পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

জারুলের পানে

  • 17 October, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 1634 view(s)
  • লিখেছেন : সোমেন বসু
জাতীয় সড়ক থেকে বাঁদিকে এই যে প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়কটা ঢুকে হারিয়ে গেছে দুপাশের সবুজ ক্ষেতখামারের মধ্যে ঠিক তার একটু আগে গাড়িটা থামাল শুভম। গাড়ি বলতে স্কুটি। পেছন থেকে আস্তে করে রাস্তায় নামল হিমু— হিমাদ্রি। খা খা পিচ সড়ক। ভাদ্রের ভরদুপুরের অক্লান্ত সূর্যালোক সেই সড়কের ওপর দিয়ে পিছলে যাচ্ছে। হেলমেটটা খুলতে খুলতে হিমু দেখল সামনে সড়কের ওপর জলরেখার মৃদু মৃদু কম্পন। মরীচিকা। বাঁকের মুখেই দাঁড় করানো পুলিশ জিপটা থেকে একজন খাকি উর্দি এগিয়ে এল ওদের স্কুটির দিকে। অফিসার না কনস্টেবল? মরুক গে! এই জিপ এবং তার ভেতরের মানুষগুলোর এই জায়গায় অবস্থিতি, অবাঞ্ছিত হলেও, গোচরে ছিল ওদের। --কোথায় যাচ্ছেন? --বন্ধুর বাড়ি। হেলমেটটা খুলে মাস্কটা নামাতে নামাতে বলল শুভম...

--উঁহু উঁহু... আঙুলের ইশারায় মাস্ক তুলে নিতে বলে অফিসারটি। নাকি কনস্টেবল? মরুক গে!

--বন্ধুর বাড়ি?? মানে আড্ডা!! এই সময়ে!

পেছন থেকে হিমু এগিয়ে এসে নিজের মোবাইল স্ক্রিনটা তুলে ধরল অফিসার নাকি কনস্টেবলটির চোখের সামনে। শুভম জানে ওটা শরতের রিপোর্ট। কোভিড পজিটিভ হওয়ার। তিনদিন আগে এসেছে। শুভমের মোবাইলেও আছে।

--কিন্তু কোভিড পেশেন্টকে দেখতে যাওয়া... অনিশ্চিত গলায় বলে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা জিপের দিকে তাকাল লোকটি। তার মানে অফিসার নয় বোধহয়। ঘাড় ঘোরাতে মাস্কের ফিতের ফাঁক দিয়ে গালের খোঁচা খোঁচা কাঁচাপাকা দাড়িগুলো নজরে এল এখন।

কিন্তু ঘাড় ঘোরালেও গাড়ির কারও থেকে কোনও পারমিশন নিল না লোকটা। তার মানে অফিসারই বোধহয়। আবার ওদের দিকে ঘুরে বলল—

--যান... কী আর বলব! রিপোর্ট হয়েছে যখন তখন তো হেলথের কাছে খবর আছে নিশ্চয়ই। সতর্ক থাকবেন। ওরকম মাস্ক নামাবেন না দুমদাম। ডিসটেন্স মেনটেন করবেন। বলেই যেন হঠাৎ নজরে এল তার। আরে আপনারা তো নিজেদের মধ্যেই ডিসটেন্স মেনটেন করছেন না। এক গাড়িতে যাচ্ছেন কেন?

ততক্ষণে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দিয়েছে শুভম। হিমাদ্রিও বসে পড়েছে পেছনে। ঢুকে যাবে প্রধানমন্ত্রী গ্রামসড়কে। দুপাশে থাকবে কচি কচি ধানগাছগুলো। বাঁকটার মুখে দাঁড়িয়ে দেখবে ঝাঁকড়া প্রাচীন পাকুড়গাছটা। এই পাকুড়ে অনেক পাখি থাকে। আরও অনেকেই থাকে নিশ্চয়ই। স্কুটিটা বাঁ দিকে ঘুরে যখন রাস্তার ওপরে ছড়িয়ে থাকা পাকুড়ের ভাঙা ভাঙা ছায়াটা পার হচ্ছে তখন হিমু ঘাড় ঘুরিয়ে পুলিশটিকে বলল—

--কিনতে গেছিলাম। বন্ধ তো! লকডাউন।

২.

--কেমন দেখেই ট্যালেন্ট চিনেছিলাম, বল? এসব জহুরির চোখ ওস্তাদ!

কমন রুমের একপাশে মুখোমুখি একজোড়া বড় বেঞ্চ। সেখানে বেশ ভিড়। আর তার মধ্যে মধ্যমণি হয়ে বসে নাটকা ওরফে বিচকে ওরফে দেড় ফুটিয়া। এখন ফার্স্ট ইয়ার। পরের বছর এইসময় ও কলেজের জিএস হবে। কিন্তু ওখানে যার সত্যিকারের মধ্যমণি হওয়ার কথা সে বসে আছে নাটকার পাশে, বেশ গুটিসুটি মেরে। শরৎকে তখনই বোধহয় প্রথম ভালো করে দেখেছিল হিমাদ্রি আর শুভম।

ভালো করে কথাটা প্রণিধানযোগ্য। একই ক্লাসে পড়ে যখন, আগেও নিশ্চয়ই চোখ পড়েছে ছেলেটার দিকে। কিন্তু চোখ-ই পড়েছে। দেখা হয়নি।

আর দেখল এই কিছুক্ষণ আগে পঞ্চাশ মিনিটের একটা স্পেলে। সেও তো ঠিক শরৎকে দেখা না। মনে হচ্ছিল, বিশেষ করে সেকেন্ড হাফের পঁচিশ মিনিট, একটা কালো বিদ্যুৎ যেন ছুটে বেড়াচ্ছে মাঠটার মধ্যে। এই অনুভূতি শুধু ওদেরই নয়, যারা খেলা দেখছিল, সবারই।

কলেজের ফুটবল টুর্নামেন্টের ফাইনালে থার্ড ইয়ার সিভিলকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হল ফার্স্ট ইয়ার মেকানিকাল। থার্ড ইয়ার সিভিল শুধু সিনিয়র টিম, তিন বছর ধরে একসঙ্গে খেলছে বলেই নয়, ওরা আগের দু বছরের চ্যাম্পিয়ন, ওদের টিমের তিনটে প্লেয়ার ডিসট্রিক্ট খেলে, মানে সব মিলিয়ে একটা অপ্রতিরোধ্য প্যাকেজ। অন্তত আজকের ফাইনালটার আগে পর্যন্ত তাই তো ছিল। সেই টিমটাকে একা শেষ করে দিল কে এক শরৎ মুর্মু। সেকেন্ড হাফে। শূন্য-দুই থেকে তিন-দুই! দুটো গোল শরতের, আর একটা বাঁদিক থেকে তোলা মাপা সেন্টারে।

--কী ফুটেজ খাচ্ছে দেখ মালটা তখন থেকে! সিগারেটে একটা বড় টান দিয়ে বলেছিল শুভম। ওরা দাঁড়িয়েছিল একটু দূরত্বে। নজর ছিল ওদিকেই।

--সে তো ওর কাজ ও করবেই। কিন্তু ছেলেটার সঙ্গে আলাপ করতে হবে রে। ওর ফ্যান হয়ে গেছি। বলেছিল হিমু।

সেই আলাপ করার তাড়নাতেই পরেরদিন টিফিনের সময় শরতের পিছু পিছু বেরিয়ে আসা। হিমাদ্রি আর শুভম বাল্যবন্ধু। একই স্কুল। বাড়িও খুব দূরে নয়। কিন্তু শরৎ যাচ্ছে কোথায়? রোজই কি যায়? এই সময়ে?

--শরতের সঙ্গে প্রথম আলাপটা মনে আছে তোর? স্কুটি চালাতে চালাতে জিজ্ঞেস করল শুভম।

--থাকবে না? সেই ওর জারুল গাছ। আমাদের জারুল গাছ...

উত্তর দিতে দিতে হেলমেটটা খুলে নেয় হিমাদ্রি বসে বসেই। না দেখেও টের পায় শুভম। গাড়িটা দাঁড় করিয়ে দেয় স্টার্ট বন্ধ না করেই।

--ভালো করেছিস। এ রাস্তায় আর হেলমেটের দরকার পড়বে না। মাথাটা চেপে থাকে একেবারে...

--তুইও খুলবি? যদি রানিং জিপ-টিপ আসে?

--থাকছে তো সঙ্গেই। বলব এইমাত্র খুলেছি। একটেরে রাস্তা… একটু পেছনটা নজর রাখিস, এলে দেখা যাবে।

সেদিন শরতের পিছুপিছু গিয়ে ওরা পৌঁছেছিল সেই জারুলের তলায়। কলেজে ঢোকার রাস্তা থেকে বেরিয়ে ডানদিকে গেলে মেন রোড। শরৎ সেদিকে না গিয়ে ঘুরে গেছিল বাঁয়ে। এদিকে একটা বড় দীঘি। তার পাড়ে বড় বড় গাছ আর ঝোপঝাড়। সাপখোপের ভয়ে শুভমরা আসেনি কোনওদিন এদিকে। কেউই আসে না। দীঘিটাকে পাশ কাটিয়ে গলিপথ ঢুকে গেছে পাড়ার ভেতরে। তা দিয়েই লোকচলাচল। শরৎ কিন্তু এগিয়েছিল দীঘির পাড় দিয়ে। কিছুটা গিয়ে একটা বড় জারুলের তলায় বসেছিল আরাম করে। দেখে ওরা কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। ক্ষণিক দ্বিধা। এক্ষুণি যাওয়াটা কি ঠিক হবে? তারপর চলেই গেছিল পায়ে পায়ে।

--তোর সঙ্গে আলাপ করতে এলাম। হিমু বলেছিল।

শরৎ শান্ত চোখে হেসেছিল অল্প। কিছু শুকনো পাতা পড়ে আছে গাছতলায়। সেগুলোতে আদর করার ভঙ্গিতে হাত বুলিয়ে একটা সমান বসার আসনের মতো করে দিয়ে বলেছিল,

--হ্যাঁ, বসো না...

--তুমি-টুমি করিস না। একই ক্লাসের তো আমরা। বসতে বসতে বলেছিল শুভম।

তারপর চুপচাপ বেশ খানিকক্ষণ। শুভম-হিমাদ্রি কথা না পেয়ে, শরৎ কেমন আত্মস্থ হয়ে। কিন্তু চারপাশের একটা অদ্ভুত শব্দ আসছিল। কেমন খা খা করা শব্দ। দীঘির জলে কখনও মাছেদের হঠাৎ ঘাই মারা, কোনও কদমগাছ থেকে টুপ করে ফুল ঝরে পড়া, হঠাৎ কোনও নাম না জানা পাখির ডেকে ওঠা, কোনও কিছুর এ গাছ থেকে ও গাছে ঝুপ করে লাফিয়ে চলে যাওয়া— এই সব শব্দগুলোকে গিলে নিচ্ছিল চারপাশের ওই খা খা ভাবটা। নীরবতারও যে একটা শব্দ হয় সেদিনই প্রথম টের পেয়েছিল ওরা দুজন।

কিছুক্ষণ অমন থাকার পর হিমু কিছু একটা বলতে যেতেই ঠোঁটে ডান তর্জনী ঠেকিয়েছিল শরৎ। ফিসফিসিয়ে বলেছিল—

--চু-প। এই জারুলগাছটায় একটা কাঠবিড়ালি ফ্যামিলি থাকে। ওদের কাল বাচ্চা হয়েছে। আমি আজ আসার পর বলল আমায়। কথা বললে বাচ্চাটার অসুবিধা হবে...

৩.

দু ধারে ক্ষেত, শিশু ধানগাছ অল্প অল্প মাথা দোলাচ্ছে হাওয়ায়। তাল খেজুর নারকেল শিশু শিমুল ইতিউতি। আম-জামও দেখা যায়, তবে সেগুলো টোলার ধারে ধারে। মাঝখান দিয়ে কালো অজগরের মতো এই প্রধানমন্ত্রী গ্রামসড়কের আঁকাবাঁকা বিস্তার। ওরকম একটা বাঁক নিয়েই স্কুটিটা দাঁড় করাল শুভম। একটা ছাপড়া দোকান। এক গ্রামীণ প্রৌঢ়া মাটির উনুনে কাঠ ঢুকিয়ে ছোট্ট অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়িতে কী জ্বাল দিচ্ছে। সামনে মাটি দিয়েই একটু উঁচু বেঞ্চ মতো করা। তাতে ঠিক তিনটে বয়াম। দুটোতে দু ধরনের বিস্কুট, একটাতে বিড়ির প্যাকেট। এই জিনিসগুলোই ওদের অপরিচিত মস্তিষ্কে খবর পাঠাল হাঁড়িতে চা হচ্ছে।

দুটো বাচ্চা খেলছিল দোকানঘরটার একপাশে। আদুল গায়ে ধুলো মাটির প্রলেপ। এমনই, যে ওরা নড়াচড়া না-করলে মাটির মূর্তি মনে হতে পারত। নিজের ভাইপোটার ছবি হঠাৎই ভেসে উঠল শুভমের চোখের সামনে। এরকমই বয়স হবে।

শরতের দাদাদেরও তো দুটো ছেলেমেয়ে আছে! এখন মনে পড়ল। কী নেবে এখন এখান থেকে! লজেন্স-টজেন্সও নেই। বিস্কুট আছে। ও-ই নিয়ে যেতে হবে কয়েকটা।

হিমু উঠে পড়ল চায়ের গ্লাসটা হাতে নিয়ে। দোকানের পাশে রাস্তার ধারে বসে চা খাচ্ছিল আরও দুজন। হিমুরা দোকানটাতে ঢোকার পরই ওদের দেখেছে পাশের মাঠ থেকে উঠে আসতে। আমাদেরও দুটা চা দিয়েন গো— বলে ওখানেই বসে পড়েছিল রাস্তার ধারে ঘাসের মধ্যে। খালি গা, গামছা পরা, গামছার তলায় হাফপ্যান্ট। পায়ে হাঁটু অব্দি আর হাতে কব্জির খানিক ওপর অব্দি ধুলোমাখা। নির্মেদ শরীরে দড়ির মতো পেশিগুলো এখন এই চা খাওয়ার অবসরে খানিক জিরিয়ে নিচ্ছে। হিমাদ্রি গুটিগুটি গেল ওদের কাছে।

--ধান কেমন গো এবার?

--এখন তো কচি একেবারে। দেখছেন না কেমন লকলক করছে। গাবুর হোক, গর্ভ ধরুক, তখন নয় বলা যাবে...

--জল লাগে না, না এই ধানটায়?

--জল লাগবে না? জল ছাড়া কিছু হয় গো?

--উনি বোধহয় মাটির জলের কথা বলছেন...

--হ্যাঁ হ্যাঁ... মানে বৃষ্টির... একটু থতমত খেয়েছে হিমু...

--হ্যাঁ... প্রকৃতির যদি খুব রাগ না হয়, তাহলে এই ধানটার তো আকাশের জলেই হওয়ার কথা। এই হেউতি ধানেও যদি মাটি থেকে জল টানতে হয়...

--হবে হবে... দেখ না কটা বছর...

অন্য লোকটা আপত্তি করল না কথাটায়। চুপ করে গেল। তিনজনই। হঠাৎই একটা অস্বস্তিকর নীরবতা। হিমুই ভাঙল—

--হবে?

--আলবাত হবে। ফস করে একটা বিড়ি ধরাল লোকটা। আমাদের জলের খাই কম? মাটি আর কত জোগান দেবে! আর মাটি-খাল-বিল-পুকুরে জল না থাকলে আকাশ জল পাবে কুনঠি থেকে?

--সত্যি! পুষাটা করতে এখন...। এই লোকটার গলায় অত রাগ নেই। হতাশা।

--আগে এক লিটার তেল ঢাললে দশ-বারো বিঘা ভুঁই আরাম করে ছ্যাকা যেত। আর এখন? মেশিন চলতেই থাকে, জল আর বের হতে চায় না। তিন-চার বিঘা হলেও মেলা।

--আর ছাড়ো ওইলা আলাপ। ওই দেখো মুস্তাফা হাঁড়ি খুলছে...

--হ্যাঁ তাই তো... একটু ঠাহর করে বলে লোকটা। চ চ... আপনারাও যাবেন নাকি? দু গেলাস রস গলায় ঢেলে দুগগা বলে গাড়ি ছুটায়ে দেবেন। রোদটা লাগবে কম...

হাসল ওরা। শুভমও এসে দাঁড়িয়েছে। এখন রস মানে তাড়ি আসলে। তালের। ওরা অনভ্যস্ত, ফলে নেশা ধরে নেবে। গাড়ি নিয়ে উলটে পড়ে থাকার ষোল আনা চান্স।

--কিন্তু কোথায় কাকে দেখছেন আপনারা? শুভম জিজ্ঞেস করল।

লোকদুটো তখন মাঠে নামতে শুরু করেছে। সেখান থেকেই হতাশজন আঙুল তুলে বলল—

--ওই তো নৈঋত কোণে... চারটে তালগাছ দেখছেন না? দেখেন...

নৈঋত!! কাউকে না দেখে নিজেদের মুখদুটোই দেখল ওরা।

৪.

মেয়েদের বিনুনি বাঁধার মতো করে বাঁধা আছে দশ-বারোটা প্রমাণ সাইজের ইঁদুর। চার-পাঁচটা ঘাড় থেকে নেমে এল ওরকম ইঁদুরের কাঁদি। একজন একটা ঝুড়ি থেকে বের করে দিল কয়েকটা সাপের মতো কী জিনিস, কালো, মোটা মোটা, বড়, মৃতপ্রায়, মাঝেমাঝে শরীর ঝাঁকাচ্ছে কেউ কেউ। ওদের জিজ্ঞাসু চোখ দেখে একটু হেসে শরৎ বলেছিল—

--কুচে। দেখিসনি কখনও?

--মাছ?

--মাছ বলে, তবে মাছ নয়, সরীসৃপই হবে...

--ও... চিংড়ি যেমন মাছ!

জায়গাটা বেশ কলকল করছিল তখন। নানা বয়সি নারী-পুরুষ-শিশুদের ভিড় আর অপরিচিত ভাষার হাসি-আমোদমিশ্রিত সংলাপগুচ্ছ। শরৎদের বাড়িটার পাশেই একটা বড় বটগাছ আর তার তলায় ফাঁকা পরিষ্কার চত্বর। পরিষ্কার মানে পরিষ্কার, সাফসুতরো। শরৎ বলেছিল রোজ নিয়ম করে ঝাঁট দেওয়া হয়। কেউ না কেউ দেয়। দশের জায়গা তো। ভাগের মা-র গঙ্গাহীনা হওয়ার বরাত সর্বত্র নয়!

--শরৎদের গ্রামের শিকারের কথা মনে আছে তোর?

আবার জিজ্ঞেস করল শুভম। এখন ও পেছনে বসেছে, হিমু চালক। হিমু বুঝল শরতের নানা কথাই শুভমের মাথায় ঘুরছে। এক-একদিন হয়। একটা গানের কলি ঘুরতেই থাকে মাথার মধ্যে। আর সেটা গুনগুনাতে আরাম হয় বেশ।

এখন ওদের দুজনেরই না হেলমেট, না মাস্ক। বাতাস বইছে। হয়তো সে বাতাসে মিশে রয়েছে এক অর্বাচীন ভাইরাস। সে বাতাসবাহী নয় অবশ্য। কিন্তু নয় জোর দিয়ে বলা যায় কই! হয়তো কদিন পর শোনা যাবে। এখনও যে কানাঘুষো শোনা যায় না মাঝেমাঝে তা তো নয়! আসলে সবাই এত কম জানে এর সম্বন্ধে! আর যেটুকু জানে, সেগুলো জানানোর মধ্যে মিশে থাকে এতরকম উদ্দেশ্য— শুভমের প্রশ্নটা এল যখন এসবই ভাবছিল হিমাদ্রি।

--কুচের ঝোল। আমি ওই একবারই খেয়েছি জীবনে...। হঠাৎ নিঃসৃত কিছু লালারস গলার দিকে টেনে নিল হিমু।

শুভমও। হিমুর মতো ওরও চোখের সামনে ভেসে উঠেছে টকটকে লাল ঝোলের মধ্যে ভাসমান কালো কালো পাইপের টুকরোর মতো কুচের টুকরোগুলি। এরা পাঁকের মধ্যে থাকে, কোঁচা বলে বল্লমের মতো একটা অস্ত্র সেদিনই দেখেছিল ওরা, সেই দিয়ে মারতে হয় নাকি এদের। শুনেছিল দুই শহুরে যুবক। দেখেছিল কাটার আগে অদ্ভুত কায়দায় পুরো ছালটা ছাড়িয়ে নেওয়া হয়েছিল প্রাণীটার। ছালটা নাকি খায় না।

--এই শিকার ব্যাপারটা কী?

তখনও ফেরেনি শিকারীবাহিনি। শরৎদের বাড়ির যে-পাশে ওই বটের ছায়াঘেরা চত্বর, তার উল্টোদিকে আলপথ ধরে একটু হেঁটে গেলে একটা নদী। ক্ষীণকায়া, তবে স্রোতস্বিনী। নদী তো! নাম না থাকলেও, মানচিত্রে না থাকলেও। শরৎ বলেছিল ওরা ডাকে ঝুমরি বলে, হয়তো অন্য গ্রামে অন্য নাম। সেই ঝুমরির পাড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল ওরা ওকে।

--হয় আমাদের। মাসে দুমাসে একবার করে। আদিম স্মৃতি ঝালিয়ে নেওয়া...

--বাঁচিয়ে রাখাও বলা যায়...

হেসেছিল শরৎ। যেমন হাসে। শব্দহীন।

--তুই যাস না?

--যাই তো! কলেজে থাকলে যাওয়া হয় না, আর আজ যাইনি তোরা আসবি বলে।

যা যা মারা হয়েছিল সব কিছুই ভাগ হয়েছিল সমান করে। কে কতগুলো প্রাণীহত্যা করেছে সেটা আলোচনা তো দূরস্থান, কারও মাথায় আছে বলেই টের পাওয়া যায়নি। যা আনা হয়েছে সবই দশের, সবেতেই সবার হক। সেদিন টোলার সব বাড়িতেই মাংস।

ভাগবাঁটোয়ারা হয়ে-টয়ে চত্বরটা ফাঁকা হওয়ার পর সিগারেট খেতে খেতে জিজ্ঞেস করেছিল শুভম—

--হ্যাঁ রে শরৎ, এই যে তুই বললি শিকারেও যাস, আবার আমাদের সেই জারুলগাছে কাঠবিড়ালির বাচ্চা হয়েছে বলে কথা বলতে না করিস— কোনটা ঠিক রে?

শুভমের স্বভাব আছে মাঝেমাঝে এরকম কূট প্রশ্ন করার। এই এখন যেমন স্কুটির পেছন থেকে হঠাৎ বলে উঠল—

--একটা জিনিস খেয়াল করলি হিমু? ওই যে চায়ের দোকানে লোকদুটোর সঙ্গে অতক্ষণ কথা বললি, একবারও কিন্তু করোনার কথা উঠল না!

শরৎ সেদিন খানিক অবাক হয়ে বলেছিল—

--ওমা! একটা ঠিক হলে অন্যটা বেঠিক কেন হবে! সম্পর্ক তো এরকমই!

আজ হিমাদ্রি বলল—

--পৃথিবীর পরের প্যান্ডেমিকটা হবে জলকষ্ট। আর তার কোনও ভ্যাক্সিন হয় না।

৫.

প্রথম দেখা হল হপনগোর সঙ্গে। শরৎদের বাড়ির বাইরেই।

--তোদের ভাষায় কাকিমাকে কী বলে শরৎ?

--হপনগো।

একটু হেসে বলেছিল শরৎ। যেমন হাসে। তারপর বুঝিয়ে দিয়েছিল—

--গো হল মা, আর বা বাবা। আর ওদিকে মারাং হল বড়, হপন ছোট। সেই হিসেবে মেলা এবার...

--তার মানে কাকা-কাকি হপনবা-হপনগো? গলায় একটা খুশিমিশ্রিত উত্তেজনা নিয়ে বলেছিল শুভম।

--আর মারাংবা-মারাংগো জেঠা-জেঠি... হিমুও শিক্ষার প্রমাণ দিয়েছিল।

--ব্যস! শিখে গেলি সাঁওতালি ভাষা...

হেসেছিল। তিনজনেই। সেই জারুলের তলায় বসে।

উঠোন ঝাঁট দিচ্ছিল হপনগো। ওদের দেখে একটু চমকাল। তারপর এক গাল হেসে বলল—

--ওমা! তোরা এলি এর মধ্যে!

উঠোনের দুই পাশে দুটো ঘর। মাটির। মাথায় খড়। উঁচু বারান্দা। অদ্ভুত নিপুণ নির্মাণ। আকাশী আর কালো রং করা আবার। এ পাড়ার সবকটা বাড়িই এমন। সেই দুটো ঘর থেকে দুটি যুবতী তুর তুর করে বেরিয়ে এল হপনগোর কথা শুনে। শরতের দুই বৌদি। হিলি। ওদের ভাষায়। শুভম-হিমু জানে এটাও। বড় বড় দুটো স্টিলের ঘটিতে জল এল আর একটা লাইফবয় সাবান। খুব করে হাত ধুল ওরা কনুই অব্দি। মাস্ক দুটো পরে নিয়েছিল টোলায় ঢোকার সময়েই। জল আবার এল। এবার খাওয়ার জন্য। একপাশের বারান্দায় পাটি বিছিয়ে দিয়েছে এক হিলি।

--তার খবর কী? ঢক ঢক করে অনেকটা জল খেয়ে হিমু শুধোল শরতের মাকে।

--ওই তো খবর। গাছে উঠেছে।

বাড়ির পুবদিকে একটা গাছের দিকে তাকাল হপনগো। জারুল।

ওরা গেল গাছের নিচে। দু-তিনটে বড় ডালের ফাঁকে বেশ সুন্দর করে কয়েকটা লম্বা তক্তা দিয়ে পাটাতন বানানো হয়েছে একটা। একটা পূর্ণদৈর্ঘ্যের মানুষ অনায়াসে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়তে পারবে। ডালগুলো এমনভাবে গার্ড দিয়ে রয়েছে যে খুব উল্টোপাল্টা না হলে ঘুমের ঘোরে পাশ ফিরলে যে পড়ে যাবে, সে ভয়ও নেই। একটা পাশে একটা বড় কালো প্লাস্টিক গুটিয়ে রাখা। সেটারই একটা পাশ মাচাটার ওপরে পাতা-টাতার মধ্যে দিয়ে একটু টানটান করে আচ্ছাদন মতো করা। বৃষ্টিবাদলের ব্যবস্থা, বোঝা গেল। গুটিয়ে রাখা অংশটা দিয়ে নিশ্চয়ই সামনেটাও ঢেকে দেওয়া যাবে। পাটাতনে একটা চাদর, কয়েকটা খড়ের আঁটি, এমনকি একটা বইও দেখা যাচ্ছে। শরতের কোয়ারেন্টিন সেন্টার।

নেমে এল শরৎ। ওর গায়ে গাছ-গাছ গন্ধ। চোখদুটো জারুল ফুলের মতো বেগুনী।

--গাছে উঠে পড়লি কেন?

--কী করতাম! দুটো তো ঘর। দুই দাদার বিয়ে হয়েছে। বাচ্চাগুলো আছে। বাবা-মা তো বারান্দাতেই শোয় বরাবর। আমিও তাই শুতাম। কিন্তু তাতে তো কোয়ারেন্টিন হয় না।

--এদিকে এই যে এতটা এলাম, খুব একটা করোনার হালচাল চোখে পড়ল না কিন্তু। বাধালি কী করে তুই?

--টাউনে একটা ব্যাচ পড়াতে যাই তো সপ্তাহে একদিন করে। ওখান থেকেই ঢুকল মনে হয়।

--এমনি শরীর কেমন লাগছে?

--দুর্বল। এছাড়া আর কিছু না। দুদিন জ্বর ছিল। তারপর আর নেই।

শরৎ মাস্টারি করে। গ্রামেই পড়ায় বেশি। তার সঙ্গে চাষবাস। পলিটেকনিক পড়াটা আর কাজে লাগেনি। এখানে কাজ কই? বড় শহরে গেলে হয়তো ছোটখাট কিছু জুটত। তার চেয়ে এই ভালো। শুভমরা এএমআইই করছে। তাতে ওই ছোটখাট-টা আর একটু বড় হতে পারে। সেই আশাতেই ঘষটানো। শরৎ আর পড়েনি।

দেশি মুর্গির ঝোল দিয়ে ভাত খাওয়া হল রাতে। শরৎ আলাদাই খেল। জারুলের তলায়। তারপর তিন বন্ধু গিয়ে বসল ঝুমরির পাড়ে। শারীরিক দূরত্ব মেনে।

সেই নীরবতাটা এখন চারিদিকে। শহরের দুই যুবক অনুভব করল। ঝিঁঝিদের অর্কেস্ট্রা বসেছে, একটা হাল্কা হাওয়া দিচ্ছে, সেই হাওয়ার শব্দ উঠছে ঝুমরির অল্প জলে তির তির করে, বাঁশঝাড়ের মধ্যে সর সর করে, কচি ধানগাছগুলোর মাথায় ফির ফির করে, সেই হাওয়ার মধ্যে মিশে রয়েছে কিছু বুনো ফুলের মৃদু মাদক গন্ধ— এই সব মিলিয়ে এক চরাচর ব্যাপী একটা অখণ্ড নীরবতা। শরৎ দু-একবার কথা বলল। ওদের ওদিকে করোনার প্রকোপ কেমন, পড়াশোনা কেমন চলছে এরকম খোঁজ নিল আলগোছে, আর শুভম-হিমু অনুভব করল শরতের কথাগুলো ঝিঁঝির ডাকের মতো। এই নিঝুম নীরবতাটাকে বিন্দুমাত্র কষ্ট দিচ্ছে না তার গলার স্বর, বরং অঙ্গীভূত হয়ে যাচ্ছে তাতে। শরতের জিজ্ঞাসার উত্তরে হুঁ হাঁ দিয়ে কাজ চালিয়ে দিল ওরা। পাছে বিরক্ত হয়— এই আকাশ, এই ধানক্ষেত, এই নদী, এই বাঁশঝাড়, এই শিমুল-জারুল, এই তিরতিরে হাওয়া, এই নীরবতা।

শেষ অব্দি বলেই ফেলল। আসলে শুভমের মাথায় অনেকক্ষণ ধরে ঘুরছিল বিষয়টা।

--হপনগো এমনভাবে বলল তুই গাছে উঠেছিস, যেন অন্য ঘরে বা অন্য বাড়িতে গেছিস...

--হুঁ... ওরকমই... একটু হাসল শরৎ।

হল না বিরক্ত। মিশে গেল শুভমের কথাগুলোও এই নীরবতার মধ্যে। একটা তৃপ্তি পেল শুভম— হিমুও।

তারপর সারারাত বসে রইল তিন বন্ধু ঝুমরির পাড়ে। টুকটাক কথা বলছিল। বেশিটাই চুপ। শরৎ মাঝে মাঝে শুয়ে পড়ছিল ঘাসের মধ্যেই।

সকালে উঠে টোলার লোকরা দেখল ঝুমরির পাড়ে তিনটে শিশু জারুলগাছ।

0 Comments

Post Comment