পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

চটাদার দ্বিচারিতায় আমি বিস্মিত!!

  • 10 February, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 2021 view(s)
  • লিখেছেন : অশোক মুখোপাধ্যায়
সাম্প্রতিক কর্ণাটকে মুসলমান কিছু কলেজ ছাত্রীকে হিজাব পরার কারণে কলেজে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়েছে, তারপর তা নিয়ে মুসলমান বেশ কিছু মহিলা হিজাব তাঁদের অধিকার বলে আওয়াজ তোলেন। বহু সাধারণ মানুষ স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতে হিজাব বিরোধী হলেও, এক্ষেত্রে মুসলমান মহিলাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। সেই সংক্রান্ত একটি কথোপকথন।

আচ্ছা চটাদা, আপনি মুসলিম মেয়েদের হিজাব পরার পক্ষে – নাকি, না?

না?

ও, তাহলে কর্ণাটকে এখন যে স্কুল কলেজে মুসলিম মেয়েদের হিজাব পরে আসার ব্যাপারে একটা বিতর্ক দানা বেঁধেছে, তাতে আপনার মতে হিজাব পরা উচিত, নাকি না?

হ্যাঁ।

আমি বেশ অবাক হয়ে গেলাম। চটাদা এমনিতে খুব স্পষ্টবাক। কোনো ব্যাপারেই ওনার বৈবেকানন্দিক কোনো দ্বি-চারণ বা দ্বিরুচ্চারণ নেই। লাল চা, না দুধ চা – উনি বরাবরই লাল চায়ের পক্ষে। লাল ঝান্ডা না অ-লাল – উনি বরাবর লাল ঝান্ডার হয়ে ওকালতি করেন। ভোটও দেন। সিঙ্গুরে কৃষি না শিল্প – ওনাকে আমি আগাগোড়াই কৃষির পক্ষে বলতে শুনেছি। করোনায় স্কুল খুলতে হবে না বন্ধ রাখতে হবে জিগ্যেস করলে চটাদা সব সময়ই বলেছেন, করোনার সঙ্গে স্কুলের কোনো ঝগড়া বা পিরিত নেই। ঘাস পিড়িতে বসে স্কুল হচ্ছে শুনেই উনি সেই যে হেসেছেন, পাক্কা সতেরো মিনিটের আগে থামেননি।

সেই চটাদাকে এবার দুরকম কথা বলতে দেখে, থুরি, শুনে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। জিগ্যেস করে ফেললাম, এটা দুরকম কথা হয়ে গেল না?

আলবাত হল। তোর কি অসুবিধা হচ্ছে এতে?

তুমি যদি হিজাবের বিরুদ্ধেই থাক, তাহলে এখানেও তাই থাকবে। তাই না? হিজাব তো মুসলিমদের ধর্মীয় প্রতীক একটা। তুমি যখন ধর্ম কম্ম মানো না, এখানেই বা হঠাৎ করে মানতে যাচ্ছ কেন?

চটাদা একটা গাট্টার মাইম বাগিয়েও কী ভেবে যেন পিছিয়ে গেলেন। আমাকে বললেন, চা বল। একটা ডিম পাউরুটি ভাজা হবে কিনা খোঁজ নে। তারুকাকার চায়ের দোকানে যেতে যেতে জানতে চাইলাম, যদি হবে বলে, কী বলব?

তাও জানিস নে উজবেক? হিজাবের হিসাব নিবি, আর, একটা ডিম টোস্ট খরচা করবি না?

পাক্কা বাইশটা টাকা গচ্চা যাচ্ছে জেনেও চুপ করেই রইলাম। হিজাবের ব্যাপারে বাইট চাই অনেকটা।

গরম ডিম পাউরুটির উপরে কয়েকটা মৃদু মলয়ের ফুঁ দিয়ে চটাদা বললেন, নে, বলে ফেল, তোর অসুবিধা কোথায় হচ্ছে।

আমি কিঞ্চিত ভেবে নিয়ে বললাম, না, আসলে আমরা তো চাইছি দেশ বা সমাজটাকে ধর্মীয় আচার থেকে মুক্ত করতে, সেকুলারাইজ করতে। আর মুসলমানরা একটু যে গোঁড়া হয় তা নিশ্চয়ই তুমি মানবে। তা, এই সময় যদি কোথাও আন্দোলন হয় যে ওদের মেয়েরা মাথায় হিজাব বেঁধে স্কুলে কলেজে আসতে পারবে না, সে তো এক দিক থেকে ভালোই, তাই না?

খুব ভালো, খুব ভালো। কী বুদ্ধি তোর। হঠাৎ করে মুসলমানদের দিয়েই সেকুলারাইজ করার ধান্দাটা মাথায় এল কেন রে? মেজরিটির কী দোষ? ওদের থেকে নয় কেন?

বুঝলাম না। হিন্দুরা স্কুল কলেজে ধর্মীয় পোশাক পরে নাকি?

তুই কর্ণাটকে গেছিস কখনও? বা সাউথে?

না যাইনি। কেন, গেলে কী হত?

গেলে দেখতে পেতিস, গুচ্ছ গুচ্ছ অধ্যাপক কপালে মাথায় তিলক কেটে পড়াতে আসেন। শঙ্কর শঙ্কর ভাব নিয়ে। সেটা কি তোর মতে যুক্তিবাদী আবির্ভাব?

না না, তা নয়।

লক্ষ করেছিস, একটা লোক মুখ্যমন্ত্রী হয়ে কী পোশাক পরে পাঁচ বছর ধরে ঘুরছে? ওটাকে কি তুই সেকুলার ড্রেস বলিস বুঝি!

ছি ছি! তা কেন বলব?

হিজাব বিরোধীওয়ালাদের কাউকে দেখেছিস, এর নিন্দা করতে?

না, তা অবশ্য কেউ করেনি।

হরিয়াণায় দুবছর আগে বিধানসভায় কী হয়েছিল মনে আছে?

হরিয়াণায় তো অনেক কিছুই হয়ে চলেছে। কোনটার কথা চটাদার মাথায় এসেছে ধরতে না পেরে ভোম্বল সাজলেম। এক্ষুনি মনে পড়ছে না, তুমিই বল।

এক সাধু ন্যাংটো হয়ে বিধান সভায় ঢুকে দু ঘন্টা ভাষণ দিয়েছিল। এই এখন যারা কর্নাটকে হিজাব খোলার জন্য লাফাচ্ছে, তাদের দেখেছিলি কিছু বলতে? ওদের কেউ বলেছিল, আপনি আগে ভদ্র পোশাক পরে আসুন, তারপর আপনার কথা শুনব’খন। তা সেই তারা আজ কেন সেকুলারি ড্রেস চাইছে বুঝিস কিছু?

আমি খানিক থতমত খেয়েই বললাম, তবুও দেখ চটাদা, একটা আন্দোলন যখন শুরু হয়েছে, তা সেটা ধরেই এগোনো যাক না। তাতে ক্ষতি কী? আমরা না হয় এর সঙ্গেই জুড়ে দেব বাকি দাবিগুলি, যাতে হিন্দুদের ধর্মীয় ব্যাপারগুলোও থাকবে?

তা দে না। আমি কি না করেছি? চটাদা বেশ উত্তেজিত হয়ে আমার দিকে একটা আঙুল তুলে বললেন।

তবে সেই কাজ তো আর এদের দিয়ে হবে না। এরা নিজেরাই তো ধর্মীয় মৌলবাদী। জয়শ্রীরাম ধ্বনি দিয়ে হিজাবের বিরোধিতা করছে।

তাহলেই বোঝ। এরা ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়ছে না। এরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়ছে। একটা অ্যান্টি মুসলিম জিগির তুলছে।

কিন্তু আমরা যদি তুলি? সমস্ত ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে আওয়াজ ওঠাই? ঠিক এখনই? তোমার কী মত?

চটাদা আবার হাসলেন। বেশ অনেক ক্ষণ ধরে। এই রকম হাসির একটা নিঃশব্দ অর্থ হচ্ছে। তুই একটা আস্ত নিরেট। তোর মতো এত নিখাদ গর্ধব (উচ্চারণ অনুযায়ী লিখলাম) আর দুটো দেখিনি। আমার খুব অসহ্য লাগল। এক কাপ চা হাতে তুলে নিয়ে বলেই ফেললাম, অত হাসির কী আছে? বলই না, কী বলতে চাইছ।

মনে হল, খুব কষ্ট করে চটাদা তাঁর বেদম হাসিতে ব্রেক চাপতে সক্ষম হলেন। শরীরের সর্ব শক্তি দিয়ে। আবার কথা বেরল, তুই যে বিজ্ঞান সংগঠন করিস, তাদের এই ফেব্রুয়ারি মাসের প্রোগ্র্যাম কী? হিজাব নিয়ে কী করতে যাচ্ছিলি?

আমাদের নিজেদের সেরকম কিছু প্রোগ্র্যাম ছিল না।

শাঁখা সিন্দুর নিয়ে? স্কুলে কলেজে বিবাহিত হিন্দু মহিলারা, ছাত্রী কিংবা শিক্ষিকা যাই হন, ওসব ধর্মীয় পিতৃতান্ত্রিক ক্যাটকেটে চিহ্ন গায়ে মেখে বা মাথায় পরে আসবেন না – এরকম একটা অ্যাজেন্ডা?

আপাতত নেই। সময় সুযোগ এলে আমরা প্রচার করে থাকি।

বেশ বেশ। কিন্তু মাঠে নেমে পড়ে আন্দোলন করবি বলে তোরা নিজে থেকে কিছু ভাবিসনি, তাই না?

চটাদা যে কোন দিকে আমাকে ঠেলছে বুঝতে পেরে গুম মেরে যাই।

আচ্ছা, তুই যে সমস্ত বামপন্থী দলগুলিকে চিনিস, তারা কেউ শাঁখা সিন্দুর হিজাব নিয়ে দেশের কোনো প্রান্তে, বা এমনকি কর্ণাটকে গণআন্দোলনের কোনো কর্মসূচি নিচ্ছিল কিনা জানিস?

আমি আমার গুম চালিয়ে যেতে থাকি। আর চটাদা আবার ধীরে ধীরে হাসির সেই ফোয়ারার মুখ খুলে ফেলেন। পুরো সাড়ে ছ মিনিট ধরে হেসে নিয়ে আমাকে কৃপা করে উনি শব্দমুখ খুললেন, তা’লে কেসটা দাঁড়াল এই যে তোদের সেকুলারিস্টদের যুক্তিমনস্কদের বামপন্থীদের এই মুহূর্তে ধর্মীয় মৌলবাদের ব্যক্তিগত শারীরিক চিহ্ন অবলম্বনের বিরুদ্ধে নিজস্ব কোনো অ্যাজেন্ডা ছিল না। তাই তো? আমি ঠিক বলছি তো?

আমি খাদের ধারে দাঁড়িয়েই মাথা নাড়ালাম, হ্যাঁ।

এমনকি ফেসবুকে বা অন্য কোনো সোস্যাল মিডিয়ায় তুই বা তোর কোনো বন্ধুবান্ধব ইদানীং কালে এই অ্যাজেন্ডা নিয়ে কিছু লিখিসনি নিশ্চয়ই? ভেবে বল।

ভাবব আবার কী? জানিই তো, আমিও লিখিনি, আমার পরিচিত কেউও লেখেনি। আবারও ঘাড় নেড়ে, তবে অ্যামপ্লিচুড অনেকটা কমিয়ে, বোঝালাম, হ্যাঁ।

এবার বল, অ্যাজেন্ডাটা আনল কে? আর কেন আনল?

কে আনল -- বলা সহজ। কিন্তু কেন, কী করে বলি? চটাদার দিকেই তাকিয়ে রইলাম উত্তরের আশায়।

উত্তর প্রদেশে ভোট হচ্ছে জানিস?

জানব না কেন? তাতে কী হয়েছে?

খবর নে, ভালো করে খবর যোগাড় কর। দেখবি, ওখানে গেরুয়া পার্টির অবস্থা পুরনো গাড়ির মতো। স্টিয়ারিং ঘুরছে না, গিয়ার আগুপিছু করছে না, তিন চাকায় পাঙ্কচার, হর্নে আর্তনাদ, দু একজায়গায় প্রার্থীরা বাড়ি বাড়ি ঘুরতে সাহস পাচ্ছে না, কোথায় কে কেলিয়ে দেবে ঠিক নেই। ঘুঁটে বানানোর ক্লাশ উদ্বোধন করতে এসেছিল এক মন্ত্রী, ছাত্ররা এক তাল গোবর ছুঁড়ে মেরেছে তার দিকে।

যাক, আমার লাইনে এসে গেছে চটাদা। আমিও জুড়ে দিলেম একটা নতুন বিন্দু, হ্যাঁ পশ্চিম ভাগের কৃষক আন্দোলনের নেতারা পশ্চিম বাংলার স্টাইলে নো ভোট টু বিজেপি প্রচারে নেমেছে বলে শুনলেম। তাতে নাকি খুব সাড়াও পাচ্ছে!

ব্যস ব্যস, এত জানিস, আর এইটা জানিস নে, এই রকম এঁটেল কাদায় পড়লে এই সব শাসক দল কী করে?

ইউ পি-তে তো এখনও কিছু করেনি?

ইউ পি-তেই করতে হবে কেন? আরে পাগলা, কর্নাটকে করলে হবে না?

এইবার আমি অনেকটা যেন আলো দেখতে পাই। “পুলওয়ামা”-র মতো?

গুড! এত জোরে চটাদা আমাকে প্রশংসা করলেন, তারুকাকা পর্যন্ত হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলেন, কি রে, কী হয়েছে নিলু?

আমি চট করে তারুকাকার হাতে বাইশটা টাকা গুজে দিয়ে চটাদাকে বললেম, বাই চটাদা।

আরে আরে, কথা তো শেষ হল না, কোথায় যাচ্ছিস?

আমি সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিতে দিতে কোনো রকমে একটা উত্তর ছুঁড়ে দিলেম, এক্ষুনি একটা স্ট্যাটাস দিতে হবে ফেসবুকে। কাল এস, আরও কথা আছে।

ছি ছি! এই সহজ জিনিসটা আগে বুঝতে পারলেম না? হিজাব মানে পুলওয়ামা-২!

0 Comments

Post Comment