পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

অশথমা

  • 21 May, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 903 view(s)
  • লিখেছেন : ব্রতী মুখোপাধ্যায়
টাকা আসছিল। আসছিল মানে দিচ্ছিল কেউ। রুমির মা ২ টাকা, শান্তির পিসি ১ টাকা, পলুর মাসি ৫ টাকা। শিওরতনের বাবা একদিন ১০ টাকাই দিল। এইরকম। সন্তুর ঠাকুমা কিছু দেয় না। চুপ করে বসে থাকে আর অতসীর মুখের দিকে চেয়ে থাকে, যেন কিছু লক্ষ করে, যেন কিছু জরিপ করতে চায়। শুধু টাকাই না। শুভ্রা একদিন পেয়ারা এনে দিল, বলল, গাছপাকা। আপ্পা একদিন কাচকলা এনে দিল, বলল, আমরা কেউ কাচকলা খাই না। দেখাদেখি একদিন কমলালেবু এনে দিল বেণী, বলল, তার ভাই নাসিক থেকে এনেছে। তবে অবাক করে দিল পুন্যির মা, সে আনল আলু বেগুন আর আলোচাল।

 

অতসী কিছু চায়নি। কাউকেই কিছু দিতে বলেনি। তবে যখন কেউ কিছু দিচ্ছিল নিষেধ করেনি, নিষেধ করতে পারেনি বা চায়নি।শুরুতে বলছিল বটে, এসব কী? এসব কেন? পরে সে আর কিছুই বলেনি। নিজেরাই অশথ গাছের তলায় একটা শাদা চাদর পেতে তার মধ্যে যে যা আনছে রাখছে। তারপর নিজেরাই চাদরটি চার কোণ জুড়ে বেঁধে অতসী যে কোয়াটারে থাকে সেখানেই পৌঁছে দিচ্ছে। প্রত্যেকদিন না, মাঝেমাঝে।

 

দুদিক ধরে সারি সারি কোয়াটার, খুপরি খুপরি ঘর। ঠিক মাঝখানটায় বড়সড় অশথ গাছ। তা বছর দুই হবে। ঠা ঠা রোদের দুপুর ছিল সেদিন। সবাই দেখল অতসী পুন্যির মাকে পাঁজাকোল করে অশথ গাছে ছায়ায় এনে শুইয়ে দিয়েছিল। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল পুন্যির মা। নরসিং তার তলপেটে লাথি মারতে মাটিতে সে আছড়ে পড়েছিল। খারাপ খারাপ গাল তখন নরসিং এর মুখে। কেউ সামনে এগিয়ে যায়নি। নরসিং যে গুন্ডা সেকথা সবাই জানত। অতসীর বড় সাহস। শুনতে পেয়েই ছুটে গেছে। সেখানে নরসিং আছে কী নেই যায় আসে না তার। পাঁচ ফুট হাইট। উবু হয়ে বসে পুন্যির মাকে দুহাতের মধ্যে তুলে ধীর পায়ে অশথ গাছের তলায়। একজন-দুজন তার পেছনে। তারপর পুন্যির মার চোখেমুখে জল ছিটিয়ে জ্ঞান ফিরিয়েছিল। তারপর পলুর মাসি এক গ্লাস লেবুর সরবত নিয়ে এসেছে। পুন্যির মা অতসীর পা জড়িয়ে কেঁদেছে। পায়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করেছে। তখন অতসী বলেছে, আমাকে না। আমাকে না। অশথকে দেখো। অশথকে প্রণাম করো।

 

সেই থেকে অতসী সন্ধে হতেই অশথতলায় এসে বসে। একা একাই বসে। এইসময় পাখিরা সব ফেরে। শালিখদের চেনা যায়। বাকিদের অতসী ঠিক চেনে না। এইসময় সবাই মিলে অশথতলা শব্দময় করে তোলে। এক-দুদিন পরে রুমির মা, শান্তির পিসি, শুভ্রারাও আসে, তার পাশে এসে বসে। সেই শুরু।

 

অতসী বেশ গল্প বলতে পারে। ছোটবেলায় ঠাকুর্দা-ঠাকুমার মুখ থেকে সেসব গল্প শোনা। সে নিজে থেকেই গল্প বলতে শুরু করে না। কেউ যদি ধরিয়ে দেয়, তার গল্প আরম্ভ হয়। যেমন, সেদিন মারশেলিং ইয়ার্ডের লাগোয়া কোয়াটারে একটা চোর ধরা পড়েছে। লোকটা গেরুয়া জামা পরে সাধু সেজে ভিক্ষে চাইতে এসেছিল।  দেখছে ঘরে কেউ নেই, কেউ নেই মানে ছিল বলতে শুধু ওই রুপনার মা। ব্যস। রুপনার মাকে ছুরি দেখিয়ে  কুড়োতে লাগল বাসনকোশন, চাল, ডাল, টেবিল ঘড়ি, সর্ষের তেল, সাবান। রুপনা মা ভয়ে কিছু বলছিল না। তখন রুপনার কাকা হঠাৎ এসে হাজির।

 

শুনে অতসী শুরু করল সীতাকে পর্ণকুটিরে একা রেখে লক্ষ্মণ তো রামের ভাই লক্ষ্মণ ভাই লক্ষ্মণ ডাক শুনে বেরিয়ে গেছে। অতসী বলতে লাগল মারীচ এসেছিল সোনার হরিণ সেজে। সীতা বলল, সোনার হরিণ চাই। বলতে বলতে রাবণের কথা এল। রাবণ সাধু সেজে এসেছিল, জটাজুটো মাথায়, নিখাদ গৌরবর্ণ, এসে সংস্কৃত ভাষায় বলেছিল, ভগবতি! ভিক্ষাং দেহি।

 

যে গল্পটি ধরিয়ে দিয়েছিল সে বলল, এই লোক কিন্তু রুপনার মাকে হরণ করতে আসেনি।

অতসী তখন বলতে আরম্ভ করেছে জামদগ্নি পরশুরাম কেন কর্ণকে শাপ দিয়েছিল, দেবরাজ ইন্দ্র কীভাবে দানবীর কর্ণের কবচকুণ্ডল দান হিশেবেই নিয়ে গেল, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কর্ণের রথ কেমন করে কাদায় আটকে গেল, নিরস্ত্র কর্ণকে কেমন করে বীরশ্রেষ্ঠ অর্জুন হত্যা করল। কর্ণের জন্যে শ্রোতাদের চোখ ছলছল করে উঠল।

 

এইসময় বি শিফটের ডিউটি শেষ হবার আগেই কারখানা থেকে ফিরে আসে আপ্পা আর শিওরতন।  সোমনাথ অশথতলার আলোছায়ায় দাঁড়িয়ে। বলছে, চলো। রাত কত হল? পারুলের তো খিদে পেয়েছে।

 

সোমনাথ গোলবাজারে জৈনদের কাপড়ের দোকানে কাজ করে। ঘরে ফিরতে অনেকখানিরাত হয়েযায়। খিদে তারও পায়। জৈনদের যত বড় কাপড়ের দোকান, সোমনাথ তত কম মজুরি পায়। আর কলোনির যে কোয়াটারে বউবাচ্চা নিয়ে সে এখন থাকে সেটা তার ভাইএর। ভাই গিধনিতে থাকে, সেখানেই সে কাজ করে।

 

সোমনাথ প্রথম প্রথম বলত, এসব কী হচ্ছে? পেয়ারা দিচ্ছে, কমলা দিচ্ছে, চাল আলু তেল সাবান, তার ওপর আবার টাকা। আমার তো মাথায় কিছু ঢুকছে না।

 

ভাত বাড়তে বাড়তে মুখ বন্ধ করে থাকে অতসী। রান্নাঘরের জানলা দিয়ে আপ্পাদের ছোট বাগানটা দেখা যায় ল্যামপোস্টের আলো এসে পড়ায়, বাগানে গুটিকয় কলাগাছ, আস্তে আস্তে নড়ে। অতসীর ভাবসাব সোমনাথ বুঝতে পারে না।

 

সোমনাথ এখন আর কিছু বলে না। পারুলের ছাত্রবন্ধু বইখানার দাম একটু বেশি। কিনে আনতে পারে। পারুল ছবি আঁকতে চায়। তার জন্যে রং পেনসিল কিনে আনতে পারে। একটা বিশ টাকা দামের কলম। একেকদিন খানছয়েক ডিম। অতসীর শরীরটা ভেঙে গেছে, সেইজন্যে পঞ্চাশ গ্রাম ঝর্ণা ঘি।

 

পারুল বলল, বাবা তুমি জানো না মা কী সুন্দর গান গাইতে পারে। আজ অশথতলায় এমন গাইল, পুন্যির মা একেবারে কেঁদে ফেলল।

অতসীর গানের গলাই সোমনাথের মন ভুলিয়েছিল। মেয়েকে সে কাহিনি বলা যায় না। সে কাহিনি রুমির মা জানে না, পুন্যির মা-ও জানে না।

 

তবে এই গানের জন্যেই সন্ধেবেলার অশথতলা জমে উঠল। শান্তির পিসি বলে, মায়ের পায়ের জবা হয়ে। রুমিরমা বলে, শ্যামা মা কি আমার কালো রে।

অতসী সবে শেষ করেছে যে কেঁদেছে সেই পেয়েছে হরিনামের জপের মালা, সন্তুর ঠাকুমা বলল, নাতিটারে তুমি সেই যে নাওয়াইছিলা, নিজের ঘরে লইয়া গিয়া নাওয়াইছিলা, তার গা ভর্তি খোসপাঁচড়া, নিমহলুদে সাফ করসিলা…

অতসীর মনে পড়ে। নিমপাতা আর হলুদ গরম জলে ফুটিয়ে সন্তুকে ঘরে এনে স্নান করিয়েছিল। তার গায়ে তখন  খোসপাঁচড়া। শান্তির পিসিরও মনে পড়ে অতসী শান্তিকেও একদিন স্নান করিয়েছিল, তারও গায়ে কীসব বেরিয়েছিল। অতসীর এমন অভ্যেস ছিল সবাই জানত। কিন্তু সন্তুর ঠাকুমা আজ যা বলল সেকথা অতসী আগে কখনো ভাবেনি। সন্তুর ঠাকুমা বলল, নাতির হইসে বেদম জ্বর, গা পুইড়্যা যাইত্যাসে, তুমি মা একবার আইস্যা তার গায়ে হাত বুলাইয়া দাও…

অতসী চমকে ওঠে। বলে, আমি? আমি হাত বুলোলে কিছু হবার না। হোমিও ডাক্তার রবিনদার কাছে নিয়ে যাও, মাসি।

কিন্তু শান্তির পিসি বলল, বলছেন যখন, যাওই না একবার। কিছুই বলা যায় না। তুমি গায়ে হাত বুলিয়ে দিলে বাচ্চাটার জ্বর নেমেও যেতে পারে।

তার কথায় সায় দিল পলুর মাসি, শুভ্রাও, এমনকি পুন্যির মা-ও।

 

সোমনাথ ক্রমশই টের পায় পারুল বই নিয়ে বসলে মাকে প্রায়ই কাছে পায় না। তার সেলাইফোঁড়াই থাকে, শান্তির পিসিদের জন্যে সময় দিতে হয়, তাদের কথা শুনতে হয়।

 

যেদিন পলুর মাসিদের ঘরে তুমুল অশান্তি ঘটে, পলুর মাসি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাবে বলে পোঁটলাপুটলি বেঁধে ফেলে, পলু এসে অতসীর হাত ধরে টানে, তার চোখে অথৈ জল, অতসী ভেবে পায় না পলুর সঙ্গে গিয়ে সে কী করবে। পলুর মাসি বিধবা হবার পরে বোনের সংসারে উঠে এসেছে অনেক বছর হল, পলুর বাবার সম্মতিতেই, কিন্তু অশান্তি যা হয় পলুর মায়ের সঙ্গেই। অতসী ভুলভাল আন্দাজ করতে চায় না, তবে কত কিছুই তো মনে আসে।

সোমনাথ বলে, তুমি গিয়ে কী করবে?

কিন্তু পলুর কান্না থামতে চায় না, মাসিকে তুমি যেতে দিও না…

 

এইভাবেই অতসী একদিন অশথ মা হয়ে যায়। সন্ধেবেলার অশথতলায় ভিড় এখন আগের চেয়ে বেশি। বেণী, বাদল আর আপ্পা মিলে অশথতলার চারদিকটা ইট বালি সিমেন্ট দিয়ে বাঁধিয়ে দিয়েছে। অশথ গাছটিরও ডালপালা বেড়েছে, মাথায়ও সে রাস্তার ল্যামপোস্টের চেয়ে উঁচু এখন।

 

অতসী গল্প বলে, তবে নতুন গল্প বলতে পারে না, পুরনো গল্পই বলে, সীতার বনবাস আর অগ্নিপরীক্ষা, হনুমানের স্বর্ণলংকাদহন, মেঘনাদের মেঘের আড়াল থেকে ঘোর যুদ্ধ, তরণীসেন বধ, রামচন্দ্রের হরধনু ভঙ্গ, পাষাণী অহল্যা। গানগুলিও নতুন হয় না। কখনো কখনো রবিঠাকুর গেয়ে ফেলে, যেসব গান ধরা যায় না ঈশ্বরের জন্যে নিবেদিত না ভালোবাসার মানুষের জন্যে নিবেদিত।

 

যেদিন শুভ্রা নিখোঁজ হয়ে গেল, সবাই অবশ্য বলছে না নিখোঁজই হয়েছে, কেউ কেউ জানত নরসিংএর ছেলের সঙ্গে ভাব-ভালোবাসা গোছের কিছু হয়েছিল, দুজনকে একসঙ্গে আপ্পাদের ঘরের পেছনে যে বড়সড় ছাতিম গাছ সন্ধের পর অনেক বেশি অন্ধকার জড়িয়ে থাকে সেখানে তাদের একেকদিন কথা বলতে দেখা গেছে, পলুর মাসি শুভ্রার মার কানে সেকথা তুলেওছে, শুভ্রার বাবা গ্যাংম্যান আর খুব রাগী, মেয়েকে একদিন তুমুল পিটেছে, আর তারপরই শুভ্রা নিখোঁজ। এখন নরসিংএর কাছে কে যাবে? কে গিয়ে জিজ্ঞেস করবে তার বখাটে ছেলেটা ঘরে আছে না শুভ্রাকে নিয়ে কেটে পড়েছে?

 

শুভ্রার মা রাত ঘন হতেই অতসীদের দরজার কড়া নাড়ল। সোমনাথ দরজা খুলে হকচকিয়ে গেল। অচেনা মহিলা। শুভ্রার মাকে সে সত্যিই চিনত না। শুভ্রার মা বলল, অশথ মার কাছে এলাম। অতসী তখন এঁটো বাসন ধোয়াপাখলায় ব্যস্ত ছিল, কিন্তু দ্রুতই উঠে এল গলার স্বর শুনে। হাত ধরে ডেকে আনল ঘরের ভেতর।

অশথ মা শুনে সোমনাথ খুব চমকায়নি, শব্দদুটি আগেও তার কানে এসেছে। সে ভেতরে সরে গেল। বারান্দার মেঝেতেই বসে পড়ল শুভ্রার মা। বসেই অঝোরে কাঁদতে শুরু করল। অতসী বসল তার পাশে। তার পিঠে হাত বুলোতে বুলোতে বলল, শান্ত হও দিদি।

শুভ্রার মা বলল, তুমি একবার গুণে দেখো কোথায় আছে।

অতসী বলল, আমি যে গুণতে জানি না।

শুভ্রার মা বলল, জানো না? তাহলে সবাই যে বলে তুমি সব পারো?

অতসী হাসল, বলল, ভুল বলে সবাই।

 

অতসী হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। সোমনাথকে বলল, বাসনগুলো একটু ধুয়ে রাখো না, আমি একবার বাইরে যাব।

সোমনাথ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবে? এখন তো রাত…

অতসী বলল, ওই অশথ তলায়।

বলে সে শুভ্রার মাকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। পারুল বলল ভেতর থেকে, তাড়াতাড়ি ফিরবে, মা।

 

অতসী সোমনাথকে সত্যি কথা বলল না। মোরামের রাস্তা ডিঙিয়ে উত্তরে আরপিএফ কোয়াটারগুলোয় যে ঘরটা নরসিং জবরদখল করে থাকে তার দরজার কড়া নাড়ল। তার পাশে শুভ্রার মা তখন ঠকঠক করে কাঁপছে। সে একবার নিচু স্বরে বলল, অশথ মা, চলো, আমরা ফিরে যাই।

অতসী উত্তর দিল না। দরজা খুলল নরসিং নিজে। কুত্তা দারুর গন্ধ তার মুখে। নরসিং বলল, ভেতরে এসো অশথ মা। অতসী বলল, ভাইয়া! 

 

নরসিং দাগী ওয়াগন ব্রেকার। সব্বাই জানে। রেলের মারশেলিং ওয়ার্ডে তার একার দাপট। একবার দুবার পুলিশ এসে তুলে নিয়ে যায়। দু-তিনদিন পরে ফিরে আসে আবার। সন্ধে নামলে রাস্তার ধারে ল্যামপোস্টের আলোর নিচে সঙ্গীদের নিয়ে জুয়ো খেলে। লছমন তার একমাত্র ছেলে। গায়ে গতরে লম্বা চওড়া। ক্লাস টেনে পড়তে পড়তে পড়া ছেড়ে ইয়াকুব দর্জির দোকানে সেলাই শিখছে। শিখছে মানে ভালই শিখেছে। কলোনির মেয়েরা তার কাছেই ব্লাউসের কাপড় দিয়ে আসে।  

 

নরসিং বলল, শুভ্রা আমাদের ঘরে আসেনি। লছমন ওই দেখো ওই ঘরে শুয়ে।

 

পরের দিনও শুভ্রা এল না। শুভ্রার মাকে সঙ্গে নিয়ে থানায় গেল আপ্পা, বেণী আর বাদল। মেজ বাবু শুনল সব। শুভ্রার মাকে জিজ্ঞেস করল, আপনার নাম?

শুভ্রার মার যে একটা নাম আছে আপ্পারা কেউ জানত না, সবাই বলত শুভ্রার মা।

জোছনা। জোছনা পাতর।

মেয়ের নাম, বয়েস, লেখাপড়া ইত্যাদি জিজ্ঞেস করে মেজ বাবু বলল, ফটো একটা লাগবে যে। এনেছেন?

জোছনা বলল, ফটো তো নেই।

ষোলো বছর বয়েস, ফটো নেই?

শুভ্রার মা কাঁদতে থাকল।

 

পরের দিনও শুভ্রা ফিরল না। শান্তির মাসি, পলুর মাসি, সন্তুর ঠাকুমা অশথতলায় অতসীকে ঘিরে বসল। অতসীর মুখে একটাও কথা নেই। গান গাওয়ার কথা ভাবতেই পারছে না। তারপর সন্তুর ঠাকুমা এল, বাপী এল, বাদল এল, তারপর জোছনা মানে শুভ্রার মা। অশথতলায় কেউ একটা মাটির প্রদীপ জ্বেলেছিল, বাতাসে তা নিবে গেছে। ধুপ জ্বেলেছিল, তার গন্ধও উড়ে গেছে। অতসী পশ্চিম আকাশে লেবুর কোয়ার মতো চাঁদ দেখতে পেল। তার কোলে শুকতারা মিটমিট করছে।

সন্তুর ঠাকুমা বলল, অশথ মা! সন্তুর আবার জ্বর আইসে। যুদি একবার…

পলুর মাসি বলল, কখনো কিছু চাই নাই, অশথমা। তুমি তো সকলই জানো।

শান্তির পিসি বলল, অশথমা, কখনো কিছু চাইনি আমিও। আমাদের সংসারে কী যে হয়… 

 

বাবা আরেকটা বিয়ে করে খরিদার দিকে চলে গেল। মা কেমন পাগল ছিল। আরও বেশি পাগল তারপরই। সেই থেকে অতসী দাদা-বৌদির ঘাড়ে। এসব সে মনে আসতে দেয় না। আজ এখুনি মনে এল। দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে অল্পক্ষণ সামলানোর চেষ্টা করল সে। পরমুহূর্তেই উঠে দাঁড়াল। আঁচল দিয়ে মুখ মুছে নিল। অন্ধকারে কেউ তার মুখের পেশীর নড়াচড়া দেখতে পাচ্ছিল না। শিশুর মতো কেঁদে ফেলল সে। কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল, আমি না কিছু পারি না। সত্যিই পারি না। তোমরা আমাকে বিশ্বাসকরো। আমি কখনো কিচ্ছুই পারিনি। 

 

পুন্যির মা তার পাশে এসে দাঁড়াল। শান্তির পিসি, পলুর মাসি, সন্তুর ঠাকুমা, সবাই আরও ঘন হয়ে। অতসী কাঁদছিল। অন্যরাও কাঁদছিল। অতসী কিছুতেই ভেবে পাচ্ছিল না মেয়েটা কোথায় যেতে পারে। নিজেও সে একদিন সোমনাথের হাত ধরে দাদার কাঁধ থেকে অনিশ্চয়ের রাস্তায় নেমেএসেছিল।

 

সোমনাথ কখন এসে দাঁড়িয়েছে সে খেয়াল করেনি। বাবার পাশে পারুল, দুহাতে ফ্রগ তুলে দাঁত দিয়ে চিবুচ্ছে। সোমনাথ বলল, ঘরে চলো।

অতসী বলল, আমি একবার থানায় যাব। তোমরা কেউ আমার সঙ্গে যাবে? 

 

 

 

0 Comments

Post Comment