যেদিন থেকে রঞ্জিতের সাথে স্মিতার বিয়ের সম্বন্ধ ঠিক হয়েছিল সেদিন থেকে আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী সবাই শৃগালের হুক্কাহুয়ার মত একসাথে বলতে শুরু করেছিল স্মিতা নাকি খুব ভাগ্যবতী। স্মিতার বাবাকেও সবাই বলতে শুরু করেছিল যে তার আর কোনও চিন্তা নেই। একমাত্র মেয়ের জন্য পাত্র পেয়েছেন তিনি সরকারী কর্মচারী। স্মিতার জ্যাঠতুতো দিদি তো বলেই বসল, ‘তোর কপালটাই দারুণ রে। তোর বর সরকারী কর্মচারী। জীবনে আর কোনও প্রবলেম থাকবে না। অফিসের বাঁধাধরা কাজ, তাও আবার যখন তখন বাড়ি চলে আসতে পারবে। আমাদের তো আর সে কপাল নেই। অফিসের বড়সাহেবের মেজাজ চড়লেই গর্দান যেতে পারে’। কেউ কেউ তো এও বলেছিল রঞ্জিত যে বিভাগে রয়েছে সেখানে উপরি উপার্জনের প্রচুর সুযোগ। তাই অর্থের দিক থেকেও স্মিতার কোনও চিন্তা নেই। তার উপরে যখন সবাই শুনল বিয়েতে পাত্রের বা তার বাড়ির কারওর দেনা-পাওনার কোনও দাবি নেই তখন তো স্মিতার বাবাকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাগ্যবান লোক মনে করে মুখে প্রশংসা করলেও মনে মনে হিংসায় সবাই জ্বলতে লাগল।
সম্বন্ধ পাকা হওয়ার মাস দুয়েকের মধ্যেই বিয়ের লগ্ন স্থির হল। বিয়ের দিনই ম্যারেজ রেজিস্ট্রির পারমিশনও পাওয়া গেল। এই অল্প সময়ে বিয়ের তোড়জোড় করতে করতেই চলে গেল। স্মিতার তাই বিয়ের আগে রঞ্জিতকে ভালো করে চেনা হয়নি। তাও যেটুকু উপরসা দেখেছিল তাতে তার মনে হয়েছিল মানুষটা আদর্শবান, ঘুষখোর নয়।
স্মিতা দেখতে শুনতে সুশ্রী হলেও সুন্দরী নয়। তুলনায় বিয়ের রাতে বরবেশে রঞ্জিতকে দেখে সবাই মানল যে ছেলের চেহারা বেশ হ্যান্ডসাম। যদিও চটকদারী একেবারেই নয়। তার ওপর সরকারী কর্মচারী। বিয়ের নেমতন্ন খেতে এসে তথাকথিত কয়েকজন শুভানুধ্যায়ী এও মন্তব্য করে গেল যে স্মিতার বাবা একেবারে জ্যাকপট পেয়ে গেছে। ‘মোটা দাঁও মেরেছে রে মেয়ের বাবা’, এমন কথাও কাউকে কাউকে বলতে শোনা গেল। যদিও স্মিতার বিয়ে এবং বউভাতে অনাবশ্যক আড়ম্বর কিছু ছিল না।
বিয়ের পরই স্মিতা বুঝে গেল রঞ্জিত সম্পর্কে সে যা ভেবেছিল ঠিক তাই। রঞ্জিত সরকারী দপ্তরের ক্লার্ক। কোনও বড় আধিকারিক নয়। যথেষ্ঠ পরিশ্রমী এবং আদর্শবান মানুষ রঞ্জিত। বিয়ের পরে মধুচন্দ্রিমায় যাবার সৌভাগ্য স্মিতার হল না। কারণ রঞ্জিতের অফিসের চাপ। বিয়ের আগে কেউ কেউ ঠাট্টা করে স্মিতাকে সরকারী কর্মচারীদের নিয়ে সাধারণীকৃত এক জনপ্রিয় জীবনমুখী গানের কলি শুনিয়ে বলেছিল যে তার স্বামীও এই একই গোত্রভুক্ত হবে। বিয়ের পর স্মিতা দেখল ছবিটা পুরো উল্টো। কাজের চাপে অফিস আওয়ারের পরেও কখনও কখনও অফিসেই আরও কিছু সময় থেকে যেতে হয় রঞ্জিতকে।
রঞ্জিতের এক সিনিয়র কলিগ অশোকদা অবশ্য ঐ গানের কলির চরিত্রের মতই। কিন্তু রঞ্জিত সেরকম নয়। এটা নয় যে অশোকদার উদাহরণ দিয়ে স্মিতা মাঝেমধ্যে রঞ্জিতের সঙ্গে ঝগড়া করেনি। কিন্তু মনে মনে রঞ্জিতকে ভীষণ শ্রদ্ধা করতে শুরু করেছিল স্মিতা সেইসঙ্গে তার জন্য গর্বও হত।
রঞ্জিত কিন্তু পরিবার সম্পর্কে কখনও কোনও ঔদাসীন্য দেখায়নি। স্মিতাকে ভালোবাসা থেকে শুরু করে তার প্রতি কোনও কর্তব্যে কখনও অবহেলা করেনি রঞ্জিত। কিন্তু একই সাথে স্মিতাকে বৈভবের কোনও জীবনও দিতে পারেনি। রঞ্জিতের সম্বল তার মাসিক মাইনে, কোনও উপরি একটা পয়সাও নয়। উপরন্তু বিয়ের আগে ভাড়া বাড়ি থেকে নিজের একটা ছোট ফ্ল্যাট করে মাকে নিয়ে সেখানে উঠে এসেছিল রঞ্জিত। তাই ঐ ছোট্ট ফ্ল্যাটের জন্যও একটা বড় হোম লোনের ইএমআই তাকে গুনতে হচ্ছিল। ফলে অত্যন্ত সাধারণ জীবনই স্মিতাকে দিতে পেরেছিল রঞ্জিত। স্মিতার এই নিয়ে কোনও অভিযোগ ছিল না, কিন্তু বাজার-হাটে জিনিসপত্রের দাম নিয়ে দরাদরি করলেই পরিচিত বিক্রেতাদের একটা মন্তব্য বারবার শুনতে হত, ‘বৌদি, আপনার দরাদরি করা মানায় না। দাদা তো সরকারী কর্মচারী। আপনাদের আবার চিন্তা কি? ডিএ থেকে শুরু করে আরও কত সুযোগ-সুবিধা রয়েছে আপনাদের’।
স্মিতা এসব কথার কোনও উত্তর দিত না। উত্তর দিত না রঞ্জিতও। রাতে যখন দুজন একে অন্যের বুকে নিজেদের চিরকালীন আবাস খুঁজে বেড়াত তখন মাঝেমধ্যে এসব কথার প্রেক্ষিতে একটা অদ্ভুত হাসি উঠে আসত দুজনের মনেই।
যেবছর স্মিতা আর রঞ্জিতের একমাত্র ছেলে রোহিতের জন্ম হল সেবছরই আবার রঞ্জিতের মা-ও দেহ রাখলেন। সেইসময় থেকেই খরচের হিসাব আরও বাড়িয়ে দিল রঞ্জিত-স্মিতা দুজনেই। সবকিছু মিলিয়েও সময়টা ভালোই চলে যাচ্ছিল দম্পতির। রোহিতও একটু একটু করে বড় হচ্ছিল। ছেলের টীকাকরণ থেকে শুরু করে তার খাওয়া-দাওয়া কোথাও কোনও ত্রুটি রাখেনি রঞ্জিত আর স্মিতা। রোহিতকে তারা ভর্তিও করেছে নামী এক ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে। নিজেরা যা পায়নি রোহিতকে তাই দেওয়ার স্বপ্ন ছিল স্মিতা-রঞ্জিতের। তার জন্য নিজেদের জীবনে আরও কিছু ত্যাগ নিয়ে এসেছিল দুজনেই। মাল্টিপ্লেক্সে কোনওদিন সিনেমা দেখা হয়নি স্মিতা-রঞ্জিতের। অশোকদা পারলেও রঞ্জিত নিজের ফ্ল্যাটে এয়ার কন্ডিশনার লাগানোর কথা স্বপ্নেও বোধহয় ভাবেনি। হয়নি কোনও সুদূরে বেড়ানোও। একবার দীঘা আর একবার পুরী। রোহিতকে নিয়ে এই দুটি জায়গায় কেবল যেতে পেরেছিল এই দম্পতি। কিন্তু বাড়িতে সবজি দিতে আসা ছেলেটি থেকে শুরু করে পাড়ার দোকানদার অসিতদা পর্যন্ত সবারই একই কথা, ‘বৌদি আপনারা আবার দরদাম করেন কেন?’ রঞ্জিতের একটি প্রোমোশন হওয়ার পর তো এই কথাটা মোটামুটি সর্বজনীন হয়ে উঠল।
করোনার প্রথম ঢেউ যখন আছড়ে পড়ল লকডাউনে তখন কিছু সময় অফিস বন্ধ থাকায় বাড়িতে ছিল রঞ্জিত। অনেকেই তাতে চোখ টাটিয়েছে। এই সময়ও কিন্তু অফিসের নির্দেশে বাড়ি বসে কিছু কাজ করতে হয়েছে রঞ্জিতকে। সেটা জনসমক্ষের অগোচরেই রয়ে গেছে। তারপর রোস্টার অনুযায়ী ডিউটি এবং ক্রমে অফিস আওয়ার্স আবার প্রায় স্বাভাবিক হয়ে উঠল। শুধু তাই নয় বছর ঘুরতেই ইলেকশন ডিউটিতেও ডাক এল রঞ্জিতের। ফার্স্ট পোলিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করল সে। নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক উত্তেজনা ছিলই। রোহিতকে আঁকড়ে ধরে স্মিতা শুধুই প্রার্থনা করে গেছে তার ঘরের মানুষটা যেন অক্ষত শরীরে ফিরে আসে। ফিরে এল রঞ্জিত। অক্ষত দেহেই। কিন্তু তার কিছুদিন পরেই রোগশয্যায় বিছানা নিল। রোহিতকে কিছুদিন আগেই স্মিতার বাবা এসে তার বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু স্মিতা যায়নি। টেস্ট হল। রঞ্জিতের রিপোর্ট এল করোনা পজিটিভ। সেইসঙ্গে দ্রুত অবনতি হল শরীরের। বেশী সময় দিল না রঞ্জিত। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া বা অক্সিজেন সিলিন্ডার এসে পৌছনোর আগেই শেষ নিঃশ্বাসটা আর ধরে রাখতে পারল না স্মিতার সরকারী কর্মচারী স্বামী।
নিদারুণ যন্ত্রণায় আইসোলেশনে কয়েকটা দিন কাটল স্মিতার। করোনার দ্বিতীয় থাবা তার শরীরে ছোবল বসায়নি। কিন্তু তার জীবনটা ওলট পালট করে দিয়েছে। অশোকদা এমনিতে যতই দুর্নীতি পরায়ণ হোন না কেন রঞ্জিতের প্রভিডেন্ট ফান্ড আর অন্যান্য প্রাপ্যের এপলিকেশন ফরোয়ার্ড করতে দ্বিধা করেননি। স্বামীর মৃত্যুর প্রেক্ষিতে একটা চাকরীর প্রেক্ষিতে তার অফিসে এপ্লাইও করেছে স্মিতা। কিন্তু করোনার আরেকটা ভয়াল প্রকোপে সবকিছু স্তম্ভিত হয়ে গেছে। স্বল্প সংখ্যক কর্মী নিয়ে কাজ চলেছে। সবকিছুতেই অনিশ্চয়তা, সবকিছুই সময় সাপেক্ষ। না, আর সরকারী কর্মচারীর বিধবা হিসাবে নিজের সুরক্ষিত ভবিষ্যৎ আর দেখতে পাচ্ছে না স্মিতা। রঞ্জিতের জমানো টাকা আর নিজের বাবার দেওয়া কিছু টাকাই এখন সম্বল স্মিতার। নিজের মত করে সাবলম্বী হতে চাইছে সে। যতদিন না রঞ্জিতের অফিস থেকে কোনও সদর্থক উত্তর আসে ততদিন নিজেকেই লড়াই করে যেতে হবে। নিজের সবটুকু সামর্থ দিয়ে অনলাইনে কয়েকটি বাচ্চাকে পড়াতে শুরু করেছে স্মিতা। এই করোনাকালে সেটাও রীতিমতো দুর্লভ। তাও সে কয়েকজনকে জোটাতে পেরেছে। রোহিতের পড়াশুনাও অনলাইনেই চলছে। তারও একটা বিশাল খরচ আছে। স্মিতা জানে না আর কতদিন সে রোহিতকে প্রাইভেট স্কুলে টিকিয়ে রাখতে পারবে। তাও লড়াই সে চালিয়ে যাবেই। জীবন থেমে থাকে না। সেদিনের সেইসব আত্মীয়দের আর টিকির দর্শনও পাওয়া যাচ্ছে না। একটা ফোন পর্যন্ত কেউ করেনি। তবে সেদিনও যখন পাড়ায় আসা সবজিওয়ালা ছেলেটির কাছ থেকে বেগুন কিনতে দরদাম করছিল স্মিতা তখন অভ্যাসবশেই ছেলেটা বলে ফেলল, ‘আপনি বৌদি বড় বেশী দরদাম করেন। আপনার আবার...’, এইটুকু বলেই স্মিতার মুখের দিকে তা্কিয়ে বড় করে একটা জিভ কেটে ফেলল ছেলেটা।
স্মিতাও শান্তমুখে বেগুনটা কিনে নিজের ফ্ল্যাটে উঠে যাওয়ার সময় পিছন ফিরে বলল, ‘আমার স্বামী সরকারী কর্মচারী ছিলেন। তিনি যখন জীবিত ছিলেন তখনও আমরা দুজনে মিলে আমাদের জীবন সংগ্রাম চালিয়েছি। আজ তিনি নেই, তাই আজ ওনার আর আমার দুজনের লড়াইটা আমি একাই চালাচ্ছি’। একথা বলেই স্মিতা সিঁড়ি দিয়ে ওপরে তার ফ্ল্যাটের দিকে উঠে গেল। কেউ এসময় স্টেয়ারকেসে না থাকায় স্মিতার দু’চোখের অশ্রুধারাকে উন্মুক্ত করতে কোনও বাধা রইল না।