পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

বোতলবন্দী জিন

  • 30 March, 2025
  • 0 Comment(s)
  • 309 view(s)
  • লিখেছেন : আবু সঈদ আহমেদ
বন্ধুবান্ধবরা একজায়গায় হলে কোনও না কোনও সময় ভূতের গল্প কখনও না কখনও করেনি, এটা কখনো হয়নি। সুরমা, সবিতারাও করেছিল। তখন তাদের উচ্ছ্বল কলেজ জীবন। সেদিন মানে সেই সন্ধ্যায় হস্টেলে আড্ডাটা একেবারে জমে ক্ষীর হয়ে উঠেছিল।

সেইসময়ই এসে যায় ভূতের প্রসঙ্গ। প্রতিটা ভূতের গল্পের আসরে যেরকম কিছু বেয়াড়া অবিশ্বাসী জুটে যায় তাদের বেলাতেও ব্যতিক্রম হয়নি। অন্যান্য অনেক হস্টেলে ভূতের বদনাম থাকলেও তাদের নতুন তৈরি হওয়া হস্টেলে সেসব কিছু ছিল না। ফলে এই বেয়াড়া অবিশ্বাসীরা বেশ দাপটের সাথেই ভূতে বিশ্বাসীদের কোণঠাসা করে দিচ্ছিল। অন্যান্য অবিশ্বাসীদের মতো অনন্যারাও যখন "এতই যখন ভূত আছে বলছিস, তাহলে একটাকে এনে দেখা না।" তখন মুখচোরা সবিতাই স্বভাববিরুদ্ধভাবে বেশ ফুঁসে উঠে বলেছিল,

"সাহস থাকে তো চল আমাদের গ্রামের বাড়িতে।"

"তাই, সেখানে ভূতেদের চিড়িয়াখানা আছে বুঝি।" বলেই হেসে গড়িয়ে গেছিল অনন্যা। মুখচোরা সবিতাকে এরকম ফুঁসে উঠতে দেখে প্রথমে ঘাবড়ে গেলেও হাসিতে যোগ দেয় একে একে অনিন্দিতা, সাগরিকারা। সুদেষ্ণা সবাইকে থামিয়ে বলে,

'আচ্ছা শোনাই যাক না ও কি বলছে। কোথায় কেমন ভূত আছে শুনি। বল সবিতা তোদের কেমন ভূত।"

সবিতা ভূতের গল্প বলার আগে এক গৌরচন্দ্রিকা নামিয়ে আনে,

"তাহলে তোদের আমাদের গ্রামের বাড়ির বিবরণ শুনতে হবে। এমন কিছু বড় বাড়ি নয়। কিন্তু যেখানে ঘটনাটা ঘটে সেটা আমাদের বাড়ির কাছেই। আমাদের পরিবারের সবাই কোনও না কোনও সময় শুনেছে এটা।"

সবিতা যে ভালো গপ্পোবলিয়ে এটা ওদের কারওরই জানা ছিল না। ওর বলার ভঙ্গিতে কিছু একটা ছিল যাতে বাইরের ভ্যাপসা গরমেও সবাই বেশ গুছিয়ে বসলো।

"ঠিক ভূত বলা যাবে না। আমাদের এলাকায় ওটাকে জিনের কান্না বলে।"

অনিন্দিতা ফুট কাটে,

"তা কান্নাটা তোর সেই জিনেরই তো? শেয়াল-খটাসের নয় কিনা  খোঁজ নিয়ে দেখেছিস?"

সবাই হেসে ওঠার আগেই সবিতা বলে ওঠে,

"অনেকেই এর আগে খোঁজ নিতে গেছে। তোরাও গিয়ে নিয়ে আয় না। অনেকেই তো অনেক রকম বিপদে পড়েছে এটা করতে গিয়ে।"

সুরমা বলে,

"বাদ দে ওদের কথা। তুই তোর গ্রামের কথা বল।"

"আমাদের গ্রামটা এমন কিছু বড় নয়। সেরকম বহুপুরনো গ্রামও নয়। আগে পুরোটাই সেখানে জঙ্গল ছিল। পাশে এক নদী বয়ে যেত। এক জমিদার সেখানে এক জমকালো শিকার কুঠি বানান। সেখানে সাহেবসুবোদের খেদমত করতেন। নদীতে যেসব জানোয়ার জল খেতে আসতো তাদের শিকার করাতেন সাহেব-মেমদের দিয়ে। আর তোরা তো জানিস শিকার ছিল সাহেবদের প্রিয় মনোরঞ্জন। এইসব খোসামোদ করে সেই জমিদার একদিন খানসাহেব হলেন। তারপর হলেন খান বাহাদুর। তারপর নবাব সাহেব আর নবাব বাহাদুর হয়ে শেষমেষ একেবারে নাইট উপাধীও পেয়েছিলেন। তারপর একদিন দেশভাগ হলো। ওনার বংশধরেরা চলে গেলেন পাকিস্তানে। আর নদীটাও সরে গিয়ে জঙ্গলের অনেকটাই গ্রাস করে নিয়েছিল। সেখানে বাঁধ নিয়ে নতুন গড়ে ওঠা পয়ন্তী জমিতে পূর্ববঙ্গ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের নিয়ে গড়ে ওঠে গ্রাম। দাদুর আমলে আমরা এখানে আসি। আর আমার বাবাকাকারা এই গ্রামেই বড় হয়েছি।"

"তা এর মধ্যে তোর সেই ভূত না জিন কোথা থেকে আসছে?" অনন্যা প্রশ্ন করলো।

"বলছি। সে বহুযূগ আগের কথা। তখন জমিদার সাহেব সবে সবে নবাব সাহেব হয়েছেন। তাঁর ছেলেরা তখন কিশোর কালে পড়েছে। তাদের মধ্যে একজনের শিকার কুঠি থেকে শিকার করে ঠিক জুত হচ্ছিল না। ওর শখ হলো লোকলস্কর নিয়ে জঙ্গলে গিয়ে শিকার করবার। জমিদারদের ব্যাপার ওমনি কিছু সাঙ্গোপাঙ্গো জুটিয়ে নবাবজাদা চললেন শিকারে। কিন্তু সমস্যা হলো শিকার থেকে ফিরে আসার পরে। নবাবজাদা তো বটেই জমিদারের লোকেরাও ঘুমের মধ্যে ভুল বকতে থাকে, কখনো রাতে একা একা হাঁটে, কখনো দুঃস্বপ্ন দেখে কেঁপে ওঠে। একেক সময় তো ওরা কাউকেই চিনতে পারে না। লোকজন ভয় পেয়ে যায়। তখন এক গুণীন ডাকা হয়। গুণীন বলেন, 'এদের ওপর জ্বিনের আসর করেছে।' সেই গুণীন এদের ওপর ভর করা জিনকে ধরে একটা তামার বোতলে ভরে শিকারকুঠির কাছেই পুঁতে রাখেন।" সবিতা এতটা বলে একটু জল খাওয়ার জন্য হাত বাড়ালো।

"তাহলে ওই পুঁতে রাখা বোতল থেকেই কান্না আসে?" সুরমা জিজ্ঞেস করে।

"হ্যাঁ, কিন্তু কান্নার ঘটনা অনেক পরের। নবাবের পরিবার পাকিস্তানে চলে যাওয়ার পরের কথা। তখন নতুন বসত গজিয়ে উঠেছে। সেসময়ই এইসব কান্না শোনা যেতে থাকে। কখনও কখনও বিকট গন্ধও আসতে থাকে। মানুষজন একে নতুন এসেছে। তার ওপর এই নয়া বিপদে ভালোমতই চিন্তায় পড়েন ওঁরা। সেসময় ওঁরা লক্ষ্য করেন যে জায়গাটা থেকে মাঝে মাঝে কান্নার শব্দ আসে সেটা শিকারকুঠির একপাশে। শিকারকুঠির পুরনো চাকরবাকররা তখনো দুএকজন ছিল। বয়স হয়ে যাওয়ায় আর নতুন দেশে যেতে পারেনি। তাদের মুখেই ওই জিনের আসরের গল্প আর বোতল পুঁতে রাখার কথা উদ্বাস্তুরা জানতে পারেন। আবার গুণীণ ডাকা হয়। পুরনো গুণীন ততদিনে মারা গেছেন। ওনার নাতি আসেন। উনি বলেন এর বন্ধু জিনেরা একে ছেড়ে পাকিস্তান চলে গেছে। আগে তাও জঙ্গল থেকে একে দেখতে আসতো। সেজন্য মনের দুঃখে কাঁদে। কিন্তু এখন আর একে ছাড়া যাবে না। আবার কোথায় কার ওপর আসর করে দেয় কে বলতে পারে? এর পর অনেক দিন চলে গেছে। নতুন শিক্ষাদীক্ষা পেয়ে অনেকেরই অবিশ্বাস গজিয়ে ওঠে। অনেকেই ওখানে কান্নার খোঁজ করতে গিয়ে বিপদে পড়েছে। কেউ কেউ পাগলও হয়ে গেছে চিরকালের মতো। একজন গ্রামে ঘুরতে এসে, বেগ সামলাতে না পেরে ওখানে মাইনাস করতে গেছিল। তার জানা ছিল না ঘটনাটা। সে বেচারা দীর্ঘদিন যন্ত্রণা নিয়ে ভুগে শেষে মারাই যায়।"

“তা এই কান্নার জন্য কারও অসুবিধা হয়না?” প্রশ্ন করে সুরমা।

“কান্না সব সময় তো এখন শোনা যায়না। আর গ্রামও আর সেই নিশুতিপুর নেই। এখন বাড়িঘর অনেক বেড়ে গেছে। শিকারকুঠির আসেপাশের জায়গা বাদ দিলে সবজায়গাতেই এখন লোক আর লোক। বিশেষ বিশেষ সময় নিঝুমরাতে কাছাকাছি এলাকাগুলোতে কখনো সখনো শোনা যায়।"

 

"অতিপ্রাকৃত গল্পে গল্পের চেয়ে ভূমিকা বড় হয়ে থাকে।

গাছ যত-না বড়, তার ডালপালা তার চেয়েও বড়।"

হুমায়ুন আহমেদ তাঁর "বৃহন্নলা" গল্পে এই কথা দিয়েই শুরু করেছিলেন অমর চরিত্র মিশির আলির যাত্রা। আমাদের গল্পের শেষ লগ্নেও একই কথা দিয়ে শেষের শুরু করতে হচ্ছে। সুরমা, সবিতাদের কলেজজীবন বহুদিন শেষ হয়ে কর্মজীবন শুরু হয়েছে। যার কিছুদিনের মধ্যে সংসার জীবনও শুরু করে দিতে হয়েছে বাড়ির লোকেদের চাপে। সবিতার বিয়ে হয়েছে বাড়ির পছন্দের পাত্রের সাথে। সুরমা বিয়ে করেছে তমঘ্নকে, একমাত্র যার সাথে গ্র্যাজুয়েশন আর মাস্টার্সের সফর পুরো করেছে। দুজনের চাকরিই ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় কিন্তু একই সময়ে হয়েছিল। তাই বাড়িতে বেশি সমস্যা হয়নি। কলেজজীবনের বান্ধবীদের মধ্যে সবিতার সাথেই নিয়মিত যোগাযোগটা দৃঢ়ভাবে থেকে গেছে।

এদিকে তমঘ্নকে অফিসের কাজে বাইরে যেতে হয়েছে। অন্যদিকে সুরমার অফিসে শনিবার ছুটি পড়ে যাওয়ায় এই ফাঁকা সময়টা বরের অভাবে কি করে কাটাবে সেটাই ভাবছিল। সেসময়ই সবিতার ফোন আসে। সবিতারাও শনি-রবি ছুটি পেয়ে গ্রামের বাড়িতে শিকারকুঠি দেখে আসার ছক কষেছে। সুরমারও মনে হয় ওদের সাথে ঝুলে পড়া মন্দ কি? সে প্রস্তাবটা পাড়তেই লুফে নেয় সবিতা।

সত্যি বলতে কি, বোতলবন্দী জিনের গল্প সেদিন ওরা শুনলেও কারওরই সবিতাদের গ্রামের বাড়িতে যাওয়া হয়নি। অনন্যা পরে বলেই দিয়েছিল "ওই ছিঁচকাঁদুনে জিনের কান্না শুনিয়ে উনি ভূতের অস্তিত্ব প্রমাণে নেমেছেন।"

"সাহস নেই তাই যেতে চাইছিস না। সেটাই বল।" ফুঁসে উঠে জবাব দিলেও  সুরমাও কোনওদিন যেতে পারেনি সবিতাদের গ্রামে। সবিতার বিয়েও শহরেই হয়েছিল। তাই এবার এই সুযোগ আর ছাড়তে চাইলো না।

সবিতাদের গ্রামে পৌঁছে শিকারকুঠি দেখে এদিক-সেদিক ঘুরে দিনটা মন্দ গেল না। রাতে সবিতাদের ঘরেই থাকার ব্যবস্থা হলো। সবিতার ভাইপো-ভাইঝিরা একসাথে শোবার জেদ করায় সুরমার আর একসাথে ঘুমনো হলো না। জায়গা হলো ওপরতলার একটা ঘরে। রাতে তমঘ্নর সাথে ভিডিও কল করতে করতে ঘুম প্রায় চলেই এসেছিল। হঠাৎ খুটখাট শব্দ শুনে তন্দ্রা ছুটে গেল। তার ঘরের বাইরে থেকেই শব্দটা আসছে। যাবে কি যাবে না ভেবে শেষ পর্যন্ত সাহস করে বেরিয়েই গেল।

বেরিয়েই বামদিকের চিলেকোঠার মতো ঘরের সামনে একটা বাঙ্ক থেকেই আসছে মনে হলো শব্দটা। মোবাইলের আলো ফেলে দেখলো বাঙ্কের ওপরে ছোট একটা টিনের পুরনো বাক্স। সেখানে একটা নেংটি ইঁদুর বাক্সটা খোলার চেষ্টা করছে। সুরমার মনে পড়ে গেল সবিতা একসময় এই বাক্সটা হস্টেলেই রাখতো। পরে আর দেখেনি সবিতা। কি মনে হতে ইঁদুরটাকে তাড়িয়ে বাক্সটা খুলে ফেললো। মোবাইলের আলোয় দেখলো হাবিজাবি জিনিসের ভিড়ে সযত্নে মোড়ানো একটা কাগজ। বেশ পুরনো। কোন একটা চিঠিই হবে। সুরমা কাজটা ঠিক হচ্ছে কিনা ভেবে খুলেই ফেললো কাগজের ভাঁজ।

তাতে লেখা,

মমহৃদয়বিজেত্রী অনন্যা,

কলেজের এই একঘেঁয়ে জীবন, নীরস ক্লাস, কঠিন সিলেবাস আর বিরক্তিকর লোকজনের ভিড়ে কেন বারবার ছুটে আসি জানো? কেবল তোমাকে একঝলক দেখতে। না, ঠিকভাবে বলা হলো না। তোমার ভূবনমোহিনী হাসির একটা ঝলক দেখা পেতে। তোমার চোখের পাতা ফেলা, তোমার তিরতির পায়ে চলে যাওয়া, বন্ধুদের সাথে তোমার খুনসুটি সবই অন্তত একলহমার তরে নিজের করে নিতে।

কিন্তু জানোই তো কেবল এক লহমাই তো আর এই অতৃপ্ত মনের আকূল পিপাসা মেটে না। এই অভাজন কি পারে না তোমাকে, তোমার সবকিছুকে সারাজীবনের জন্য আপন করে নিতে? আমি কি এতই হীন?

বেশি কথা বলতে পারিনা। লিখতে পারি আরও কম। তাই যেটুকু বলতে পারলাম সেটুকুই বললাম। বাকিটা তুমিই না হয় বোল।

তোমারই হস্টেলের সবিতার হাত দিয়ে এই চিঠি পাঠাচ্ছি বলে কিছু মনে কোর না। চাপাস্বভাবের এই মেয়েটাকেই তোমার বন্ধুদের মধ্যে সবচেয়ে নিরীহ মনে হয়। তাই তাকেই একমাত্র ভরসা করে কিছু বলতে পারি। এই অভাজনের প্রতি অনুগ্রহ হলে জবাব দিও। প্রাণভরে ভালো থেকো।

ইতি

তোমার চিরজনমের

তমঘ্ন

 
0 Comments

Post Comment