আজ গোটা ভারত তাদেরকে পরিযায়ী শ্রমিক বলছে, তাদের কথা ভাবছে। কাস্তে হাতুড়ি, পদ্ম ফুল থেকে শুরু করে ঘাস ফুল সবাই টিভিতে দুঃখ প্রকাশ করছে, অনেক উপদেশ দিচ্ছে এবং একে অপরকে দোষারোপ করছে। আসল কথা হল এরা কারা, এই মহামারির আগে কি তারা এই দেশের কেউ ছিল না, নাকি সেই সময় কোনো ফুল মালিকের সময় হয়নি নিজের ক্ষেতের ফসলের দিকে চোখ দেওয়ার? এই প্রশ্ন করলে সবাই বিপদে পড়বে, আসলে আজকের বাজারে প্রশ্ন করাও অপরাধ তাও কিছু মনে করিয়ে দেওয়াটা একজন নাগরিক হিসাবে জরুরি। সুজন বাবু টিভির চ্যানেলে বামফ্রন্ট সরকার নিয়ে অনেক কথা বলেছেন, কিন্তু উনি ভুলে গেছেন কেরালা বামফ্রন্ট আর আমাদের বাংলার বামফ্রন্ট এক নয়। কেরালা যেভাবে আজ এই দুর্দশার দিনে আশার আলো দেখিয়েছে, বাংলার বামফ্রন্ট নিজেদের শাসনকালে তার এক তৃতীয়াংশও করতে পারেনি। কেরালার বিজ্ঞান সম্মত জনস্বাস্থ্য পরিষেবা আজ যেভাবে করোনা ও আটকে থাকা শ্রমিক সংকটের সম্মুখীন হয়ে কাজ করছে তা সত্যি অতুলনীয়। কেরালার বামেরা এই পরিকাঠামো বছরের পর বছর কাজ করে তৈরি করেছে এবং তার সুফল এখন তারা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। কিন্তু তাদের সাথে বাংলার বামেদের তুলনা করলে সুজন বাবুরা নিতান্তই লজ্জায় পড়ে যাবেন।
ওদিকে বিজেপির মুখপাত্ররা কেন্দ্রীয় সরকারের ভুমিকা এড়িয়ে সব কিছুর জন্যই রাজ্য সরকারকে দায়ী করছেন, কাদা ছোড়াছুড়ি করছেন কিন্ত তারা একবারও বলছেন না অর্থনীতির পুনরুজ্জীবনের নামে কেন উত্তর প্রদেশে যোগী সরকার তিন বছরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শ্রম আইন (৩৫ টি শ্রম আইন ৩৮ টির মধ্যে) ও শ্রমিকদের অধিকার রদ করার অধ্যাদেশ জারি করেছে্ন? কেন মধ্য প্রদেশে শিবরাজ সরকার ও সেই রাস্তায় হাটছেন? উল্লেখযোগ্য কয়েকটি শ্রম আইন যার মধ্যে নুন্যতম মজুরি আইন, প্রসূতি সুবিধা আইন, কারখানা আইন, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিসপুটস অ্যাক্ট, ইকুয়াল রেমুনেরেশন অ্যাক্ট, ট্রেড ইউনিয়নস অ্যাক্ট, ইন্ডাস্ট্রিয়াল এমপ্লয়মেন্ট (স্ট্যান্ডিং অর্ডারস) অ্যাক্ট না থাকলে আমাদের দেশ হাজার বছর আগের দাস ব্যাবসাতে ফিরে যাবে। জবাব চাইলেই তারা দিল্লির তাব্লিঘি জামাতে ফিরে যাচ্ছেন। তাহলে প্রশ্ন হল মহামারির দিনে কেন বিজেপি শাসিত কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার কে পরিযায়ী শ্রমিকদের কথা ভাবিয়েও ভাবাচ্ছে না?
ওরা তো আগেও শ্রমিক ছিল কিন্তু তখন কারো রাজনৈতিক সদিচ্ছা কেন দেখা যায়নি যখন দিল্লির সেপ্টিক ট্যাঙ্কে দম বন্ধ হয়ে সাফাই কর্মীরা মারা গেছিলেন, বা মহারাষ্টের ধুলের কেমিক্যাল কারখানায় বিস্ফোরণ হয়ে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছিল। শ্রম ও কর্ম সংস্থান মন্ত্রকের (ভারত সরকার) ২০১৪-২০১৬ র সংখ্যা বলছে ভারতে প্রতিদিন তিনজন শ্রমিক মারা যায় এবং ৪৭ জন আহত হয়, ২০১৪-২০১৬ এর মধ্যে গোটা দেশে কারখানাগুলির দুর্ঘটনায় ৩৫৬২ জন শ্রমিক মারা গেছেন এবং ৫১১২৪ জন আহত হয়েছেন। মজার ব্যাপার হল গুজরাট ও বাংলা দুজনেই প্রথম স্থান অধিকার করেছে, ওই তিন বছরে গুজারাতে ৬৮৭ জন শ্রমিক মারা যায় এবং বাংলায় ৪৫১০ জন আহত হয়। ব্রিটিশ সেফটি কাউন্সিলের (২০১৭) গবেষণায় জানা গেছে ভারতে পেশাগত দুর্ঘটনায় প্রতি বছর ৪৮০০০ শ্রমিক মারা যায় এবং তার ২৪% হচ্ছে নির্মাণ শিল্পে। এত কিছুর পরও কেন রাজ্য সরকার বা কেন্দ্রীয় সরকার যথাযথ ব্যাবস্থা নেয়নি? কারন তারা সবাই তখন নিজের নিজের রাজনীতি নিয়ে ব্যাস্ত ছিলেন, তখন ফেসবুক টুইটারে #পরিযায়ীশ্রমিক নিয়ে এত আলোচনা হয়নি এবং কোন সরকারকে (রাজ্য থেকে কেন্দ্র) শ্রমিক সমস্যা নিয়ে এত সমালোচনার মুখে পড়তে হয়নি। সত্যি কথা বলতে চোখ খোলা রেখেও আমরা আমাদের দেশের শ্রমিক ভাইবোনেদের দিকে একবার কোনদিন চেয়েও দেখিনি আর অনেকে দেখতে চেয়েও দেখেনি। আজ করোনা ভাইরাস জনস্বাস্থ্যের পরিকাঠামো থেকে শ্রমিক সমস্যা দেখতে আমাদেরকে বাধ্য করেছে যা এতদিন হেয় হয়ে এসেছে।
করোনার হ্রাসে আজ শয়ে শয়ে খেটে খাওয়া মানুষ বাড়ি ফেরার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েছেন, যেটা খুবই স্বাভাবিক। ক্লান্তি, ক্ষুধা এবং হতাশায় বহু শ্রমিক মারাও গেছেন, লকডাউনের পর থেকে ৩রা মে পর্যন্ত শুধুমাত্র সড়ক দুর্ঘটনায় গোটা দেশে ১৪০ জন মারা গেছেন যার মধ্যে ৩০% পরিযায়ী শ্রমিক, যারা নিজ রাজ্যে যাওয়ার জন্য হাটছিলেন, বাস এবং ট্রাকে লুকিয়ে নিজের বাড়ি যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। সেই শ্রমিক স্পেশাল ট্রেন চলল কিন্তু অনেকগুলো প্রান যাওয়ার পর, বিগত এক মাস তর্ক বিতর্কের পর কিন্তু আবার শুরু হল ট্রেনের ভাড়া কে দেবে? এরই মধ্যে তারা ৯১০ টাকার টিকিট (৭১০ এর টিকিট ২০০ টাকা প্রতিনিধি ফীস ) কেটে বাড়ি চলে এলেন কিন্তু ভাড়া বিতর্ক আজও চলছে এবং চলবে। এর পেছনে দুর্নীতিও কম হচ্ছে না, গুজরাতের সুরাতে তিন গুন দামে টিকিট বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে কেন্দ্রীয় সরকার প্রবাসী ভারতীয়দের আনার জন্য বন্দে ভারত মিশন লঞ্চ করেছে, খুবই ভাল কিন্তু পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরাতে এখনও কেন এত দ্বিধা? কেন কর্ণাটক সরকার শিল্পপতিদের সঙ্গে মীটিং এর পর ট্রেন বাতিল করলেন, কেন এই দুর্ভিক্ষের সময়েও খেটে খাওয়া মানুষদের থেকে টিকিটের নামে মোটা টাকা লোটা হচ্ছে? প্রশ্নটা হল, গরিব শ্রমিকদের জীবনের কি কোন দাম নেই নাকি নিজের অধিকারের জন্য এই নুতন ভারতবর্ষে স্বাধীনতার মতই নিজের জান কুরবানি দিতে হবে?
*গবেষক, সেন্টার অফ সোশ্যাল মেডিসিন এন্ড কমিউনিটি হেলথ, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়