কদিন আগেই স্টাফ স্পেশাল ট্রেনে উঠতে দেওয়া, তথা লোকাল ট্রেন চালানোর দাবীতে হাওড়ায় বিক্ষোভ হয়, আরপিএফ ভালরকম লাঠিচার্জ করে। এর আগে এবং পরেও অনেক স্টেশনেই এরকম ঘটে এবং ঘটছে।সেসব নিয়ে ভাবতে বসে কতগুলো কথা চলে এল। আমি নিজে রাজ্য সরকারী কর্মচারীদের ইউনিয়ন করেছি কয়েক বছর, নিজের অভিজ্ঞতা জড়িয়েই কথাগুলো মনে হল।
রাজ্য সরকারী কর্মচারীদের সম্পর্কে চলতি কথাই হল এরা ফাঁকিবাজ, দুর্নীতিগ্রস্ত, খালি নিজের মাইনে আর ডিএ নিয়ে চিন্তা, নচিকেতা তো গানই লিখে ফেলল। চাকরিতে যখন ঢুকি, তখন সিপিএম প্রভাবিত কোঅর্ডিনেশন কমিটির দারুন দাপট। তাদেরকে নাকি অফিসাররাও সমঝে চলে। কর্মচারীদের শতকরা পঁচানব্বই ভাগ নাকি তাদের সাথেই আছে। দিন যত যায়, নিজের পাওনাগণ্ডা নিয়ে যত সচেতন হই, ততই দেখি কোঅর্ডিনেশনের নেতারা বক্তৃতায় বলে, অনেক সংগ্রামের ফসল এই বামফ্রন্ট সরকার, এ হল সংগ্রামের হাতিয়ার, এই সরকার হল বন্ধু সরকার, মোদ্দা কথা হল বকেয়া পাঁচকিস্তি ডিএ নিয়ে দাবী করে সরকারকে বিব্রত করা যাবে না, এমন কোন আন্দোলন করা যাবে না যাতে করে সংগ্রামের হাতিয়ার সরকার বিব্রত হয়। এদিকে নানা দাবী নিয়ে তো কর্মচারীর মধ্যে বিক্ষোভ আছেই। সেগুলোকে সামাল দেওয়া হত অনেকটা এইভাবে -- ক) কর্মচারীদের পোস্টিং, বদলি, প্রমোশন, জিপিএফ লোন, ছুটি মঞ্জুর, এসব কাজের জায়গাগুলো সব কোঅর্ডিনেশন কমিটির নেতাদের দখলে, সেখানে বিরুদ্ধ মতের লোক দূরে থাক, খোদ লোক ছাড়া সেসব কাজের দায়িত্ব কেউ পায় না, কর্মচারীকে তার প্রয়োজনে এইসব ব্যক্তিদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতেই হয়। খ) কর্মচারী হয়তো ১০০ কিমি দূর থেকে ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করে অফিসে আসেন, একটু আগে বেরোলে তার সুবিধা হয়, কো-অর্ডিনেশন কমিটি করলে সে সুবিধে মিলবে, নচেৎ নয়। যাদের প্রয়োজন নেই, ফাঁকিবাজ, তারাও ঐ সংগঠন করলে দেরীতে আসা বা আগে যাওয়াটা বেশ কিছুটা দেখা হবে না। গ) সরকারী দফতর হওয়ায়, কিছু সুযোগসুবিধে পাওয়ার অবকাশ থাকেই, সেগুলো কো-অর্ডিনেশন কমিটি করলে মিলবে, ইত্যাদি। ঘ) নিজের ন্যায্য দাবীদাওয়া পেতে হলে ইউনিয়নের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ইউনিয়নের নেতা। ঙ) সরাসরি বৈষম্য এবং/বা শারীরিক আক্রমণ। ইত্যাদি।
এ হ'ল নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে, অর্থনীতিবাদ ও আমলাতান্ত্রিকতার বহিঃপ্রকাশ। যখন ট্রেড ইউনিয়ন তার মূল ভূমিকা, নিয়োগকর্তার বিরুদ্ধে লড়াই, ভুলে যায় বা সেই লড়াই তার বড় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ভুলে যায়, তখন ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে এসবগুলোই সামনে আসে। পুরনো লোকেরা আরও ভালো বলতে পারবেন, তবে আমার ধারণা, পার্টিগতভাবেই কো-অর্ডিনেশন কমিটির মধ্যে নির্দেশ ছিল, কর্মচারীদের ছুটি, বদলি, প্রমোশন, জিপিএফ লোন এসব জায়গাগুলো কব্জা করো, তাহলেই কর্মচারী সংগঠন করা সহজ হবে এবং ষাটের দশকেই এই নির্দেশ ছিল। এ হল শ্রমিক কর্মচারী আন্দোলনে সংশোধনবাদ বা অর্থনীতিবাদের, মূল লক্ষ্য ভুলে দুটুকরো রুটির পেছনে ছোটার লাইন, নির্দিষ্ট বহিঃপ্রকাশ। এগুলো করবার জন্য একটা ঘটনা ঘটাতে হত, তা হল অফিসারকুলের সাথে একটা বোঝাপড়া, তোমরা চুরি করো, অবৈধ সুযোগ নাও, নিজের লোককে টেণ্ডার পাইয়ে দাও, আমরা দেখবো না, বদলে কাকে কোথায় পোস্টিং দেওয়া হবে, বদলি হবে, ইত্যাদিতে তোমরা নাক গলাতে এসো না। কর্মচারীর দুর্নীতি তখনই সম্ভব হয়, যখন ওপরতলা সেই দুর্নীতির সিংহভাগ পায়, নয়তো কর্মচারীর ক্ষমতাই নেই যে সে একা কোন কাজ করিয়ে দেবে।
মুশকিল হল, ট্রেড ইউনিয়নগুলো এই সমস্যা নিয়ে ভাবেনি। ভাবেনি কারণ, তারা যে দলের দ্বারা চালিত হয়, তাদের লক্ষ্য কোন সচেতন শ্রেণী আন্দোলন গড়ে সমাজ পরিবর্তন নয়, তাদের লক্ষ্য বর্তমান কাঠামোর মধ্যেই ইধার উধার কিছু পরিবর্তন করে সরকারী ক্ষমতায় আসা। আর এজন্যই তারা ট্রেড ইউনিয়ন ভেঙে দলভিত্তিক একেকটা ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তুলেছে।
ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে প্রকৃত শ্রেণীআন্দোলনে পরিণত করা কোন মুখের কথা নয়, বড় কঠিন কাজ। কারণ তার জন্য নির্দিষ্ট ট্রেডে, একেকটি ক্ষেত্রে সংগ্রামের, লড়াইয়ের, দাবীদাওয়ার সেই ধরনগুলো কষ্ট করে খুঁজে বের করতে হয়, যে দাবীদাওয়াগুলোয় ইউনিয়নের দাবী আর ব্যাপক জনসমাজের দাবী এক হয়ে মিলে যাবে।
আলোচনা শুরু হয়েছিল রেল দিয়ে। ফেরা যাক সেখানে।
ভারতীয় রেলের সেফটি রুলে, ম্যানুয়ালে যেখানেই ড্রাইভারের কথা আছে, সেখানেই অ্যাসিস্ট্যান্ট ড্রাইভারের কথাও বলা আছে, শুধু একজন ড্রাইভার দিয়ে ট্রেন চালানোর কথা কোথাও বলা নেই। নেই, কারণ নিরাপত্তা। দ্রুতবেগে অত বড়, অত ভারী একটা ট্রেনের নিরাপত্তা শুধু একজন চালকের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়, সেজন্যই এক ড্রাইভারের কথা কোথাও কোন রুলে নেই। তাছাড়া ড্রাইভার অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন, সেক্ষেত্রে সামাল দেবে কে? অথচ, আমরা সবাই জানি, লোকাল সুবার্বন ট্রেনে একজন ড্রাইভারই থাকেন। এই বিপজ্জনক পরিস্থিতির সমাধান রেল করেছে কীভাবে, না সে একটা হ্যাণ্ডেল বসিয়ে দিয়েছে ড্রাইভারের জন্য ইঞ্জিন কোচে, ড্রাইভারকে সবসময় সেই হ্যাণ্ডেল চেপে ধরে রাখতে হয়, ছাড়লেই ট্রেন ব্রেক লেগে থেমে যাবে। অর্থাৎ যদি ড্রাইভার অসুস্থ হয়ে পড়ে, তাহলে হ্যাণ্ডেল ছেড়ে দিলেই ট্রেন ধীরে ধীরে থেমে যাবে, দুর্ঘটনা ঘটবে না। কিন্তু যদি ড্রাইভার অসুস্থ হয়ে মুখ থুবড়ে ঐ হ্যান্ডেলের ওপরেই পড়ে, তাহলে? ঠিক এরকমই ঘটেছিল মুম্বাইতে, হার্ট অ্যাটাক হয়ে ড্রাইভার পড়ে ছিলেন হ্যাণ্ডেলের ওপরেই, ট্রেন চলতে থাকে, এবং দুর্ঘটনা ঘটে, কিছু ব্যক্তি মারাও যান। এখন এই প্রশ্নটি তুললে, একদিকে ব্যাপক জনতার, যাত্রীদের নিরাপত্তা, অন্যদিকে রেল কর্মচারীর ওপর মানসিক চাপ কমানো, এবং একই সাথে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সুযোগ ঘটতো, যদি রেলওয়ে ইউনিয়নগুলো লোকাল সুবার্বন ট্রেনেও অ্যাসিস্ট্যান্ট ড্রাইভার নিয়োগের দাবী তুলতেন, তাদের নিজস্ব ইউনিয়নগত দাবী হয়ে দাঁড়াত জনগণের দাবী, নিছক ট্রেড ইউনিয়নের নিজস্ব দাবী তা আর থাকতো না। কিন্তু, বাস্তবত তা হয়নি। যদিও কিছু লোকো পাইলট চেষ্টা করেছেন সেই দাবী তুলতে।
রেল ওয়ার্কশপে, স্টেশনে প্রচুর চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী আছেন যারা 'নোংরা' কাজগুলো করেন, ঝাড়ুদার, নর্দমা পরিষ্কার, মলমূত্র পরিষ্কার ইত্যাদি। ভারতে ঐতিহাসিকভাবে এই কাজ করে এসেছে 'নীচু' জাতের মানুষ, রেলেও তাই ছিল। তখন এই সমস্ত পদগুলোতে লোক নিয়োগ অনেকটাই অফিসারদের হাতে ছিল, কোন নিয়মনীতি ছিল না। পরে যখন পদগুলোতে নিয়োগের নিয়ম তৈরী হল, মাইনে বেশ খানিকটা বাড়লো, সেসময় প্রতিযোগিতার কারণে এইসব পদগুলোতেও 'উঁচু' জাতের লোকেরা ঢুকতে থাকলেন, তারা বেশ পড়াশুনো জানা লোকও। কিন্তু দিন যতই গড়ায়, এই বাবুরা শ্রমিক পদে যোগ দিলেন বটে, কিন্তু অচিরেই ঐ 'নোংরা' কাজগুলো করানোর জন্য তারা নিজেরা লোক রাখলেন, সেই 'নীচু' জাতের শ্রমিকদেরই, তবে অনেক কম পয়সায়। ব্যাপক বেকারিত্ব এটাকে সম্ভব করে তুললো। ইউনিয়ন চুপ, অফিসাররাও চুপ। ফলও ফললো। একসময় রেল সিদ্ধান্ত নিল ইউনিয়নগুলোকে জানিয়েই, যে দেখেছ, অত পয়সা দিয়ে এই কাজে লোক নেওয়ার কোন মানেই নেই, আমি এই কাজ বেসরকারী সংস্থাকে দিয়ে অর্ধেক পয়সায় করাবো, এবং তাইই করলো, কাঁচরাপাড়া ওয়ার্কশপ সহ সমস্ত জায়গাতেই এই কাজের জন্য আর সরকারী নিয়োগ হয় না। ইউনিয়নও জাতিবাদী ও নিছক অর্থনীতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গীর হওয়ায়, নিজের কাজে পয়সা দিয়ে লোক নিয়োগের বিরোধিতা না করায়, এই বেসরকারিকরণের বিরোধিতা করতেই পারলো না।
এই সময়ে মোদী সরকার জোরেসোরে রেল বেসরকারীকরণের দিকে এগোচ্ছে। রেলে কর্মচারী কমিয়ে দেওয়ার জন্য ৫৫ বছর বয়স বা ৩০ বছর চাকরি হলে স্বেচ্ছাবসর করিয়ে দেওয়ার জন্য স্কীম আনছে, পাশাপাশি ভাড়া বাড়ানো, বয়স্ক ও শিশুদের সুযোগসুবিধে কমিয়ে দেওয়া, স্টেশনগুলোকে বেসরকারী হাতে তুলে দেওয়ার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে। এদিকে দীর্ঘ সাত মাস লোকাল ট্রেন বন্ধ থাকায় শ্রমিক, ছোট ব্যবসায়ী, কর্মচারী, হকার, ছোট উৎপাদক, কারিগর, বহু মধ্যশ্রেণীর চাকুরীজীবী বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। প্রায় নিয়ম করে কয়েকদিন অন্তর বিক্ষোভে ফেটে পড়ছেন মানুষ, ট্রেন চালানোর দাবীতে। বাসে গাড়িতে বাদুড়ঝোলা হয়ে অফিসে কারখানায় ব্যবসাস্থলে গেলে নাকি করোনা ছড়াবে না, ট্রেন চালালেই করোনা খুব ছড়াবে!! আসলে কেন্দ্র সরকার যা চেষ্টা করছে বলে যাত্রী রেলকর্মী সাধারণ মানুষের আশঙ্কা, তা হল রেল ক্রমশ তার সার্ভিস কমাবে, বিশেষ করে গণপরিবহনে তার ভূমিকা, ট্রেনের সংখ্যা কমানো হবে, ভাড়া বাড়ানো হবে, হকার উঠতে দেওয়া হবে না, স্টেশন চত্বরে ব্যবসা বন্ধ করা হবে, সবই করা হবে করোনার অজুহাতে, এভাবেই ক্রমশ কর্মীসংখ্যা কমানোরও যুক্তি ও পরিস্থিতি তৈরী করা হচ্ছে। রেল শ্রমিক-কর্মচারীদের ইউনিয়নগুলো কি সেকথা বুঝছে? সচেতন জনতা কি সেকথা ধরতে পারছেন? ছুটির মেজাজ উপভোগ করা কিছু কর্মচারী কি সেই বিপদ আঁচ করতে পারছেন? ইউনিয়নের নিজস্ব দাবী আর জনগণের দাবী যে একসাথে তোলার মতো পরিস্থিতি তৈরী হচ্ছে সেকথা কি আমরা উপলব্ধি করতে পারছি? আজ লোকাল ট্রেন চালু না হলে, আগামীদিনে গণপরিবহন হিসাবে রেলও উঠে কি যাবে না? ট্রেড ইউনিয়ন কেন দাবী তুলবে না ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক করার? তাদের রানিং স্টাফরা তো ট্রেন না চালানোর জন্য মোট বেতনও কম পাচ্ছে, তাই না?
এই প্রশ্নগুলোই এই ক্রমশ ঘটে চলা যাত্রীবিক্ষোভগুলো তুলে ধরছে।