পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

একটি মৃত্যু এবং আরও কিছু

  • 23 March, 2025
  • 0 Comment(s)
  • 363 view(s)
  • লিখেছেন : কাজী ফয়জল নাসের
আব্দুল হক তাহলে সত্যিই মারা গেছেন। কে যেন বলল "লাশের মুখটা একটু খুলে দাও"। লাশ কথাটা তাঁর মৃত্যুকে যেন প্রত্যয়িত করল, হক সাহেব নিশ্চিন্ত হলেন এই ভেবে যে, আবার তিনি সালেহার পাশে গিয়ে শুতে পারবেন।
ছেলেদের হাজার আপত্তি সত্ত্বেও তিনি সালেহাকে উঠোনের পশ্চিমদিকে কলতলার পাশে কবর দিয়েছিলেন। আসলে সালেহাকে না, হক সাহেব সেদিন পাড়ার প্রোমোটার মুন্নার হাতে এই সাত কাঠা জমিসহ বাড়িটা তুলে দেওয়ার জন্যে তাঁর তিন ছেলের সম্মিলিত অশুভ প্রয়াসের কবর দিয়েছিলেন।
 
এই সময়টা সমস্ত লাশের মত হক সাহেবেরও বেশ ভালো লাগছিল। মেজ বউটা অসময়ে চা খেতে চাইলে চায়ের কাপটা এমন ভাবে সামনে এনে রাখত, যে প্রতিবারেই হক সাহেব প্রতিজ্ঞা করতেন চা খাওয়া ছেড়ে দেবেন... সেই মেজ বউটার কান্না দেখে হক সাহেব বেশ মজা পাচ্ছিলেন। নেহাত লাশ, নইলে হাসির আওয়াজ সকলেই শুনতে পেত। প্রতিবেশী মান্নান মোল্লা, যে কিনা পাঁচিল দেওয়ার সময় গা জোয়ারি করে, মাস্তান ডেকে হক সাহেবের জমিতে প্রায় দেড় ফুট ঢুকে এসেছে, সেও কত কি ভালো ভালো কথা বলছে। হক সাহেবের বমি পাচ্ছিল, তবে লাশেদের কিনা বমি হয়না!
 
কিন্তু এরা এত দেরি করছে কেন? আত্মীয়-পরিজন প্রায় সকলেই তো এসে গেছে। গোসল দেওয়াও হয়ে গেছে সেই কখন! আর কোন ব্যবস্থাই তো হচ্ছে না। মাটি দেবে কখন এরা? হক সাহেব সালেহার পাশে, কাছাকাছি যাওয়ার জন্যে একটু বেশিই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। 
 
হঠাৎ বাইরে একটা গাড়ির শব্দ। বড় খোকার ছোট ছেলেটা এসে খবর দিল ম্যাটাডোর এসে গেছে। ম্যাটাডোর কি হবে? ভেবে পাচ্ছিলেন না হক সাহেব।
 
এমন সময় দোতলার সিঁড়ি দিয়ে বেশ কয়েক জনের পায়ের শব্দ... ঐ তো তাঁর তিন ছেলে, সঙ্গে  মৌলানা সাহেব। কানে ভেসে এল মৌলানা সাহেবের কন্ঠ, "তাহলে তোমরা সবাই একমত? কিন্তু হক সাহেব তো প্রায়ই বলতেন, এখানেই, ভাবীর পাশেই তাঁর মাটি দেওয়া হবে ঠিক হয়ে আছে"। 
 
বড় ছেলে বলল, "আসলে চাচা, সবারই ছেলে মেয়ে বড় হচ্ছে। আর কয়েক বছরের মধ্যেই জায়গার অভাব দেখা দেবে। তাছাড়া দেশে তো অনেকেই আছে, আর আমরাও তো যাব মাঝে মধ্যেই"। 
 
ছাঁৎ করে উঠলো হক সাহেবের বুকটা, মারা গিয়ে না থাকলে এই ধাক্কায় দু'নম্বর স্ট্রোকটা নিশ্চিত বাঁধা ছিল। এরা তাঁকে দেশের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে কবর দেবে?
 
হক সাহেবের কেমন একটা ঘোর ঘোর লাগছে। যেন সমস্ত শব্দ থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। চারপাশের শব্দগুলো যেন ক্রমশই অস্পষ্ট হয়ে উঠছে। এই সময় খাটিয়াটা নড়ে ওঠে। খুব ধীরে। হক সাহেব স্পষ্ট টের পান, তাঁর খাটিয়াটা নড়ছে। খাটিয়াটা উঠছে। তিন ছেলে আর এক নাতির শক্ত চওড়া কাঁধে হক সাহেবের পলকা শরীরটা সহজেই উঠে যায়। ম্যাটাডোরের পিছনের কাঠ  নামানোর শব্দ হয়। হক সাহেব চারটে শক্ত কাঁধে চেপে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছেন। উঠোন থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। ওরা কি তাহলে এই উঠোনটা আর রাখবে না? একটা আম গাছ আর দুটো পেয়ারা গাছ পেছনে পড়ে থাকে। হক সাহেব চলে যাচ্ছেন। চলে যাচ্ছেন। তিনি টের পাচ্ছেন তিনি দূরে কোথাও চলে যাচ্ছেন, দূরে... বহুদূরে। তিনি আর কোনও শব্দ শুনতে পাচ্ছেন না। 
 
সব কিছু কেমন নিস্তব্ধ, নিশ্চুপ। হঠাৎ কেমন তীব্র একটা ইচ্ছে হলো হক সাহেবের। সালেহার কী হবে? সালেহা বিবি? তাঁর প্রবল ইচ্ছে হতে থাকলো খাটিয়ার ফাঁক দিয়ে সালেহার কবরটা একবার দেখার। একবার। কলতলার একেবারে পাশেই। অন্তত একবার। কিন্তু কী করে দেখবেন...
 
আব্দুল হক তো মারা গেছেন!
 
অনুবাদ - গৌতম চক্রবর্তী
0 Comments

Post Comment