কারবারে লাভ-লোকশান যাইই হোক মুখে একটা বাড়ি ফেরার সুখ লেগে থাকে সবসময়। কিন্তু আজ সেসব উধাও। সাদিয়াও অবাক! সূর্য কি আজ পশ্চিমে উঠেছিল! এত ব্যাটাবিটির জান ফাপড়ালেও যে মিনসে বেলা থাকতে বাড়ির ছমু হয় না। বলতে গেলেই বলে, ‘সাথে করি ব্যালা আনলে প্যাট চলবে? প্যাটের লেগি টাকা উজগার করি আনতে হয়।‘ সে মানুষ আজ বলা নেই কহা নেই হুট করে অবেলায় বাড়ি! বাইকের ডাবলস্ট্যান্ডটা যেই বুকের ভর দিয়ে ঘুত করে তুলে দাঁড় করাল অমনি সাদিয়া বলল, “কী গ আজ এত্ত আগাড়ি! লাড়ার গাড়ি আসিনি খ নাকি?”
“আর লাড়া এসি কী করবে? আমরাই লাড়া হয়ি যেচি কি না দ্যাখো।“ দুম করে বাজল জানিফের কন্ঠ। সাদিয়া তার কটাঝটা ভ্রূগুলো কুঁচকাল! স্বামীর কথার আগাগোড়া কিছুই বুঝল না। তবে কি মহাজন আজ ঝেপে দিয়েছে! না কোনো গাহাক টাকা না দিয়েই কেটে পড়েছে! না কি কোনো পাওনাদার গেরস্ত সুযোগে পেয়ে পকেট ফতুর করে দিয়েছে! হাবিজাবি অনেক কিছুই সাদিয়ার মাথায় খেলল। কিন্তু সেসবের কোনো কিছুই উগরালো না। উল্টে গালে একটা মিহি টোল ফেলে মশকরা করল, “লাড়া কী গ, আমরা তো কবেই খড়ি হয়ি গেছি। দেখচ না, ব্যাটাবিটিগুলেনের শরীলগুলান ক্যামুন পাটকাঠি!”
“ইবার ভুষি হয়ি যাবে।“ টং করে উঠল জানিফ। তারপর ফিসফিস করে বলল, “আচ্চা, তুমার বাপধের তো জমিজমা সেরকম কিছুই নাই। ভিটেটা তো লিজের নাকি? নাকি উডাও খাস?”
বাপদের জমি! ভিটে! এত বছর পর আবার ওসবের খোঁজ কেন! যা ভাগাবাটি করে পাওয়ার তা তো কবেই আব্বা দিয়ে দিয়েছে। কোনো বিটিকেই ঠকায়নি। বরং আমাকেই অন্য বোনদের তুলনায় কিছুটা বেশি জমি দিয়েছে। এই পাকুড়তলার ভিটেটা। দেড় কাঠার আউশে মাটি। নুরুর বাপ তো পড়ে পাওয়া জামাই। দ্যাশ দুনিয়ার ঠিক ঠিকানা ছিল না। কোত্থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেছিল। ভালো খেটনে ছিল বলে আব্বা ধরে বেঁধে বিয়ের কলেমা পড়িয়ে দিয়েছিল। ভেবেছিল, আজকালকের দুনিয়াই বাপ-মায়ের কী দরকার? ছেলে তো খাটনে? ঠিক গায়ে গতরে খেটে চালিয়ে নেবে। জানিফের কথাটা ধোঁয়ার মতো পাক মারতেই সাদিয়া বলে বসল, “ক্যানে এত্ত দিয়েও তুমার প্যাট ভরেনি?” জানিফ সাদিয়ার দিকে খুঁটল চোখদুটো তুলল। ভাবল, সাদিয়া নিশ্চয় তাকে ভুল কিছু বুঝছে। ফোকলা দাঁত বের করে বলল, “তুমি যা ভাবচ ওসব কিচ্চু লয়। আমি ওসব লিয়ালিয়ির কথা বুলচি নে।“
“তাইলে হুট কইরি জমিজমার কথা জিজ্ঞাসা কচ্চ ক্যানে?”
“বিপদ! দ্যাশে বিপদ আসচে তাই।“
“বিপদ! কীসের বিপদ?” ভ্রূ টান করল সাদিয়া। তারপর মিনমিন করে বলল, “বিপদ কি আজ লতুন গো। বিপদ আপদ লিয়িই তো বেঁচি আছি। অ্যাখুন না হয় সংসারে দুটে সুখ এসচে। অ্যাকদিন অ্যামুনও তো ছিল, না খেয়ি রাইত কেটিচে। এক গাদলের পানিতে রসি রসি ঘরের দ্যাওয়ালডা হুড়মুড় করি ভেঙি পল্লো! সে মত্তে মত্তে কুনুরকমে আল্লার হেদায়তে বাঁচনু! নুরু ত্যাখুন সাত মাসের প্যাটে। পোথম ব্যাটাডাখেও আল্লা মরণ রোগ দিয়ি কেড়ি লিলো। আমার কোল খালি করি আল্লা কী সুখ যে পালো!”
“তার থেকিও বড় বিপদ।“ জানিফের কালো কষটে মণিদুটো ঘোলা হয়ে উঠল।
“মায়ের কোল থেকি জলজ্যান্ত ছেলি মরি গ্যালো! অ্যার থেকিও বড় আজাব কি আর ই জম্মে হয় গ?”
“অ তো একটা ছেলি। যদি গুটা গুস্টিই কবরে চলি যায়, তবে?” পিয়ারা গাছের মতো দোআঁশলা মুখটা বাবলা গাছের গুঁড়ির মতো কালো কেশটে হয়ে উঠছে জানিফের। দড়ির মতো কেমন পাকিয়ে যাচ্ছে জানিফ। আজ খ্যাতালেই কথাটা শুনল। এতদিন টুকটাক শুনছিল। অনেক ফিসফিসানিও কানে আসছিল। ওসব ‘হুজুগ’ বলে পাত্তা দেয়নি। কিন্তু আজ মাথায় বাঁশ পড়ল যখন বুটাডাঙার সামসুল গেরস্ত কথাটা পেটো সূঁচের মতো করে বলে তার মগজে হেঙ্গে দিল। আজ সামসুল হাজির বাড়িতেই নাড়া তুলছিল জানিফ। জানিফ পায়কারি দরে গেরস্তের কাছে নাড়া কিনে গাঁয়ে গাঁয়ে ফেরি করে। একতলা বাড়ির সমান উঁচু করে আধখানা গাড়ি সাজানো হয়েছিল সদ্য অমনি সামসুল মণ্ডল জানিফকে ডেকে বলল, “জানিফ, ইবার তো তুমার জিদ ছাত্তে হবে। সব রাগ অভিমান পানিতে ভাসি দিয়ি বাপ-দাদোর ভিটেয় ছুটতে হবে।“
“অমুন উচ্ছেন্নি কথা বুলছেন ক্যানে গ চাচা! আপনি তো ভালোই জানেন উ বাড়ি কবেই হারাম করি দিইছি।” জানিফ আকাশ থেকে পড়েছিল। মেজাজ কিছুটা খচেও গিয়েছিল তার। বাপ-দাদোর বাড়ির কথা বললেই তার মাথা বিগড়ে যায়। সে তওবা করেছে জান থাকতে বাপের ভিটে ছমু হবে না। সামসুল হাজী তার মাথার ফেজ টুপিতে ফুঁ দিয়ে বলেছিল, “হারাম করি দিলেই কি সব হারাম হয়ি যায় গ। যে বাপ-মা এই দুনিয়াই জন্ম দিয়ছে তারা কখুনও হারাম হয় না। অমুন কুফরি কথা আর বুলো না। আল্লা বিরাগ হন।“ তারপর মিনমিন করে ‘আসতাগ ফেরুল্লা’ পড়তে পড়তে সামসুল বলেছিল, “মুসলমান জাতটাই যে উচ্ছেন্নে যাতে চলেচে গ। দ্যাশের সরকার মুসলমান খ্যাদাও আইন আনচে। এনআরসি।“ তারপর তার লম্বা সূঁচালো দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে বলেছিল, “বংশের শেকড় ঢুঁড়ো গা। বাপ-দাদোর জমির কাগজ। পিরির পিরির পোমান। যত্ত পুরেনু কাগজ হয় তত্ত ভালো। তুমি তো বাপ, বাড়ি ছেড়ে পালানে মানুষ। তুমাকে তো তুমার বাপ-দাদোর ভিটেয় যাতেই হবে।“
“ওসব কিচ্ছু হবে না। হুজুগ।“ কথাটা আলগা করে যেই বলেছিল জানিফ অমনি তড়াক করে উঠেছিল সামসুল, “তাইলে টাকা বাতিল ক্যানে হল? তখুনও তো মেল্লা লোকে বুলিছিল ‘হুজুগ’। শেষমেশ সেই ঘরের পুঁটলা-পুঁটলির ভেতর সাঁদি থুয়া টাকাগুলেন লিয়ি ব্যাঙ্কে ছুটতে তো হল? কুনু লোকে কি কিছু কত্তে পেরেছিল? নোটবাতিলের মুতন এই লতুন ফ্যাকড়াডাও ঠিক ঘাড়ে চাপলো বুলি।“ আর বেশি কথা খুঁড়তে হয়নি। হাড়ে মাংসে টের পেয়ে গেছিল তাকে কী করতে হবে। ব্যাজার মুখে আর খ্যাতালও যায়নি জানিফ। সোজা বাড়ি ফিরে এসেছিল।
গুটা গুষ্টি! চোখ ঢ্যালা হয়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম হল সাদিয়ার। ফিসফিস করে বলল, “বাপধের আর জমি কই। থাকা বুলতে গ্যালে ওই বাস করা ভিটেটুকুনই আছে। আগে খাস ছিল। পরে দালাল ধরি বগগা করি লিয়েছে। কাগজপাতিগুলেনও বড়ভাইয়ের হেফাজতে। তাতে বিপদ কৈত থেকি আলো?” মনের প্রশ্নটা ঝেরে বললেও স্বামীর ঢুঁড় ঢুঁড় মন আর পানসে মুখ দেখে মনে সকুন এল না। ভেতর নিংড়ে আবারও জিজ্ঞেস করল, “গুটা গুষ্টি কী অ্যামুন পাপ কল্লো যে কবরে চলি যাবে?” জানিফ আপন খেয়ালেই বকে গেল, “তুমার ভোটের ছবি আধার কাড রেছন কাডের সব জাগাতেই তো পরিবারের পোধান হিসেবে আমার নাম আছে। তাই তো?”
“হ্যাঁ।“ মাথা হেলাল সাদিয়া। জানিফ বলল, “তাইলে তুমি কার বিটি তার পোমান এসবে নাই খ। এসব মাগ-ভাতারের নাড়াবাঁধা কাড। তুমার বাপের নাম থাকা বুলতে গ্যালে, শুদু এই বাড়ির জমির দলিলেই আছে। বাপ-বিটির একমাত্র বংশের লতি।“ সাদিয়ার দেওয়া পানির গেলাস থেকে ঢগঢগ করে পানিটা পান করে একটা শুকনে ঢেকুর তুলল। তারপর মনে মনে বিড়বিড় করল, একটা হলে কী হল, অতেই ফাঁদ গলা যাবে। কিন্তুক আমি? আমার কী হবে? আমি যে সাদিয়ার স্বামী সে পরিচয়ে তো আর ফাঁদ গলা যাবে না? তার জন্যি লাগবে, আমার বাপ-দাদোর জন্ম লতি। নাড়ির যোগ। এ ফাংড়ি ও ফাংড়ি দিয়ে বংশের শেকড়ে ফেরা।
“কতদিন বাড়ি যাইনি!” খেয়ালি হয়ে উঠল জানিফ।
“বাড়ির কথা য্যাখুন এতই মুনে পচ্চে তো যাও না দুদিনকার লেগি ঘুরি আসো গা।“ বুকে এক জোর শ্বাস নিয়ে বলল সাদিয়া। স্বামীর মনে হুট করে জেগে ওঠা ইচ্ছেটাই তার ভেতরে একটা খুশি খুশি ঢেউ দোলা দিল। একটা ঢলঢলে আনন্দ শরীরের রগ-রক্তে নেচে উঠছে। আনন্দ কেনই বা হবে না? চার ব্যাটাবিটির মা হয়ে গেল। দুই নাতির নানি বনে গেল। একদিনও শ্বশুরবাড়ির মুখ দেখল না। যেটাই বাপের বাড়ি সেটাই শ্বশুরবাড়ি হয়েই থেকে গেল। শ্বশুর-শাশুড়ি, ভাসুর-দেওর, ননদ-জা যে কী জিনিস কিছুই বুঝল না। অর্ধেক পৃথিবীই তার কাছে অচেনা। কানের কাছে এতদিন ঘ্যানর ঘ্যানর করলেও বাপ ভাইদের কথা পাড়তে দেয়নি যে মানুষটা সে আজ যখন নিজে থেকেই বাড়ির কথা বলছে তখন আনন্দ না হয়ে কি আর থাকে?
দুই
ভাই বোনেদের জন্ম নেওয়া চার চালার খড়ের ঘরটা তো নেইই যে পুকুরটায় দু-বেলা গা পানিতে ডুবিয়ে পড়ে থাকতাম সেটাও আস্ত উধাও! কাদা-ধুলো পথঘাটগুলো সব পিচ কংক্রিটে মুড়ে গেছে। বাড়িগুলোও ঘাড়ে কাঁধে এঁটে ঘিঞ্জি। হালফিলের ছেলেমেয়েদের তো চেনা যাবেই না কিন্তু পুরোনো লোকগুলোকেও ঠিক ঠাহর করা যাচ্ছে না। আইনুদ্দি সেখকে দেখলাম গালের চামড়া মুড়িয়ে গেলেও চোখদুটো একই আছে। আজাদদের বাড়ির বারান্দাটা খাঁ খাঁ করছে। মনে হয় আজাদের বাপ মরজেম বিশ্বাস আর বেঁচে নেই। বেঁচে থাকার কথাও নয়। গ্রাম ছাড়া কি দু-দশদিন হল? পাক্কা তেইশ বছর। বাপজির সাথে স্কুল ছেড়ে গরু চরানো নিয়ে ঠুকমুক হয়েছিল। সে রাগেই বাড়ি ছাড়া। সম্মুখের নীমগাছটাকেও দেখছি নে। পুরোনো কোনো চিহ্নতই আর অবশিষ্ট নেই! কাউকে কি জিজ্ঞেস করব, প্রশ্নটা মাথায় খেলতেই আচমকা জানিফের চোখে পড়ল তাদের দু-মাথার খেজুর গাছটা! খেজুর গাছটা এখনও বেঁচে আছে! বিস্মিত হল জানিফ। ছোটবেলায় এই খেজুর গাছে যখন খাশপাড়ার লুজু গাছাল রসের হাঁড়ি পাততো তখন জানিফ এক কাতারি রসের জন্য নিচে দাঁড়িয়ে থাকত। আর যখন গাছে হাঁড়ি পাতা থাকত না তখন চাঁছি দিয়ে টসটস করে ঝরে পড়া রস জিভ বার করে খেত জানিফ। খেজুর গাছটার দুটো মাথা বলে জানিফদেরকে অনেকে ঠাট্টা করত, এদের বাড়ির ছেলেগুলোরও দুটো মাথা গজাবে। জানিফ নিশ্চিত হল আকাশি রঙের দোতলা গ্রিল লাগানো বাড়িটাই তাদের। গা’টা হেলে উঠল। ভেতরে একটা অদ্ভুত নাড়া দিচ্ছে। এ নাড়া আনন্দের। খুশির। এই আনন্দ তার পাদুটোকে আরও সচল করল। সদরগেটটার দিকে এগিয়ে গেল জানিফ। ঠকঠক করল গেট। ‘আসছি’, ভেতর থেকে ভেসে এল একটা মেয়ে মানুষের স্বর। জানিফ ঠিক বুঝে উঠতে পারল না, কন্ঠটার কার? সে অনেককিছুই আন্দাজ করল। অনেক হাবিজাবিও ভাবল। এমন সময় ‘খট’ করে লোহার পাল্লাটা হাট করে খুলে গেল! গেট আগলে দাঁড়াল বছর পঞ্চাশের এক ধুবসি মহিলা! ঘোমটাটা ভ্রূ পর্যন্ত ঝুলে আছে। গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামা। চোখগুলো টানা টানা। জানিফের মা পান সাজানোর সময় যে বড় আকারের পানপাতাটা সাজাত, মেয়েটির মুখটি সেই পানপাতার মতো। জানিফ আন্দাজ করল মেয়েটি নিশ্চয় হানিফভাইয়ের বউ। সেই আন্দাজ নিয়েই জানিফ বলল, “ভাবি, বড়ভাই বাড়িতে আছে?”
ভাবি! বড়ভাই! ভদ্রমহিলা বিস্ময়ের চোখে জিজ্ঞেস করল, “কেডা গো আপনি? কৈত থেকি আসচেন?”
“আমি জানিফ।“ বুকের সব বাঁধন খুলে কথাটা বেরিয়ে এল জানিফের। ‘জানিফ!’ ভদ্রমহিলা তখনও আন্দাজ লাগিয়ে যাচ্ছে। জানিফ বলল, “তুমি হানিফভাইয়ের বৌ তো?” ভদ্রমহিলা ঘাড় হেলিয়ে ‘হ্যা’ বলল। জানিফ বলল, “ভাবি তুমি আমাকে চিনতে পারবা না। তুমাধের বিহের আগেই আমি ই বাড়ি ছেড়ি চলি গেছুনু। হানিফভাইকে ডাকো, তাইলেই হবে।“ ভদ্র মহিলা জানিফের আপাদমস্তক বিস্ময়ের দৃষ্টি দিয়ে জরিপ করতে লাগল। কোথাও কি তার স্বামী হানিফের সাথে আগন্তুক লোকটির মিল-সাদৃশ্য আছে? নাকে-মুখে? থুতনির গড়নে? চোখের চাহনিতে? কিম্বা কথার ওঠানামায়? তারপর হুড়মুড় করে বাড়ির ভেতরে চলে গেল। একচিলতে উঠোনটা তার পায়ের এই নতুন চলনটা টের পেল। উঠোনটা থেকে কিছুটা ধুলো উড়ল। জানিফ ভাবল, বাপ-দাদোর জমির খোঁজ নিতে আসাই হয়ত বড়ভাই হানিফ বলবে, তা এত বছর পর তুই জমির ভাগ নিতে এসেছিস! সে হয়ত বুঝবে না, আমি জমিতে আবাদ করতে আসিনি। জমির কাগজ নিতে এসেছি, শুধু এটুকু প্রমাণ করবার জন্যে যে আমি আব্দুর রহিম সেখের সন্তান ছিলাম। জলিল সেখের নাতি। দোতলা বাড়ির দাওয়ায় নাড়ু হয়ে বসে থাকা এক থুত্থুরে বৃদ্ধাকে দেখেই জানিফের ভেতরটা ধড়াক করে উঠল! মা! তুমি বেঁচে আছো! জানিফ দু-ধাপ এগিয়ে গেল। অনেক বছর পর তার পায়ে ঠেকল জন্মভিটের মাটি। ধুলোগুলোও যেন আনন্দে ধেই করে উঠল। এই উঠোনে কতদিন হামি টেনেছে জানিফ। দুনিয়াদারির প্রথম হাঁটাটা সে এই উঠোনেই হেঁটেছিল। তার গা-গতর ঘষলে এখনও এই উঠোনের ধুলো-মাটি উঠে আসবে। দাওয়ায় বসে থাকা বৃদ্ধা জানিফকে লক্ষ্য করে ভারি চোখের পাতাদুটো তুলল। জড়ানো চোখ। ঘোলা দৃষ্টি। চামটা গালে সেটে আছে জীবনের শেষ পড়নের মাংস। মাথায় পেঁয়াজের শিকড়ের মতো উসকোখুসকো চুল। চুনের মতো তার রঙ। জানিফ যখন সদ্য প্রসব হয়েছিল তখন যে নাড়ির টানের দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়েছিল তার সদ্যজাত সন্তানের দিকে সেই অপত্যের দৃষ্টি দিয়ে জানিফকে দেখছে বৃদ্ধা। জানিফ ঠাহর করল, যেন তার জন্মদায়িনী মা নয়, তার দেশ ভারতবর্ষ তাকে শনাক্ত করছে আর বলছে, এ তো আমারই গর্ভের সন্তান।