পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

কোথায় গেলে তুমি তিলোত্তমা

  • 03 October, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 604 view(s)
  • লিখেছেন : অরুন্ধতী দাশ
উৎসবে ফেরার নিদান এসে গেছে। সিদ্ধান্তে হাতুড়িপেটা পড়তে না পড়তেই ম্যারাপ বাঁধা হচ্ছে শহর জুড়ে। বচ্ছরকার মতো আবারও বাঁশে-বাঁধা ফেস্টুনের বিজ্ঞাপনী ফ্লেক্সে মুখ ঢাকছে পথঘাট।আধখানা মন বলছে জমি ছাড়ব না, বাকি আধখানা বলছে রোশনাই দেখব না? এই যযৌ ন তস্থৌ-এর দাওয়াই দিয়েছেন মধ্যপন্থীরা, বিপ্লবের মধ্যে উৎসব অথবা উৎসবের মধ্যে বিপ্লবের ডাক উঠছে।

৯ আগস্টের পর থেকে শহর কলকাতার বুকে আর-একটি রাতও কি আগের মতো থাকবে কোনোদিন? পুরুষ কবিদের মধ্যরাতের ফুটপাত বদলের উদ্‌যাপন কি একইরকম উজ্জ্বল ঠেকবে আর কবিতায়? ধর্মতলা, যাদবপুর, বউবাজার, করুণাময়ী কিংবা শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ের ভিড়গুলোকে কি আর কোনোদিন নিশ্চরিত্র নিরুত্তাপ চোখে দেখে পেরিয়ে যেতে পারব? ‘জাস্টিস’, ‘জমায়েত’, ‘দখল’— এই শব্দগুলোর সঙ্গে জুড়ে যাওয়া ঐতিহাসিক স্মৃতি কি এ জীবনে আর ফিকে হতে পারবে? একটি ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহের অস্বাভাবিক ওজন ঘাড়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ানোর অক্ষম চেষ্টার এই দিনগুলি রাতগুলি কী অনাবশ্যক দীর্ঘ!

       অথচ, উৎসবে ফেরার নিদান এসে গেছে। সিদ্ধান্তে হাতুড়িপেটা পড়তে না পড়তেই ম্যারাপ বাঁধা হচ্ছে শহর জুড়ে। বচ্ছরকার মতো আবারও বাঁশে-বাঁধা ফেস্টুনের বিজ্ঞাপনী ফ্লেক্সে মুখ ঢাকছে পথঘাট।আধখানা মন বলছে জমি ছাড়ব না, বাকি আধখানা বলছে রোশনাই দেখব না? এই যযৌ ন তস্থৌ-এর দাওয়াই দিয়েছেন মধ্যপন্থীরা, বিপ্লবের মধ্যে উৎসব অথবা উৎসবের মধ্যে বিপ্লবের ডাক উঠছে। এ ওর ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছে বিপ্লব আর উৎসব। গতিক বুঝে ঘোষণাও এসে গেছে তড়িৎগতিতে— কোথাও কোনো জমায়েত করা যাবে না পাঁচজনের বেশি, কোনো মণ্ডপে বা মহল্লায় সম্মিলিত ন্যায়ের অধিকার নিয়ে গলা চড়ানো যাবে না। অসহ্য রাগে চিৎকার করার আগেও ভাবতে হচ্ছে চারদেয়ালের কোন্‌পাশে ক-জোড়া কান ওঁত পেতে আছে। শুরু হয়েছে আন্দোলনের মুখ বেছে বেছে গ্রেফতারি পরোয়ানা আর জিজ্ঞাসাবাদ। প্রচুর অ্যাড্রিনালিন ঝরিয়ে এবার ডাক্তারদের পথমুখী অবস্থানও ক্ষান্ত দিচ্ছে যে ঠিকানায় এসে, সেটা যে স্থিতাবস্থার নামে আদতে ‘নাকের বদলে নরুণ’, তা বুঝতে রকেট ছোড়ার বিদ্যেও লাগে না।

       অথচ এই তিন পক্ষকাল পেরোনো আন্দোলন তাহলে এসে দাঁড়াল কোথায়? ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, অতীতের যে-কোনো বিদ্রোহ বা বিপ্লব চিরকাল নতুন মুখের সন্ধান করেছে। যে মুখ হাওয়াবদলের খোঁজ জানে, দিনবদলের আশা জাগায়। জনজাগরণ চিরকাল কোনো একটি মুখের পরিচয়ের ভেতরে নিজের অভিমুখ খুঁজতে চেয়েছে। সেই মুখকে আপনি ‘প্রতিনিধি’, ‘নেতা’ অথবা ‘ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর’— যে কোনো নামেই ডাকতে পারেন। ঠিক কীভাবে আপনি তাকে চিহ্নিত করতে চাইছেন, তা বড়োজোর আপনার ঝোঁকটিকে চিহ্নিত করবে। কিন্তু আমাদের ইতিহাস চিরকাল নায়ক চায়। যার দোষগুণের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সে মহাকাব্য রচনা করার সুযোগ পাবে, যার উজ্জ্বল উত্থান অথবা ভরাডুবির ঘাড়ে গণ-উত্থানের দায়ভার চাপিয়ে মানুষ নিশ্চিন্তে ফিরে যাবে নিজস্ব গৃহকোণে, মাঝেমাঝে উঁকি মেরে নিশ্চিত করবে নিজের সমর্থন অথবা চায়ের কাপে ঝড় তুলে জাহির করবে নিজস্ব জ্ঞানগর্ভ বিরোধিতা। এ আন্দোলনের সবচেয়ে বড়ো সীমাবদ্ধতাও ঠিক এইখানে, আবার সবচেয়ে বড়ো সার্থকতাও ওই একই জায়গায় যে, এ আন্দোলন এখনও পর্যন্ত কোনো বহুসমর্থিত অথবা সংখ্যাগরিষ্ঠ-সমর্থিত মুখ হাজির করতে পারেনি। এই আন্দোলন বহুস্বরীয়, বহুস্তরীয়, বহুদলীয়।

       অথচ, রাজধানী শহরের বুকে অহোরাত্র ভিড়াক্রান্ত একটি সরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের ভেতরের যে অন্ধকারকে জনসমক্ষে টেনে বের করেছিল আগস্ট মাস, তার জেরে একেবারে বে-আব্রু হয়ে গিয়েছিল মেয়েদের নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যব্যবস্থার হাঁড়ির হাল, অপরাধদমনের নামে পেশিশক্তি আর রাষ্ট্রশক্তির যুগপৎ প্রয়োগে দ্রুততম ধামাচাপা দেওয়ার ঘৃণ্য প্রচেষ্টা, একই বিষয়কে ঘিরে একদিকে তদন্তে পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা আর জনক্ষোভ সামাল দিতে পুলিশি তৎপরতার আশ্চর্য অদৃষ্টপূর্ব সব নজির। একটা গোটা রাজ্য যখন বিচার চেয়ে পথে নামল, ন্যায়ের দাবিতে এ ওর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নিজেদের শক্তি পরীক্ষা করতে চাইল বারবার, ঠিক তখনই কারাপৃথিবী থেকে একের পর এক ছাড়া পেতে থাকলেন ভূতপূর্ব অপরাধীর দল। অপরাধ প্রমাণ হল কি হল না, সে বিচার আজ আর জনতার আদালতের হাতে নেই। ক্রমাগত মুক্তিসংবাদের এই স্রোতদেখতে আপনার কেমন লাগছে? সমাপতন, নাকি যোগসাজশের মতো?

       আন্দোলনের একেবারে গোড়ার পর্যায়ে সম্মিলিত রাগগুলো কিছুদিন ঘুরপাক খাচ্ছিল মেয়েদের অধিকারের প্রশ্ন ঘিরে। ‘রাত দখল’, ‘পথের দাবি’, ‘গণ কনভেনশন’— বিবিধ নামে উঠে আসছিল নিজের শরীর, নিজের বাঁচা, নিজের জীবন, নিজের সম্মান নিয়ে লড়ে-যাওয়া মেয়েদের দ্রোহের বয়ান। কিন্তু এসব কথা তেতে-ওঠা মাথায় শুনতে ভালো, বলতে আরও সরেস। এই অধিকার বুঝে নিতে হলে যে প্রতিরোধের আগুন বুকের মধ্যে জ্বেলে রাখতে হয়, তা তো শুধু জ্বালায় না, পোড়ায়ও বটে। সেই ভস্মস্তূপের ক্লান্তি রোজ বইতে পারা সহজ নয়। অন্তত, দু-দিনের আরোপিত খেয়ালি উত্তেজনায় তার কোনো সহজ সমাধান নেই। প্রাথমিক চমকটুকু থিতিয়ে গেলেই ছাঁকনির তলা থেকে সবার আগে যা ঝরে পড়ে, তার নাম ধৈর্য। ফলে স্বাভাবিকভাবেই, ক্রমশ এই আন্দোলনেরঅভিমুখ মেয়েদের ওপর থেকে সরে এসে দাঁড়িয়েছিল ডাক্তারদের দিকে। সাম্প্রতিককালের দীর্ঘতম কর্মবিরতি ঘোষণা করে যে দাবিদাওয়া নিয়ে তাঁরা অবস্থান বিক্ষোভ শুরু করলেন, সাধারণ জনতার যে স্বতস্ফূর্ত সমর্থন সেখানে দেখা গেল, তার সমতুল্য কোনো নজির আমি অন্তত দেখিনি। মুখের কথা খসতে না খসতে হাজির হল মুখে তোলার খাবার, মাথা ঢাকার ত্রিপল, তাত জুড়োনোর পাখা, বৃষ্টিপরের শুকনো কাপড়। রাজ্যের সর্বোচ্চ নাগরিকের সঙ্গে দফায় দফায় তাঁদের কথাবার্তার প্রচেষ্টা ও প্রত্যাখ্যান, লাইভ সম্প্রচারের দাবি ওঠা এবং প্রত্যাখ্যান, আন্দোলন প্রত্যাহারের নির্দেশ ও প্রত্যাখ্যান,পরিসেবায় ফেরার পরামর্শ ও প্রত্যাখ্যান—সব মিলিয়ে টানটান চিত্রনাট্য। কিন্তু সম্ভাবনার মেঘে শুধু বিদ্যুৎই চমকাল, বৃষ্টি ঝরল কই? কয়েকটি সুপরিকল্পিত বদলি আর অহৈতুকী আশ্বাসের ভরসায় গোটা জনবিস্ফোরণের বোমাটিকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলা হল গূঢ় রাজনৈতিক অভিসন্ধি নিয়ে। বিচার এতই ক্ষুদ্র, এতই সংকীর্ণ, এতই সোজা?

       আজ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের একটা কবিতা ভারী মনে পড়ছে। সে কবিতার নাম ছিল ‘সালেমনের মা’। পাঁচ ইস্টিশান পেরোনো এক মিছিলের ভেতরে সেখানে পাগল বাবরালির ছোট্ট মেয়ে সালেমন মিছিলের পায়ে-পায়ে বারবার পিছিয়ে পড়ে, তবু মিছিলের গলায় গলা মিলিয়ে বারবার খুঁজে মরছিল তার মা-কে। “এ কলকাতা শহরে/ অলিগলি গোলকধাঁধায়/ কোথায় লুকিয়ে তুমি,/ সালেমনের মা ?” আগামী নির্বাচন ঘিরে এই যে এত সন্দেহ, মসনদ ঘিরে এই যে এত চিৎকার, থ্রেট কালচার নিয়ে এই যে এত তর্ক, সিন্ডিকেট নিয়ে এই যে এত প্রতিরোধ— এই সবের মধ্যে আমারও সেই এক প্রশ্ন, এত কিছুর মধ্যে কোথায় গেলে তুমি তিলোত্তমা?

0 Comments

Post Comment