আন্তিগোনে নাটকটিতে নাট্যকার সোফোক্লিস থিবসের রাজা ক্রেয়ন আর আন্তিগোনের মধ্যে বিরোধ-কেন্দ্র হিসেবে রাখেন আন্তিগোনের এক ভাই পলিনেসিয়াসের মৃতদেহ। ক্রেয়ন তাকে রাষ্ট্রদোহী হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং তার মৃতদেহকে সামাজিক রীতি মেনে সৎকার করতে দিতে অস্বীকার করেন। পলিনেসিয়াসের ছোট বোন আন্তিগোনে ভাইয়ের সৎকার করে ও রাষ্ট্রদোহিতার শাস্তি পায়। নাটকটির একটি প্রচলিত পাঠ বলে যে, রাজা/রাষ্ট্র/ক্ষমতা যার বা যাদের বিরুদ্ধে অসন্তুষ্ট হয়, তার বা তাদের জন্য নিরন্তর হিংসা বহন করে চলে। এমনকি ক্ষমতার রোষ থেকে রক্ষা পায় না মৃত শরীরও।
আন্তিগোনে নাটকটির মতো সাম্প্রতিক এন আর এসের ঘটনার কেন্দ্রে ছিল এক মৃতদেহ। সে দেহে জরা এসেছিল স্বাভাবিক নিয়মে। পলিনেসিয়াসের মতো এই বৃদ্ধ মানুষটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যান নি। স্রেফ রোজার ধকলটা নিতে পারেনি তাঁর দেহ। তাই তাঁকে, তাঁর উদ্বিগ্ন প্রাপ্ত-বয়স্ক আত্মীয়রা নিয়ে যায় কাছের বড় সরকারি হাসপাতালে। পারিবারিক সম্পর্ক ও সেই সম্পর্কের মধ্যে সযত্ন দায়বদ্ধতাবোধ থেকেই বোধহয় নিম্ন অর্থনৈতিক বর্গের মানুষের দল অসুস্থ বৃদ্ধ পিতার দেহকে সুস্থ করে তোলার শেষ চেষ্টা করে। এটা জেনেই করে যে, সরকারি শিক্ষা বা স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলিতে তাঁরা উপেক্ষিত অপর শ্রেণি বা সাব-অল্টার্ন। উল্লেখ্য যে এই শ্রেণি শব্দটির মধ্যে বর্ণ, সম্প্রদায়, জাতি, লিঙ্গ এবং তাদের স্তরভেদ অন্তর্ভুক্ত।
সেই মৃতদেহকে মাঝখানে রেখে হবু ডাক্তারের দল আর রুগির বাড়ির লোকজনের মধ্যে বিতণ্ডা হল। ডাক্তারি পড়তে আসা এক ছাত্র আহত হল, আর ঘটনা ঘনীভূত হল। ডাক্তার সমাজ একত্রিত হলেন, সরকারি স্বাস্থ পরিষেবা প্রায় শিকেতে উঠল, তাই নিয়ে আরও নোংরা রাজনীতি চলল, সভ্য-সমাজ মিছিল করে বিচার চাইল, পাঁচ জন জীবিত মানুষকে অ-জামিনযোগ্য ধারায় গ্রেফতার ও মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার পর হাসপাতালগুলির অচলাবস্থা কাটল। কিন্তু ঘটনার কেন্দ্রে থাকল সেই বৃদ্ধের মৃতদেহ। আর থাকল তাঁর পরিজনেরা-যাঁরা পেলেন দোষীর তকমা। শোক পালনের সময় তাঁরা পেলেন কিনা জানি না, কিন্তু প্রতি-আক্রমণের আশঙ্কা তাঁদের জীবনের সঙ্গী হয়ে রইল। এই ঘটনার সময়ে এঁদের বয়ান উঠে আসে নি। মৃত্যুশোক কি তাঁদের স্বাভাবিক বুদ্ধি নষ্ট করে দিয়েছিল? নাকি তাঁরা স্বভাবত ঝামেলাবাজ? (তাঁরা তো সেই সম্প্রদায়ভুক্ত যাঁদের সম্বন্ধে হিংসা ও অপরাধ প্রবণতার গল্প প্রচলিত।)
অতএব গত ২০/০৬/২০১৯-এর সন্ধেবেলা সহমন-এর বন্ধুরা মিলে তাঁদের কথা শুনতে গেছিলেন। সহজ হয়নি সেই কাজ। তাঁরা সন্ত্রস্ত ছিলেন আমাদের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে। ভয় পাচ্ছিলেন কথা বলতে। যারা তাঁদের সমাজ পরিমণ্ডলীতে থাকেন না, কোনদিন থাকেন নি, কোনদিন সম-সম্পর্কের সংলাপে অংশগ্রহণ করেন নি, তাদেরকে মৃতের পরিজন এবং পরিচিত জনেরা যেন ভরসা করতে পারছিলেন না। এমনকি মহল্লার অন্য তরুণেরা তাঁদের কথার ভাঁজে ভাঁজে আলতো করে, সন্তর্পণে ঢুকিয়ে দিচ্ছিলেন হিন্দুস্তান যে তাঁদেরও দেশ, তাঁদের মহল্লা যে হিন্দু-মুসলিম ভাইচারায় বিশ্বাসী, তাঁরা আইনের পক্ষপাত বা কোনপ্রকার তোষণবাদে বিশ্বাসী নন-ইত্যাদি কথা। অস্বস্তি হচ্ছিল শুনতে। কারণ সেই কথাগুলোর মধ্যে যেটা সব চেয়ে বেশি ছিল, সেটা-ভয়, ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা নিয়ে আশঙ্কা। আরও ক্রুরভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল ক্ষমতাশীল আমরা আর ক্ষমতাহীন ওরার বিভাজন রেখাটি।
অবশেষে, অপর এক বন্ধুর মধ্যস্থতায় সদ্য পিতৃহারা পুত্র এলেন কথা বলতে। তাঁর আস্থাভাজন দুই গুরুজনের সামনে বললেন তাঁর কথা। বললেন কীভাবে তাঁদের অন্ততপক্ষে তিনবার একই ঘরে ছুটে যেতে হয় সিনিয়র ডাক্তারকে ডাকতে। কারণ তাঁর বাবার অবস্থা ক্রমে খারাপ হচ্ছিল। আর ডাক্তারেরা ঠাণ্ডা ঘরে সামান্য কর্মবিরতি নিচ্ছিলেন। (এবারে গরমটা আরও জঘন্য)। এর পরে জনৈক আত্মীয়, জনৈক ডাক্তারের হাত ধরে রুগীর কাছে নিয়ে যান। তিনি তখন মৃত। অতঃপর আরও কিছু বাক-বিতণ্ডার পরে মৃতের ছেলেকে বলা হয় ডাক্তারদের কাছে ক্ষমা না চাইলে তাঁর বাবার মৃতদেহকে ছাড়া হবে না। আদতে হয়ও তাই। চার ঘন্টার নির্দিষ্ট সময়-সীমা পেরোনোর পরেও ক্ষমা চাওয়ার শর্ত অক্ষুণ্ণ রেখে ডাক্তারেরা মৃতদেহ ছাড়তে রাজি হন না।
হাসপাতাল যদি চিকিৎসা ব্যবস্থার ক্ষেত্র হয়, আর সেই ক্ষেত্রকে যদি ক্ষমতার পরিভাষায় বিশ্লেষণ করা যায়, তাহলে সাধারণ অবস্থায় (অন্তর্বতী স্তরভাগ থাকা সত্ত্বেও) চিকিৎসক বা ডাক্তারেরা হাসপাতাল নামক ক্ষমতা ক্ষেত্রের উচ্চস্তরভুক্ত শ্রেণি। প্রথমত তাঁরা রোগীদের বাঁচানোর ক্ষমতা রাখেন, দ্বিতীয়ত সভ্য-সমাজের পরিকাঠামোতে তাঁরা সম্মানজনক পেশার আওতাভুক্ত। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে আমার মনে হয়েছে চিকিৎসকেরা নিজেরাও তাঁদের উচ্চস্তর নিয়ে নিঃসন্দেহ। তাই ক্ষমার প্রসঙ্গটি, মৃতদেহ সৎকারের প্রসঙ্গ থেকেও তাঁদের কাছে বড় হয়ে দাঁড়ায়। মৃতের ছেলের বক্তব্য অনুযায়ী ডাক্তারের দল সেই তিনজনের কাছ থেকে ক্ষমা দাবি করেন যাঁরা ডাক্তারের উচ্চস্তরকে যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করতে পারেন নি। এমন কি তাঁরা নাকি এটাও বলেন যে, ডাক্তারদের ঘরে গিয়েই ক্ষমা চাইতে হবে। পুলিশ এ অবস্থায় যখন মৃতের বাড়ির লোকেদের সঙ্গে ডাক্তারদের ঘরে যেতে চান, ডাক্তারেরা তাতেও রাজি হন না। সময় গড়িয়ে যায়। বৃদ্ধের মৃতদেহ ক্ষমা ও ক্ষমতার দ্বন্দ্বে হাসপাতালের চৌহদ্দিতে আটকা পড়ে থাকেন। সাব-অল্টার্নের জন্য কেই বা বিচার চায়? আর কারাই বা সাব-অল্টার্নের মৃতদেহকে যথাযথ সম্মান দেখিয়ে সৎকার করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে?
তারপরের ঘটনা আর নাই বা বললাম। নাই বা প্রশ্ন করলাম জুনিয়র ডাক্তারেরা কীভাবে ট্রাম লাইনের ওপর এসে রুগীর আত্মীয়ের হাতে মার খেলেন? আমি শুধু প্রশ্ন করব সহমর্মিতা নিয়ে।
কোন সেই বিচার-ধারণা যা মৃতের প্রতি সম্মান দেখানোর চেয়ে ক্ষমা চাইয়ে নেওয়াকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে? শুধু শেষ বিদায় জানানোর জন্য কেনই বা কাউকে অন্যের পা ধরতে যেতে হয়? মূল্যবোধহীনতাকে কি হিংসার দায়রাভুক্ত করা যায়?