পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

প্রতিবাদী মহিলার আটপৌরে জীবনঃ শেলী মুর্মু

  • 08 March, 2021
  • 1 Comment(s)
  • 1582 view(s)
  • লিখেছেন : মেরুনা মুর্মু
আমার বাবা গুরুচরণ মুর্মু, যিনি ভারতবর্ষের সান্তাল জনগোষ্ঠী থেকে প্রথম আই.পি.এস. অফিসার হন, তাঁর সামাজিক অবমাননা আর প্রাতিষ্ঠানিক বঞ্চনার কথা লিখে উঠলেও, বাবার এই প্রতিরোধ আখ্যানে আমার মায়ের ভূমিকার কথা লেখা হয়নি কখনও। লিখিনি বলাটাই ভাল কারণ আমার মা আখেরে কেমন যেন আর পাঁচজনের মায়ের মতই জীবন কাটান। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে সেই মায়ের কথাই শোনা জরুরী। অন্তরালে থাকলেও যাঁদের কথা আজ না বললে হয়তো বাকি থেকে যায় অনেক কথা।

দুদিনের তরে হেথা বাঁধিয়াছি বাসা

আহ্বান আসিলে যেতে হব সহসা

আসক্তি থাকে না যেন হেথা কারো প্রতি।

থাকে যেন সর্বদা তাহাতেই রতি।।

ওপরের কটা লাইন দিয়ে আমার মা শেলী মুর্মুর ডায়রি লেখা শুরু। রোজনামচা নয়, কারণ ১৯৭৮-র একটা ডায়রিতেই সারা জীবনের নানা ঘটনা ও মুহূর্ত বন্দি করা। এর অস্তিত্বের কথা জানলেও এ ডায়রি আমার নাগালের বাইরেই ছিল। এই বছর ৩রা জানুয়ারি সেরিব্রাল স্ট্রোকে মা আমায় ছেড়ে যাওয়ায় এই প্রাপ্তি। পাঁচ মিনিটের ব্যবধানে প্রিয়জনের ‘আছে’ থেকে ‘নেই’ হয়ে যাওয়ার আকস্মিক ধাক্কা থেকে বেরিয়ে মা’কে আবার ছুঁতে পারার বাসনা নিয়েই ডায়রি হাঁতড়ানো। এ এক অন্য মা। যে দাপুটে মা’কে নিজের শর্তে বেঁচে থাকতে দেখেছি, গভীর, গোপন একান্ত আপন সেই মায়ের জীবনের অশেষ আক্ষেপ মন ভারী করে বই কি।

আমার বাবা গুরুচরণ মুর্মু, যিনি ভারতবর্ষের সান্তাল জনগোষ্ঠী থেকে প্রথম আই.পি.এস. অফিসার হন, তাঁর সামাজিক অবমাননা আর প্রাতিষ্ঠানিক বঞ্চনার কথা লিখে উঠলেও, বাবার এই প্রতিরোধ আখ্যানে আমার মায়ের ভূমিকার কথা লেখা হয়নি কখনও। লিখিনি বলাটাই ভাল কারণ আমার মা আখেরে কেমন যেন আর পাঁচজনের মায়ের মতই জীবন কাটান। আত্মবলিদান আর সহনশীলতায় বলীয়ান মাতৃত্বকে ঘিরে পিতৃতান্ত্রিক নির্মাণকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে যেন তাঁর জীবন। আর লেখনীতে প্রতিবাদী চরিত্রকে গড়ে তোলাই যদি না গেল তাহলে নারীবাদী প্রতর্কের কীই বা এল গেল এমন অহমিকা থেকেই লিখিনি বোধহয়। আজ আর্ন্তজাতিক শ্রমজীবী নারী দিবসে মনে হল যে মানুষটা সারা জীবন তাঁর শ্রম আর অবিচল কর্তব্যবোধ থেকে সংসার করে গেলেন, তাঁকে মরনোত্তর শ্রদ্ধা জানাবার জন্য লিখতে আমি দায়বদ্ধ।

২০শে অক্টোবর ১৯৪৬ সালে হিন্দু বাঙালি ঘরে আমার মায়ের জন্ম। দাদু Land Settlement অফিসার ছিলন বটে তবে চার ছেলেমেয়ে নিয়ে টানাটানির সংসারই ছিল। মেয়েকে বেশি লেখাপড়া শেখানোর প্রয়োজন নেই এহেন মনোভাবাপন্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য হওয়ার দরুণ মা’কে উচ্চশিক্ষার সংকুলান নিজেকেই করতে হয়। মুরলীধর কলেজ থেকে বি.এ. পাস করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক ভারতের ইতিহাস নিয়ে এম.এ. করেন ১৯৬৯ সালে। এম.এ. পাশ করার পর মা এল.এল.বি.-ও পাশ করেন। রামচন্দ্রখালি কলেজে ইতিহাস বিভাগে অধ্যাপনার সুযোগ পেলেও মা শেষে এ.জি. বেঙ্গল-এ চাকরি নেন ১৯৭২ সালে। ওই বছরেই আমার বাবা সর্ব্বভারতীয় পরীক্ষা দিয়ে আই.পি.এস. নির্বাচিত হন।

১৭ই জুলাই ১৯৭৩ স্নাতোকোত্তরস্তরের আদিবাসী সহপাঠীকে বিয়ে করে মা পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষিতে ইতিহাস রচনা করেন। অবশ্য মায়ের কাছে তা ছিল নেহাতই অজস্র চিঠি আর সামাজিক বাধা বিপত্তি কাটিয়ে, পরিচিত গণ্ডি পেরিয়ে প্রেম বিবাহ। ডায়রির একটা পাতায় লেখা আছে: If love without marriage is illegal, marriage without love is immoral...Love has its peaks which only one in a million is able to climb through mature and responsible love. সামাজিক বিধির বিধান মেনে বিয়ে করলে জীবন যতটা সাচ্ছন্দ্যে কাটানো যায়, বলাই বাহুল্য যে তা মা-বাবার বেলায় হয়নি। আদিবাসী জনগোষ্ঠী বা বাঙালি সমাজ কেউই এই অসম বিবাহের সামাজিক স্বীকৃতি দেয়নি দীর্ঘ সময় ধরে। আমাদের এক ঘরে করা হয়। শুনেছিলাম আমার দিদাকে কেউ একজন মায়ের কথা জিজ্ঞাসা করাতে তিনি বলেছিলেন যে মা কালো কালো দুটো বাচ্চার জন্ম দিয়েছেন।

এই ছক ভাঙা বিয়ে মায়ের জীবনের সবচেয়ে বড় আক্ষেপের কারণও হয়ে দাঁড়ায়। আমার বাবার বদলির চাকরি হওয়ায় আর এ.জি. বেঙ্গল-এর কলকাতা ছাড়া কোন শাখা না থাকায় বিয়ের পর চাকরিটা ছেড়ে দিতে হয়। মা বারবার আক্ষেপ করতেন যে এত সম্ভাবনাময় জীবন হওয়া সত্ত্বেও ‘অস্তিত্বহীন’ ‘মিসেস মুর্মু’ হয়েই থেকে যেতে হল। মা এই বাস্তবকে কোনদিনই মেনে নিতে পারেননি তবে জীবন জ্ঞান করে মানিয়ে নিয়েছিলেন দাদা আর আমাকে বড় করার দায়িত্বকে। আমাদের আগলে রাখাটা যে গুরু দায়িত্ব ছিল। ‘ছেলেমানুষ’ থাকার সময়ই আমায় বুঝিয়ে দেওয়া হয় যে আমি শুধুই মানুষ নই, ‘প্রান্তিক মানুষ’ মাত্র এই হিন্দু বাঙালি ভদ্রলোক সমাজে। অপরায়ণের বোধের জন্ম হয় দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় যখন হঠাৎই ক্লাসের মাঝে আমাকে দাঁড় করিয়ে ক্লাস টিচার জিজ্ঞাসা করেন আমি “এস.টি.” কিনা। আমি যে এমন দুটি শব্দের ধারক-বাহক এমন কোন কথাই তো জানায়নি মা-বাবা। তবে সেদিন এটা বুঝেছিলাম যে আমি এমন একটা কিছু যেটা ক্লাসের সবার থেকে আমাকে আলাদা চিহ্নিত করে। যখন আমি অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি তখন “এস.টি.” শব্দটির জীবনে প্রত্যাগমন। সরকারি নথিতে আমি “এস.টি.” সেটা প্রমাণসাপেক্ষ তাই “এস.টি.” সার্টিফিকেট পেতে হবে। বাড়িতে তখন তুমুল অশান্তি। মা বলছেন, আমি যেহেতু পড়াশোনায় ভালো তাই আমার এই সার্টিফিকেট নিষ্প্রয়োজন। বাবা বলছেন, ওটি আমার জাতিগত পরিচয়ের প্রমাণ। আমার আদিবাসী অস্তিত্বের সরকারি স্বীকৃতির জন্য ছবি আমাকে তুলতেই হবে। মতানৈক্যের শেষে আমার সরকারি “এস.টি” হয়ে ওঠা হল। মায়ের এ দোটানার কথা ডায়রিতেও লেখা আছে: ওরা না হল সাঁওতাল না হল বাঙালি। ধিক্কারেই ওদের দিনগুলো কেটে যাবে।

আমাদের বড় করা নিয়ে আরও কিছু বিষয় মা বাবার মধ্যে মতপার্থক্য দেখি। যেমন চার বছর বয়স থেকে মায়ের আমাকে গান শেখানোর ইচ্ছে। বাবা মনে করতেন সান্তালরা সহজাত ভাবেই গাইতে পারে কারণ তা দৈনন্দিন জীবনের অংশবিশেষ। আমার দিদা উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে তালিম নিয়ে Bengal Music Conference-এ যেহেতু গানও গেয়েছিলেন, মা বিশ্বাস করতেন যে শুধু গান গাইতে পারলে হয় না, তার জন্য চাই তালিম আর অধ্যবসায়। মায়ের জেদের ফলেই আমার পনেরো বছর সঙ্গীত চর্চা। সেই ভালোবাসা থেকেই আঠারো শতাব্দীর শেষার্ধে বিষ্ণুপুরের রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় বিষ্ণুপুর ঘরানার উত্থান ও বিস্তার নিয়ে সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গবেষণা করব ঠিক করি জে. এন. ইউ.-তে। আমি যে ইতিহাসকেন্দ্রে পড়াশুনা করি তার চেয়ারপার্সন আমায় প্রায় ভর্ৎসনার স্বরে বলেন যে, আমি ভাবলামই বা কি করে যে আদিবাসী হয়ে মার্গীয় সঙ্গীতের ইতিহাস নিয়ে কাজ করতে পারব? আমার পক্ষে এই কাজটা করা অসম্ভব কারণ আমি সেই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল বর্হিভূত এক প্রান্তিক মানুষ। জাতিগত অবস্থানের প্রেক্ষিতে উচ্চজাতের সংস্কৃতি নিয়ে আমার কাজ করার ইচ্ছেটাই যেন অনধিকারচর্চা। স্তম্ভিত, ব্যথিত হয়ে নতুন বিষয় চয়ন করি। উনিশ শতকের ‘নবজাগরণে’র জোয়ারে ভাসা বঙ্গদেশেও পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় উপেক্ষিত থেকে যান হিন্দু ও ব্রাহ্ম বাঙালি ভদ্রমহিলা লেখিকারা। আসলে সব পথ এসে মিলে গেল শেষে আমার পদবীখানিতে!!

মেয়ের জে.এন.ইউ.-তে পড়া নিয়ে মায়ের খুব গর্ব ছিল। ২০০১ সালে ওখানে আমার সঙ্গে দেখা করতে একাই আসেন মা। সংসারের ঘানি টানতে টানতে ক্লান্ত মায়ের কাছে যে দিল্লীতে কাটানো ওই কটা দিন এত আনন্দের তা জানলাম ডায়রি পড়তে পড়তে। লিখেছেন:

আরাবল্লী পাহাড় কেটে তৈরি J.N.U. এককথায় অপূর্ব। আমি আমার মেয়ের জন্য ওখানে পৌঁছাতে পারলাম—নইলে ওখানে পৌঁছানো ছিল আমার জীবনে অকল্পনীয়…আমার কাছে সব স্বপ্নের মতোই।…Secular House Students & Staff Canteen—ওখানে খেলাম আমার জীবনে সর্বপ্রথম মাটন কোর্মা, বোনলেস কড়াই চিকেন আর রুটি। ২৭ বছর পর কদিনের জন্য মুক্তি। এ মুক্তির আস্বাদ আমি জীবনেও ভুলব না...Secular House Canteen থেকে ফেরার পথে নীলগাই দেখলাম। নীলগাই দেখলে লোকে নাকি J.N.U. তে PhD করে। আমিও করব in my next birth’.

মায়ের এই ‘মিসেস মুর্মু’ হয়ে বেঁচে থাকার গ্লানি ডায়রির ছত্রে ছত্রে। ডাঁটের সঙ্গে সংসার করলেও ওটা মায়ের কাছে ছিল শুধুই কর্তব্য।

1 Comments

নিরঞ্জন মিত্র

09 March, 2021

filling enriched myself

Post Comment