করোনা ও লকডাউন সময়কালে ‘নিউ নর্মাল’ বা নতুন স্বাভাবিক শব্দটি চারিদিকে বেশ প্রচলিত একটি শব্দ। বর্তমানে আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজের মোটামুটি সুবিধাভোগী শ্রেণীর নানা বক্তব্যের মধ্যে এই শব্দটি চলে আসছে।
কোনরকম প্রস্তুতি না নিয়েই যখন সরকার স্বেচ্ছাচারীর মতো লকডাউন ডেকে দিল, আমরা তখন থেকে টানা তিন মাস ধরে টিভি পর্দাতে দেখলাম অসংখ্য শ্রমজীবী পরিযায়ী শ্রমিকের ঘরে ফেরার জন্য মাইলের পর মাইল পথ হেঁটে চলা। একমাসের মধ্যেই আমাদের কাছে এই পায়ে হেঁটে লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের ঘরে ফিরতে চেয়ে না পারার যন্ত্রণা; পথে খিদে তেষ্টা, অসুস্থতা, দুর্ঘটনাতে মৃত্যুগুলো ক্রমেই টি।ভি চ্যানেলের প্রোপাগান্ডা মেনে ‘ নিউ নর্মাল’ হয়ে গেল। সেই স্বাভাবিক গল্পটা যেন সরকারের দায়িত্ব জ্ঞানহীনতা ও অব্যবস্থা অবহেলার কারণে নয়; এই পরিযায়ী শ্রমিকের যন্ত্রণা আসলে তাঁদের কিসমতের লিখন। যেন এই দেশব্যাপী আরও সুতীব্র অসাম্যের কারণ গোটাটাই নাকি কিসমত, দুর্ভাগ্য। সেখানে কোন শোষণের গল্প নেই, বঞ্চনার, অধিকারের কোন গল্পই নেই। এই শ্রমিকদের ঘরে ফিরতে চেয়ে হাজার মাইল হাটা ও মরে যাওয়া ক্রমেই আমাদের দেশে হয়ে উঠলো একটি “নতুন স্বাভাবিক”।
কিন্তু এই দেশে অনেক বছর ধরে মিডিয়া ও সামাজিক মাধ্যমের হাত হয়ে এই নিউ নর্মাল কথাটা একটু একটু করে নির্মিত হয়েছে। আমরা প্রথম প্রথম কিছু মব লিঞ্চের ঘটনাতে এতটা বিস্মিত অসহায় হয়ে উঠে তাঁর প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিলাম। তারপর এই দেশে এই কয়েক বছরে এত অসংখ্য, এত বিকৃতভাবে মানুষের মধ্যে গণপ্রহার করে মানুষ খুনের এই নয়া প্রক্রিয়া ক্রমাগত বাড়তে শুরু করলো, তখন এটা নর্মাল হতে শুরু করলো। এই দেশে এখন যে কোন কোনায় মানুষ অসুরক্ষিত, যে কোন কোনায় ধর্মের কারণে, জাতের কারণে, লিঙ্গের কারণে, বা পাতি সন্দেহের কারণে কিছু মানুষ কত সহজে মানুষকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারতে পারে। আবার উল্লাসের সাথে সেই বিকৃতির ভিডিও করে ভাইরাল করে দেয়। আর মানুষের এই আদিম হিংসাকে প্রশ্রয় দেয় বা ত্রাস তৈরির জন্য পুষে রাখে রাষ্ট্রব্যবস্থা। তাই মবলিঞ্চ করে খুনিরা এই ব্যবস্থাপনা/ সিস্টেমে শাস্তি-তো পানই না বরং জয় শ্রীরাম, বা ভারত মাতার শ্লোগানে তাঁদের খুনের শাস্তি মকুব হয়ে এই রাষ্ট্রের তারা নায়কের সম্মান পেয়ে থাকেন।
আপনারা যদি গুগলে লিঞ্চ শব্দ দিয়ে সার্চ দেন তাহলে আপনারা দেখবেন এই কয়েক বছরে উইকিপিডিয়াতে একটি স্বতন্ত্র বড় পাতা নির্মিত হয়েছে যেখানে ভারতের ২০১৪ পরবর্তী মবলিঞ্চের একটি দীর্ঘ বিবরণ পাওয়া যায়। আমার সাতটি ছবি এই মবলিঞ্চ বা খুনি বা খুনে ব্যবস্থাপনার উপর নয়। আমি এই সময়ে দাঁড়িয়ে এই ছবিগুলো আঁকছি আমাদের এই নিউ-নর্মাল শব্দটিকে প্রশ্ন করে। আজ আমরা টিভির পর্দাতে আসামের , বিহারের বন্যাতে ভেসে যাওয়া মানুষের ছবিগুলোকে প্রশ্ন-হীনভাবে স্বাভাবিক করে নিচ্ছি, কদিন আগে শ্রমিকের এই অব্যবস্থাপনার কারণের হাজার মাইল পথ হাটা ও মৃত্যুকেও স্বাভাবিক করে নিয়েছিলাম। তারও আগে স্বাভাবিক করে নিয়েছিলাম আমরা এই দেশে কিছু নরখাদকের খুনে উল্লাসকে। আমাদের এই সিস্টেমটা আমাদের শিখিয়েছে সমস্ত ঘৃণা, হিংসার আগুনে খুনে উন্মত্ততা স্বাভাবিক সেটা যদি একটি বিশেষ ধর্ম বা জাতীয়তাবাদের নাম নিয়ে হয়। নিউ-নর্মাল শব্দটি আসলে বহুল প্রচলিত হচ্ছে কিন্তু ২০১৪ থেকে আমরা এক নতুন বাস্তবের সাথে পরিচিত হচ্ছি ও প্রথম দিকে অসহায় লাগলেও তা ক্রমেই আমাদের যাপনের মধ্যে দিয়ে স্বাভাবিক হয়ে উঠছে।
চিত্র ১ -
চিত্র ২ --
চিত্র ৩ --
চিত্র ৪---
চিত্র ৫---
চিত্র ৬ ---
শেষে
ছবিগুলো কোনটিও কল্পিত নয় প্রতিটি ঘটনা ভিডিও ও ছবি সমেত মজুদ আছে কোথাও কোন সার্চ ইঞ্জিনে। তবে ছবির দৃশ্য আমার ও আপনাদের মনের মধ্যে অন্য আরও অনেক ইস্যুর নীচে একটু একটু করে বিস্মৃত হচ্ছে। তাই সাদাকালো রঙের ব্যবহার। এই সব ছবিগুলোতে যাকে লিঞ্চ করা হচ্ছে সেই মানুষটার ক্ষতবিক্ষত শরীর দেখে ততটা ভয় লাগছে না আর। এই সব ছবিগুলো বা ভিডিও গুলো দেখলে আমরা দেখতে পাবো এই ক্ষতবিক্ষত শরীরটাকে খুবলাচ্ছে দুই চার বা দশজন; আর কয়েক শত মানুষ সেই খুবলানোর প্রক্রিয়াটাকে উল্লাসের সাথে বা নীরবে দাঁড়িয়ে দেখছে। তাই চারিপাশের দাঁড়িয়ে দেখা নানা বয়েসের নানা লিঙ্গের এই দর্শকের পা ও দেখাকে সব থেকে বেশী ভয়ের দৃশ্য বলে মনে হয়েছে তখনো এখনও। কারণ আমরা আমাদের এই নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে এখনও এই খুনে উল্লাসের দর্শকের স্থানে নিষ্ক্রিয়তা যাপন করে-চলেছি। আমরা ক্ষমতাবানদের দ্বারা খুবলানো শরীরের দৃশ্য দেখতে অভ্যস্ত কাছ থেকে বা দূর থেকে, সামনা সামনি বা টিভির পর্দাতে।