছেলেবেলা থেকেই অভিনয়ে?

অর্চনা জানতেন, এই প্রশ্নটা দিয়েই কথা শুরু হবে। তাই হয়। এই দু’হাজার সালের দোরগোড়ায় পঞ্চাশ আর ষাটের ঠিক মাঝখানে যে বয়সে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন, সেই বয়সে পিছন ফিরে তাকিয়ে অনেক কিছু তিনি স্পষ্ট দেখতে পান। দেখা যায়। সামনের দিকেও অনেকটা রাস্তা পরিষ্কার। নতুন শতাব্দী আসছে। অর্চনার কাছে কোনও বাঁক আর কোথাও অপেক্ষা করে নেই। সব সোজাসাপটা।

  • সাধ করে তো এই পেশায় আসিনি বাবা। এমন নয় যে অ্যাক্টিং করতে ভালোবাসতাম। বুঝতামই না। যদি ভালোবাসা বলো, তবে তা’ তৈরি হয়েছে অ্যাক্টো করতে করতে। স্টেজের আলো, রঙ, নতুন মানুষের সঙ্গে আলাপ পরিচয়, সামনে কত লোক হাঁ করে বসে দেকচে আমায়, আমার হাসি-কান্না, রাগ শোক সবকিছু মিলিয়েই তো আমি। কখন আসল আমিটাকে ভুলে গিয়েচিলাম... এখন তো এই যেমন দেকচ আমাকে।
  • আমাদের দেখা নয়, আপনার চোখ দিয়েই দেখব আজ আমরা। সেই সময় যখন আপনি প্রথম এলেন অভিনয় করতে... তখনকার কথা একটু বলুন।

এরা আজ নাছোড়বান্দা। সকাল থেকেই এসে বসে পড়েছে। নেহাত আজ অর্চনার একাদশী। যাহোক দু’চারটে খই-বাতাসা খেয়ে কাটিয়ে দেবেন। রান্নাবান্নার বালাই নেই। অবশ্য অন্যদিনও সেই পাট তেমন থাকে না তাঁর। এখন তো ঝাড়া হাত-পা জীবন। কোনওরকমে বয়ে নিয়ে যাওয়া। তবে আজ ওরা সকাল সকাল না এলে একটু সেলাই নিয়ে বসতেন। কাঁথাকাজের কয়েকটা অর্ডার আছে। সেগুলো করে ফেলতে হবে। রেডিওর লোকগুলো হুট করে এসেই সব গোলমাল করে দিল। রতনদার কথা ফেলাও যায় না। শত হলেও সে এখন বিপদের বন্ধু।

  • বাড়ি আমার বসিরহাটে। বাড়ি মানে তো বাপ-ভায়ের বাড়ি। মেয়েমানুষের আবার বাড়ি কীসের? পাড়াগাঁ। সেই গাঁয়ের নামটা নাই বা বললাম। বহুদিন আগেই সেই বাড়ির সঙ্গে আমার সব সম্পর্ক চুকেবুকে গ্যাচে। আমাদের ছিল অভাবের সংসার। ওই যেমন হয়। আমার ওপরে দুই দিদি, আমার পরে দুটো ছোট ভাই। এই পাঁচ ছেলেপুলের ঘর। বাপ-ঠাকুর্দার জমিজিরেতের গল্প শুনেছিলুম। অল্পস্বল্প যতটুকুনি মনে পড়ে। সেসব ঘরবাড়ি খেত পুকুর জমিজমা সবই ছিল নাকি ওপার বাংলায়। কবে কে কোদ্দিয়ে এসচে, আজ আর মনে নেই তেমন। কিচুই যে তারা তেমন সঙ্গে করে আনতে পারেনি, সেটুকু বেশ মনে পড়ে। ঠাকমার মুখে হা-হুতাশ শুনেছি। টেনেটুনে চলত। মা সেলাইফোঁড়াই জানত। আমরাও শিকেপড়ে নিয়েছিলুম। লেকাপড়া হয়নি তেমন। কিন্তু টানা মুকস্ত কইতে পারতাম সব। যেখানে যা শুনেচি, মনে থেকে যেত। পালাকার অনিল মুহুরীর নাম শুনেচ তোমরা? তিনি রোজ বলতেন, অর্চনার পম্পটার লাগে না। একবার শুনলেই কণ্ঠস্থ। পম্পটার জানো তো? ওই যে অ্যাক্টোর সময় পেছন দিক থেকে ধরিয়ে দেয়। আমার ওসব লাগেনি কোনওকালে। ছেলেবেলায় বেস্পতবারের লক্ষ্মীর পাঁচালী, ঠাকমার যত ব্রতকথা, রামায়ণ-মহাভারতের গল্প, গীতাপাঠ, গাঁয়ের বামুন পঞ্চুকাকা যজমানদের ঘরে ঘরে মন্তর পড়ে পুজো করত, সেই মন্তর অবদি একবার শুনলেই মনে গেঁথে যেত আমার...

সেই আধো মফঃস্বল আধো গ্রামের মজা পুকুরের ধার ঘেঁষে শুষনি কলমি আর গিমা শাক। দুধ মানকচুর ঝাড়। অবরেসবরে কলমির ঝোল, কচুর শাক বা গিমাশাকের বড়া করত অর্চনার মা। অর্চনা তখনও অর্চনা হয়ে ওঠেনি। সে তখনও উদ্বাস্তু চাটুজ্যেবাড়ির মেয়ে ফুলি। এখনও পঞ্চাশ বছরের ওপার থেকে ফুলির মায়ের রান্না ঝোলের পাঁচফোড়ন আর মরিচপোড়ার সুবাস নাকে এসে লাগে। ওই ঝোলের মধ্যে টুকটুকে হলুদ একটুকরো কুমড়ো, একফালি নরম বেগুনের সঙ্গে নুয়ে পড়া লাউশাক কিংবা নটের কচি ডাঁটাতে নিরাপত্তা জড়িয়ে ছিল। সন্ধের ঝুপসি আঁধারে কারখানার কাজ সেরে ঘরে ফেরা হা-ক্লান্ত বাপের গলায় ভাটিয়ালির উজান গাঙের ঢেউয়ের ডাক শুনলে চোখ জড়িয়ে আসত ঘুমে। কুপির আলোয় তখন ফুলির ছোট ভাইটা দুলে দুলে মুখস্থ করে চলেছে, আমাদের ছোট নদী চলে আঁকে বাঁকে... ফুলির আজও মনে আছে পুরো কবিতা। ওটা রবি ঠাকুরের লেখা। এই বীরভূমেই নাকি তিনি ছিলেন অনেকদিন।

  • আসলে জানো তো, আমাদের গাঁয়ের নিতাইমামা যাত্রাদলে পার্ট করত। নানারকম পার্ট। সন্নিসি, ভবঘুরে, পাগল, বিবেকের চরিত্র... এগুলোতেই ওর নাম ছিল বেশি। গলা ছেড়ে গাইতে পারত যে! যাত্রাদলের সঙ্গেই চলে যেত দূরের গাঁয়ে। খুব গুমোর ছিল লোকটার। সকলের সঙ্গে মিশত না। আমার মা’কে ‘বুইন’ বলে ডাকত। আমিও সেই সূত্রে মামা বলতাম। আমায় কেমন যেন আপন করে নিল। কেন, তা’ বলতে পারি না। মাঝেমধ্যে একলা মানুষটার দাওয়ায় গিয়ে বসতাম। টুকটাক আনাজ কুটে দেওয়া। হাতে হাতে কাজ এগিয়ে দেওয়া... মানা করত। আবার চুপচাপ মেনেও নিত। ওর কাছেই প্রথম শুনি যাত্রাদলের গল্প। কত সাজপোশাক থাকত ওর কাছে। ওগুলো ওর নিজের। সাজতে জানত। ভুরু আঁকা, কাজল পরা, ঠোঁট রাঙানো সব ওর কাচেই শিকেচি। মেকআপের বাসকো দেখি সেই প্রথম...

একটা বড়সড় টিনের তোরঙ্গ ছিল নিতাইয়ের। সেই তোরঙ্গের অল্প কিছু জামাকাপড় বের করে উঠোনে ভাদ্রমাসের রোদ খাওয়াত নিতাই সরকার। সন্ন্যাসীর গেরুয়া, ভবঘুরের ছেঁড়া পোশাক, আলখাল্লা, তাপ্পি দেওয়া জোব্বা—এইরকম কিছু নিজস্ব পোশাক। একটা কুরুশবোনা কাপড়ের ঝোলায় অনেক ছোটবড় মেডেল। ফুলির কাছে সে এক বিস্ময়। কয়েকটা নাকি সোনার। সোনা না সোনার জল, তা’ বুঝতে অনেক দিন লেগে গিয়েছে। নিতাই পালাগান গাইতে যাবার সময় ওই তোরঙ্গর চাবি থাকত ফুলির মায়ের জিম্মায়। মাস তিন-চার পরে পরে ফিরত নিতাইমামা। বলত, এবার সিজিনে পালা বেশ জমসিল। ফুলি রে, অনেক বখশিস পাইসি। তোরে অ্যাকখান ডুরে শাড়ি কিন্যা দিমু হনে। লাল পাড়। ভারি মানাইবো তরে।

  • সিজিন বুঝো তো বাবা? সিজিন হল...

অর্চনা মন্ডলের কথা শেষ হওয়ার আগেই রেকর্ডার হাতে ধরা কালো গুঁফো ছেলেটা বলে ওঠে, হ্যাঁ দিদি, সিজন জানি। আপনি বরং কেমন করে অভিনয়ে যুক্ত হলেন, সেই গল্পটা যদি বলেন আমাদের... এই নিতাইবাবু কি আপনার প্রথম ট্রেনার, আই মীন, গুরু?

ক্যাসেটের ফিতে অনন্ত নয়। তার একটা নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্য রয়েছে। আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে ‘ওবি’ করতে আসা দুই নব্য যুবক একটা এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউ থেকে কালারফুল স্টোরি চায়। খামোখা নস্ট্যালজিয়ার ফুটেজ তাদের প্রয়োজন নেই।

ফুলির অবিশ্বাস্য স্মরণক্ষমতা। গানের গলাটি অবশ্য চলনসই। চেহারাটি চটকদার নয় একেবারেই। কিন্তু রঙ মেখে তো কত খেঁদিবুঁচিকে পরী বানিয়ে দেওয়া যায়। কম তো দেখেননি নিতাই। ভদ্রঘরের মেয়েরা এই লাইনে নামে না। ছেলেরাই আসে। রঙ মেখে মেয়ে সাজে। কলকাতায় মেয়েরা নামছে ঠিকই। তারা পড়ালেখা জানা মেয়ে। সেইসব পালাকে গুরুপ থিয়েটার বলে। তাদের নাটক ভদ্দরলোকেদের জন্য। গাঁঘরের মা-বোনেরা সেসব দেখে না। ওতে মনও ভরে না। ওই শতচ্ছিন্ন প্যাণ্ডেলের চট, নানান চেঁচামেচি, মুখোমুখি শয়ে শয়ে মানুষ। আর পরপর তিনবার ঝ্যাং করে ঘণ্টা পড়লেই সব চুপ। ওই তো আসল টান।

নিতাই সরকার ফুলির কথায় বাঙালভাষার টান কাটাতেন। নিজে সে দেশের ভাষা অনর্গল বললেও ফুলির উচ্চারণ শুধরে দিতেন। মনের মধ্যে কেমন যেন একটা আশার বীজ, তিরতির করে বয়ে চলা মরানদীর গোড়ালি ভেজানো জল... ফুলি নিশ্চই একদিন নামকরা অ্যাকট্রেস হবে! গাঁগঞ্জের নানান ক্ষুদ্রতা, মিথ্যাচার। অপবাদ আর লোকনিন্দা তো আছেই। পাড়াতুতো ভাগ্নীর প্রতি তাঁর বাড়তি পক্ষপাতে স্নেহ ছাড়া আর কোনও মশলার আভাস যেন না পাওয়া যায়, তা নিয়েও সচেতন থাকতেন নিতাই সরকার। সেইসঙ্গে চলত তাঁর ট্রেনিং।

  • মুখের মধ্যে সুপারি পুরে দিয়ে কথা কওয়াত নিতাই মামা। উচ্চারণ শেকাত। জিভের জড়তা কাটাত। তা’ও কি সব শিকেচি, না শিকতে পেরেচি?

আনমনা হয়ে গেলে বা আসল কথা ছেড়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলে তাকে ট্র্যাকে ফিরিয়ে আনা ইন্টারভিউয়ের সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ। গুঁফো ছেলেটা ঘ্যাঁচ করে রেকর্ডার বন্ধ করে। পরে এডিটিং করতে গেলে বেশি কাটতে হবে না।

  • দিদি, আপনার প্রথম অভিনয় কবে?
  • প্রথম যখন স্টেজে উঠি, তখন আমার বয়স ষোলো। মনসামঙ্গল পালায় চাঁদ বণিকের এক ছেলের বউ সাজলাম। সেই বউয়ের বিয়ে হয়, আবার সে বেধবাও হয়ে দাঁড়ায়। একই সঙ্গে নতুন কনেবউ আর বেধবার সাজ। একবার ব্যানারসি আর এক গা গয়না পরে সে্জেগুজে এলাম। আবার পরের সিনেই সাদা থান। তেমন ডায়ালগ ছিল না। বেধবা হয়ে কেবল বাবা বলে আছড়ে পড়ে কাঁদতে হবে... ওই ডুকরে ওঠা কান্না শিকিয়েছিল নিতাইমামা। বলত, সব দুঃখ জমায়ে রাখবি ফুলি। খিদার জ্বালা, কাঠপিঁপড়ার কামড়, পায়ের তলায় আচমকা বাবলাকাঁটা ফোটার ব্যথা, বৃষ্টির জলে ভিজা কাঁথায় শুইয়া রাত কাটানোর যন্ত্রণা... বলতে বলতে ফিসফিস করে বলেছিল, মাসিকের দিনগুলার কথাও মনে আনবি ফুলি। জেবনের সব কষ্ট, সব যন্ত্রণা একটা ছোট্ট বোতলে আঁচলে বাঁধা থাকে য্যান। মোক্ষম সময়ে উপুড় কইর‍্যা ফ্যালাইবি। চোখের জল য্যান আপনি আসে। পাবলিক য্যান বুঝে, তুই হাসতে হাসতে কান্দতে জানোস। ...

কথা বলতে বলতে শিরদাঁড়া সোজা করে বসেন অর্চনা। তার ঘরের এক কিনারে ছিটে বেড়ার ধার ঘেঁষে পুঁইডাঁটা উঠে বসেছে। কঞ্চিবাঁশের মাচায় তার বাড়বাড়ন্ত এখনও তেমন জমে ওঠেনি। এক ফালি রোদ এসে চুমু খায় কচি ডগায়। ছোট্ট দুর্গা টুনটুনি দোল খেয়ে উড়ে যায় ব্যস্ত হয়ে। তার সংসারের হাজারো ব্যস্ততা। অর্চনার মতো পিছন ফিরে জীবন দেখার সময় নেই তার।

  • আপনার উল্লেখযোগ্য অভিনয়ের কিছু স্মৃতি যদি বলেন আমাদের।
  • শুরু থেকেই পৌরাণিক পালাতে আমায় কাজ দিত সকলে। মনসামঙ্গল, সতীর দেহত্যাগ, দক্ষযজ্ঞ, সীতাহরণ, নল-দময়ন্তী, খনা, গান্ধারীর অভিশাপ, সাবিত্রী-সত্যবান... প্রথম প্রথম সাইড রোল। পরে এক্কেবারে লীড রোল। হিরোইন।
  • নিতাইবাবুই আপনাকে গাইড করতেন?
  • হ্যাঁ। নিতাইমামার হাত ধরে এক-আধটা দলে গিয়েচি তখন। শুরুতে সেই ছিল গার্জেন। মায়ের থেকে চেয়ে নিয়েছিল আমায়। বলেছিল, ভাগ্নীরে নিলাম বুইন। সেরা অ্যাকট্রেস হবে একদিন। সক্কলে অবাক হবে। মা রাজি হয়নি। মনে আছে। বাপ ছিল ভোলাভালা। সে’ও ছিল নিমরাজি। কিন্তু অভাবের সংসার। এতগুলান পেট। খাব কী? দুটো পয়সা রোজগারের জন্যিই তো... গায়ের রঙ বলো আর রূপই বলো, সে তো তেমন দ্যাকার মতো ছিল না। কিন্তু নিতাইমামা কী যে দেকেচিল... খুব বলত, তুইই পারবি ফুলি। কেন বলত, বুঝিনি তখন। পরে বুঝেচি, মুকস্ত। ওই একনাগাড়ে রোল মুকস্ত বলে দিতাম প্রথম রিহার্সালে। রিহার্সাল ছাড়াও কতবার নেমে গিয়েচি। গোপালবাবু বরাবর খুঁজতেন, হিরোইন কে করছে? অর্চনা?
  • গোপালবাবু কে?

গোধূলির রাঙা আলো ছাড়াই কখনও কখনও মুখে উজ্জ্বল কোমল আভা এসে পড়ে। এই পৃথিবীর রঙ নয়। মনের গহন থেকে ছলকে ওঠা রাগিণী। অর্চনার মুখের সেই লালচে লজ্জারুণ ছবির জন্য খুব বুঝদার না হলেও চলে। গোপন এবং প্রিয় সম্পর্কের এক্সক্লুসিভ বাঁকের খোঁজে মুখিয়ে থাকে দুই সাক্ষাতপ্রার্থী যুবক।

  • গোপালবাবুই আশ্রয় দিয়েছিলেন আমায়। নিতাইমামা অকালে চলে গেল। আঘাটায় পড়ার হাত থেকে বাঁচালেন ওই গোপালবাবু। ঘরে তোলেননি ঠিকই। কিন্তু ঘরওয়ালীর সম্মান দিয়েছেন। এই যে জায়গাজমি, মাথা গোঁজার কুঁড়ে... সবই ওনার টাকায়। তখন বুদ্ধি করে জমিয়ে রেকেচিলুম। তেমন জলে পড়িনি।
  • কিন্তু আপনি কাজ ছেড়ে দিলেন যে?
  • কাজ ছাড়লাম কোথায় বাবা? গাঁগঞ্জের যাত্রাপালায় কলকাতার নায়িকারা ভিড় করলে যে। সেই বোধহয় আটাত্তর সাল থেকে চুরানব্বই... ষোলো-সতেরো বছর একটানা কাজ করেচি। জন্মের সালতারিখ তো তেমন জানিনে বাবা, যখন কাজ কমতে শুরু করল তখন আমি সদ্য তিরিশের কোঠায়। অথচ সাইড রোল পাই। সে সাইড রোলে আমায় সকলেই ডাকে এখনও। ওই যে রতনদা তোমাদের পাটিয়েচে, ওই রতনদাই খবর দেয়। টুকটাক যাই। দুটো পয়সা তো শুধু নয়। ওই রঙ, আলো, পর্দা উটলে অত কালো কালো মাথা, হাততালি... সব টানে। লোকে তো আমাদের খোঁজে না। পয়সা খরচ করে রংমাখা অর্চনার কান্না আর কে শুনবে? যতই যাত্রালক্ষ্মী, যাত্রাসম্রাজ্ঞী খেতাব দাও, একে একে আমার মতো সকলের কপাল পুড়ল। আমি, কাকলি, তটিনী, নুপুর, স্বপ্না... সব একে একে বসে গেলাম। বায়না করতে এসে সবাই সিনেমার মুক চায়। আমরা ধীরে ধীরে সাইড রোলে।

খুব চিরাচরিত ছকে ইন্টারভিউ গড়াচ্ছে দেখে দুই যুবক আর উৎসাহিত হয় না। ওদের কলকাতায় ফেরার তাড়া, ট্রেন ধরতে হবে। ফিরে আবার এডিটিং। প্রোগ্রাম রেডি করে জমা দিতে হবে দপ্তরে। ওরা গুছিয়ে নিতে থাকে।

অর্চনা বোঝে ওর প্রয়োজন শেষ।

  • আর কিছু জিগ্যেস করলে না?
  • না দিদি, আজ এইটুকুই। আবার পরে আসব কখনও। আপনার প্রোগ্রাম কবে শোনানো হবে, আমরা জানিয়ে দেব। ওই রতনবাবুর নম্বর আছে আমাদের কাছে। ওনাকেই বলব, শুনবেন রেডিওতে। কেমন? আজ আসি তাহলে?
  • সেই সকাল থেকে এতক্ষণ কথা বলালে, পয়সা দিলে না? দাও না তোমরা? এতটা সময়... স্টেজে আমার এখনও এক পাতা টানা ডায়ালগে পঞ্চাশ টাকা রেট...

একটু অপ্রস্তুত হলেও ওরা হোমওয়ার্ক করেই এসেছিল। কাজ ফুরিয়ে যাওয়া বিহানবেলার নট-নটীরা অনেকেই এমন দাবি করেন। অন্যায্য কিছু নয়। তবুও, এই ওবি’র কাজের জন্য তেমন কোনও বাজেট ধরা থাকে না। এগুলো নতুন আসা ক্যাজুয়ালদের কাজের অভিজ্ঞতা বাড়ানোর জন্য দেওয়া। স্টুডিওতে অতিথি করে নিয়ে গেলে তবেই কনট্র্যাক্ট ফর্ম সই করে টাকাপয়সা দেওয়া হয়। আর অর্চনা ঠিক সেই মাপের জনপ্রিয় অভিনেত্রীও নন। মানে বক্স আর্টিস্ট বলতে যা বোঝায়।

  • দিদি, আসলে কি জানেন তো, এটা বলতে পারেন একটা রিহার্সাল। এটা রেডিওতে বাজলে, শ্রোতাদের ভাল লাগলে তবে তাঁরা চিঠি দেবেন আমাদের। সেই চিঠি বড়সাহেবরা দেখবেন। তারপর তাঁরা যখন বলবেন, আমরা আবার এসে আপনাকে গেস্ট করে নিয়ে যাব কলকাতার স্টুডিওতে। তখন আপনি গেস্ট আর্টিস্ট হিসেবে পেমেন্ট পাবেন। এখন তো... বুঝতেই পারছেন, আমরাও তো ক্যাজুয়াল। কন্ট্র্যাক্টে কাজ করছি।

অর্চনা চুপ করে তাকিয়ে থাকেন। ছেলেদুটি ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে। চোখের তারা, ভুরুর ভাঁজ, ঘাড় ঘোরানো, চোখের চাহনি, কপালের কুঞ্চন, গলার স্বরের সামান্য ওঠানামা দিয়ে অভিনয় শিখেছেন তিনি। নিতাই মামা বলত, ফুলি, সংসারে অভিনয় করে সবাই, দেখে বোঝে কজনা? আস্তিনের ভাঁজে কিছু নিজস্ব প্যাঁচপয়জার রাখতেই হয়। ওস্তাদের মার... সবই কি প্রথম দেখায় পাওয়া যায়? ফুলি বোঝে। দিনের পর দিন মাচায় উঠে তালিম নেওয়া অ্যাকট্রেস সে। জীবন দিয়ে অভিনয় শিখলে যে কোনও চরিত্র ফুটে ওঠে। তবু সেরা অভিনেত্রী হয়ে উঠতে গেলে আরও কিছু লাগে। আর একটু কিছু। অল্প বয়সে ভাবতেন, কপালের ফের। ভাগ্য। এখন বোঝেন, শুধু কপালের দোষ দিয়ে লাভ নেই। নিজেকে বিক্রি করতে জানাও একটা প্র্যাকটিস। একটা রিহার্সাল। নিখুঁত করে রপ্ত করতে হয়। ওরা তো আজ গল্প শুনতেই এসেছিল। বাড়তি কিছু রংচং দিয়ে একটা রগরগে গল্প ওদের দেওয়াই যেত। না-খেতে পাওয়া জীবনের বাইরে মানুষ বঞ্চনা অবহেলা আর নির্যাতনের রসদ খোঁজে। পাবলিক খাওয়ানোর উপকরণ। তেমন কিছু মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া গল্প তো নেই অর্চনার। রাতারাতি তৈরিও করতে পারেননি।

দিনের অনেকটা সময় ওদের দিয়ে দেওয়ার আগেই ক্ষতির অঙ্ক কষে নিয়েছিলেন। ওরা কিছু দিতে আসেনি, দেবার ভান করল শুধু। গল্প বানিয়ে বলার ভানটুকু তো কোনওদিন শেখেননি অর্চনা। তাই বোধহয় আজও প্রাপ্য সবটুকু পেলেন না।

0 Comments

Post Comment