প্রচার প্রোপাগাণ্ডা এমন একটি বিষয়, যা দিয়ে খুব সহজেই মানুষকে অনেক কিছু বোঝানো যায়। জার্মানিতে হিটলার যেমন এই বিষয়টা জানতেন আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীও এটা বোঝেন। তাই আধার, যা কোনও পরিচয়পত্র নয়, যা কোনোদিনও কোনও কার্ড নয়, তা নিয়ে ২০১৪ সাল থেকে এমন প্রচার করা হয়েছে, যে এখন আমরা প্রায় সকলেই বিশ্বাস করতে শুরু করেছি, আধারই আমাদের বাঁচার চাবিকাঠি।
বাঁচার চাবিকাঠি কি না, তা জানা না গেলেও, আধার যে শাসকদের হাতে নাগরিকদের মৃত্যুর অন্যতম একটি ওষুধ, তা অবশ্য দেশের বহু মানুষ ইদানিং বুঝতে পারছেন। নাজি জার্মানিতে এই রকমই একটি পরিচয়পত্র তৈরী করেছিল আইবিএম, যা দিয়ে তাঁরা ইহুদিদের চিহ্নিত করার বন্দোবস্ত করেছিল। তারপরে ইহুদিদের গণহত্যার কথা তো ইতিহাসে লেখা আছে। ভারতে আধার সেইরকমই একটি উপকরণ, যা দিয়ে সহজেই একজন নাগরিককে মেরে ফেলা যায়, তাঁর অস্তিত্ব মুছে ফেলে। এখন আর গণহত্যা করতে হবে না, এখন যে কোনও নাগরিককে বে নাগরিক করে দিয়ে তাঁর ‘সিভিল ডেথ’ করে দেওয়া সম্ভব।
কেন এই কথাগুলো বলতে হচ্ছে আবার? কারণ, আধার নিয়ে আবার সমস্যা শুরু হয়েছে। যেদিন থেকে আধার আনা হয়েছিল সেদিন থেকেই অবশ্য এই আধার মানুষের জীবনে আঁধার নামিয়ে এনেছে, কিন্তু এবারের সমস্যাটা অভিনব। যদিও খুব নতুন কিছু নয়, দেশের সর্বোচ্চ আদালতে শুনানির সময়ে এটা প্রমাণ করে দেওয়া হয়েছিল, যে বহু মানুষকে আধার দিয়ে চেনা সম্ভব হচ্ছে না বলে, সরকারি সুযোগ সুবিধা তাঁদের কাছে পৌছচ্ছে না, ফলে তাঁরা সরকারের চোখে ‘ভূতুরে’ বলে গণ্য হচ্ছেন। ২০০৯ সালে যখন আধার প্রকল্প এনেছিল কংগ্রেস, তখন তাঁদের যুক্তি ছিল, দেশের বহু মানুষের কোনও পরিচয়পত্র নেই, তাই তাঁদের জন্য দেশের সরকার একটা পরিচয়পত্র দিতে চায়। তখন হিসেব করে দেখা গিয়েছিল, দেশের ০.০৩ শতাংশ মানুষ এই আধার পাওয়ার যোগ্য। সেই সময়ে যিনি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তিনি আজকে দেশের প্রধানমন্ত্রী। সেই সময়ে, তিনি বলেছিলেন, কংগ্রেসের আনা এই আধার প্রকল্পতে তিনি সন্তুষ্ট নন। সেই সময়ে তাঁর করা একটি টুইট নিয়ে আজো চর্চা হয়। নরেন্দ্র মোদী বুঝতে পেরেছিলেন, এই আধার হচ্ছে এমন একটি হাতিয়ার, যা ব্যবহার করলে প্রশাসনিক শুধু সুবিধা হবে এমনটা নয়, ক্ষমতায় টিকে থাকাটাও অনেক অনায়াস হবে। এই আধারকে তিনি আইনে পরিণত করলেন। তারপরে আসতে থাকলো একের পর এক নিদান, আধারের সঙ্গে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, গ্যাসের ভর্তুকির জন্য গ্যাসের সঙ্গে আধার সংযোগ, রেশনের জন্য, ফোনের জন্য সংযোগ করতে হবে। মানুষকে বোঝানো হলো, আগের সরকার ঠিক মানুষের কাছে, সরকারি সুযোগ সুবিধা পৌঁছতে পারেনি, এই আধার দিয়ে সঠিক মানুষকে চিনে, তাঁর ব্যাঙ্কে সরকারি টাকা পৌঁছে দেবে। আঙুলের ছাপ, মুখের ছবি বা চোখের মণির ছবি তুলতে তখন বিভিন্ন আধার নিবন্ধিকরণ কেন্দ্রে মানুষের সারি পড়ে গেল। এই যে হাতের ছাপ, চোখের মণি বা মুখের ছবি তোলা হলো, সেটাকেই বায়োমেট্রিক্স বলে। এই বায়োমেট্রিক্স একটি কেন্দ্রীয় রিপোসিটারিতে সংরক্ষণ করা থাকে, পরে তার সঙ্গে একজন ব্যক্তির বায়োমেট্রিক্স মিলিয়ে দেখে চেনাকেই আধার দিয়ে চেনা বলে। এটি একটি পদ্ধতি, যা মিলতেও পারে আবার নাও মিলতে পারে। এখন এই অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে, একজন মানুষের অস্তিত্বের সঙ্গে আধার মিলে মিশে গেছে এমনভাবে যে জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি আধারের প্রয়োজনীয়তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছেন সবাই। বোরোলিন কোম্পানির একটি বিজ্ঞাপণ ছিল, জীবনের নানা ওঠা পড়া যেন গায়ে না লাগে, কিন্তু আধারের দৌলতে, জীবনের প্রতিটি চড়াই উৎরাই যথেষ্টই গায়ে মালুম হচ্ছে ইদানিং সবার।
যদি খেয়াল করা যায়, যখন সমস্ত ক্ষেত্রে আধার বাধ্যতামূলক হয়নি, তখন কিন্তু এই ধরনের আঙুলের ছাপ দিতে হতো না। রেশন থেকে জিনিষ তোলা, মোবাইলের সংযোগ বা অন্যান্য যে কোনও দৈনন্দিন প্রয়োজনে এইভাবে আঙুলের ছাপ চাওয়া হতো না। সেই সময়ে কি তবে জমি, বাড়ি কেনাবেচা হয়নি? নাকি মানুষজন রেশন থেকে চাল, ডাল, আটা তুলতেন না? নাকি ব্যাঙ্কের লেনদেন করতেন না? তখন তাহলে এই কাজগুলি সম্পন্ন হতো কী প্রক্রিয়ায়? নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখলেই দেখা যাবে এই প্রযুক্তি নির্ভরতা যত বেড়েছে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে, তত সাধারণ মানুষ অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছেন। যে মানুষটিকে আগের দিন অবধি ব্যাঙ্ক কিংবা রেশন দোকানের মালিক চিনতে পেরেছেন, যেদিন থেকে এই সমস্ত বিষয়ে আধারকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, সেদিন থেকে দেখা গেছে, ঐ গ্রাহককে আর চিনতে পারছে না প্রযুক্তি। আধার নম্বর এবং হাতের ছাপ বা চোখের মণি না মেলে, তাহলে সেই উপভোক্তা বা গ্রাহককে কি তাহলে বাতিলের খাতায় ফেলে দিতে হবে?
এখন অনেকে বলতে পারেন, আগের ব্যবস্থাপনায় প্রচুর দুর্নীতি হচ্ছিল, সেই দুর্নীতি কি বন্ধ করার প্রয়োজন ছিল না? অবশ্যই ছিল, কিন্তু সেই দুর্নীতি রুখতে গিয়ে এমন প্রযুক্তি আনা হলো, এবং দুর্নীতিকেই মান্যতা দিয়ে দেওয়া হলো, যে কোনও ব্যক্তি মানুষ, রেশনে তাঁর প্রাপ্য জিনিষ না পেয়ে, বা তাঁর নিজস্ব অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা চুরি হয়ে গেলেও, কোথাও অভিযোগ অবধি জানাতে পারবেন না। আজকে যে সমস্যাটা দেখা যাচ্ছে, সেটা ভয়ঙ্কর। হঠাৎ কিছু মানুষ আধার কতৃপক্ষের কাছ থেকে চিঠি পেয়েছেন, তাঁদের এ দেশে থাকার শর্ত না পূরণ হওয়ার কারণে তাঁদের আধার নিস্ক্রিয় করা হলো। যাঁরা এই চিঠি পেয়েছেন, তাঁরা এবার বুঝতেও পারছেন না, এখন তাঁদের কী করণীয়। কার কাছে গেলে এই সমস্যার সমাধান হবে। যা দেখা গেছে, মূলত আদিবাসী, মতুয়া এবং অন্যান্য বেশ কিছু গরীব মানুষ এই চিঠি পেয়েছেন। লোকসভার নির্বাচনের আগে এই চিঠি আসাতে, কেন্দ্রীয় শাসকদলের বাংলার নেতা মন্ত্রীরা স্বভাবতই অস্বস্তিতে পড়েছেন। তড়িঘড়ি সামাল দিতে তাঁরা মাঠে নেমে পড়েছেন। তাঁদের একেক জনের বক্তব্যের সঙ্গে হয়তো অন্য জনের বক্তব্যের মিল নেই, কিন্তু সকলেই এটা প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন, এটা একটা প্রযুক্তিগত সমস্যার কারণে হয়েছে, কারো আধারই নিস্ক্রিয় করা হয়নি। কেউ আবার বলেছেন, এটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আধারের রাঁচি অফিসের চক্রান্ত। পরিস্থিতি ক্রমশ ঘোরালো হচ্ছে আর মানুষজন অসহায়ভাবে ছোটাছুটি করছেন। একজন বিজেপির নেতা আগ বাড়িয়ে বলেছেন, সামনের নির্বাচনে বিজেপির পক্ষে ভোট না দিলে আরো অনেকের এই রকম হতে পারে। কেন্দ্রীয় জাহাজ প্রতিমন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর, নিজের মোবাইল নম্বর এবং ইমেইল আইডি দিয়ে বলেছেন, যাঁরা অসুবিধায় পড়েছেন, তাঁরা যেন সরাসরি তাঁর কাছে অভিযোগ জানান।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, এই বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, তাঁরা রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে আধারের বিকল্প একটা নতুন কার্ডের ব্যবস্থা করছেন এবং রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে একটা হেল্পলাইন খুলেছেন, কিন্তু এই পদ্ধতিতে কি এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব? এক তো হচ্ছে, আধার যে উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় সরকার ব্যবহার করতে চাইছে, তার বিপরীতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেভাবে বলছেন, তার কোনও তুলনাই হয় না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা সেই অর্থে বিজেপি বিরোধী যে কোনও দলই এটা বুঝেও বুঝছেন না, যে আধার আসলে সঠিক উপভোক্তা যাচাই করার নামে একটি বাদ দেওয়ার উপকরণ। আধার একজন মানুষকে নাগরিকত্ব দিতে না পারলেও, কেড়ে নিতে পারে এবং যে কোনও মানুষকে বে নাগরিক করে দিতে পারে এক লহমায়। যেটাকে এডওয়ার্ড স্নোডেন, সিভিল ডেথ বলেছিলেন। বিরোধী রাজনৈতিক নেতা নেত্রীরা এইটুকু বুঝলেও যথেষ্ট। আসামের ১৭ লক্ষ মানুষের আধার নিস্ক্রিয় হওয়ার ঘটনাতেও তাঁদের যে কেন টনক নড়ছে না, তা তাঁরাই জানেন। আধার ধ্বংস করা না গেলে সামনে সমূহ বিপদ, তা বলাই বাহুল্য। অনেকে হয়তো ভাবছেন এটা শুধুমাত্র মতুয়াদের বা আদিবাসীদের সমস্যা, কিন্তু যে কোনও দিন এটা যে কারো সমস্যা হিসেবে দেখা দেবে।
১৯০৮ সালে মহাত্মা গান্ধী দক্ষিণ আফ্রিকায় এমনই একটি পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক করার বিরুদ্ধে, সেখানকার সরকারকে অসহযোগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আন্দোলন শুরু করেছিলেন তিনি সেখানকার ভারতীয়দের নিয়ে। বাধ্য হয়েছিল সেখানকার সরকার ঐ পরিচয়পত্র ফিরিয়ে নিতে। আগামী দিনে আধারের বিরুদ্ধে লড়াইটাই হবে একমাত্র লড়াই। জার্মানিতে আইবিএম ছিল, এখানেও আধারের পিছনে নন্দন নিলেকনির আইস্টক এবং ইনফোসিস বলে বেশ কিছু সংস্থা আছে, যাঁদের লক্ষ্য বাঁধা শ্রমিক বানানো। রবীন্দ্রনাথ আজ থেকে একশো বছর আগে রক্তকরবী নাটকে এই রকম কিছু শ্রমিকদের বর্ণনা দিয়েছেন, যাঁদের কোনও নাম ছিল না, যাঁদের পরিচিতি ছিল সংখ্যায়। কেউ ছিলেন ৪৭ফ আবার কেউ ৬৯ঙ। রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন মানুষকে সংখ্যায় পরিণত করে ফেলতে পারলে, তাঁদের কোনও সুখ দুঃখ থাকে না, চাওয়া পাওয়া থাকে না, দাবী দাওয়া থাকে না। প্রত্যেকেই সংখ্যা হয়ে গেলে সংগঠিত হয়ে লড়াইও করা যায় না। একজন মানুষকে নজরে রাখার চেয়ে, সংখ্যাকে নজরে রাখা সোজা। রবীন্দ্রনাথ যা একশো বছর আগে দেখতে পেয়েছিলেন, তাই আজকে বাস্তবে দেখা যাচ্ছে।
“চন্দ্রা। কতদিনে তোমাদের কাজ ফুরবে?
বিশু। পাঁজিতে তো দিনের শেষ লেখে না। একদিনের পর দুদিন, দুদিনের পর তিনদিন; সুড়ঙ্গ কেটেই চলেছি, এক হাতের পর দু হাত, দু হাতের পর তিন হাত। তাল তাল সোনা তুলে আনছি, এক তালের পর দু তাল, দু তালের পর তিন তাল। যক্ষপুরে অঙ্কের পর অঙ্ক সার বেঁধে চলেছে, কোনো অর্থে পৌঁছয় না। তাই ওদের কাছে আমরা মানুষ নই, কেবল সংখ্যা। ফাগুভাই, তুমি কোন সংখ্যা।
ফাগুলাল। পিঠের কাপড়ে দাগা আছে, আমি ৪৭ফ।
বিশু। আমি ৬৯ঙ। গাঁয়ে ছিলুম মানুষ, এখানে হয়েছি দশ পঁচিশের ছক। বুকের উপর দিয়ে জুয়োখেলা চলছে।
চন্দ্রা। বেয়াই, ওদের সোনা তো অনেক জমল, আরো কি দরকার”।
একশো বছর আগে রবীন্দনাথের রক্তকরবীর এই অংশটুকুই, এই লেখায় রাখা হলো, যাতে সহজে বোঝা যায়। রক্তকরবীর নন্দিনী পেরেছিল, সমস্ত কিছু নিয়ম ভেঙে নতুন করে শুরু করতে। এখন কোন নন্দিনী আসবে মানুষের মুক্তির জন্যে সেই অপেক্ষায় থাকা ছাড়া কী বা করার আছে।