কয়েক বছর আগে একটি শারদীয়া পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল শ্রীজাত’র লেখা উপন্যাস “তারায় তারায়”। উপন্যাসটি ফরাসি চিত্রশিল্পী ভ্যান গগের জীবনকে কেন্দ্র করে। সরাসরি জীবনীমূলক নয়। লেখক কতগুলি কাল্পনিক চরিত্রের অবতারণা করে উপন্যাসটিকে একটি ইতিহাস আশ্রিত কল্পকাহিনীর পর্যায়ে উন্নীত করেছেন। একই সঙ্গে এখানে প্যারিসে ভ্যান গগের সময়কালে তাঁর নিজস্ব সমস্যা এবং বর্তমানে কলকাতায় ‘ঋত্বিক’ নামে একটি কাল্পনিক চরিত্রের ঠিক একইরকম সমস্যা সমান্তরাল ভাবে এগিয়েছে।
স্বপ্ন সন্ধানীর প্রযোজনাটি ওই উপন্যাসটিকে ভিত্তি করেই। মূল গল্পটি নিয়েই নাটক এগিয়েছে। নির্দেশনায় রয়েছেন কৌশিক সেন। তাঁকে অভিনন্দন জানাতে হয় ভিনসেন্টের চরিত্রে অঞ্জন দত্তকে বেছে নেবার জন্য। সত্যি কথা বলতে নির্দেশনা, আলো, মঞ্চভাবনা, সঙ্গীত সব কিছুকে ছাপিয়ে নাটকটিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছেন অঞ্জন দত্ত। মঞ্চের অঞ্জন দত্ত যে কতটা শক্তিশালী, মনমুগ্ধকর অভিনেতা তা সকলের কাছেই সুবিদিত। ‘তারায় তারায়’ নাটকেও তাঁর ব্যতিক্রম হয়নি। বরং তাঁর বিগত কয়েকটি নাটকে যেমন অবনী অপেরা, তিন পয়সার পালা বা সেলসম্যানের সংসারের থেকেও এখানে তিনি নিজেকে ছাপিয়ে গেছেন। এই অভিনয় চাক্ষুষ করতে পারাটা এক অনন্য অভিজ্ঞতা। বাংলা থিয়েটারে এক নিবিষ্ট অভিনয়ের উদাহরণ এই ভ্যান গগ চরিত্রটি। কোথাও তিনি যেন বাংলা থিয়েটারের ছাত্রদের কাছে প্রবলতা এবং সত্যবাদিতার পাঠ দিয়ে গেলেন।
নির্দেশনায় খুব কিছু নতুনত্ব পাওয়া যায়নি। স্বপ্ন সন্ধানীর নাটকে এই ঘরানার নির্দেশনা দর্শকদের পরিচিত। একই কথা মঞ্চ ভাবনার ক্ষেত্রে। একটি বিশেষ মুহূর্তে বার থেকে নেমে আসা সুবিশাল ছবি আঁকার ক্যানভাসটি চমকপ্রদ। আলো বেশ ভাল। কয়েকটি জায়গায় আলোর ব্যবহার মুহূর্তগুলোকে সফল ভাবে তৈরি করতে সাহায্য করেছে। প্রপ হিসেবে ভ্যান গগের প্রচুর ছবির প্রিন্টের ব্যবহার এই নাটকটিতে একটা অন্য মাত্রা দিয়েছে এটাও উল্লেখের দাবী রাখে।
অভিনয়ের ক্ষেত্রে অঞ্জন দত্ত এতটাই মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছেন যে খুব স্বাভাবিক ভাবেই দলের বাকিরা ভালো অভিনয় করলেও কোথাও যেন তাঁর অভিনয়ের সঙ্গে একটা তারতম্য তৈরি হয়েছে। কৌশিক সেনের থেকে যেমন আশা করা যায় তিনি তেমন ভাবেই তা পূরণ করেছেন। তাঁর বলা কবিতাগুলো প্রকৃত অর্থেই কবিতার মতোই শুনিয়েছে। এছাড়া ঋত্বিকের বাবার চরিত্রটিতে তাঁর অভিনয় বহু দিন মনে থাকবে তাঁর স্বর প্রক্ষেপণ এবং শরীরী ভঙ্গিমার জন্য। রেশমি সেন যথাযথ। রিদ্ধি সেন ইতিমধ্যেই একজন সুপ্রতিষ্ঠিত অভিনেতা, স্বভাবতই তাঁর কাছে প্রত্যাশাও বেশী। তাঁর করা ঋত্বিকের চরিত্রটি যেন আরও একটু পরিণত হতো এই আশাটা করাই যেতে পারে। এই প্রসঙ্গে একটা প্রশ্ন আসে যে উপন্যাসে ঋত্বিকের বয়স ছিল ৩০ এর কাছাকাছি, এখানে বলা হয় ২১-২২। সেক্ষেত্রে এতো কম বয়সী একটি ছেলে বিবাহিত, কাজের প্রচুর চাপ, চাকরিতে প্রমোশন না পাওয়া এবং তার থেকে তৈরি হওয়া হতাশা এবং ডিপ্রেশন এই বিষয়গুলোতে একটু যৌক্তিকতার অভাব লেগেছে। সুরঙ্গনার অভিনয় ভালো, তবে একই ভাবে মঞ্চে অন্যদের তুলনায় কম বয়সী এবং আড়ষ্ট লেগেছে।
যে কথাটা না বললে এই লেখাটা অসম্পূর্ণ হবে তা হলো সঙ্গীতের ব্যবহার। সেই সময়কার ইউরোপিয়ান ক্লাসিক দর্শকদের একটা অন্য জগতে নিয়ে ফেলে। ডন ম্যাকলিনের এর ভিনসেন্ট, এই গান ছাড়া ভ্যান গগ দর্শকদের কাছে দূরের মানুষ। এই গান তাই নাটকের শেষেও রেশ রেখে যায়। আর কোনও কোনও দর্শক হারিয়ে যায় তারায় তারায়।