'সিল কাটাই', 'বঁটি সানালাই'-এসব আওয়াজ আজকাল আর শোনা যায় না। মাঝদুপুরে হঠাৎ সেই ডাক শুনে জানালায় দাঁড়াতেই করুণ অনুনয় "সিল কাটাবেন মা---? কাজ কাম নেই, শুধুই ঘুরচি---?"
দরকার অবশ্য ছিল। ডাকলাম। (শিলটা শাশুড়ীমা এনেছিলেন দেশভাগের সময়। বরিশাল থেকে। কী করে সেই ভারী শিল এনেছিলেন, কেন--জানিনা। হয়তো মা কাকিমার স্মৃতিজড়ানো বলে!)
প্রৌঢ, কিন্তু পেটানো চেহারা। ঝাড়খণ্ডের দেওঘরে বাড়ি। কিন্তু তিন পুরুষ এইখানেই , শিল কাটাইয়ের পেশায়।
-দেশ-গাঁ ছেড়ে এখানে কেন? -জমি জমা খুব কম মা। রুখা শুখা দেশ। বিষ্টি বাদল হয় কম। চাষ বাসও কম।
এখানে সেই গাঁয়ের চল্লিশ জন একসঙ্গে থাকেন। ভাড়া ঘরে-এক এক ঘরে দশ জন করে। সবার ঐ একই পেশা। অথচ নিজেই বললেন- এখন শিলের জায়গা নিয়েছে মিক্সি। তাহলে?
-পরিবার? তারা কোথায় থাকে?
পকেট থেকে সাদামাটা ফোনটা বার করে বললেন-এখানে!
একটু কুণ্ঠা। বললেন-ছেলে ছেলে করে পাঁচটা মেয়ে হয়ে গেল। তারপর ছেলে। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। --মেয়েদের পছন্দে?
-আরে না, না। আমাদের গাঁয়ের সবার মতামত নিয়ে তবে বিয়ে দিতে হয়। কেউ মরলে গাঁ শুদ্ধু সবার অশৌচ লাগে।
নিজের মাথাটা দেখালেন। কিছুদিন আগে কামাতে হয়েছিল।
-বাড়ি যান?
-খুব কম। কী করব গিয়ে? বৌ নিজের কাজ নিয়ে থাকে।
-তিনি কী করেন?
-বিড়ি বাঁধে। আরও সব কাজ থাকে--
-ছেলেও কী আপনার পেশায়?
-না, না! ওকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়িয়েচি। পড়ায় মাথা ছিল। উচ্চ মাধ্যমিকে সেকেন্ড ক্লাস (ডিভিশন)।
-কী করছে? আপনার সঙ্গে থাকে?
- এক জামাইয়ের সঙ্গে একই দোকানের গ্যাসের গাড়ি চালায়। এই তো আঠারো বছর হল।
-জামাইরা কী করে?
-কেউ শিল কাটায়, কেউ মার্বেলের কাজ করে, কেউ ট্রেনে ভেন্ডার , কেউ হকারি করে। -কেউ চাকরি করে না।
-কোথায় বিয়ে দিলেন?
-ঝাঁঝা, জামুই, লক্ষ্মীসরাই
---নাম শুনেছেন?
এর মধ্যেই ফোন এল। অনেকক্ষণ নিচুগলায় কথাবার্তা। মাঝে মাঝে গলাটা চড়ে যাচ্ছে। আমি উশখুশ করছি। দুপুর গড়িয়ে বিকেলের দিকে রওনা দিয়েছে, চান-খাওয়া বাকি। সেটা দেখে ফোন রেখে শিল খোদাইয়ে লেগে গেল মানুষটি। আমি ছবি তুলতে হাসিমুখে বললেন, " নাতিকে দেখাবে, না?" ততক্ষণে শিলে একটা মাছ খোদাই হয়ে গেছে। বললেন," অনেক বছর আগে একবার আপনার বাড়ি এসেছিলাম, তখনও মাছ খোদাই করে দিয়েছিলাম।
তাই বুঝি! মনে নেই।
জোর দশ মিনিট।
-হয়ে গেছে মা! --হরি হরি--
মনে হচ্ছিল ক্লান্ত মানুষটাকে জল দিই। দিলাম না। শুধু জল দেব? মিষ্টি টিষ্টি তো কিছু নেই--
আবার ফোন। কথা শেষ করে ফোন রাখতে রাখতে বললেন," ছোট মেয়ে; খুব ঝামেলা হচ্ছে। বরের বৌদির সঙ্গে প্রেম। দশ বছর ধরে। ভাসুর বিকলাঙ্গ। সংসারে বৌদিই সব। মেয়েটাকে খুব খাটায়। ছাগল, গরু চরাতে পাঠায়। বলে, আমিই তোর শাস্। ঐ মেয়েছেলের কথা শুনে জামাই মেয়েটাকে মার ধর খিস্তি করে---একবার সবক শিখিয়ে দিয়েছিলাম--আবার শুরু করেছে। বলে, পাঁচটা তো মেয়ে, সেই লোক আমার কী করবে! --দেখি, থানা-পুলিশ করতেই হবে। নাতিটার এখনও একবছর হয়নি--
"জানো এই জামাইকে তিন লাখ টাকা ক্যাশ দিয়েচি। বাকিদেরও এক-দুলাখ করে দিতে হয়েচে। একে বেশি কেন? এর রংটা ফরসা, তাই। জমি উমি বেচে কোন রকম--তখন কি জানতাম এমন বদমাশ! আজ মেয়েটাকে এমন মেরেচে চোখের পাশে কপালটা নাকি কালো হয়ে গেছে--বুকটা ফেটে যাচ্ছে আমার" বলে নিজের বুকে হাত রাখে লোকটি।
খারাপ লাগলো। দুঃখ প্রকাশ করে কথামত দু'শ টাকা এগিয়ে দিই। সত্যিই তো, বাইশ বছরের মেয়েটা- এই ফাগুন দিনে কোথায় প্রজাপতির মত চঞ্চল পায়ে ঘুরে ঘুরে, আপন মনে গুনগুনিয়ে কাজ করবে, তা না--মনটা খুব দমে গেল।
"মেয়েটার জন্যে কিছু পয়সা দিন না--"
মহা ফাঁপড়ে পড়লাম। এক দু তারিখ মানে মাসের শেষ
--এমনিই দুশোটা টাকা গেল।
প্রত্যাখ্যান করতেই হল।
" কিছু খাবার থাকলে দাও না --রুটি পাউরুটি যাহোক--"
এই বেলায় সেসব ছিল না। ভাতে অনেক হ্যাপা। চল্লিশটা টাকা হাতে দিয়ে কাছের হোটেলে মাছ ভাত খেয়ে নিতে অনুরোধ করি। যদিও মনটা খচখচ করছিল। (আমার মা, শাশুড়ীমা কখনও ক্ষুধার্তকে ফেরাতেন না। এ ব্যাপারে কোন দ্বিধা ছিল না তাঁদের। কাউকে বসিয়ে খাইয়ে তৃপ্তিই পেতেন। নিজেরা কম খেয়ে, এমনকি না খেয়েও থাকতেন অনেক সময়। অথচ আমি? কী অবলীলায় হোটেল দেখিয়ে দিলাম! আমার এই 'উন্নতি' (অধঃপতন)কবে থেকে, কীভাবে,কেন হল!)
এই রাজ্যে, এই শহরে এমনিকরেই কত মানুষ পুরুষানুক্রমে আছেন, নিজেদের দেশ গাঁয়ের পরম্পরা নিয়ে। হয়তো কষ্টে , কিন্তু নির্ভয়ে। নিজের মত করে। থাকবে তো আমার বাংলা ভিন রাজ্যের গাঁ গঞ্জের এইসব শ্রমজীবী হতদরিদ্র মানুষের 'নিজের ঠাঁই' হয়ে?