বেটাছেলে মানুষ, পাথরে ঘুষি মারবে, দদ্দর করে জল ঝরবে, তা না তো লোকের কাছে দশরকমের কথা শুনতে হয়। তাছাড়া ওই হাততোলা রোজগারে আর ক-দিন চলবে? এখনই তো এক বেটা আর দুই বিটি। আগামীদিনে আল্লাহ দিলে আরও কোল ভরবে। মারিয়মের হককথা, আমার স্বামী তো আর ন্যাংড়া-খোঁড়া নয়? সুস্থ-সবল দেহের জ্বলজ্যান্ত মরদ।
বকখিলে ঠ্যাংঠ্যাঙে শরীর হলেও, তজুর গায়ে পাড়িমোষের দোম। এই তজুই যখন চামটা পশ্চাৎদেশ তুলে খাড়া হয়ে যেই প্যাডেলে ‘ঘুঁত’ করে চাপ দিত, অমনি ভ্যানটা গড়গড় করে গড়তে শুরু করত। এখন অবশ্য আর অত শরীর খাটাতে হয় না। দরদর করে গা দিয়ে অত ঘামও বের হয় না। এখন তজু তার তেলচিটচিটে সাইকেলভ্যানটার সঙ্গে একটা বেটেখাটো ঘোড়া সান দিয়ে নিয়েছে। লাগামটা তজুর হাতে ধরা থাকে। তজু লাগামটা ধরে যেই হ্যাঁচকা টান মারে অমনি লাল রঙের ঘোড়াটা চিহি করে ওঠে, টমটম করে ভ্যানটাকে টানতে লাগে। ঘোড়াটা বুড়ো। হাড়জিরজিরে চামটা শরীরের ঘোড়াটাকে তজু জীবন্তির হাট থেকে সস্তা দামে কিনে এনেছিল। মারিয়মের কথা রাখতেই তার এই ঘোড়া কেনা। মারিয়ম বুঝতে পারছিল, মানুষটা তার কথা শুনবে না, ‘ছোটলোকি’ কাজটাও ছাড়বে না, অত কী যে নেশা আছে! তাই ভেবেচিন্তে এই মতলবটা এঁটে ছিল, একটা ঘোড়া কেনায়, তাহলেই হাড়খাটুনিটা কমে যাবে। মারিয়ম ক দিন ধরেই কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করছিল, মোষের মতো অত না খেটে একটা ঘোড়া কেনো, অত বুকের বল দিয়ে ভ্যান চালাতে হবে না। বুকের অসুখ হয়ে যাবে! ঘোড়াটা যখন পুরো খ্যাতাল ঘুরে তার ঘুপসি আস্তাবলে ফেরে তখন এমন করে হাঁপায় যেন মনে হয় চোখদুটো কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসবে! চোখের কোণা দিয়ে গলগল করে অশ্রু ঝরে। মুখের কলসা দিয়ে গড়িয়ে পড়ে গেঁজানো ফেনা। হাপরের মতো ওঠানামা করে কঙ্কালসার পেট। চামটা পেটটা যখন দুমড়িয়ে পিঠের শিরদাঁড়ার সঙ্গে চেপ্টে লেগে যায়, তখন তজুর অন্তরটাও ডুকরে ওঠে, ‘ঘোড়াটা মনে হয় এবার গেল’! আসলে সাধাসিধে মানুষ তজু ঘোড়াটাকে আলাদা কোন জন্তু মনে করে না। তিড়বিড়ে ঘোড়া আর হাড়গিলে তজু যেন একই পেটের ভাই। সেও তো ঘোড়াটার মতো ভ্যানটানার কাজ করে? তাছাড়া ফেরেশতার বাহক বলে তজুর কাছে ঘোড়ার কদরও বেশি। সে ঘোড়াজ্বিনের কথাও জানে। মাইকটায় যখন আল্লাহ রসুলের কথা গাওয়া হয়, তখন তজু ভাবে, নিশ্চয় আল্লাহর কোন ফেরেশতা আসমান থেকে নেমে এসে ঘোড়াটার পিঠে সওয়ারি হয়েছেন। তখন তজু ঘোড়াটার পিঠে চাবুক চালাতে ভয় করে। শুধু মুখ দিয়ে ‘হাট’ ‘হাট’ করে। লেজে সুড়সুড়ি দেয়। পিঠের কুঁজে হাতের আঙুল দিয়ে খোঁচা মারে। ঘোড়ার গা গরম হয়ে উঠলেই, তজু মিনমিন করে ‘দোয়া’ পড়তে লাগে। ভাবে, নিশ্চয় ফেরেশতা ঘোড়ার পিঠে চেপে বসেছেন। তজু মিলাদ-মজলিশে শুনেছে, যেখানে আল্লাহ আর আল্লাহর রসুলের নাম করা হয়, হাদিস-কোরানের কথা বলা হয়, সেখানে আসমান থেকে দলে দলে ফেরেশতা নেমে এসে সেসব কথা শোনেন আর আল্লাহর কাছে তাঁর পয়গাম পাঠাতে থাকেন। বিনিময়ে আল্লাহও নেকি বর্ষাতে থাকেন।
তজুরা যখন খ্যাতালে বের হয়, তখন তার মনে হয় সে যেন আল্লাহর পয়গাম মানুষের কাছে পৌঁছনোর কাজে বেরিয়েছে। তাদের কথা শুনে না জানি কত বে-নামাজী নামাজি বনেছেন, কত বে-পথে যাওয়া মানুষ আল্লাহর পথে ফিরে এসেছেন। এসব কি কম সওয়াবের কাজ? তাদের আদায়ের চাল-গমের ঝোলার থেকে বেহেশতে যাওয়ার নেকির ঝুলা বেশি ভরে ওঠে। মারিয়ম এ কথা কোনভাবেই বুঝতে চায় না। তার এক বোল, এই ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে দোরে দোরে ঘোরা বন্ধ করো। পাড়া-পড়শির কাছে আমি মুখ দেখাতে পারি নে।
তজু ফ্যাসাদে পড়েছে। সে না পারছে নুহুচাচাকে ছাড়তে, না পারছে বৌ’র কথা রাখতে। নুহুচাচাকে সে আপন বাপের মতো দেখে। বেচারি লোকটাকে একা ছেড়ে দেওয়া মানে অথৈ সমুদ্রে ফেলে দেওয়া। তাকে হাতে না মেরে ভাতে মারা। এভাবে বাপের বয়সী একটা অন্ধ লোককে পেটে লাথি মেরে মেরে ফেললে, আল্লাহ কখনও তাকে ক্ষমা করবেন না। তজুর বিশ্বাস, তার জীবনের একটা অংশ নুহুচাচাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্যেই আল্লাহ তাকে পয়দা করেছেন। গায়ে আর সেরকম লোকও নেই যে হপ্তাহে দু-তিন দিন নুহুচাচাকে দু-চাট্টে গ্রাম ঘুরিয়ে আনবে। কম করে জুম্মাবারের খ্যাতালটা দু চক্কর মেরে আনবে। চাষের মুনিশই পাওয়া যাচ্ছে না তো নুহুকানার ভ্যান টানা প্যাটলার! তারপর আজকালকার লোকের আবার ভড়ং কত। বলে কিনা, বলদের মতন সারাদিন ভ্যান টানতে যাব কেন? একবেলা খাটব আর একবেলা ফুটেনি করে বেড়াব।
কিন্তু তজু ওরফে তজিবুর রহমান অত শক্ত হতে পারে না। যখন ঘোড়াটা ছিল না, সে প্যাডেল করে করে ভ্যান টেনে গোটা খ্যাতাল ঘুরত, তখন ঘানিটানা বলদের মতো কেলিয়ে ন্যাকড়া হয়ে যেত তজু। মাঠের মধ্যে কোন বট বা পাকুড় গাছের ছায়া পেলে দুদণ্ড জিরিয়ে নিত। তার ধকলমাখা লুঙ্গিগুটোনো শরীরটা যখন ছায়ানিবিড় ঘাসের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে থাকত, তখন মনে হত যেন একলাদা মাটি ঘাসের ওপর পড়ে আছে। অথচ এই তজুই এক জীবনে বারুদের মানুষ ছিল। অন্ধকার জগতের বাঘা মস্তান! কিন্তু আল্লাহর কি কুদরতি! নুহুচাচার মতো এক অন্ধফকিরের পাল্লায় পড়ে আমুল বদলে গেল তজু! নুহুচাচার বিশ্বাস, আল্লাহ হেদায়েত করেছেন ওকে।
দিনের দিন ক্যাঁচালটা আরও পেকেই যাচ্ছে। মারিয়ম কোনমতেই বুঝতে চায়ছে না যে, তজু না থাকলে নুহুচাচা না খেয়ে মারা পড়বেন। ইচ্ছে না থাকলেও, বৌ’র চাপে তজু এই ক-দিন তলে তলে বিকল্প অন্য কাউকে খুঁজেছে, কিন্তু কেউই এ মুখো হতে চায়ছে না। উল্টে কেউ কেউ খোঁচা মেরে বলেছে, ওসব ফকির ঘোরানো কাজ করবে না। চিন্তায় চিন্তায় তজুর শরীরটা দড়ির মতো পাকিয়ে যাচ্ছে। ঘুলঘুলে চোখগুলো ঢুকে যাচ্ছে কোটরের মধ্যে। হাঁ হয়ে তাকাচ্ছে বাতির ঘাড়।
দুই
“বামে মাটি, ডানে মাটি, মাটির হবে বিছানা.........।“
বিভোর হয়ে শুনছে তজু। ঘোড়ার খুরের খটখট শব্দ আর চাকার ক্যাঁচক্যাঁচ ধ্বনি মাইকের মরমিয়া কন্ঠের সাথে মিশে মাতমের সুর তুলছে। তজুর রক্ত-মাংসের শরীরটা এই বাঁশ-কাঠের টাপাভ্যানে থাকলেও তার নেকদার মনটা কিন্তু মক্কা-মদিনায় ফুঁড়ুৎ করে উড়ে গেছে। খ্যাতালে বের হওয়া অনেকক্ষণ হল। তিনখানা গাঁ আদায় হয়ে গেছে। ভ্যানের টাপাটার ছায়াও ঘুরতে শুরু করে দিয়েছে। বেলা এখন আসরের দোরগোরায়।
“বাড়িতে কি কিছু ঘটেছে? অত চুপচাপ ক্যানে বাপ?” জিজ্ঞেস করলেন নুহুচাচা।
“কই! না তো?” ঘাড় নাড়ালো তজু।
“তাহলে কথা বুলছ না ক্যানে? অন্যদিন তো গুটা খ্যাতাল বকরবকর করো।“
“এমনি।“ আলগোছে বলল তজু।
“না, লিশ্চয় কিছু একটা ঘটেছে। আমার কাছে লুকোচ্ছ?“
“না চাচা, কিচ্ছু ঘটেনি। মুন দিয়ি হাদিসের কথা শুনছি, তাই।“ কাঁচুমাচু করল তজু।
নুহুচাচা ভাবেন, কথা তো ঠিকই, তার সঙ্গে জোড় বাঁধার পর থেকে তজুর অনেক বদল ঘটেছে। আগে তজু এক রাকাত নামাজও পড়ত না। কেমন যেন বাউণ্ডুলে ছিল। এই খ্যাতালে আসার পর থেকে তজুর মধ্যে অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটে গেল। এখন তজু এক ওয়াক্ত নামাজও কাজা করে না। পাকা মুসল্লি। মুখে দাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। মাথায় সব সময় ফেজ টুপি। তজু প্রথম প্রথম লুঙ্গি পরে খ্যাতালে বের হত। তখন ঘোড়াটা ভ্যানের সাথে জোড়া হয়নি। তজু প্যাডেল করেই ভ্যান চালাত। কোমর এদিক ওদিক নামিয়ে ভ্যান টানত। এতে পরনের লুঙ্গিটা হাঁটুর ওপরে উঠে পড়ত। তজু নুহুচাচার কাছ থেকে যেই শুনল, লুঙ্গি হাঁটুর ওপরে উঠে পড়লে ওজু ভেঙে যায়, তখন থেকে তজু পাজামা পরে। গায়ে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি। সাদা রঙের পাজামা পাঞ্জাবিতে তাকে বেশ ‘মুরব্বি’ ‘মুরব্বি’ লাগে।
“আমি যদি অসুখ-বিসুখে পড়ে যাই, তাহলে তুমি কী করে খ্যাতাল করবা, চাচা?” চোখ বন্ধ করে বলল তজু। আসলে চোখ খুলে এমন প্রশ্ন করার আস্পদ্দা নেই তার। কথাটা জিজ্ঞেস করবেনাই ভেবেছিল, কিন্তু কথাটা কেন যেন গলা দিয়ে ঠেলে বেরিয়ে এল! কথাটা বলেই, তার মন এখন খুঁতখুঁত করছে। কথাটাই, চাচা কষ্ট পাবেন না তো? জিভ কেন এত বেশরম হয়ে ওঠে? জিভকে দুষে তজু। কানদুটো এঁটে ধরে। যেন নুহুচাচার মুখ থেকে বের হওয়া উত্তরটা কানের ফুটো দিয়ে না ঢোকে। চাচার উত্তর যে তার জানা। চাচা নিশ্চয়ই বলবেন, কী আর করব, বাড়িতে না খেতে পেয়ে মরব।“ এমন কথা হজম করার মতো পাষান মানুষ এখনও হয়ে উঠতে পারেনি তজু।
“রুজির মালিক আল্লাহ, কার প্যাটের দানা কতি আছে কেহু বুলতে পারে বাপ? একদানা আহার বাকি থাকা অবধি কাহুর ইন্তেকাল হবে না খ। তুমি একদম চিন্তা করো না, লিশ্চয় আল্লাহ অন্য কুনু বিহিত করে থুয়েছে।“ ঠোঁটে হাসি মাখিয়ে বললেন নুহুচাচা। তজু ভাবল, নুহুচাচা কথাগুলো তাকে কষ্ট না দেওয়ার জন্যে বললেন। আসলে তার ভেতরটাও ছ্যাত করে উঠছে। নুহুচাচা হাড়ে হাড়ে জানেন, তজু না থাকলে, একবেলার জন্যেও এই ভ্যানটানার লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাকে আল্লাহর শেষ হুকুমের জন্যে মোনাজাত করতে হবে।
নুহুচাচার কানে এসেছে, তজুর বউ মারিয়ম চায় না, তজু তার সঙ্গে খ্যাতাল টানা কাজ করুক। ব্যাপারটা অনেক দূর গড়িয়ে গেছে। ঠুকমুক থেকে সংসারভাঙা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। মারিয়ম তো ক-দিন আগে রাগ করে বাপের বাড়ি হাঁটা ধরেছিল। সে আপদ জোর করে কোনমতে আটকানো গেছে। নুহুচাচা নিজেও চান না, তার মতো এক অন্ধলোকের জন্যে তার ছেলের মতন তজুর এতদিনের সংসারটা ভেঙে যাক। সেরকম কিছু হলে, আল্লাহ তাকে কখনও ক্ষমা করবেন না। যে তাকে পেটের খোরাক জোগাচ্ছে, তারই সর্বনাশ করছেন তিনি! আচমকা নুহুচাচা গলা ফেড়ে ‘হক রব্বানা হক’ উচ্চারণ করে বলে উঠলেন, “গাড়ি থামাও, তজু।“
নুহুচাচা আচমকা এভাবে গলা ঝেরে ওঠায় প্রথমে ভয়ই পেয়ে গেল তজু। থতমত করে বলে উঠল, “ক্যানে চাচা, এখানে গাড়ি থামাবো ক্যানে? এ তো ফাঁকা মাঠ! গাছগাছালিও নাই!”
“ওজু করব। আসরের সুমা হয়ে এল।“ তারপর জলের ঘটিটা হাতে নিয়ে নুহুচাচা বললেন, “তুমার ওজু কাজা হয়ে গ্যালে তুমিও ওজু করে ল্যাও। দুই বাপ-ব্যাটা মাটিতেই নমাজটা আদায় করে লিব।“
নুহুচাচার আন্দাজ দেখে তাজ্জব বনে যায় তজু। সে যাচাই করে দেখেছে, চাচার আন্দাজ একবারও গড়মিল হয়নি! নুহুচাচা আজন্ম অন্ধ। কানাকড়িও দেখতে পান না। অথচ সময়জ্ঞ্যান মারাত্বক। আযানের সময় হলেই বলে দেন, নমাজের ওয়াক্ত হল বাপ।
হাসানপুরের মসজিদ থেকে আসরের আযান মিহি করে ভেসে আসছে। থড়বড় করে ভ্যানের মাইকটা বন্ধ করে দিল তজু। তজু শুনেছে, আযানের সময় কথা বলতে হয় না, মনে মনে আযানের কথাগুলোর পুনরাবৃত্তি করতে হয়। তাহলে আল্লাহর সওয়াব মেলে। ভ্যানটা রাস্তার একপাশে একঠ্যাঙা করে দাঁড় করিয়ে দুজন মানুষ পশ্চিমমুখো করে নামাজে দাঁড়িয়ে গেল। অঘ্রানের মাঠ। পাকা ধানের শিষে গোটামাঠ যেন সোনালি হয়ে উঠেছে! মখমলের চাদরের মতো ঝিলমিল করছে মাঠ! ধানের এই শিষকেই তজু বলে, ধানের কানের দুল। ঝিরঝির করে বয়ছে উত্তরে বাতাস। নামাজ শেষ হলে তজু জায়নামাজের জন্যে পাড়া গামছাটা ঘাড়ে ফেলে, ভ্যানের আড়ালে গিয়ে একটা বিড়ি ধরাল। বিড়ির নেশাটা অনেকক্ষণ আগেই পেয়েছে। কিন্তু টানার ফুরসত পাচ্ছিল না। এই একটা বদ অভ্যাস এখনও ছেড়ে উঠতে পারেনি তজু। নুহুচাচা কত করে বলেছেন, তামাক হারাম। কিন্তু তজু হাজার চেষ্টা করেও বিড়ি খাওয়াটা ছাড়তে পারেনি। নুহুচাচা তখনও হাঁটুমুড়ে কেবলামুখি করে বসে আছেন। তসবিহ গুনছেন। তজু তার সুখটানের গবগব করে বের হওয়া ধোঁয়ার আবছা আলো দিয়ে দেখছে, নুহুচাচার সারা গা দিয়ে যেন আলোর দ্যুতি বের হচ্ছে! নুহুচাচার ধবধবে গা’টা হিরের মতো জ্বলজ্বল করছে! তজু শুনেছে, নেকদার মানুষের শরীর দিয়ে নূরের আলো বের হয়। এ আলো বেহেশতের আলো। নুহুচাচাকে এমন ঈমানদার দরবেশের মতো দেখে তজুর মুখ দিয়ে ‘সুবহানআল্লাহ’ বের হয়ে এল। আর তক্ষনি আঙুলের ফাঁক থেকে ‘টপ’ করে পড়ে গেল জ্বলন্ত বিড়িটা।
তিন
“দূরে সরে শও। তুমার সাথে গা ঠ্যাকাতে আমার ঘিন্না লাগে।“ মুখ ভ্যাংচালো মারিয়ম। তজু কেবলই বিছানাটায় গা দিয়েছে, অমনি ছিনবিন করে উঠল মারিয়ম। সড়সড় করে গা ঘেষ্টে কিছুটা সরে এল তজু। তেলচিটচিটে বালিশে মুখ গুঁজে তজু ভাবল, এ আর আজ নতুন কি, মাসদুয়েক থেকেই তো গা’এর সঙ্গে গা’এর সম্পর্ক নেই। শরীরের সিয়াম পালন যখন করেই যাচ্ছি, তখন এ সিয়াম পালন চলতেই থাকুক। আবার কত, হাড় তো পেকেই গেল।
“ভাবছি, সামনে হপ্তাহ থেকেই খ্যাতাল ছেড়ে দিব। চাচার সঙ্গে আর যাব না।“ ফিস করে বলল তজু।
“ছেড়ে দিবা মানে? ছেড়ে দিবা বুললেই ছেড়ে দ্যাওয়া হবে?” তেড়ে উঠল মারিয়ম। তজু অবাক হল, মারিয়ম বলছে কী! ওইই তো একাজ ছেড়ে দেওয়ার জন্যে দেহের হাড়-মাংস এক করে দিল! আর আজ বলছে কিনা, ছাড়া যাবে না! তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে তজুর। সে ঘুরে শুলো। চোখ ফেড়ে তার জাঁদরেল বউকে দেখল একবার। মারিয়ম, সুড়সুড় করে তজুর দিকে এগিয়ে এসে মিনমিন করে বলল, “এখুন ফসলের মরশুম আসছে, সামনের মাস থেকেই অঘঘানের ধান উঠতে শুরু করবে। কুনু গেরস্তই খালি হাতে ফিরাবে না। এক খ্যাতাল ঘুরলেই ভ্যান উপচে যাবে। তাছাড়া একমাস পরেই রমজান মাস। যাকাত-ফেতরার সুমা। দুহাতে লুটে লিতে হবে। এই মাসকডা গলা ডুবি খেটে ল্যাও। আর কান খাড়া করে শুনো, এবার থেকে ভাগের হারটা আরও বাড়হি লিও। দুহাতে কুঠা কুঠি ভরে লি। তারপরে উসব ফকিরি কাজ ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে অন্যকাজে লেগে যায়ও। হিল্লে একটা ঠিকই হয়ে যাবে।“
চোখের পাতা এখনও নামেনি তজুর। মারিয়মকে চোখ ভরে দেখছে। আর ভাবছে, বউটা কত স্বার্থপর! ঘাড় ঘুরিয়ে শুলো তজু।
“কই গ, কিচ্ছু বুলছ না যে!” তজুর পেটে খোঁচা মারল মারিয়ম।
“শুধু টাকা-পয়সাই দেখলা! ব্যাচারি অন্ধ মানুষটার কথাডা একবারও ভাবলা না! আল্লাহ না করান, একদিন আমিও তো অন্ধ হয়ে যাতে পারি? ত্যাখুন কি তুমি আমাকে এমনি করে ছেড়ে চলে যাবা?”
“চুপ করো, যত অলুক্ষনে কথা।“ হাতের আঙুল দিয়ে তজুর ঠোঁটদুটো ঠেসে ধরল মারিয়ম। আচমকা মারিয়মের চোখ লাল হয়ে উঠল। সে ঝ্যান করে উঠে বলল, “আমি আর ওই কানাবুড়হে লোকটা কি এক হল্যাম? নিজের বউকে রাস্তার ফকিরের সাথে মিলিয়ে ফেলছ? তুমি আর মানুষ হবা না। তুমার সাথে কথা বুলাই পাপ।“ ‘দপ’ করে নিভিয়ে দিল ঘরের আলো। ‘ঝুপ’ করে নেমে এল থোক অন্ধকার।
হাশরের ময়দান। জ্বিন আর ইনসানের বিচার চলছে। মীযানের দাঁড়িপাল্লায় মাপা হচ্ছে, নেকি আর গোনাহ। যাদের নেকির পরিমাণ বেশি হচ্ছে, তাদেরকে বেহেশতে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আর যাদের গোনার পাল্লা ভারি হচ্ছে, তাদের জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করা হচ্ছে। তজু দেখছে, ঈমানদার মানুষেরা তাদের নেক আমলের দৌলতে ভর করে জান্নাতে চলে যাচ্ছেন। আর পাপী, কাফের, মুনাফেকগণ দোজখের গনগনে আগুনে জ্বলছেন! তজুর সিরিয়াল নম্বর এখনও আসেনি। সে লাইনে আছে। সে ‘হায়’ ‘হায়’ করতেও পারছে না, আবার আনন্দে ‘ধেই’ ‘ধেই’ করতেও পারছে না। সে শুধু চিন্তায় বিভোর হয়ে আছে, আমার কী হবে! আমার কী হবে!
বলতে বলতে তজুর ডাক এল। এবার তার বিচারের পালা। কাঁধের দুই ফেরেশতা মুনকির আর নাকির তাঁদের হিসাব জমা দিলেন। তজুর চোখ-মুখ দুশ্চিন্তায় পাংশে হয়ে উঠছে! যাহঃ! দাঁড়িপাল্লার কাঁটা বাম দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে! তজুর পাপের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে! তজু মনে মনে এই আশঙ্কাটাই এতক্ষণ করছিল, সে যে প্রথম জীবনে একজন খুনি ছিল। নামাজ-রোজার ধার ধারত না। কিচ্ছু করার নেই, তাকে জাহান্নামে যেতেই হবে। আর শ-খানেক নেকি হলেই তজু বেহেশতে যেতে পারত। আল্লাহ তজুকে দোজখে যাওয়ার কথা যেই ঘোষণা করতে যাবেন, অমনি ধড়ফড় করে দৌড়ে এলেন একজন বৃদ্ধ! তিনি আল্লাহর কাছে দুহাত তুলে বললেন, এ কেমন বিচার আল্লাহ, আমাকে যে মানুষটা সারাজীবন পথে পথে ঘুরিয়ে খাওয়ালো, যে না থাকলে আমি গায়ে গায়ে তোমার কোরানের বাণী ছড়াতে পারতাম না। যে মানুষটার জন্যেই আমার দুনিয়ার জীবন বেঁচে ছিল, খেয়ে-পরে টিকে ছিল রক্ত-মাংসের শরীর, সে লোককে দোযখে ফেলে রেখে আমি বেহেশতে যাব? কক্ষুনও না। আমাকে যদি বেহেশতে পাঠাতে হয়, তাহলে এই লোককেও আমার সাথে বেহেশতে পাঠাতে হবে। তানাহলে, আমিও বেহেশতে যাব না। এই ঠাই দাঁড়িয়ে থাকলাম। তজু বারকয়েক চোখ ঝেরে দেখল, নুহুচাচা না! হ্যাঁ, নুহুচাচাইই তো! তজুর চোখদুটো খিলখিল করে উঠল।
মহান আল্লাহপাক ধ্যানে মগ্ন হলেন। তিনি রহমানের রহিম। কয়েক মুহূর্ত পর চোখ খুললেন। তারপর তিনি খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, শোনো, জ্বিন ও ইনসান, আমার ফেরেশতারাও শোনো, যে মানুষটি এক অন্ধ কানা মানুষকে পরের দোরে দোরে ঘুরিয়ে সে অসহায় মানুষের রিযিকের ব্যবস্থা করেছে জীবনভর, তার সঙ্গে কি আমি নাফরমানি করতে পারি? আমি ফরমান জারি করলাম, নুহু আর তজু দুজনেই বেহেশতবাসী হল।
“এই, ওঠো, আর কত ঘুমায়? কত্ত ব্যালা হয়ে গ্যালো! খ্যাতাল যাবা না?” গা’টাকে ঝটকানি দিয়ে খ্যাঁক খ্যাঁক করে উঠল মারিয়ম। মারিয়মের খ্যাঁকানিতে ঘুম ভেঙে গেল তজুর।
শব্দার্থঃ ১) হাশর- মরণের পরে শেষ বিচারের মাঠ
২) নেকি- পুণ্য
৩) খ্যাতাল- যে এলাকা জুড়ে কারবার করে সে এলাকা
৪) পয়গাম- বার্তা
৫) সওয়াব- পুরস্কার
৬) পয়দা- সৃষ্টি করা
৭) কুদরতি- বাহাদুরি
৮) হেদায়েত- রক্ষা করা
৯) মাতম- দুঃখে বিহ্বল হয়ে বুক থাবড়ানো
১০) আসর- বিকেলের নামাজ
১১) টাপা- ছই
১২) রাকাত- এক সিজদাহর নামাজ
১৩) ওয়াক্ত-একবারের পুরো নামাজ
১৪) মুসল্লি- যারা নামাজ পড়েন
১৫) ওজু- জল দিয়ে হাত মুখ ধোয়া
১৬) ইন্তেকাল- মৃত্যু
১৭) কাজা- নির্ধারিত সময়ে না পড়া নামাজ পরে পড়া
১৮) হারাম- নিষিদ্ধ
১৯) কেবলামুখি- মক্কার কাবার দিকে মুখ করা
২০) নেকদার- পুণ্যবান
২১) সিয়াম- বিরত থাকা
২২) মীযান- শেষ বিচারের দিনে ভালো মন্দ কাজ পরিমাপের দাঁড়িপাল্লা
২৩) মুনাফেক- যে ব্যক্তি আল্লাহ, আল্লাহর বাণী ও আল্লাহর নবীকে বিশ্বাস করে না।
২৪) রিযিক- খাদ্য