পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

শুভাশুভ

  • 04 December, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 1227 view(s)
  • লিখেছেন : প্রতীক
ভট্টাচার্য বাড়িতে এক যুগ পরে উৎসব --- অরিন্দম ভট্টাচার্যের বিয়ে। শেষ খাওয়াদাওয়া হৈ হুল্লোড় হয়েছিল অক্ষয় ভট্টাচার্যের ছোট বোন খুশির বিয়েতে। এই প্রজন্মে অরিন্দমই একমাত্র ছেলে। তার বিয়ের জাঁকজমকও তেমন হওয়া চাই তো, তাই অক্ষয়বাবু উদয়াস্ত পরিশ্রম করছেন। একা হাতেই সব করতে হচ্ছে। ভাইরা সকলেই দূরে দূরে, এসে পৌঁছাবে ঠিক বিয়ের আগের দিন।

অফিসগুলো যা হয়েছে আজকাল, দুদিন আগে এসে যে একটু সাহায্য করবে তার উপায় নেই। অবশ্য বরটি নিজেই যেখানে বিয়ের মোটে দুদিন আগে আসছে, সেখানে অন্যদের উপর রাগ করা চলে না। অক্ষয়বাবুর গিন্নী যদি একটু বলিয়ে কইয়ে হতেন, তাহলে চাপটা কমত। কিন্তু তিনি তো এ বয়সেও রান্নাঘর থেকে বেরোতেই চান না। ফলে অক্ষয়বাবু কারো বাড়িতে নেমন্তন্ন করতে গিয়ে দু দণ্ড বসার সময় পাচ্ছেন না।

প্রায় আধ ঘন্টা ধরে মুড়ি, পেঁয়াজি আর চা সহযোগে অরিন্দমের বিয়ে সম্বন্ধে এতসব খবর দিয়ে অক্ষয়বাবু বারবার অণিমাকে বলে গেলেন “তোমাকে কিন্তু যেতেই হবে। তুমি না গেলে ভুতো খুব দুঃখ পাবে। তোমাকে তো ও অন্য চোখে দেখে, ছেলেবেলায় কতটা সময় কাটিয়েছে তোমার কাছে… না না, কোন অসুবিধে হবে না। বিধবাদের জন্যে একদম আলাদা ব্যবস্থা করেছি। তুমি ঘরে বসে খাবে। আমাদের পল্টুর শাশুড়ি, খুশির ননদ --- ওরাও তো খুব নিয়ম মেনে চলে, তাই তোমাদের রান্না ক্যাটারারকে দিয়ে করাচ্ছিই না। কুসুমদিকে রাখছি, আমাদের রান্নাঘরে আমাদের বাসনকোসনে তোমাদের জন্যে রান্না করে দেবে।”

অণিমার জন্য অবশ্য অত কাণ্ড করার কোন দরকার নেই। সে থান পরে না, অম্বুবাচী করে না। মাংস খেতে কোনোদিনই ভালবাসত না বলে খায় না, মাছ ডিম দুটোই খায়। এ বয়সে রং বেরংয়ের শাড়ি পরতে ভাল লাগে না বলেই হালকা রঙের শাড়ি ব্লাউজ পরে, নইলে স্বামী মারা যাওয়ার পর শাঁখা সিঁদুর ছাড়া আর কিছুই সে ত্যাগ করেনি। বিভূতি ওসব পছন্দ করত না। যখন বুঝল আর বাঁচবে না, দুবেলা অণিমাকে বলত “আমি মরলে তুমি খবরদার বৈধব্য পালন করবে না। করলে কিন্তু আমার আত্মার শান্তি হবে না।” অণিমা তার কথা রেখেছে, তবে কোনো ভোজ বাড়িতে খায় না। মানে খেতে পারে না। বিভূতি খেতে বড্ড ভালবাসত। তাকে বাদ দিয়ে নেমন্তন্ন খেতে কিছুতেই মন চায় না। তাই অন্নপ্রাশন, পৈতে বা বিয়ে থাকলে অণিমা গিয়ে উপহারটা দিয়ে চলে আসে। শ্রাদ্ধবাড়িতে ছবিতে মালা দিয়ে আসে এক ফাঁকে। এত কথা অক্ষয়বাবুকে আর বলল না। পাড়াসুদ্ধ লোক জানে। অক্ষয়বাবু উল্টোদিকের বাড়ির লোক হয়ে জানেন না যখন, খামোকা কথা বাড়িয়ে কাজ কী? অণিমা যা ভাল বুঝবে, করবে। ভাবছে আদৌ যাবে না। ভটচায বাড়িতে সে শেষ পা রেখেছিল বছর পনেরো আগে। এতদিন না যাওয়ায় তো কারোর কিছু এসে যায়নি, এখনই বা না গেলে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হবে?

সিদ্ধান্তটা খুব সহজ হত, যদি বিয়েটা ভুতোর না হয়ে ও বাড়ির অন্য কারোর হত। ভুতোকে কিছুতেই আর পাঁচজনের মত করে ভাবতে পারে না অণিমা। সে যখন বিয়ে হয়ে মণ্ডল বাড়িতে আসে, ভুতোর তখন বছর আষ্টেক বয়স। ক্যালেন্ডারের ননী চোর কৃষ্ণ ঠাকুরের মত চেহারা, দৌরাত্ম্যও তার মতই। ভটচাযদের যৌথ পরিবার, বাড়ি ভর্তি লোকজন। সেই পরিবারের কর্ত্রী বড় বউ, মানে ভুতোর মা নমিতা বৌদি। তাঁর পক্ষে ঐ দস্যি ছেলেকে সামলানো প্রায় অসম্ভব। দেওর, ননদরাও পেরে ওঠে না, কারণ ভয় বা আদর --- কোনোটা দিয়েই ভুতোকে বেশিক্ষণ এক জায়গায় বসিয়ে রাখা যায় না। তার উপর একমাত্র নাতিকে তার বাবা-মা বকতে গেলেও ঝাঁপিয়ে পড়েন ঠাকুমা পার্বতী দেবী। এমন সময় উল্টোদিকের বাড়িতে বিয়ে হয়ে এল অণিমা। আর কী করে যেন ভুতোর ভারী পছন্দ হয়ে গেল তাকে।

ভুতো স্নান করবে না। “নূতন কাকির কাছে করব”। ভুতো ভাত খাবে না। “নূতন কাকির কাছে খাব”। ভুতোর জ্বর হয়েছে, কিছুতেই জলপট্টি দিতে দেবে না। অগত্যা তার ছোটপিসি গিয়ে ডেকে আনে নূতন কাকিকে। ছুটির দিনগুলোতে প্রায়ই গোটা দিন অণিমার কাছে থাকত ভুতো। সন্ধের পর হাতের সব কাজ সেরে নমিতা বৌদি ঘুমন্ত ছেলেকে কোলে করে বাড়ি নিয়ে যেতেন, আর রোজ বলতেন “অণিমা, তোমাকে ভগবান নিজে পাঠিয়েছেন। এই গুন্ডা ছেলেটাকে নিয়ে আমি হিমশিম খাচ্ছিলাম। ও বোধহয় আর জন্মে তোমারই ছেলে ছিল।”

নিজের যে এ জন্মে ছেলেপুলে হবে না, সে কথা অণিমার তখনো জানা ছিল না। সে ভাবত এমন একটা সুন্দর ছেলেকে পেয়ে ভালই হয়েছে, মানুষ করার অভ্যাসটা হয়ে যাচ্ছে। যে যে অস্ত্রে ভুতোর দুষ্টুমিকে ঘায়েল করেছিল, তার মধ্যে ব্রহ্মাস্ত্র ছিল গল্প শোনানো। উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার, অবনীন্দ্রনাথ, দক্ষিণারঞ্জন, যোগীন্দ্রনাথ --- সব উজাড় করে দিয়েছে। যখন জানতে পেরেছে নিজের আর মা হওয়া হবে না, তখন ভুতোর হাতে ফেলুদা, টেনিদা, ঘনাদাও ধরিয়েছে অণিমাই।

বিভূতি কোনো দিক থেকেই সেকেলে লোক ছিল না। একাধিকবার বলেছে “অনু, চলো আমরা দত্তক নিই। মাকে আমি ঠিক রাজি করিয়ে নেব।”

অণিমা বলেছে “কী দরকার? আমাকে নিয়ে ভাবছ তো? আমার তো ভুতো আছে।”

“সে তো এখন। কদিন পরেই আর থাকবে না। পরের ছেলে পরেরই হয়।”

“আহা! আমি তো ওর থেকে কিছু দাবি করতে যাব না! এই একটু আসে, আমার কাছে বসে, গল্প করে… এটুকুতে আর কে আপত্তি করবে?”

“আপত্তি করতে লাগবে না। ওর লেখাপড়া বাড়বে, বন্ধুবান্ধব, খেলাধুলো --- এসব হবে না? আর ছেলেরা গোঁফদাড়ি গজাতে শুরু করলেই অনেকটা বদলে যায়। তখন আর আসতে ইচ্ছে করবে না তোমার কাছে।”

অণিমা প্রতিবাদ করেনি, বিশ্বাসও করেনি। কিন্তু ভুতোর অরিন্দম হওয়া শুরু হতেই মণ্ডল বাড়িতে তার যাতায়াত কমে গেছে। প্রথম প্রথম অণিমার মনখারাপ হয়েছে। মেজাজ গরম করে শাশুড়ির সাথে, কাজের লোকের সাথে, স্বামীর সাথে ঝগড়া করেছে। এমনকি দু-একবার গোপনে কান্নাকাটিও করেছে। বিভূতি বলেছে “বাড়াবাড়ি কোরো না, অনু। কান্নাকাটি করার মত কিছু হয়নি। পেটের ছেলেও এই বয়সে মায়ের থেকে দূরে সরতে শুরু করে। চিরকাল কোলের খোকা হয়ে থাকা কি ভাল নাকি?” মাথা ঠান্ডা হলে অণিমা ভেবে দেখেছে কথাটা ঠিকই। তাছাড়া ভুতো আর ন্যাওটা না থাকলেও, একেবারে ভুলে যায়নি। কখনো খারাপ ব্যবহারও করেনি। রাস্তায় দেখা হলে এখনো সেই ছোটবেলার মতই একগাল হেসে জিজ্ঞেস করে “কেমন আছো, নূতন কাকি?” চাকরি নিয়ে বাইরে চলে যাওয়ার পর থেকে আর দেখা সাক্ষাৎ প্রায় হয়নি। নিজে থেকে তো আর এ বাড়ি আসেনি গত দশ বছরে। তবু বৌভাতে অণিমা না গেলে হয়ত দুঃখই পাবে ছেলেটা --- অক্ষয়বাবু ঠিকই বলেছেন।

ভুতোর আসা যাওয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বিভূতির চাপাচাপিতেই বাড়িতে বাচ্চাদের আঁকা শেখানো শুরু করেছিল অণিমা। কাজটা যে কত ভাল হয়েছে সেটা উনি চলে যাওয়ার পরে বুঝতে পেরেছে অণিমা। কচিকাঁচাদের যাতায়াত না থাকলে এই বিরাট বাড়িতে শয্যাশায়ী শাশুড়ি আর কাজের লোকেদের সাথে থাকতে থাকতে পাগলই হয়ে যেতে হত। তবে তার অনেকদিন আগেই ভুতোকে আঁকা শেখানোর চেষ্টা করেছিল । ওর একগুচ্ছ আঁকার খাতা এখনো রাখা আছে ট্রাঙ্কে। আজ অনেকদিন পরে সেগুলো বার করল অণিমা।

যত ছেলেমেয়েকে আঁকা শিখিয়েছে এই বাড়িতে বসে, তাদের মধ্যে ভুতোই বোধহয় সবচেয়ে ওঁচা ছাত্র। সাতপুরনো খাতাগুলো খুলে কুকুরের মত দেখতে হাতি, কাকতাড়ুয়ার মত দেখতে মানুষ, আকাশ পর্যন্ত উঁচু জঙ্গল আর বালির রঙের সমুদ্র দেখে এতদিন পরেও খুব হাসি পেল। সবচেয়ে ওঁচা হলেও ভুতোই সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছাত্র। অণিমার মুখে তার আর্ট কলেজে পড়ার গল্প শুনে শুনে এমন পেকে গিয়েছিল, যে দশ-এগারো বছর বয়সে বলত “প্যারিসে আমার একজিবিশন হবে। তোমাকে আর বিভুকাকাকে জেট প্লেনে করে নিয়ে যাব।” অণিমা বলত “হ্যাঁ, এরকম কাগের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং আঁকলে হবেখন একজিবিশন।” ভুতো কিছুতেই মানতে চাইত না সে ভাল আঁকতে পারে না। চোখে জল টলটল, কিন্তু তখন আবার নতুন নতুন আত্মসম্মানবোধ হয়েছে। তাই কান্না চেপে গুম হয়ে থাকত।

সেই ছেলের বিয়ে। না গিয়ে থাকা কি সোজা কথা? চমৎকার কাঁথা সেলাই করতেন অণিমার দিদিমা, বিদ্যেটা নাতনিকে দিয়ে গিয়েছিলেন। বিয়ে হয়ে আসার পর মণ্ডল বাড়িতে নানা রঙের সুতো দিয়ে অসংখ্য নকশি কাঁথা সেলাই করেছে সে। দুটো মুখোমুখি বসা নোটন পায়রার নকশা করা একখানা বিশাল কাঁথা বানিয়েছিল অনেকদিন ধরে। ভুতো দেখে জিজ্ঞেস করেছিল “এই কাঁথাটা কার জন্যে?”

“এটা আমার রাঙা বউয়ের জন্যে।”

“রাঙা বউ! সে কে গো?”

“ও তুই চিনবি না।”

“কোথায় থাকে?”

“তা জানি না। তবে এই পাড়ার বউ হয়েই আসবে।”

“ও মা! বিয়ে হয়নি তো বউ বলছ কেন? আর কোথায় থাকে না জেনে কাঁথা বুনছ কেন? দেবে কী করে?”

“এখন দেব না তো। বিয়ের সময় দেব। রাঙা বউ আর তার বর শোবে।”

“কে গো রাঙা বউয়ের বর?”

“আমার ছেলে।”

অণিমা গম্ভীর মুখে বলেছিল। মানেটা বুঝতে পেরে ভুতোর সে কি লাজুক হাসি! তখনো দশে পা দেয়নি। সেই রাঙা বউ আসছে। অণিমা যাবে না? বিভূতি থাকলে তার সাথে পরামর্শ করা যেত। ও নির্ঘাত যেতেই বলত, নিজে তো যেতই।

“পুরনো কথা মনে রেখে দিতে নেই, অনু। এসব তো চিরকাল সহ্য করে এসেছি। সব মনে রেখে দিলে তো বন্ধুবান্ধব টিকত না। কী করা যাবে, বলো? অক্ষয়দার মা সেকেল মানুষ তো, তার উপর ঠাকুর দেবতা নিয়েই সারাদিন থাকতেন। ওসব লোক ওরকমই হয়। কিন্তু ভুতো তো তোমাকে সত্যিই ভালবাসত, তাই না? ঠাকুমার দোষে তুমি তাকে শাস্তি দিও না।” নিশ্চয়ই এ কথাই বলত। অণিমার মনও তেমনটাই বলছে। কিন্তু সেদিনের অপমান মনে পড়লেই মন বিষিয়ে উঠছে বারবার।

অণিমা বিশেষ কেউ নয়, সামান্য গৃহবধূ। জীবনটা যেভাবে কেটেছে সেভাবে কাটবে বলেই সে ছোট থেকে প্রস্তুত ছিল। কেবল একটা সময়েই তার মনে হয়েছিল নিজের একটা স্বতন্ত্র পরিচিতি হলেও হতে পারে --- আর্ট কলেজে পড়ার সময়। পড়াশোনায় মামুলি ছিল বলে আলাদা করে কখনো মাস্টারমশাই, দিদিমণিদের নজরে পড়তে পারেনি। আর্ট কলেজে কিন্তু ওকে একটু অন্য চোখে দেখত সবাই। দু-একজন মাস্টারমশাই আলাদা করে সময় দিতেন, বলতেন অণিমা লেগে থাকলে সত্যিকারের শিল্পী হতে পারে। বাবা অবশ্য তেমন মনে করতেন না। পাঁচ পাঁচটা ছেলেমেয়ের মধ্যে ছোট মেয়েকে নিয়ে আলাদা করে ভাবার সময় তাঁর ছিল না। তিনি আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়ায় সায় দিয়েছিলেন পাত্র খুঁজে পাওয়া পর্যন্ত মেয়েটাকে ব্যস্ত রাখতে। তিনি তখন জনে জনে বলে বেড়াচ্ছেন “সন্ধানে ভাল ছেলেটেলে থাকলে জানিও। সামান্য কেরানিগিরি করেও ছেলে দুটোকে নিজের পায়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছি, বড় মেয়ে দুটোর ঠিকঠাক বিয়ে দিতে পেরেছি। এখন রিটায়ারমেন্টের আগে ছোটটার গতি করে দিতে পারলে নিশ্চিন্ত হই।” তাই কলেজ ছেড়ে দিয়ে বিয়ে করতে হবে জানতে পেরে অণিমা খুব অবাক হয়নি, কাউকে দোষও দেয়নি। এতদিন পরে সে নিয়ে বিশেষ অভিযোগও নেই। ভদ্রলোক স্বামী পেয়েছিল, শাশুড়িও মাটির মানুষ বললেই হয়। যেটুকু অশান্তি হয়েছে, সে অণিমার টনটনে আত্মসম্মানের জন্য। ওই জায়গাটায় কোনোদিন সে আপোস করতে পারেনি। বিভূতি একবার রাগের মাথায় বলেছিল “সাধারণ ঘরের বউয়ের আবার এত ইগো কিসের?” সেই ইগোতেই আটকে যাচ্ছে এবারও।

শেষ পর্যন্ত বৌভাতে গেলে কেবল কাঁথাটা নিয়ে যাওয়া যাবে না। যে বউ হয়ে আসছে তার কাছে ওটার আর কী দাম? এতকাল পরে হয়ত ভুতোরও ওসব কথা মনে নেই, তার কাছেও ও কাঁথার কোন দাম নেই। তাছাড়া নমিতা বৌদি তেমন লোক না হলেও, বউয়ের হাত থেকে উপহারগুলো নিয়ে গুছিয়ে রাখার দায়িত্বে থাকবে ভুতোর কোনো কাকিমা, বা পিসিরা কেউ। তারা সব বড় বাড়ির মেয়ে, বড় বাড়ির বউ। একটা ভাল কিছু না দিলে আড়ালে কী বলাবলি করবে অণিমা জানে। ভটচায বাড়ি থেকে অপমানিত হয়ে বেরিয়ে আসার সময় ওরা কীভাবে মুখ বেঁকিয়েছিল ছবির মত মনে আছে। অথচ অক্ষয়বাবুর ছোট দুই বোন হাসি আর খুশি সময়ে অসময়ে কত এসেছে অণিমার কাছে। কখনো হোম সাইন্সের রান্না শিখতে, কখনো ওয়ার্ক এডুকেশনের রুমালে নকশা তোলাতে। হাসি তো তার পিছনে ঘুরঘুর করা ছেলেদের মধ্যে কাকে হ্যাঁ বলবে, তা নিয়ে পরামর্শ করতেও এসেছে কয়েকবার। সেই বৌদি পর হয়ে গিয়েছিল তাদের মায়ের এক কথায়। শুধু পর নয়, অবজ্ঞার পাত্র, ঘৃণার পাত্র। কী করে ভুলবে অণিমা?

যাওয়া হোক আর না হোক, যাওয়ার জন্য তৈরি থাকা ভাল। তাই পরদিন বিকেলের দিকে স্টেশনে গিয়ে একটা ভাল বেড কভার কিনে আনল অণিমা। নিজের হাতে বানানো, পরম যত্নে রেখে দেওয়া সেই কাঁথাটাকে দেড় হাজার টাকায় কেনা বাহারি বেড কভারের পাশে বড্ড ম্যাড়মেড়ে লাগল। নাঃ! ও আর দিয়ে কাজ নেই। আজকের অরিন্দম ভট্টাচার্যকে সে দিনের ভুতোর সাথে গুলিয়ে ফেললে চলে না। এ বছর নভেম্বরেই বেশ ঠান্ডা পড়েছে। আগের দিনই রূপা বলছিল, ওদের ঘরের পশ্চিমের দেয়ালটা এমন ড্যাম্প যে “বৌদি, রাতের বেলা মনে হয় আগুন জ্বেলে শুলে শান্তি হবে।” “অমন সব্বোনেশে বুদ্ধি করিস না, বাবা। ছেলেপুলে নিয়ে বেঘোরে মারা যাবি কিন্তু,” অণিমা আঁতকে উঠে বলেছিল। রূপাকেই কাঁথাটা দেওয়া ভাল।

“খুব উপকার করলে গো বৌদি,” রূপা জিনিসটা হাতে নিয়েই বলল। “আমাদের কিছু হবে না, নাতিটাকে নিয়েই চিন্তা। ছয় মাসের বাচ্চা অমন ভেজা ঘরে থাকা কি ভাল, বলো? এ কাঁথাটা বেশ মোটা আছে, ওর গায়েই দেব।” তারপর কাঁথাটা খুলে দেখেই মুগ্ধ উক্তি “ও মা! এ কার হাতে বানানো গো? কি সুন্দর! আমার ঠাকমা পারত এমনধারা।”

“আমিই বানিয়েছি। অনেকদিন আগে।”

“বাবা, বৌদি! তোমার কত গুণ গো! এ কাঁথা বানানো কি সোজা?”

“অ্যাই যা তো, কাজ শেষ কর। খালি বাজে কথায় সময় নষ্ট…”

“এ রাম! তুমি বুঝি কার জন্যে এত খেটেখুটে এমন কাঁথা বানিয়েছিলে, আমায় দিয়ে দিচ্ছ। সে রাগ করবে না?”

“কার জন্যে আবার বানাব? আমার কি নাতি পুতি আছে রে পাগলি? তোর নাতি গায়ে দিলেই আমার আনন্দ হবে। তুই নিয়ে যা বাজে না বকে।”

রূপা সাত রাজার ধন এক মানিক নিয়ে গেল। অণিমার মনে হল, ভুতোর বৌভাতে যাওয়ার ইচ্ছেটাও যেন আরো কমে গেল।

চোখ ফেটে জল এসেছিল, কিন্তু সে জল ভটচায বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে কাউকে সে দেখতে দেয়নি সেদিন। গটগট করে হেঁটে যখন ওদের বড় লোহার গেট দিয়ে বেরিয়ে আসছে, অক্ষয়বাবু পিছু ডেকেছিলেন “অণিমা, যাচ্ছ কোথায়? খেয়ে যাও।” সে কথায় কান না দিয়ে গটগট করে হেঁটে বাড়ি চলে এসেছিল। তারপর আর সামলাতে পারেনি নিজেকে। দরজায় তালা দিয়েই ভেঙে পড়েছিল। আশ্চর্যের কথা, শাশুড়ি একবারও জিজ্ঞেস করেননি কী হয়েছে। বুকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন “কাঁদে না, মা। কাঁদে না। বামুনদের ধরন ধারণ আলাদা, বুঝলে না? তার উপর অক্ষয়ের মা সাত্ত্বিক মানুষ। উনি থাকতে মণ্ডল বাড়ির বউ ওনার নাতির ভিক্ষে মা হতে পারে?”

অণিমার ভিক্ষা মা হওয়া ভুতোর আবদারেই। সে তখন ক্লাস এইট। ঠাকুমার আদরে বাবার মতে “বাঁদর হয়েছে,” পাড়ার লোকের মতে “লায়েক হয়েছে”। তার কোনো আবদার কেউ ফেলে না। নমিতা বৌদি বলেছিলেন “আমার ছেলে অনেক অন্যায় আবদার করে বটে, তবে এটা কিছু অন্যায় বলেনি। তুমি ওর জন্যে আমার চেয়ে কম করোনি, অণিমা। ব্রহ্মচারীর প্রথম ভিক্ষা তোমার থেকেই নেওয়া উচিত।” বিভূতি হেসে বলেছিল “যাক, তোমাকে আর শুনতে হবে না আগের জন্মে তুমি ওর মা ছিলে। কেউ বললে বলবে, এ জন্মেও আমি ওর ভিক্ষে মা।”

অক্ষয় ভটচাযরা চার ভাই, তিন বোন। লক্ষ্মী, সরস্বতী দুই বোন বোধহয় কেবল ওদের বাড়িতেই মিলেমিশে বাস করেন। অক্ষয়বাবু ইনকাম ট্যাক্স অফিসার ছিলেন, তাঁর দুই ভাই অধ্যাপক, এক ভাই সরকারী ইঞ্জিনিয়ার। বোনেরা কেউ ডবল এমএ, কেউ ট্রিপল। ডাক্তার, উকিল, আমলাদের সাথে বিয়ে হয়েছে। পাড়ায় ভটচাযদের সম্মান আকাশছোঁয়া। তাদের বাড়ির ছেলের ভিক্ষা মায়ের অভাব? কিন্তু ভুতোর পছন্দ নূতন কাকীকে --- এ কথা ভেবে গর্বে বুক ফুলে উঠেছিল। পাড়ায় তখন একটাই মুদির দোকান। সে দোকান থেকে চাল না কিনে বিভূতিকে দিয়ে অফিস ফেরতা বড়বাজার থেকে ভাল চাল আর গাওয়া ঘি আনিয়েছিল। আর নিজে রেলবাজার থেকে বেছে বেছে অন্য জিনিসগুলো কিনে এনেছিল। একখানা নতুন কাপড় পরে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল দণ্ডি ঘরের দরজায়।

ভুতো সবে অণিমাকে প্রণাম করতে যাচ্ছে, হঠাৎ আর্তনাদ করলেন তার ঠাকুমা আরতি দেবী। “এ কি! এ তোরা কাকে ভিক্ষা মা করেছিস!” ভুতোর মাথায় হাতটা রাখতে গিয়ে সরিয়ে নেয় অণিমা।

“কেন মা, কী হয়েছে?” নমিতা বৌদি ক্ষীণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন।

“কী হয়েছে! কী আবার হবে? তোমরা সব নিয়মকানুনের মাথা খেয়েছ। বামুনের ছেলের ভিক্ষা মা হবে একটা নীচু জাতের মেয়ে?”

“ও… সে কথা তো…”

“মাথায় ছিল না তো? তা থাকবে কেন? তোমরা সব মডার্ন হয়েছ, না? আমি ঠাকুর নিয়ে থাকি বলে বাড়িতে কত অধর্ম চলে টের পাই না ভাবো? সব সামলাতে গেলে আর ঠাকুরের নাম করা হবে না বলে কিছু বলি না। তা বলে এতটা বাড়াবাড়ি! এই বুড়ি না থাকলে তোমরা এই পাপটাও করে ফেলতে, অ্যাঁ? ছি ছি ছি!”

“মাসিমা, ভুতোই তো বলেছিল…” বলতে গিয়ে আরতিকে আরো চটিয়ে ফেলল অণিমা।

“আহা গো! কি সরল মেয়ে আমার! ‘ভুতো বলেছিল’। ভুতো এ বাড়ির কর্তা? একটা পুঁচকে ছেলের কথায় আমরা ওঠবোস করব? শাস্ত্র এত ঠুনকো জিনিস?”

অণিমা ধপ করে বসে পড়ল। চোখে চোখ পড়তে দেখল উপস্থিত ভদ্রমহিলারা অনেকেই হাসি লুকোচ্ছেন। আরতি তখন তারস্বরে চেঁচাচ্ছেন “এ পাড়ায় এতগুলো কায়েত, বদ্যিদের বাড়ি? কোনো বাড়ির বউকে বলা গেল না ভিক্ষা মা হতে? আমার চার চারটে উপযুক্ত ছেলে, তারা এই কাজটুকু করতে পারল না নিজেদের বুদ্ধিতে?”

অক্ষয়বাবু শুনতে পেয়ে দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে বললেন “মা, ঠিক আছে, ঠিক আছে। ভুল হয়ে গেছে। অন্যায় হয়ে গেছে। তুমি এখানে বসো, আমি এখনই বাবলুর বউকে ডেকে আনছি। কোনো অসুবিধা হবে না…”

“অসুবিধা হবে না আবার কী? এখন ঠেকায় পড়ে আরেকজনকে ডাকতে যাচ্ছ। ভিক্ষা মা কত সম্মানের জিনিস তোমরা জানো? মণ্ডল বাড়ির বউকে এনেছ ভিক্ষা মা হতে? ছি ছি ছি! আমি বেঁচে থাকতেই এই, চোখ বুজলে তো তোরা বাড়িতে গরুর মাংস রাঁধবি রে।”

অণিমা কোনোমতে উঠে দাঁড়িয়ে মহার্ঘ ভিক্ষায় ভরা ব্যাগটা টানতে টানতে বাড়ির দিকে হাঁটা দিয়েছিল। লায়েক ভুতো একটিও কথা বলেনি।

***

“হ্যাঁ রে, রূপা? ও বাড়িতে তোর নেমন্তন্ন আছে তো?” বৌভাতের দিন সকালে রূপাকে অণিমা জিজ্ঞেস করল। রূপা ভটচায বাড়িতেও বাসন মাজা, ঘর ঝাঁট দেওয়া মোছার কাজ করে।

“হ্যাঁ গো। আমায় একখানা নতুন কাপড়ও দিয়েছে,” একগাল হেসে জবাব দিল।

“আচ্ছা, তুই তাহলে রাতে খেতে যাওয়ার সময় একবার আমার কাছে হয়ে যাস।”

“কেন গো?”

“প্রেজেন্টেশনটা তোর হাতে দিয়ে দেব।”

“সে কি গো! তোমায় যে বাড়ি বয়ে অত ভাল করে নেমন্তন্ন করে গেল!”

“আমি নেমন্তন্ন খাই না তুই জানিস তো।”

“তা এ বেলা গিয়ে বউ দেখে আশীর্বাদ করে এসো…”

“নাঃ! শুভ দিনে ও বাড়ি আমার না যাওয়াই ভাল। তুই মনে করে নিয়ে যাস আমার থেকে।”

রূপা শুভাশুভ বোঝে না, তবে অণিমার কথা সে কখনো ফেলে না।

0 Comments

Post Comment