সংখ্যা
ফুচিক আলাদুমবার যাবে বলে বেরিয়েছিল। বাস কন্ডাকটর বলল, “কোথায় যাবেন?” ফুচিক বলব বলব করেও না বলায় সে তিন ঘন্টা চলার এক টিকিট ধরিয়ে দিয়ে বলল,“দিন। ” ফুচিক বলল,“আমি তো বললামই না কোথায় যাব।” কন্ডাকটর আশ্চর্য হয়ে বলল,“আপনি জানেন না?”
— —কী?
—— সময় রেশনিং বাধ্যতামূলক হয়েছে। প্রতিটা জিনিসের একটা সংখ্যা আছে।
—— কিসের সংখ্যা।
—— সময় রেশনিংয়ের। দাঁড়ান সাউন্ড সিস্টেমটা চালিয়ে দিচ্ছি।
কন্ডাকটর সাউন্ড সিস্টেমটা চালাতে একটা গমগমে গলা বলতে লাগল,“বাসের টিকিট বেশি হলে পাঁচ ঘন্টা। ট্রেনের টিকিট বেশি হলে দশ ঘন্টা। প্লেনের টিকিট বেশি হলে পনেরো ঘন্টা। খাওয়ার টিকিট বেশি হলে আধ ঘন্টা । চান করার টিকিট বেশি হলে এক ঘন্টা সঙ্গে পায়খানা । শোওয়ার টিকিট বেশি হলে সাত ঘন্টা সঙ্গে সংগম ,মায়ের দুধ খাওয়ানো। ”
গমগমে গলা বলেই চলেছিল। ফুচিক বুঝতে পারল তার আর আলাদুমবার যাওয়া হবে না। তাই সে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করতে লাগল। যখন ফুলেরা গাছে ফুটত আর মানুষেরা ওষুধ ছাড়াই রোগ সারাতে পারত তখন একমাত্র মানুষে মানুষে বা পশুতে পশুতে কথা বলতে পারত। এখন ধারণা বিস্তৃত হয়েছে। মানুষ এখন জায়গার সঙ্গে কথা বলতে পারে শুধু কতক্ষণ কথা বলার রেশনিং আছে সেই সংখ্যাটা জানলেই হয়। কী কথা বলবে সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। সেই সময়ের কথা,আলাদুমবারের সঙ্গে সংযোগের নির্দিষ্ট সময় রেশনিং সংখ্যা ফুচিকের কিছুতেই মনে পড়ছিল না। কন্ডাকটরের কাজ সাহায্য করা তাই ফুচিক সাহায্য চাইল। কন্ডাকটর বলল,“এখন পারব না। এখন সব সিস্টেম লক হয়ে গেছে। প্রিমিয়ার বলবেন কিছু —জাতির উদ্দেশ্যে। ” কিছুক্ষণের মধ্যে প্রিমিয়ারের গলা শোনা গেল— জাতির উদ্দেশ্যে কিছু বলছেন। গমগমে নয় বেশ অযান্ত্রিক, মিহিই বলা যায়। ফুচিকের শুনতে খারাপ লাগার কথা নয় তবু তার মনে পড়ে আলাদুমবারের কথা। সংযোগের কথা। নির্দিষ্ট সময় রেশনিং সংখ্যা তাকে জানতেই হবে। সে কন্ডাকটরকে বলে,“প্রিমিয়ার কতক্ষণ বলবেন।” কন্ডাকটর বলল,“জানি না।” ফুচিক আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার জিঙ্গেস করে,“ সময় রেশনিং নেই?”
—— কার?
—— প্রিমিয়ারের।
কন্ডাকটর কোন উত্তর দেয়নি ফলে ফুচিককে তিন ঘন্টার রেশনিং মেনে নেমে পড়তে হয়। আলাদুমবার যাওয়া হয়নি।
এস ই জেড
--------------------------------
ওপর দিয়ে মেট্রোর সম্ভাব্য লাইন চলে গেছে। মেট্রো হবে কি? হয়েছিল কি ? এ সব জানার লোকজন কোভিডে মরে গেল কিনা ভাবতে ভাবতে আবারও ওপর দিকে তাকলাম। জল ঝরে পড়ল জলের মতোই। কতটা জল ? দু ফোঁটা কি ? এত তাড়ার মধ্যে আকাশের দিকে তাকালে এরকমই হয়। বেকার মেট্রোর ওপর দিয়ে দিয়ে চলা ভায়াডাক্ট থেকে নোংরা জল পড়ে। এই জল দিয়ে কোভিড আসার মতো কোন উপক্রম হল বলে মনে হওয়ায় মাস্কটা ধুয়ে নিলাম সেই তরল দিয়ে যা বয়ে বয়ে মানুষকে দাঁড় করিয়ে করিয়ে বসিয়ে বসিয়ে রেখে তার জীবিকা অছেদ্দা করেছে। সেই তরল দিয়ে দিয়ে সব চাকরি গলে গলে গেছে।মানুষ ফিরেছে বটে তবে তার চাকরি হয়েছে হালুম কারণ তাকে খাবে বলে বসিয়ে রাখা হয়েছে। সে মানুষ শুধু মেট্রোর জন্য অপেক্ষা করে আর আমি তার মুখে এক মাস্ক বসিয়ে দিলাম। সে বলল,“ কবে চালু হবে।”
—— কালই।
—— কালই ?
—— হ্যাঁ । কালই।
—— সত্যি সত্যি কাল?
—— এই তো, বিশ্বাস হচ্ছে না তো।
—— না বিশ্বাস করার মতো যথেষ্ট আছে ।
—— যথেষ্ট বলে যথেষ্ট। বড় বড় থাম্বা বড় বড় আখাম্বা ওপর দিয়ে চলার মতো পথ।
—— হ্যাঁ কিন্তু চলছে কি?
—— চলার মতো করে বানানো হয়েছে তো- নাকি ?
—— বটেই তো বটেই তো।
—— এখন শুধু চলাই যা বাকি। চলবে চলবে ।
—— চললেই ভালো।
—— আলবাৎ ভালো। ভীষণ।
এ রকম করে যেতে ও আসতে, চলতে ফিরতে মেট্রো কেন্দ্রীক সব বিজ্ঞাপন দেখতে বেরলাম। কারণ শুধু তো চলার বাকি । সব রেডি তৈরি হয়ে গেছে। শুধু চলতে আরম্ভ করলেই সব চালু হয়ে যাবে। প্রচুর বিজ্ঞাপন লাগানোর বোর্ড লাগানো হয়েছে। সারি সারি শুধু লাগানোর অপেক্ষা। মানুষটাকে বললাম দেখছেন। সে মাস্ক পরে মুখ ঢেকে বসেছিল তার চোখে চশমা তাও অনেকটা মাস্ক ঢেকেছে। সে দেখার জন্য তৈরি হয়ে বসেছিল শুধু দেখার অপেক্ষা। এমন সময় মেট্রো কি চলতে আরম্ভ করে না সে শুধু আরম্ভের অপেক্ষা? এ প্রশ্ন করতে করতে দেখি কি যেন চলছে আর আওয়াজ হচ্ছে যেন চাকরিরা যারা চলে গেছে সব আসছে। তরলের সঙ্গে সঙ্গে গড়িয়ে গড়িয়ে আসছে কাজ আর কাজ আর কাজ কত কাজ। মানুষটাকে বললাম,“নিন হাত ধুয়ে নিন। পরিষ্কার হোন। মুক্ত হোন। কোভিড কিচ্ছুটি করবে না।” সে বলে,“তালে মেট্রো চালু হবে বলছেন?”আমি কিছু বলি না শুধু দেখাতে থাকি অ-চলা না-চলা মেট্রোর থাম ধরে ধরে বিজ্ঞাপনের শূন্য বোর্ডগুলো দেখাতে থাকি। সেখানে কেন্দ্র থেকে অতি নির্দিষ্ট এক প্রবল কেন্দ্র থেকে সারি সারি বিজ্ঞাপন মারা হয়ে চলে এস ই জেড-এর বিজ্ঞাপন । সময় নেই ঘন্টা নেই আইন নেই মজুরি নেই বসত নেই উঠোনের তুলসীটি মুড়িয়ে সেই বিজ্ঞাপন সারি সারি হয়ে সব কাজ করিয়ে ফিরিয়ে আনার কথা বলতে থাকে। মানুষটা বলে,“ তালে চলল বলছেন। মেট্রো। ” আমি বলি,“চলল মানে শুধু চলার অপেক্ষা।” সারি সারি থাম বেয়ে খালি বিজ্ঞাপনের বোর্ড বেয়ে ওপর দিয়ে একের পর এক অধিকার করে করে নিচের এস ই জেড-এর বিজ্ঞাপনের বোর্ড বেয়ে অ-চলা না-চলা মেট্রোর ভায়াডাক্টের নোংরা জল পড়তে থাকে ফোঁটা ফোঁটা ফোঁটা ফোঁটা ফোঁটা----
গাছটা এমন ভাবে দেখছিল
----------------------------------------
গাছটা এমন ভাবে দেখছিল যেন দেখতে পাচ্ছে। লোকটা সব্জি বিক্রি করছিল। নানান সব্জি। তাজা তাজা। গোটা গোটা । তার পাশ দিয়ে পোকারা ঘুরছে। পোকারা সব্জি লক্ষ্য করছিল। তারা লক্ষ্য করছিল। লোকটা বসেছিল, সে বুঝতে পারছিল গাছটা তাকে লক্ষ্য করছে।
গাছটা অনেক কিছু লক্ষ্য করছিল বলে লোকটা ভাবেনি। গাছের কথা ভাবেনি। এখানে বর্ণনা দেব কী করে বলতে পারব না। বর্ণনা দিলে ছবি তৈরী করতে হবে। ছবি তৈরী করলে রঙ তৈরী করতে হবে। তার চেয়ে রেখাদের সঙ্গে সঙ্গে। মাঠেদের সঙ্গে থাকা যায়। যাতে অন্য কারুর সঙ্গে ধাক্কা না লাগে সেরকম ভিড়ে আমরা অসংখ্য সব্জি কিনলাম যার ওজন হচ্ছিল। দেখা গেল অসংখ্য সব্জির ওজন কম। কম মানে যা বেশি নয়।এমন কম যা বেশি মনে হচ্ছে গাছটা জানে। বিরাট ড্যামের পাশে বড় বড় রাস্তা কী ভাবে হল এও এক ভাবার কথা। দেখলাম কোনা দিয়ে একটা ফুল ফুটেছে। সেটার বর্ণনা করতে দেখি রঙ মনে পড়ছে না। বড় বাঁধের তলায় কী করে গ্রাম ডুবল তার তলায় সূর্য ডোবে। সে জন্য বড় বাঁধের কাছে গাছ থাকে না। বড় বড় বড় গাছ লাগানো যায় না। ছোট গাছ লাগালে তারা অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে। যে ভাবে গাছটা লক্ষ্য করছিল সে ভাবে কোন গাছ দেখলাম না। বাঁধের আসপাশে কিছু বাড়ি রেখা দিয়ে এঁকে রাস্তার সঙ্গে মিশে আছে। রাস্তা অনেক দূর দূর গেছে বলে বাড়িগুলোকে টেনে নিয়ে গেছে। সেরকম একটা বাড়িতে ঢুকে কী দেখলাম একদম জানিনা। একটু জানি বলে ওটা বাড়ি একদম না জানাতে ওখানে গরম কিনা কে জানে। গাছটার কথা কী রকম ভাবে যেন মনে থাকল। সে লক্ষ্য করছিল যেন দেখতে পাচ্ছে। গাছ দেখতে পায় সে তো বোঝা যাচ্ছে , সে নিশ্চয় করে কিছু দেখছে না কারণ রেখা দিয়ে হাঁটা যায় না কেউ না কেউ পড়ে যাবে। আর তখনই বোঝা যাবে গাছটা লক্ষ্য করছে বড় ড্যামের ওপর তার ছায়া। রাস্তার সঙ্গে সঙ্গে তার ছায়া সঙ্গে সঙ্গে আসতে চাইছে।