পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

নদীর জীবন্ত লোককথা

  • 01 January, 1970
  • 0 Comment(s)
  • 204 view(s)
  • লিখেছেন : দেবজ্যোতি কর্মকার
বাংলা সাহিত্যে এরকম বই বিরল। শুধুমাত্র নদী নির্ভর, সাহিত্য গুণে এবং কিছু তথ্য দিয়ে নদীমাতৃক বাংলার ইতিহাস ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা তার সঙ্গে কাতর আবেদন, যাতে করে নদী বাঁচে, আমাদের সভ্যতা বাঁচে। নাহলে যে কতবড় বিপদ হতে চলেছে তা খুব তাড়াতাড়িই টের পাব। "জলের ইতিকথা নদীর উপকথা" বইটি পড়লেন দেবজ্যোতি কর্মকার।

''সে বহুদিন আগের কথা। এক পাহাড় ঘেরা দেশে দুই বোন থাকত। সঙ্গে থাকত তাদের মা ও বাবা। দুই মেয়ে ছিল তাদের বাবা মায়ের চোখের মণি। প্রতিদিন সকালে তাদের বাবা যেতেন পাহাড়ে, রান্না করার জন্য কাঠ সংগ্রহ করতে। বড়োবোনের নাম ছিল লিস আর ছোটোবোনের নাম ছিল তুরাং। সেবার পাহাড় ঘেরা দেশে খুব বৃষ্টি হয়েছিল। একবার লিসের খুব জ্বর এসেছিল। সেই জ্বরে আর চোখ খুলতে পারছিল না লিস। এমন সময় তুরাং এই খবর পেল। একমাত্র জলে গুলে হিমালয়ের কাছ থেকে ওষুধ আনতে পারলে তবেই লিসের জ্বর কমবে। এই শুনে তুরাং হিমালয়ের কাছে যায়। হিমালয় ওষুধ দিতে চাইলেও কোনো পাত্র না নিয়ে যাবার জন্য ওষুধ আনতে পারে না তুরাং। তখন সে নদীর ধারা হয়ে ওষুধ জলে মিশিয়ে নিয়ে আসে বন্ধুর জন্য। বন্ধু সুস্থ হয়। কিন্তু তুরাং নদী থেকে যায়। বন্ধু যাতে বিচ্ছেদ না হয়, তাই লিসও নদী হয়ে বয়ে যায়। এই হল দুই নদী-বন্ধুর আখ্যান।''

এই গল্পটি পড়লাম এই সময়ের অত্যন্ত সুলেখক বা বলা উচিত নদী বিশেষজ্ঞ, ক্ষেত্র গবেষক ও সাহিত্যিক সুপ্রতিম কর্মকার এর 'জলের ইতিকথা, নদীর উপকথা' বইয়ে। এরকম বেশ কিছু ছোট ছোট গল্প আছে বইটিতে। সব ক'টিই জীবনের গল্প। অতি অলৌকিক কিছু নয়। অথচ পড়তে ভাল লাগছে। কাহিনি ঘিরে আকর্ষণ তৈরি হচ্ছে। আরও গল্পের খিদে জন্মাচ্ছে। অদ্ভুত এক মায়াবী পাঠ সৃষ্টি করেছেন সুপ্রতিম কর্মকার। কিন্তু আসলেই কি এই গল্প সেই ঠাকুমার ঝুলি থেকে বেরুনো গোছের মনভোলানো কিছু? একেবারেই নয়। গল্পগুলির প্রতিটিতে লেগে আছে জন্মদাগ। ক্ষয় আর সময়ের বেদনাও। প্রতিটি গল্পই জীবন্ত। যার পাঠ বহু যুগ ধরে থাকবে আমাদের মননে। আর বাঙালি হিসেবে, প্রকৃতি প্রেমিক হিসেবে আমাদের তা বহন করারই একান্ত দায়বদ্ধতা। তাই বইটি পড়তে পেরে সে দায়ভার কিছুটা বহন করতে পারব এই সুযোগও আমার কাছে একটা প্রাপ্তি যোগও বটে। 

এবারে আসি গল্পগুলোর কথায়। আসলে গল্পগুলো এক একটি নদীর জন্মবৃত্তান্ত। হতে পারে যার কোনও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই। কিন্তু কাহিনির ব্যাপ্তি আছে। আসলে এই গল্পগুলোই উপকথা। যা আসলে বইটির মূল উপজীব্য। সুপ্রতিম কর্মকার বইয়ের শুরুতে যে মুখবন্ধ লিখেছেন সেখানেই তিনি বিস্তারিত বলেছেন কেন এই উপকথার প্রয়োজন হল। কী সৎ তাঁর উদ্দেশ্য! মহৎ কাজ নিঃসন্দেহে।সুতরাং এই কাজ বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাঁর এই ঋণ মনে রাখবে। 

শুরুতেই যে গল্পটি বললাম তা দার্জিলিং এর পাহাড়ি নদী 'লিস' এর জন্ম কাহিনি। লিস নদীটি দার্জিলিং থেকে এসে তিস্তায় মিশেছে। লিস এবং তুরাং নদীর কথা আমরা শুনেছি। কিন্তু এই দুটো নদী যে আসলে বন্ধু নদী তার কাহিনি বা লোকগল্প পড়ে মনে হয় নদীদুটো আমাদের মতোই রক্তমাংসের মানুষ। ওদের জন্মকথা যা উপকথা হিসেবে লোকমুখে এখনও শোনা যায়। এই কাহিনি শুনলে আমরা যারা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কিংবা তার পরবর্তী উত্তরকালের দায় বহনকারী তারা কি নদীর প্রতি সদয় হব না? এই প্রশ্নও কিন্তু লেখক তাঁর ভূমিকায় রেখেছেন। অর্থাৎ এক দিকে যেমন লোককাহিনির মোড়কে নদীকে জীবন্ত করে তুলেছেন। নদীর যন্ত্রণা উপলব্ধি করাতে চেয়েছেন আবার আমাদের কাছে ছুড়ে দিয়েছেন দায়বদ্ধতার আবশ্যকতার প্রশ্নও। তুলে দিয়েছেন ভবিষ্যৎকে রক্ষা করার মন্ত্রটিও। যা পাঠ করলে একদা নদী'প্রিয় বাঙালি আবার তার ভুল সংশোধন করে নেবে। লেখকের এই মুন্সিয়ানাই বইটির এক অনন্য দিক। উল্লেখযোগ্য সার্থকতা। টিকে থাকার সংকেত। বইটির ভূমিকার একেবারে শেষে লেখকই লিখেছেন, ''যা ছিল নদীর নিজের জীবন -কথা। সে -কথাগুলোকে বাঁচিয়ে রাখাই এখন আমাদের উত্তর প্রজন্মের প্রতি দায়বদ্ধতা।... নদীর উপকথাকে সঠিকভাবে বুঝতে পারলে, সব স্তরের মানুষের কাছে 'নদীর নিজস্ব নিয়ম' ও নদীপারের মানুষের জীবনকে বোঝা সহজতর হবে। নদীদের একটু ভালো হোক। এটাই এই বইয়ের উদ্দেশ্য।'' নদীদের ভাল থাকাই চেয়েছেন লেখক। কী সহজ, সরল আবেদন। কতটা আবেগ থাকলে এই বেদনামাখা কথাটি এত সহজ করে বলা যায়?ভাবা উচিত আমাদের। 

বাংলা সাহিত্যে এরকম বই বিরল। শুধুমাত্র নদী নির্ভর, সাহিত্য গুণে এবং কিছু তথ্য দিয়ে নদীমাতৃক বাংলার ইতিহাস ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা তার সঙ্গে কাতর আবেদন, যাতে করে নদী বাঁচে, আমাদের সভ্যতা বাঁচে। নাহলে যে কতবড় বিপদ হতে চলেছে তা খুব তাড়াতাড়িই টের পাব।

বইটির মূল কথায় আসি। এই বইটিতে দুটো বিভাগ আছে। প্রথম বিভাগে আছে 'জলের ইতিকথা'। পৃথিবীর সব দেশেই সৃষ্টি রহস্য নিয়ে বেশ কিছু অলৌকিক কাহিনি আছে। একটা স্থির বিশ্বাসও আছে। সৃষ্টির নেপথ্যে আছে জলের কাহিনি। লোকগাথায় মেশানো সেই কাহিনির পুনর্নির্মাণ করেছেন সুপ্রতিম কর্মকার। বিশ্বাস ও বিজ্ঞানকে মিশিয়ে দিয়ে সৃষ্টিরহস্য তুলে এনেছেন তিনি। এই ভাগেই আছে 'নদ' 'নদী' নিয়ে মূল্যবান আলোচনা। আছে নদীর ভাষাও। আর দ্বিতীয় ভাগে আছে ২৮ টি ছোট বড়ো নদীর উপকথা। যা আসলে জীবনের কাহিনি। আমাদের বিশ্বাসে মোড়া নদীজীবনের স্বাভাবিক স্রোত। কালখণ্ডে যা কখনও গতিরুদ্ধ হয়েছে ঠিকই কিন্তু অস্তিত্ব হারায়নি। প্রতিটি উপকথাই লোকজীবনের কাহিনি। 'মাটি জল হাওয়া'য় তৈরি। মুখে মুখে শোনা লোককাহিনি যা এবার লিখিত রূপ পেল। সেই অর্থে এ এক জীবন্ত দলিল হয়ে থাকল। কৃষি নির্ভর বাঙালি জীবনের ইতিহাস যেমন আমাদের অনেকটাই জানা। কিন্তু কাহিনি নির্ভর বাঙালির অন্তরে এতকাল লালন করা বাঙালির নিজস্ব লোকগল্প যা ধুলোয় ঢাকা পড়েছিল, যার খোঁজ এতদিন কেউ করেননি তার উপলব্ধি একজন নদী বিশেষজ্ঞ শুধু নন একেবারে নদীর মতো বহমান মানুষের পক্ষেই সম্ভব এই অসাধ্য সাধন করা। 

মুর্শিদাবাদ জেলার পঞ্চানন আচার্যের কথা উল্লেখ করেছেন লেখক। তাঁর কাছেই নদীর উপকথা শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল লেখকের। সে কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেছেন তিনি। ২০০৫ থেকে দীর্ঘ এক পথ হেঁটেছেন তিনি। তারই এক ফসল এই বই। যা পড়তে পড়তে শুধু আগ্রহে আটকে থেকেছি এমনটা নয়। বারবার প্রতিটি কাহিনিকে ছুঁতে চেয়েছি। যেমন, আমি নিজে মৃতপ্রায় জলঙ্গি নদীর তীরবর্তী এক বাসিন্দা। আমার যেখানে বাড়ি এক সময় যেখানে প্রতি বছরই প্লাবিত হত জলঙ্গির জলে। সেসব কাহিনি আমিও শুনেছি কত। তারপর আমার সেই নদীটি কীভাবে হারিয়ে গেল! সুপ্রতিম কর্মকার এর এই বইয়ে আমার সেই হারিয়ে যাওয়া নদীর উপকথাও আছে। আমি প্রথমেই সেই গল্পটি পড়েছিলাম। জেলেবউ নদীতে খয়রা মাছের কাছে যা চেয়েছিলেন তা কীভাবে পেলেন তার লোকগল্প পড়ে ভীষণ ভাল লেগেছে। 

'নদীর নাম' শীর্ষক বিভাগে তিস্তা মহানন্দার গল্প। ঋকবেদে তিস্তাকে বলা হয় 'সদানীর'। কিন্তু বোদো জাতির কাছে এই নদীর নাম 'তি- স্তা' বা 'দি -স্তা'। বোদো ভাষায় 'তি' ও 'দি' শব্দের অর্থ জল। আবার মহানন্দা নদী যে আনন্দে ভরা নদী তাও জানা গেল এই লেখায়। 'নদীর ভাষা' বিভাগটিও চমৎকার। সঙ্কোশ নদীর সঙ্গে কোচ জনজাতির ভাষা কীভাবে জুড়ে গেছে তা জানা যায়। কোচ ভাষায় 'সং' শব্দের অর্থ 'গৃহ'। আবার রায়ডাক নদীকে কালো নদী বলে কেন তার কাহিনিও বর্ণনা করা আছে। এই বিভাগটিও বেশ আকর্ষণীয়। 

সব মিলিয়ে বইটি একটি অসামান্য নির্মাণ এ কথা বলতেই হবে। বাঙালির নিজস্ব লোকগল্প এবং নদী নির্ভর বাঙালি তার নিজস্ব ঐতিহ্যকে আপন করে নেবে এই বিশ্বাস আমার আছে। বইটি পড়ে এই বিশ্বাস আরও সুদৃঢ় হয়েছে। লেখক সুপ্রতিম কর্মকার এর হাত ধরে এক নতুন ইতিহাসের জন্ম হল এটুকু বলাই যায়। 

 

0 Comments

Post Comment