পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

বোবোর নামেই রোবো

  • 15 December, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 340 view(s)
  • লিখেছেন : বাসুদেব গুপ্ত
সব গল্পই তো ভালোবাসার। বোবোকে বোঝাতে চাইছিলাম। বোবো বলল “তাই? আমিও ভালোবাসার গল্প ভালবাসি।”

বোবোর শীত করছিলো। পার্কের  বেঞ্চে আবছা চাঁদের তেরছা আলো। ও বলল একটু জড়িয়ে ধরো না? ঊঃ কখন যে রোদ উঠবে। বোবোকে জড়িয়ে ধরতেই সেই চাঁদের আলোর ওম টসটস করে উঠল। আলো ছাড়া বোবোকে যেন ভাবাই যায় না। ওর শরীরটা যেন সোলার সেল দিয়ে মোড়া এক শোলার প্রতিমা।

 

বোবোকে আমি খুউব ভালোবাসি। বোবোওও আমাকে। এ ব্যাপারে আর কোন সন্দেহ নেই।  অবাক লাগে, এটা বুঝতে, জানতে আমাদের লাগলো মাত্র একমাস। একমাস আগেও আমি বোবো নামে কাউকে চিনতামই না। কোনো নদীর মত মেয়ের নাম কি বোবো হয়? হতে পারে তিস্তা। সোনাঝুরি। বিয়াস। ও বলল ‘ওর নাম বোবো। ডাকবে তো ডাকো। নইলে চললাম। আমি কি তাহলে নিজের নাম পাল্টে বোবা রাখবো?’

 

চললাম বললেই হয় না। এ যেন বিধাতা বললেন আমার নাম বেশ কোয়ান্টম। ব্রহ্মা জিহোভা বা মুখে আনা যাবে না সেই ইয়াঃওয়েঃ নয়। ডাকবে তো ডাকো নইলে আমি বিগ ব্যাঙ থলিতে গুটিয়ে চললাম। বোবো চলে যাওয়া মানে তো আবার ফিরে যাওয়া পূর্বজন্মে। সাত দিন আগেও আমি যেন ছিলাম শুধু একটি ব্যাঙ। স্মল ব্যাঙ। বোবো এলো শ্রাবণের সকালের মত ঝাঁপিয়ে। লাউডগার মত লতিয়ে উঠল গলায়। চুমু খেয়ে ফেলল সেই ব্যাঙকে, বুকে আমার বৃষ্টি এলো আকাশ ঝেঁপে। শুকনো গহ্বর ভরে জেগে উঠল দিঘি নদী সাগর আর গল্পে। আমার নবজন্ম হলো। আমি হলাম প্রিন্স অফ ড্রিমস।

 

বোবো আমাকে ওই নামে ডাকে। আমার ডাক নাম যে বংশীবদন সেটা ওকে বলা যায় নি। আমার সাধুজেঠুর রাখা নাম আমার ড্যাশবোরডে লুকানোই থাক।

 

এই যে আজ কীবোর্ড ছুঁলেই কাব্যের ঢল নামছে তার দায় কিন্তু বোবোর। মেয়েরা কি কবি হয়? কি জানি। তারা কি তবে কায়াহীন, শুধু কবিতা? বোবো কিন্তু নিজেই এক কবিতা। আমি কবিতা লিখি না, আমি ওকে লিখি। যখন পংক্তি আটকে যায়, বোবো বলে এটা লেখো, ওটা লেখো। যদি ছন্দ ভুল হয় বোবো বলে দেয় এই দুটো শব্দ ধরে ঘুরিয়ে দাও রুবিক কিউবের মত। এবারে দেখো।

 

বোবোর সংগে আমার দেখা তো কোন ফুলের জলসায় নয়। এক আইসোপ্রোপাইলের গন্ধ ভরা রাতে পূর্ণচাঁদের মায়ায়। হ্যাঁ দীপক সরকার। সে আমার পেশেন্ট নয়, খোঁজ পেয়েছিল আমার ছড়িয়ে রাখা কন্ট্যাক্টদের কাছে। আমায় হাসপাতালে ডেকে নিয়ে গেল । তার বোনকে নাকি আটকে রেখেছে ভেনটিলেটরে। দীপক একজন চার্টারড একাউনেটেন্ট।   বারে বারে ডিচ খাওয়া ব্যাচেলর। তার বোন রুমঝুম। ছোট এক কাগজের রিপোর্টার। পলিটিকাল। নিজের ইউটিউব চ্যানেল খুলেছিল। মাঝে মাঝে নিউজ চ্যানেলেও খবর সাপ্লাই করে।

দুপুরের পার্ক স্ট্রীট যেন এক রোমান এভিনিউ। Via amoris। দেশবিদেশের মানুষের পাশে পাশে পাপ হাঁটে পাপ হাসে পাপ শুয়ে পড়ে। কোন এক পুঁজিপতির সংগে এক দাপুটে মন্ত্রীর অভিসারের খবর পেয়েছিল ফোনে। চেনাশোনা সোর্স, ভোরভোর পিং করল। ফিসফিস করে কথা। নাকি অনেক নোনা জমি হাতবদল হবে। ঝড় সুনামি থেকে আমাদের রাজ্যের একমাত্র পাহারাদার সুন্দরবন। সেখানে গোপনে এসেছে হঠাৎ পাওয়া তেলের খনির খবর। যখন খনির কাজ শেষ হবে, সে জমির যে কি দাম হবে একদিন ভাবা যায় না। তাই এই চুপিচুপি আঁধারে অন্ধকারে হাতফেরতা। সেই খবর করতে গেল লিকপিকে ঝিকঝিকে মেয়ে রুমঝুম। ইন্টারভিউ চাইল সেই মহারথীর কাছে। পেয়েও গেল।

 

তারপর? ওরে যায় না কি জানা।

 

শুধু হাসপাতাল থেকে খবর আসে দূরভাষে, রুমঝুম সিরিয়স, একটা বিএমডব্লিউ নাকি দড়াম করে ধাক্কা মেরেছে ক্যামাক স্ট্রীটের মোড়ে।

 

আলোছায়া মাখা সারি সারি গুমঘর। আইসিইউ। ঝিমঝিমের পায়ে নিটোল করে পরানো নীল মোজা। নানারকম গ্রাফের আঁকিবুকি ঈশ্বর স্যারের ব্ল্যাকবোর্ডে। রিমঝিম হয়ত স্বপ্নের দেশে লাইভ করছে। জানা গেল ও কোমায়। ভেন্টিলেটর ছাড়া বাঁচবে না। এরকম চলছে চারদিন। তবু আশা ও চেষ্টা চলছে, হঠাৎ তো মিরাকলও হয়।

 

দীপক ভালো মানুষ। করিতকর্ম তার যত হিসেবের খাতায়। জীবনের হিসেব ওর কেবল গোলমাল হয়ে যায়। আমাকে ফ্যালফ্যাল করে বলল কি করবো? এভাবে কতদিন?

 

আমি যে কি সেটা না বলাই থাক। তবে আমার অভিজ্ঞতা আছে এই ব্যাপারে। সংগে একটা পালক ছিলো এদিক ওদিক তাকিয়ে পায়ে সুড়সুড়ি দিলাম। আলতো করে টেনে দিলাম নলটা। কটকট করে চেয়ে আছে ডিউটি নার্স। ওপরে কোথাও চেয়ে আছে শ্রীমান সিসিটিভি। লুকিয়ে চুরিয়ে করলাম কাজগুলো।

 

বাইরে এসে দীপককে বলতেই হলো। রুমঝুম আর এ তল্লাটে নেই। যা আছে সেটা ওর দেহ। ফল্স হারট বিট চালিয়ে রেখেছে। ভাইটাল রেসপন্স নেই একটাও। যতদিন না হারট ফেল করে ততদিন মিটার উঠবে। আর চার্জ করে যাবে ওরা।

 

দীপককে চোখের জলে ভিজিয়ে আমি ধীরে ধীরে শুকনো ধুলোর ওড়াউড়ি পেরিয়ে গাড়িতে ঊঠছি পিছনে আলতো কন্ঠস্বর, গলায় ইতস্ততঃ ভাবটা স্পষ্ট।

আপনি ডঃ বোস না? আপনার তো বিরাট নারসিং হোম কেষ্টপুরের মোড়ে। আপনার পেসেন্ট আইসিইউতে কোমায় আছে, দেখতে এসেছিলেন?

ঝটিতি ঘুরে আমি দেখি দাঁড়িয়ে আছে বোবো। উর্বশী হলেও অবাক হতাম না

দুর্বাসা বা বিশ্বামিত্রেরও স্খলন হয়, আমার দাড়ি থাকলেও আমি অত ভারী নই। নেহাতই ছাপোষা মেডিক্যাল প্র্যাক্টিশ্নার। পা একটু কেঁপে গেল। আলোর বৃত্তের বাইরে একটু গোল ছায়া, সেই ছায়াকে দাউদাউ করে একলা হাতে জ্বালিয়ে দেওয়া এক রমণী।

পথিক তুমি পথ হারাইয়াছো? কে অমন সময়ের মত করে ডাক দেয় অতীতের ধূসর মায়াজাল ছিঁড়ে?

সম্বিত ফিরলে শুনি নারী বলছেন-

-আপনি কি লেকটাউন হয়ে যাবেন? আমার গাড়ীটা ব্রেক ডাউন করে গেল হঠাৎ। বলে হাতে একটা রিমোটে টিকটিক করে। বেশ কিছু দূরে ওঁয়াও ওঁয়াঁও করে কেঁদে ওঠে এক স্কোডা সুপার্ব।

-সব ঠিক কিন্তু স্টার্ট নিচ্ছে না। অথচ আমার এক জুম মিটিং আছে সিয়াটলে, মিস করা যাবে না।

নার্ভাস একটু হাসি। অল্প লজ্জা মেশানো। একদম পারফেক্ট এক্সপ্রেশান। কোন চনমনে মর্দ এই হাসি দেখে কি না বলতে পারে?

গাড়িতে উঠতেই রমণী এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে।  গাড়ীর পারফিউমকে ঢেকে ফেলে ঝপ করে নেমে এল শ্রাবণ সন্ধ্যা,  একরাশ হাসনাহানার গন্ধ।

আমার নাম সিলভিয়া। ডাক নাম বোবো।

নামের বিদেশী প্রভাব দেখে যত না অবাক হলাম তার চেয়ে অবাক হলো চটপট নিজের নাম ডাকনাম সব বলে দিতে।

আমি বসু। ডঃ বিবি বসু। নাইস মিটিং ইউ।

এই ভদ্রতা দেখানোর কোন প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু অবচেতনের দস্যিটা জানে এরপরে হ্যান্ডশেক করতে চাইলে সেটা আপত্তির কিছু হবে না।

অদ্ভুত হাত বোবোর। নরম কিন্তু তুলতুলে নয়। অল্প অল্প ভিজে। স্পঞ্জি।

-আমাকে চিনলেন কি করে?

-সেটা না হয় নাই বললাম। বলে মিষ্টি করে হাসলো বোবো।

-আশ্চর্য। না বলার কি আছে?

-আপনাকে টিভিতে দেখেছি। আপনার ইউটিউব দেখেছি, আপনাকে কে না চেনে। আপনার বিশাল নারসিং হোম, সেখানে অল্প খরচায় চিকিৎসা হয়, অপারেশান হয়, এতো সবাই জানে।

কথাগুলো ঠিক। কিন্তু ব্যক্তিগত পরিসরে আমি পেশার আলোচনা পছন্দ করি না। সেটাই বললাম।

-ব্যক্তিগত পরিসর আর কোথায়? গাড়ীতে যাচ্ছি, বাড়ীতে নেমে যাব। আপনি খুব ভাল গান গাইতে পারেন, সেটাও খবর রাখি ডাক্তারবাবু।

 

ডাক্তারবাবু উচ্চারণ কতরকম ভাবে শোনা। মরতে থাকা রুগীর গলায়, শেষ ভরসাটুকু আঁকড়ে থাকা পরিজনের গলায়, ফিসফিস করে বলা ক্ষমতাবানদের ফোনে। কিন্তু এই ডাকটি যেন ডাক তার ব্যবস্থার অনেক বাইরে দিয়ে এসে আমাকে ইমেলের মত, ইমোজির মত, তীরের মত বিদ্ধ করল।

 

তারপর তারপর তারপর। পরের দিন, তার পরের দিন, তার পরের দিন।

সবটা না বললেই ভাল। তবে যা ভাবছেন তা নয়। পুরোপুরি প্লেটনিক সম্পর্ক। আমিও ম্যাচিওর, ওরও বয়স ৩৫। কিছু তাড়া নেই, হাঁকুপাঁকু নেই। বলা যায় একটা বিশুদ্ধ প্রেম।

 

 

 

 

বোবো বলে, ভালবাসতে ওর ভারী ভালো লাগে। ও ডিভোরসি, আমি হারিয়েছি আমার স্ত্রীকে। বাড়ীর কথা বাবা মার কথা ও বলতে চায় না, অস্বস্তি লাগে ওর। আমিও জোর করি না। ওর বাবা নাকি একজন বিজ্ঞানী, কোয়ান্টাম কম্পিউটার নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। মা এক কম্পিউটার কারখানার প্রোডাকশান ম্যানেজার ছিলেন। ব্যাস এটুকুই। কিছু যেন একটু অভাব। মেহসুস করতা থা। সময়ের ষড়যন্ত্রে আমরা কখন হয়ে গেলাম এ থিং। ঘুরঘুর ওড়াউড়ি। গেলাম নাটক দেখতে। কলকাতা খুব নাটকীয় শহর। লোকে কথা বলে  না, ডায়লগ বলে।  হয় কবিতা, নয় খিস্তি। শেক্সপীয়রের কিং লিয়ার অভিনয়, কিন্তু বম্বের দল। ভিজে ভিজে হাতে হাত রেখে নাটক দেখলাম। ও একমনে দেখতে থাকল। গাড়ী থেকে ড্রপ দেবার সময় একটা ছোট্ট চুমু দিল গালে। বলল,

“ love you more than words can wield the matter, Dearer than eyesight, space and liberty”

নাটকের ডায়লগ ঝেড়ে দিয়ে নেমে গেল। আর আমি ঝানু ঘাঘু মেডিক্যাল প্র্যাক্টিশনার বসে রইলাম বুদ্ধিমান হয়ে।  

 

 বোবোর সঙ্গে দেখতে গেলাম কলকাতার সিনেমা। কলকাতা সিনেমার শহর। শহরে যে বীভৎস মজা আছে, যা সেই হুতুম যুগ থেকে ৪৬এর মন্বন্তর থেকে দেশ ভাগের ছিন্নবিচ্ছিন্ন হওয়া মানুষের স্রোত থেকে ২০২৪এর অনন্ত মিছিল কেবলই তা মনে করায়। আমরা নাগরিকরা সেই বীভৎস মজার অংশীদার, রোগীর মাংস না খেলেও তার টাকাগুলো খাই, নিজেদের মধ্যে ছেঁড়াছিঁড়ি করি। মজা লাগে। নিজেদের জীবন্ত লাগে। এই সব বড় বড় শুশ্রূষাকেন্দ্র যখন লাশ বাঁচিয়ে পয়সা করে, তখন আমি সেই কোমায় যাওয়া লাশগুলো নিয়ে যাই নিজের নারসিং হোমে। সস্তায় চিকিৎসা করি। নাম হয়। ইউটিউব থেকে টিভির চ্যানেল সবখানে আমি রেস্পেক্টেড, আমি ডাক্তারবাবু। বোবো আমাকে ঐ নামেই ডাকে এখন।

 

সিনেমার সিট খোপ খোপ জোড়ায় বসবার। এবং একশান মুভি দেখতে দেখতে একশান সিকোয়েন্স। কিন্তু বোবো সব ভুলে ভীষণ মন দিয়ে সিনেমা দেখে গেল। ছবির নাম প্যারাসাইট। যেন চোখের মণি দিয়ে রেকর্ড করে নেবে সব। আমি সব পুরুষের মতই এক শুদ্ধ পুরুষ, ক্রীড়ামোদী, খেলতে ভালবাসি। আমার হাত ঠিক থাকে না, শরীর গরম হতে থাকে, আর কতদিন শুধু চুমু দিয়ে চালিয়ে যাবে বোবোরাণী। এবার আমার রাগ হয়। নিজেকে প্যারাসাইট মনে হয়।

 

বোবোকে বললাম আজ আর সোজা বাড়ী নয়, আজ একটু কফি খেতেই হবে মেরা ছোটা রহাইসমে তশরিফ লায়েঙ্গে?

আমার পাকামো করে উরদু বলার চেষ্টা করেই মনে হল, বোবো কি বুঝবে? আশ্চর্য, বোবো উত্তর দিল, জ্ররুর, ডাক্তার বাবু। ম্যায় থোড়িই আপসে ডরতী হুঁ।

বোবোর বুদ্ধির তল পাওয়া সত্যিই মুশকিল। দিব্যি বুঝে ফেলল উরদু ভাষা। এতে আমার আকর্ষণ আরো বেড়ে যায়। হেলা ফেলা সাজুগুজু রমণী নয়, একজন সত্যিকারের নারী। গারগী মৈত্রেয়ী, সরোজিনী নাইডু, সরলা দেবী, বিদুষী রমণী অনেক অনেক। আর এরকম একজনকে নর্মসঙ্গী করতে কার না ইচ্ছে হয়। আজ একবার হেস্ত নেস্ত করেই ছাড়ব।

 

বোবো আর আমি হোটেল রেস্তোরাঁতে কখনো যাইনি। ‘আমরা কি কচি লাভার নাকি?’ বলে বোবো সেইরকম করে হাসে। ‘তার চেয়ে চলো মিলেনিয়াম পারকে বসে গঙ্গায় নৌকো ভাসা দেখি। ‘

 

বোবোকে বসালাম লিভিং রুমে। আমার ঘরদোর একটু বেশি সাজানো। দেওয়াল জুড়ে বইএর আলমারি। আর সেগুলো ঘোরালে পিছনে দরকারি জিনিশ, সেলার, আর মোটা মোটা রিসারচের ফাইল। ফাইল ভর্তি আছে অজস্র পাখীর ছেঁড়া ডানার মত ক্যাশ। চুপিচুপি বললাম। জোরে বললেই বা কি? সবাই সব জানে। শুধু বেছে বেছে পাকড়ানো হয়। আমরা এখন শিক্ষা মন্ত্রীর কাছে শিক্ষিত, আরো পরিণত। তাঁরা বিক্রি করতেন চাকরি, ডিগ্রি। আমাদের হাতে আছে জীবন মৃত্যু, বডি পারটস, কিডনী, লাশ। সবকিছু থেকেই ক্যাশ। ক্যাশ লেস হবার বৃথা চেষ্টা আমলাদের ঘোষণার বাইরে আর শোনা যায় না।

 

বোবো না বসে ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকল। এই বই টানে, ঐ বই টানে, লেখকের নাম পড়ে আর মুচকি মুচকি হাসে। বোবোর এই মুচকি হাসি ভীষণ ডেস্ট্রাক্টিভ, ধ্বংসাত্মক। ডোপামিনের ঢেউ উঠতে থাকে। আমি নিজেকে সামলাই। লম্বা ইনিংস খেলতে হলে দুমদাম প্রথম বল থেকে দুমদাম ব্যাট চালালে চলে না। দেখতে হয়, ছাড়তে হয়, হাল্কা টাচ দিয়ে বল গালির ফাঁক দিয়ে বাউন্ডারীতে পাঠিয়ে দিতে হয়।

 

আপনার বাড়ীটা খুব ভালো। এর বাউন্ডারী এরকম উঁচু দেওয়াল দিয়ে ঘিরেছেন কেন? পেসেন্টের আত্মীয়রা হল্লা করার ভয়ে?

বোবো এমন অদ্ভুত ডিটেক্টিভ মার্কা প্রশ্ন করে মাঝে মাঝে। আমি হা হা করে হেসে উঠি, ওর কোমর জড়িয়ে এক পা একপা করে ওয়ালজের স্টেপ নি, আমার আলেক্সার বোতাম আলতো টিপে দিতেই বাজনা বাজতে থাকে, আলোটা ডিম হতে হতে নীল পাখির ডানা হয়ে যায়। বোবো আমার কাঁধে মাথা রেখে নোরা জোন্সের সঙ্গে গলা মেলায়। কাম এওয়ে উইথ মি। আহ, এই না হলে প্রেম। আমার প্রাণে কাম চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়তে থাকে।

 

একটু চুমুর আশায় সাহস করে ওর চোখের মধ্যে গভীর করে আমার দৃষ্টি ডুবিয়ে দিয়ে, ধীরে ধীরে ঠোট নামিয়ে আনি। ওর ঠোঁটে কোন লিপ্সটিক নেই, অল্প ফোলা, নরম কিন্তু নরম নয়, ভিজে ভিজে, বোবো আমাকে আশ্লেষে জড়িয়ে ধরে।

 

সিংগ্লস নয়, দুই রান বলা যায়। বাউন্ডারীর অনেক দেরী, একপাক চক্কর দিয়ে আমি ওকে আলতো করে সোফায় বসাই, ফিস ফিস করে বলি, আসছি। পানীয় নিয়ে।

 

এই তো ভাল, আবার পানীয় কেন? বসুন না পাশে। সিনেমা দেখবেন? চালান না একটু আপনার টিভিটা। বেশ বড় সিনেমার মতই তো।

 

এর নাম আছে এক –--পনা। আমার ভাষা ভদ্র, আমি স্বপ্নেও খারাপ ভাষা ব্যবহার করি না, কিন্তু কথাটা মনে চকিত এসে মিলিয়ে গেল। ঠোঁটে হাল্কা কামড়ের দাগ, জিভ দিয়ে চাটলাম, ভাবলাম, এখনো তো রাত বেশি নয়।।

টিভিতে নেটফ্লিক্স চালিয়ে দিলাম। ও রিমোটটা কেড়ে নিয়ে নিজেই দেখতে থাকল। সার্চ দিলো, সাই ফাই থ্রিলার। নানা রকম নাম ভেসে উঠতে লাগল, ও তাদের প্রিভিউ নিয়ে বোবো হঠাত খুব ব্যস্ত।

 

আমি কফি ভেন্ডিং মেশিনে কফি বানাই, ব্রাজিল, কলম্বিয়া, কূর্গ, ভিয়েতনাম সব জায়গার কফি, এরাবিকা, রোবাস্টা, হেজেলনাট ভ্যানিলা,  বোতাম টিপলেই কাপ ভরে দেবে। সব জায়গায় আমার ঘোরা। বছরে একবার একটি টিকিট আসে, অল এক্সপেন্স পেড। আমি বছরে একবার হারিয়ে যাই। বলি লেকচার দিতে কনফারেন্সে যাই। ছবি পোস্ট করি ফেসবুকে। খুব নাম হয়। কিন্তু নাম দিয়ে তো আর বরফ গলবে না। গরম কফি চাই।

 

বোবোকে জিজ্ঞেস করলাম, কি কফি চাই? ও উত্তর দিল ফিল্টার কফি। কড়া করে। কারো বিলিতি পছন্দ, কারো দিসি। তাই সই।

 

কফি আনতে আনতে ততক্ষণ টিভিতে মুভি চালু হয়ে গেছে। বোবো দেখছে, পর্দায় অনেক অনেক টাকার নোট, হাওয়ায় উড়ছে, আর অনেক অনেক মানুষ তার পেছনে দৌড়চ্ছে।

সিনেমার নাম ডারক নাইট। একটা বিরাট টাকার পাহাড়, তার ওপর দিয়ে লাফ দিচ্ছে জোকার। জোকার এসে সামনে দাঁড়ায়, তার কষ বেয়ে লাল কি একটা ঝরছে। দেখতে দেখতে হঠাত যেন ভিরমি খেলাম।  জোর ঝটকা লাগল, জোকারের মুখটা তো আমার নিজের মুখ। । আমি একজনকে গ্যাসোলিন আনতে বললাম। টাকার ওপর ঢালা হল।

দেখি বোবো আমার মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। আমার চটকা ভাঙ্গল, না না ওটা আমি নই। ওটা তো হীথ লেজার। সেও তো ছ বছর আগে ড্রাগ ওডি করে মরে গেছে।  এখন সব লেজারে শুধু মন্ত্র লেখা থাকে।

‘কি ডাক্তারবাবু, মনে হচ্ছে আপনি ভাবছেন আপনিই যদি ওইখানে থাকতেন, আপনি নিশ্চয়ই পেট্রোল ঢালতেন না। কি বলুন, ঢালতেন? আপনার মুখটা ঐ জোকারের মুখের সঙ্গে এক মনে হল না তো? বলেই খিল খিল করে হেসে পড়ে বোবোরাণী।

 

 আমার খুব অপমান লাগলো এ কথা শুনে। আমাকে জোকারের সঙ্গে তুলনা। তবু উত্তর দিলাম,

‘আমি তো টাকার পাহাড় বানানো মন্ত্রী মশাই নই, আমাকে কষ্ট করা নারসিং হোম চালিয়ে রোগীর সেবা করে খেতে হয়।‘

সুরটা কেমন কেটে গেল। বেশ একটা রোমান্টিক সন্ধের আশায় ছিলাম, বোবোর কি শুধুই শরীর, মন নাই? একটু ইমোশনাল হবার চেষ্টা করি। বোবোর হাতটা তুলে নি। মনে পড়ে রবি ঠাকুরের গানের লাইন, হাতখানি ঐ বাড়িয়ে রাখো, দাও গো আমার হাতে।

 

বোবোর হাত আজ আর নরম নয় অত। ভিজেও নয়। বোবো আমার দিকে তাকায়। এত কাছ থেকে আলোতে ওর চোখে চোখ রাখিনি আগে। চোখের মণি নীল। ঠিক যেন রক্তমুখী নীলা। তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।

 

চোখের ভিতর থেকে একটা নীল আলো ধীরে ধীরে উজ্জ্বলতর হয়। লেজারের মত। আমার চোখে মুখে এসে পড়ে। এই কি প্রেম? এই কি সর্বনাশ?

 

বোবোর হাত ধীরে ধীরে কঠিন হতে থাকে। আমার হাতটা পিষতে থাকে সেই নরম ভিজে ভিজে হাত। এই কি প্রেমের বন্ধন?

 

টিভিতে আমি ছুটেই চলেছি, আর আমার পিছনে টাকার নোট, আমার চোখ ধীরে ধীরে বন্ধ হতে থাকে, নীল আলো আমাকে সম্মোহিত করে ফেলে।

ঝন ঝন করে আওয়াজ হয় চারদিকে। আকাশটা কি ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়ছে চারদিকে? বোবোর হাসি দূর থেকে শোনা যায়। আমাকে জোর জোর করে ঝাঁকায়।

-কি ডাক্তার বাবু, কি খেয়েছেন? এত নেশা চড়ে গেল কি করে? এদিকে আসুন, একটু শুয়ে পড়ুন সোফায়।

জলের ঝাপটার পর ঝাপটা। চোখ খুলে দেখি বোবো চেয়ে আছে। চোখ নিটোল বাঙালি কালো হরিণ চোখ। ঠোঁটে কৌতুক উপচে পড়ছে।

-একটু রয়ে সয়ে খাবেন তো। আমি বুঝেই ছিলাম আপনার পেটে কিছু পড়েছে আজ। তাই বললাম কফি খাবো। তার আগেই আপনি ধপাস।

 

কতক্ষণ ব্ল্যাক আউট হয়েছিলাম জানি না। টিভিতে এখন একটা মিছিলের ছবি, খবর হচ্ছে। কেউ খুব জোরে জোরে বলছে দুর্নীতির শাস্তি চাই। ডাক্তারদের বিচার চাই।

 

মাথাটা ভারী। বোবো দরজা টেনে দিয়ে চলে গেছে। ধীরে ধীরে উঠি। রিমোট দিয়ে টিভি বন্ধ করি। এলোমেলো ঘুমের মধ্যে ছেঁড়া ছেঁড়া স্বপ্ন ভাসে, নীল আলো, লেজার, হাত পিষে দিচ্ছে বোবোর হাত নরম থেকে কঠিন ইস্পাতের মত হয়ে যাচ্ছে।

 

তিনদিন চুপচাপ। বোবোর কাছ থেকে কোন মেসেজ নেই, কল নেই, সাত দিনের প্রবল উচ্ছাসের পর হঠাত এই নীরবতা আমাকে চিন্তায় ফেলে। বোবো কি ভয় পেয়ে গেলে আমাকে? ও তো ইচ্ছুকই ছিল মনে হল, সাত দিনের এই বিল্ড আপ তো একটা তুংগ সুনামির মতই উঠছিল। টেক্সট করলাম,

‘আমি ভালো আছি। আবার ভালো নেই। কবে দেখা হচ্ছে’

অনেকক্ষণ কোনো জবাব নেই। হঠাত দরজায় অস্থির আঘাত। কী হোল দিয়ে দেখি বোবো। সঙ্গে আরো কয়েকজন, তাদের হাতে অস্ত্র। ইন স্যাস।

 

চারজন আমাকে ঘিরে ধরে। বোবোর গলায় অদ্ভুত এক শব্দ। সে শব্দ বলে, কোন চালাকি করবেন না, চুপচাপ সোফায় বসুন আর যা জানতে চাই তার জবাব নেই।

আমি বোবোকে বলতে যাই, বোবো, ব্যাপার কি? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। ওর হাত ধরতে যাই, দুজন দুদিক থেকে ঠান্ডা নল আমার দুদিকে ধরে।

 

অগত্যা আমি বসি। বোবো বসে না। ও দুহাত বাড়িয়ে দুই কান দিয়ে টান দেয়। একটা মুখোস খুলে যায়। আর ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে একটা ধাতব মুখ, অনেক দেখা টিভির পর্দায়। এমেকা, সফিয়া। রোবট। বুদ্ধিমান, সেক্সি, ডেঞ্জারাস।

 

বোবো হাসে। রোবটের হাসি যেমন হয়। আমার দিকে তাকায়। চোখ থেকে নীল লেজারের মত আলো আমার কপালে এসে পড়ে। কপাল জ্বলতে থাকে। বোবো একটা হাতের চামড়া খুলে ফেলে। বেরিয়ে আসে ইস্পাতের দাঁড়ার মত হাত।

 

বোবো দুই সঙ্গীকে দেখিয়ে দেয়, তারা ফাইলগুলো বয়ে আনে এক এক করে, ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে কোটি কোটি টাকার নোট।

বোবো টিভির দিকে তাকায়। সেই নীল আলোটা পর্দার ওপর গোল হয়ে ঘুরতে থাকে। টিভি নিজেই চালু হয়। তার মধ্যে ফুটে ওঠে সেদিনের সেই ছবি, অনেক অনেক টাকা আর জোকারের মত সাজগোজ করা আমি। টাকা গুলো ওড়াচ্ছি আর ঢেলে দিচ্ছি জ্বালানী তেল।

 

আমি ডিটেকটিভ বোবো। ভারতের প্রথম রোবট স্লুথ। আপনাকে আমি ও আমাদের এ আই ডিটেকশান সিস্টেম অনেকদিন ফলো করেছে। আমি নিজে দেখে সব এক্স রে ক্যামেরা দিয়ে রেকর্ড করে নিয়ে গেছি। পালাবার পথ নেই। ইয়ু আর আন্ডার এরেস্ট।

বোবো আমার হাত ধরে। ভিজে ভিজে সেই স্পর্শের কথা মনে পড়ে। আমি চীৎকার করে উঠি,

‘বোবো তুমি যেই হও, ভালোবাসা ভালবাসি তুমিই বলেছিলে। সত্যি না মিথ্যে। সেটা একবার শুনতে চাই। রোবট কি ভালবাসতে পারে না? তোমার এ আই দিয়ে তৈরি মনে বোঝো কাকে ভালোবাসা বলে?

 

বোবো কথা না বলে আবার আমার দিকে তাকায়। সেই নীল আলো। আমার ঘুম পেতে থাকে। আমি হারিয়ে যাই এক নীল তমিস্রায়।

 

জোরে জোরে কলিং বেলের শব্দে জেগে উঠি। বুঝতে পারি না আমি কোথায়। ধীরে ধীরে নীল তমিস্রা সরে যায়। আমার সোফাতেই আমি। ঘর ময় ছড়ানো কোটি কোটি টাকার নোট।

তাহলে বোবো? রোবট? কোথায় গেল তারা?

 

ডাক আসে, ডাক্তার বাবু, দরজা খুলুন। দরজা খুলুন।

দরজা খুলবো? কিছুই মাথায় আসে না আর।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

0 Comments

Post Comment