পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

গল্প হলেও সত্যি

  • 22 July, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 1159 view(s)
  • লিখেছেন : উজ্জয়িনী হালিম
রাজবাড়িতে কয়েকমাস ধরে মহা ধুমধাম। ছোট রাজপুত্রের বিয়ে; পাত্রী এক স্বপ্নের রাজকন্যা। চারিদিকে সাজ সাজ রব। সারা পৃথিবীর সেরা অলঙ্কার, বস্ত্র, বৈভব সামগ্রী এসে জড়ো হচ্ছে রাজপ্রাসাদে। তার দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ছে দিকবিদিকে। সেই ছটায় চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে দেশের মানুষের। মুগ্ধ বিষ্ময়ে তারা দেখছে প্রাচুর্যের প্রবল আস্ফালন। ক্ষুধার্ত, জীবনসংগ্রামে ক্লান্ত, রিক্ত মানুষগুলো দুচোখ ভরে দেখছে রাজ ঐশ্বর্য্যের কি বাহার।

এক দেশে এক রাজা ছিল। তার ধন সম্পদের সীমা পরিসীমা ছিল না। মণিমাণিক্য খচিত প্রাসাদে, পারিষদ পরিবেষ্টিত হয়ে তার দিন কাটে মহা সুখে। দেশ বিদেশের নেতা থেকে অভিনেতা, কে নেই তার 'নবরত্ন সভায়? পাটরাণী, এক রাজকন্যা ও দুই রাজপুত্র নিয়ে রাজার সুখের সংসার। ধর্ম প্রাণ রাজার দেশের মানুষ বা প্রজারাও বড় সুশীল। আধপেটা খেয়ে বা না খেয়েও তারা চতুর্দিকে রাজার জয়জয়কার করে। হাজার বিদুষক শতাধিক প্রচার মাধ্যমের মধ্য দিয়ে দিবারাত্রি করে রাজার গুণকীর্তন। এত সুখের মধ্যেও কাঁটা কিছু দুষ্ট প্রজা, যারা রাজার কাজকর্মের সমালোচনা করে; রাজা কিন্তু তাদেরও কিছুই বলে না।, রাজা মহানুভব। দেশ চালানো, দুষ্ট প্রজাদের শাস্তি দেওয়া ইত্যাদির কাজ রাজা দিয়েছে তার মন্ত্রী-সান্ত্রীদের, এরা হোল জনপ্রতিনিধি। ঝামেলা ইত্যাদি সামলানোর দায়িত্ব এদের, বিনিময়ে রাজা এদের দিয়েছে খেতাব, খানিকটা ক্ষমতা ও প্রয়োজনীয় অর্থবল। রাজার বিশাল দেশে সমস্যার শেষ নেই। খরা, বন্যা, মহামারী, বেকারত্ব, দারিদ্র্য, অপুষ্টি, অশিক্ষা লেগেই আছে - তালিকা অনেক লম্বা। অবশ্য তাতে রাজার কিছু যায় আসে না। এই সব সমস্যার ছায়াও পড়ে না রাজবাড়ির রূপকথা সদৃশ দিনযাপনে। সেখানে শুধুই জাঁকজমক, রূপকথার জগতে বাস্তব কবেই বা স্থান পেয়েছে? কাজেই রাজার দেশে চালু আছে এক চমৎকার বন্দোবস্ত, যার মূল কথা, রাজার কারুর কাছেই কোন জবাবদিহিতা নেই।

রাজবাড়িতে কয়েকমাস ধরে মহা ধুমধাম। ছোট রাজপুত্রের বিয়ে; পাত্রী এক স্বপ্নের রাজকন্যা। চারিদিকে সাজ সাজ রব। সারা পৃথিবীর সেরা অলঙ্কার, বস্ত্র, বৈভব সামগ্রী এসে জড়ো হচ্ছে রাজপ্রাসাদে। তার দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ছে দিকবিদিকে। সেই ছটায় চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে দেশের মানুষের। মুগ্ধ বিষ্ময়ে তারা দেখছে প্রাচুর্যের প্রবল আস্ফালন। ক্ষুধার্ত, জীবনসংগ্রামে ক্লান্ত, রিক্ত মানুষগুলো দুচোখ ভরে দেখছে রাজ ঐশ্বর্য্যের কি বাহার। আহা এরা কত পুণ্যই না জানি করেছে, কত সুখী এরা - মধ্যবিত্ত থেকে হতদরিদ্র দেশবাসী দেখে আর ভাবে। নিজ নিজ গৃহে আজকাল তাদের আলোচনার বিষয় একটাই, ছোট রাজপুত্রর বিয়ে। অবশ্য বিয়ের উৎসব উপলক্ষে যে-সব অনুষ্ঠান হচ্ছে, তা নিয়ে সারা বিশ্বেই চর্চা হচ্ছে, হতেই হবে; সোনা - রূপায় খচিত নিমন্ত্রণ পত্র থেকে শুরু করে হীরে- জহরত খচিত  পোশাক পরিচ্ছদ আর রাজবাড়ির সাজসজ্জা - এমনটা আর কেউ আগে দেখেনি। সারা বিশ্বের নামীদামী ব্যক্তিবর্গ, বিনোদন জগতের সেরা প্রতিভারা সরগরম করে রেখেছে মজলিস, বিয়ের অনুষ্ঠান চলছে মাসাধিক কাল ধরে। দেশব্যাপী গভীর দারিদ্র্যের সাথে এই প্রচণ্ড প্রাচুর্যের যে বৈপরীত্য, সেই অসাম্য যেন রাজ-ঐশ্বর্যর ঝলকানিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। গভীর অন্ধকারেই তো মণিমাণিক্যর দ্যুতি সব থেকে বেশি প্রখর হয়।

সবই চলছিল ভালো কিন্তু রাজার কানে খবর গেল, নিন্দুকেরা মন্দ বলছে। রাজা মন্ত্রীদের ডাকল জরুরি আলোচনা সভায়। ভুরু কুঁচকে মন্ত্রীদের বলল - এসব কি শুনছি? লোকে নাকি নিন্দা করছে? তোমরা থাকতে এই স্পর্ধা লোকের হয় কি করে? বেচারা মন্ত্রীরা রাজাকে আস্বস্ত করার সুরে বলল - এসব কিছু না মহারাজ, নিন্দুকরা ঈর্ষাকাতর। আরে বাবা রাজা আর প্রজায় ফারাক তো থাকবেই, রাজার গর্বে প্রজার গর্ব, এটাই তো নিয়ম। রাজ কার্যে অর্থের যোগান দেওয়া প্রজার কর্তব্য। এই সেদিন যে নতুন কর বসানো হলো, ছোট রাজকুমারের বিয়ে উপলক্ষে, তা নিয়েও কটাক্ষ করছে কিছু নিন্দুক, প্রজাদের খেপিয়ে তোলার চেষ্টা করছে, এত সাহস এদের। তবে আপনি ভাববেন না দেশের এই সব শত্রুদের অচিরেই আমরা শাসন করে দেব, বিদ্রোহীরা কারাগারে নিক্ষিপ্ত হবে আপনি নিশ্চিত থাকুন।

রাজা একটু শান্ত হয়ে প্রচার মন্ত্রীকে ডেকে বলল - ছোটকুমারের বিবাহ উৎসবের প্রচারে যেন কোন ত্রুটি না থাকে। প্রচারমন্ত্রী সাথে সাথে জবাব দিল - মহারাজ দেশ বিদেশের হাজারো প্রচারমাধ্যমে এখন একমাত্র শিরোনাম আমাদের ছোটকুমারের বিবাহ। অন্য কোন খবর, তা সে ঘটনা হোক বা দুর্ঘটনা – সেসব পরিবেশন করে যাতে মানুষকে বিভ্রান্ত করা না হয়, তার জন্য কড়া নির্দেশ দেওয়া আছে। রাজা খুশি মনে অর্থমন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করল খরচের হিসাব কিছু রাখছ? একগাল হেসে অর্থমন্ত্রী বলে - মহারাজ আপনার কুবেরের ভাণ্ডার, তার ১ শতাংশও খরচ হবে না, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। এবার রাজা বিরক্ত হয়ে বলে, খরচের চিন্তা কে করছে? এমন খরচ হওয়া উচিৎ যা ত্রিভুবনে আর হয়নি। অর্থমন্ত্রী বলে, মহারাজ, ছোট রাজকুমারের বিবাহের নিমন্ত্রণপত্র ছাপার যা খরচ, তা আপনার দেশের সব প্রজাদের বার্ষিক গড় বেতনের থেকে বেশি। সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডতে এত বিলাসবহুল বিবাহ আগেও হয়নি আর পরেও যদি হয়, আপনিই সেটা করবেন। রাজার মুখে প্রশান্তির হাসি ফুটে ওঠে। নগরপালকে সম্বোধন করে রাজা বলে, দেখ উৎসবের সময় উটকো লোক যেন আমার প্রাসাদের ধারে কাছে না আসে, রাজপথে পাহারা কড়া কর। আর বিনোদন মন্ত্রী তুমি সকল তারকাদের নৃত্য গীত অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া অবিলম্বে নিশ্চিত কর । বিনোদন মন্ত্রী নড়েচড়ে বসে ও জানায় সক্কলে আসবে, নেচে গেয়ে রাজপুত্রর মনোরঞ্জন করবে, কেউ ট্যাঁফু করলে তার নিস্তার নেই, পেশাদারি জীবনের সেখানেই সমাপ্তি, এই কথাটা সক্কলকে জানানো হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী উঠে দাঁড়িয়ে বলে, মহারাজ আপনি বিশ্রাম করুন, আমরা তো আছি। আপনার আশীর্বাদে আমাদের শাসন - শোষণ নির্বিবাদে চলছে, সবই আপনার দয়া, যতদিন আপনি - ততদিনই তো আমরা। সভা ভঙ্গ হয়।

শহরের যে প্রান্তে হাভাতে মানুষের বাস, সেখানেও ছোট কুমারের বিয়ের নৃত্য গীতের আওয়াজ পৌঁছে যাচ্ছে অবিরাম, দেখা যাচ্ছে রাজবাড়ির আকাশে মুহুর্মুহু আতসবাজির আলো। রাজপথে দামি গাড়ি চেপে দেশ বিদেশের ধনকুবের ব্যক্তিরা রাজবাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে, রাজ নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে। নগরীর বাকি মানুষদের এখন ঐ পথে চলা নিষেধ। তাদের অনেক ঘুরপথে যেতে হচ্ছে কাজে কর্মে, দুমুঠো অন্নের সন্ধানে। করের বোঝার চাপ, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্য বৃদ্ধি তাদের কঠিন জীবনসংগ্রামক কঠিনতর করেছে, কিন্তু কে শুনবে তাদের দুর্দশার কথা? একদিন ছিল, যখন নাকি দশের উন্নতিকেই দেশের উন্নতি বলা হতো, রাজা থাকত তাদের মাঝেই, তাদের একজন হয়ে, তখন জনপ্রতিনিধি শব্দের সংজ্ঞাই ছিল ভিন্ন। জনতার রাজা ছিল জনতার ধরা ছোঁয়ার মধ্যে, তার ছিল বাস্তবের সাথে যোগ; সেযুগ গেছে। কবে ছিল সে যুগ সেকথা আর মনেও নেই দেশের মানুষের, আদৌ কি ছিল এমন কোন যুগ, নাকি সেও এক কল্পগল্প? কে জানে!

এখন নতুন যুগের নতুন রাজার রাজকীয় জাঁকজমক মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে দেয়, চিন্তা চেতনাকে আচ্ছন্ন করে। মানুষের চোখে এক নেশার ঘোর লাগে; ধনের নেশা, ক্ষমতার নেশা, অন্য সকলকে পদদলিত করে, হারিয়ে দিয়ে জেতার নেশা – অসম্ভবের নেশা। আধপেটা খেয়েও অগণিত মানুষ তাই মন্ত্রমুগ্ধের মতন দেখতে থাকে রাজার নির্লজ্জ ঐশ্বর্য্যের ছটা, ঠাঁটবাট। শুধু দেশদ্রোহিতার অভিযোগে জেল খাটা জটা পাগলা অলিগলিতে ঘুরে ঘুরে এখনো গান গেয়ে ঘোষণা করে -

“আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে--

Like our Facebook Page

নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে?’

(দেশ তথা বিশ্বের অন্যতম ধনকুবের মুকেশ আম্বানির কনিষ্ঠ পুত্রের বিবাহ উপলক্ষে, মাসাধিক কাল ধরে যে বিলাসবহুল উৎসব আম্বানি পরিবারে চলছে, তা সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমের সৌজন্যে এক জাতীয় উৎসবে পরি্ণত হয়েছে। নেতা থেকে অভিনেতা /সেলিব্রিটি সকলে হাজিরা দিয়েছেন এই অনুষ্ঠানে। ধনসম্পদের নির্লজ্জ প্রদর্শনী ও বিলাস বৈভবের আড়ম্বর একদিকে যেমন বহু সাধারণ মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করেছে, তেমনি অন্যদিকে বহু মানুষের মনে জাগছে একটা প্রশ্ন - সেটা হলো এই অতি আড়ম্বর কতটা শালীন? যে দেশে সরকারি দলিলের হিসাবেই ..প্রায় ৪ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করে, বিশ্ব খাদ্য সূচকে যে দেশের স্থান.১২৫ এর মধ্যে ১১১, বেকারত্বের অভিশাপ যে দেশে যুবসমাজকে গ্রাস করেছে, ধনী - দরিদ্রের বৈষম্য যেদেশে আশঙ্কার বিষয়, যে দেশে ১% ধনকুবেরদের হাতে দেশের ৫৩% সম্পদ; সে দেশে এক ধনকুবেরর পারিবারিক উৎসব নিয়ে এই মাতামাতি, আরো একবার আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আসলে কারা রয়েছে? কাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ও বিত্তবান গোষ্ঠী উদগ্রীব। যদিও সংবিধান বলেছে আমাদের দেশ এক জনকল্যাণমুখী দেশ, যার কর্ণধার প্রতিটি  দেশবাসী, কিন্তু বাস্তবটা আসলে কি, সেটা আম্বানি পরিবারের একটা উৎসব থেকেই স্পষ্ট। কাজেই উৎসবের চাকচিক্যের আড়ালে ঢাকা পড়া কঠিন সত্যকে এড়িয়ে যাওয়ায় উপায় নেই।)

0 Comments

Post Comment