পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

অর্ধেক দিন

  • 31 March, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 433 view(s)
  • লিখেছেন : নাগিব মেহফুজ
নাগিব মহফুজ এক মিশরীয় সাহিত্যিক। মরুময় মিশরে উদ্যানসম তাঁর সাহিত্যসৃষ্টি। মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারে কঠোর ইসলামি অনুশাসনে জন্ম ১১, ডিসেম্বর, ১৯১১। অল্পবয়সে মিশরীয় বিপ্লবে অংশগ্রহণ করেন। সেই বিপ্লবের একটা বড় প্রভাব তাঁর সাহিত্যকর্মে প্রতিফলিত হয়েছে। মাত্র ১৭ বছর বয়সে থেকে প্রায় অর্ধশতকেরও বেশি সময় ধরে আরবের সাহিত্যাকাশে তিনি এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। অস্তিত্ববাদী লেখকদের মধ্যে প্রথম সারিতে তাঁর অবস্থান। সাহিত্যজীবনের প্রারম্ভে তাহা হুসেন, হাফিজ নাজিব, সালামা মৌসা প্রমুখ লেখক ও বুদ্ধিজীবিদের দ্বারা তিনি প্রভাবিত হন। ১৯৮৮ সালে নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পান।

বাবার ডানহাতটা আঁকড়ে ধরে পাশে পাশে হাঁটছিলাম। আমার যাবতীয় পোশাক - কালো জুতোজোড়া, সবুজ স্কুলপোশাক, লাল টুপি সব নতুন। তবে সেগুলো আমায় মোটেই খুশি - করতে পারেনি। কারণ এই দিন আমায় প্রথমবারের মত স্কুলে ভরে দেওয়া হবে।

মা জানলা দিয়ে আমাদের এগিয়ে চলা দেখছিলেন। মাঝে মাঝে আমি ফিরে দেখছিলাম। যদি তাঁর কাছ থেকে কোনো সাহায্য পাওয়া যায় সেই আশায়। আমরা যে রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম তার দু'পাশে বাগান আর মাঠ। সেখানে শস্য, নাশপাতি আর খেজুর গাছের সমারোহ।

'স্কুলে যাব কেন? আমি কী দোষ করেছি?', বাবাকে বললাম।

'আমি শাস্তি দিচ্ছি না তোকে', তিনি হেসে বললেন। 'স্কুল কোনো শাস্তির আখড়া নয়। এখানে ছোট শিশুদের কাজের উপযোগী মানুষ করে গড়ে তোলা হয়। তুই কি তোর ভাইদের মত কাজের মানুষ হতে চাস না?'

আমার ঠিক বিশ্বাস হল না। আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না যে আমাকে বাড়ি থেকে উপড়ে নিয়ে এসে এই বিশাল, দেওয়াল-উঁচু বাড়িতে ছুঁড়ে ফেলে কী এমন লাভ হবে।

স্কুলগেটে পৌঁছে বিশাল চত্বরে দেখলাম মেলা ছেলেমেয়ের জটলা।

'নিজে নিজে গিয়ে ওদের সঙ্গে যোগ দে। হাসিমুখে যা, অন্যদের কাছে একটা দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠ', বাবা বললেন।
আমি ইতস্তত করে বাবার হাতটা আঁকড়ে ধরলাম। বাবা আলতোভাবে হাতটা সরিয়ে দিয়ে বললেন, 'মানুষ হয়ে ওঠ।'

'আজ থেকে তোমার সত্যিকারের জীবন শুরু। ফেরার সময় তুমি আবার আমায় দেখতে পাবে।'

আমি কয়েক-পা এগোলাম। ছেলেমেয়েদের মুখগুলো আমার নজরে এলো। ওদের কাউকে আমি চিনি না। ওরাও আমাকে। মনে হল সেখানে আমি পথহারা এক অপরিচিত।

ঠিক তখন কিছু ছেলে কৌতুহলভরে আমার দিকে তাকালো। একজন এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলো, 'তুমি কার সঙ্গে এসেছো?'

ফিসফিসিয়ে আমি বললাম, 'বাবার সঙ্গে।'

সে সহজভাবে বললো, 'আমার বাবা নেই।'

ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না কী বলবো। স্কুলের দরজা এখন বন্ধ। কিছু ছেলেমেয়ে কান্নাকাটি শুরু করে দিলো।

ঘন্টা বাজলো। কিছু মানুষকে সঙ্গে নিয়ে একজন মহিলা এগিয়ে এলেন। একজন মানুষ আমাদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করালেন। বিশাল স্কুলচত্বরে, উঁচু উঁচু বাড়ির ঘেরাটোপে, তৈরী হলো এক জটিল নক্সা। প্রত্যেক তলায় কাঠের ছাদে ঢাকা লম্বা ঝুলবারান্দা থেকে আমাদের প্রতি লক্ষ রাখা হলো।

'এই তোমাদের নতুন বাড়ি। এখানে বাবা-মায়েরাও আছেন। উপভোগ্য ও উপকারে লাগার মতো সব কিছু এখানে আছে। চোখের জল মুছে হাসিমুখে জীবনের মুখোমুখি হও,' বললেন মহিলা।

আমার মনে হলো বেশ, আশঙ্কার তাহলে কোনো কারণ নেই। প্রথম থেকেই আমার অনেক বন্ধু হলো এবং অনেক মেয়েকে ভাল লাগলো। কল্পনাতেও ছিলো না যে স্কুলে এরকম বিচিত্র অভিজ্ঞতা হতে পারে।

নানান খেলায় আমরা মেতে উঠলাম। গানের ক্লাসে প্রথম গান গাইলাম। ভাষার সঙ্গে প্রাথমিক পরিচয় হলো। গ্লোব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পৃথিবীর নানা দেশ, মহাদেশ দেখা হলো। সংখ্যা চেনা শুরু হলো। শোনানো হলো পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তার গল্প। সুস্বাদু খাবার খেয়ে, অল্প ঘুমিয়ে ফের উঠে পড়লাম। বন্ধুতা, ভালবাসা, খেলা, শেখা একসঙ্গে চলতে লাগলো।

আমাদের এই পথ সম্পূর্ণভাবে মধুর বা মেঘমুক্ত ছিলো না। ধৈর্য ও মনোযোগের সঙ্গে আমাদের এগিয়ে চলতে হতো। শুধু খেলায় বা আলস্যে সময় কাটানোর সুযোগ ছিলো না। শত্রুতা থেকে কষ্ট ও ঘৃণার জন্ম হতো, কখনও হাতাহাতি। মহিলা সাধারণত হাসিমুখে থাকলেও প্রায়ই চিৎকার বা ভর্ৎসনা করে উঠতেন। উঠতে-বসতে শাস্তির বিধান দিতেন।
এক সময় মন পরিবর্তনের আর কোনো সুযোগ থাকতো না। গৃহের স্বর্গসুখে ফিরে যাওয়ার কোনো প্রশ্ন ছিলো অবান্তর। আমাদের সামনে ছিলো শুধু উদ্যম, সংগ্রাম আর অধ্যবসায়ের হাতছানি। সামর্থ্য যাদের ছিলো তারা সফল ও সুখী হওয়ার সুযোগের সদ্ব্যবহার করতো।

ঘন্টা বাজলো। দিন শেষ, কাজের শেষ। ছেলেমেয়েরা দৌড় লাগালো স্কুলগেটের দিকে। সেটি আবার খোলা হয়েছে। বন্ধুদের ও প্রিয়বান্ধবীদের বিদায় জানিয়ে আমি গেট দিয়ে বাইরে এলাম। এদিক-ওদিক তাকিয়ে বাবাকে দেখতে পেলাম না। অথচ বাবা সেখানে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ধারে সরে গিয়ে আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। দীর্ঘ সময় ধরে ব্যর্থ অপেক্ষার পর আমি নিজে বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নিলাম। কয়েক পা এগিয়ে বিস্ময়ে থমকে দাঁড়ালাম। হায় ভগবান! কোথায় সেই রাস্তা যার দু'ধারে বাগানের পর বাগান? কোথায় অদৃশ্য হলো? কখন সেখানে হানা দিলো এতো সব গাড়ি? কোথা থেকে এলো এতো মানুষ পৃথিবীর বুকে? রাস্তার ধারে কীভাবে এলো এই সব আবর্জনার স্তুপ? মাঠগুলোই বা কোথায়? সেখানে সার দিয়ে বহুতল। রাস্তায় ছেলেমেয়েদের জটলা। বাতাসে বিরক্তিকর কোলাহল। রাস্তার এদিকে-ওদিকে চলছে যাদুকরের হাতসাফাই কিংবা সাপের খেলা। এক সার্কাসের দল এগিয়ে চলেছে, সামনে বিদূষক ও পালোয়ানের দল, চলছে সার্কাস শুরু হওয়ার ঘোষণা।

হে ভগবান! সে এক হতবিহ্বল অবস্থা আমার। মাথায় ঘুরপাক। পাগলপ্রায় অবস্থা। অর্ধেক দিনে, সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয়ের মাঝে, কিভাবে এসব ঘটা সম্ভব? বাড়িতে গিয়ে বাবার কাছে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে হবে আমায়। কিন্তু কোথায় আমার বাড়ি? চৌমাথার দিকে আমি দ্রুত এগিয়ে গেলাম। আমার মনে আছে যে বাড়ি পৌঁছতে গেলে আমায় রাস্তা পার হতে হবে। কিন্তু গাড়ির স্রোতে আমি তা পারছি না। আমি বিরক্ত, খু-উ-ব। ভাবছি যে কখন রাস্তা পার হতে পারবো।

অনেকক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে রইলাম। তার পর এক সময় কোণের ইস্তিরির দোকান থেকে একটা অল্পবয়সি ছেলে আমার দিকে এগিয়ে এলো।

হাত বাড়িয়ে সে আমায় বললো, 'দাদু চলো তোমায় রাস্তাটা পার করে দি।'

নাগিব মহফুজের যুগান্তকারী রচনা 'কায়রো ট্রিলজি'। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর তিনি বলেন যে তাঁর সঙ্গে আরব-দুনিয়াও এই পুরস্কার পেলো, পেলো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, নজর কেড়ে নিলো বিশ্বের পাঠককুলের। ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত উপন্যাস 'অওলাদ হারেতনা' ইসলাম-বিরোধী পরিগণিত হওয়ায় কিছুদিন আগেও তাঁর রচনা আরব-দুনিয়ায় ব্রাত্য ছিলো। মৌলবাদী আক্রমণে ডানহাত পঙ্গু হওয়ার ফলে জীবনের শেষ বারো বছর তিনি কলম ধরতে পারেননি। ২০০৬ সালে তাঁর দেহাবসানের পর আরবি সাহিত্যের এক দীর্ঘ অধ্যায় সমাপ্ত হয়

 

অনুবাদ: তথাগত

0 Comments

Post Comment