দশ মাস গর্ভধারণের কষ্ট- প্রসব যন্ত্রণা- সেই নাড়ি-ছেঁড়া ধনকে কষ্টের সংসারে তিলে তিলে বড় করে তোলা। আর তারপর ২৩ বছরের সন্তানের দেহের ময়নাতদন্তে উপস্থিত থাকা! এমন মর্মন্তুদ অভিজ্ঞতা যাঁর হয়েছে, তাঁর কষ্টের পরিমাপ করা অন্যের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু যন্ত্রণার সেই অতলান্ত খাদ থেকে মাথা উঁচু করে, শিরদাঁড়া সোজা রেখে যিনি রাষ্ট্রের কাছে ন্যায় বিচার চেয়েছেন, তাঁর লড়াইকে আভূমি প্রণত হয়ে কুর্নিশ জানাতেই হয়।
ছেলেমানুষি মাখা একটি মুখ। মনে আছে হয়তো কারও কারও। ফয়জান আহমেদ। অসমের তিনসুকিয়ায় তার বাড়ি। সর্বভারতীয় জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ১১তম স্থানাধিকারী খড়্গপুর আইআইটি-তে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনীয়ারিং-এর তৃতীয় বর্ষের ছাত্রটির আংশিক পচন ধরা মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল আইআইটি-র হোস্টেলেরই একটি ঘরে। এক বছর আগে, গত ১১ অক্টোবর, ২০২২ তাকে নৃশংস ভাবে খুন করা হয়েছিল। তিন দিন পর মৃতদেহ উদ্ধারের সময় থেকেই মেদিনীপুর পুলিশ এবং খড়্গপুর আইআইটি কর্তৃপক্ষ বলতে থাকেন-এটা নিছক আত্মহত্যার ঘটনা। ফয়জান গভীর অবসাদে আত্মঘাতী হয়েছে। মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে প্রথম ময়নাতদন্তের রিপোর্টে বলা হয় ফয়জান বাঁ হাতের শিরা কাটায় মৃত্যু হঢয়েছে। কিন্তু এটা মেনে নিতে পারেননি ফয়জানের মা - বাবা। রেহানা ও সালিম আহমেদ জানান, এটা আত্মহত্যা নয়, খুন। তাঁরা ন্যায়বিচারের জন্য কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন। বিচারপতি রাজশেখর মান্থা প্রথম ময়নাতদন্তের রিপোর্টে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তিনি মৃত্যুর প্রকৃত কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য প্রবীণ ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ অজয় গুপ্তকে নিয়োগ করেন। শ্রী গুপ্ত প্রথম অটপ্সি-র ভিডিও ক্লিপ দেখে জানান মৃতদেহের মস্তিষ্কে ও শরীরের নানা জায়গায় হেমাটোমা (জমাট শক্ত ডেলা বাঁধা রক্তজনিত ফোলা)-র চিহ্ন আছে। (হোস্টেলের ঘরে রক্তের নমুনা পরীক্ষার সময়ও তিনি একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করেন। সেখানে দুটি গ্রুপের রক্তের নমুনা মিলেছে। অর্থাৎ মৃত্যুর আগে কারও সঙ্গে সম্ভবত ধস্তাধস্তির কারণে রক্তপাতের জন্য দ্বিতীয় গ্রুপের রক্তের অস্তিত্ব মিলেছে।) তদ পরিপ্রেক্ষিতে তিনি আদালতে, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের তত্ত্বাবধানে দ্বিতীয় অটপ্সি-র আবেদন জানান। আদালত তা মঞ্জুর করে।
কবর থেকে ফয়জানের দেহ তুলে ডিব্রুগর থেকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। দ্বিতীয় ময়নাতদন্তেই প্রথম ফয়জানের মা রেহানা ও ডাক্তার উপস্থিত ছিলেন ডঃ গুপ্তের সঙ্গে। এই দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের রিপোর্টেই প্রথম উল্লেখ করা হয়, ফয়জানের মৃত্যুর ধরণ 'হোমিসাইড'-হত্যা।
এই রিপোর্ট পর্যালোচনা করে বিচারপতি মান্থা নতুন করে তদন্তের জন্য বর্ষীয়ান আইপিএস অফিসার কে জয়রামনকে শীর্ষে রেখে স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম (সিট) গঠণ করেন এবং প্রয়োজনে নার্কো অ্যানালিসিস টেস্টেরও অনুমতি দেন। তাৎপর্যপূর্ণভাবে এই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আইআইটি কর্তৃপক্ষ এবং পুলিশ প্রধান বিচারপতি শিবজ্ঞানম ও বিচারপতি হিরণ্ময় ভট্টাচার্যের ডিভিশন বেঞ্চের দ্বারস্থ হয়। কর্তৃপক্ষ মামলাটি নাকচ করতে চাইছিল এবং তাদের যুক্তি ছিল মান্থা একতরফা শুনানির ভিত্তিতে এই রায় দিয়েছেন। বেঙ্গল পুলিশও সিট চায়নি, তাদেরও বক্তব্য খড়্গপুর পুলিশের তদন্তই যথেষ্ট।
ডিভিশন বেঞ্চের বিচারপতিদ্বয় গত ১৬ আগস্ট বিচারপতি মান্থার নির্দেশের পুনরাবৃত্তি করে বলেন, ফয়জানের হত্যা একটি খুন এবং সিট তার তদন্ত চালিয়ে যাবে। আরও বলেন, রাজ্য দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের পর্যবেক্ষণের চেয়ে সিট-কে তদন্ত থেকে বিরত করার ব্যাপারেই বেশি ব্যস্ত ছিল।
ডিভিশন বেঞ্চের এই রায়ের পরও মামলা কতটা এগিয়েছে? ফয়জানের আইনজীবী রাণা চ্যাটার্জি ইনিউজরুম কে কী বলেছেন "দীর্ঘ লড়াইয়ের পর আমরা সিট পেয়েছি। কিন্তু জানিনা, এই বিশেষ তদন্তকারী টিম এই মামলায় কতটা এগোতে পেরেছে। আজ (৯ অক্টোবর) একটা শুনানি ছিল। কিন্তু রাজ্যের তরফে আদালতে কেউ হাজির ছিলেন না।" গত ১৬ আগস্ট থেকে একটা শুনানিও হয়নি।
এই মামলা, র্যাগিং-এর অন্য কেসগুলোর মত সংবাদমাধ্যমে তেমন প্রচার পায়নি। রাজ্য ও খড়্গপুর আইআইটি কর্তৃপক্ষও কোন সাহায্য সমর্থন তো দূরের কথা, নিহত ছাত্রটির ন্যায়বিচার পাওয়ার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই প্রসঙ্গে ফয়জানের মা ইনিউজরুম কে বলেছেন, "এক বছর আগে আমার ছেলের মৃতদেহ যখন পাওয়া গেল,ভেবেছিলাম আইআইটি খড়্গপুর কর্তৃপক্ষ থেকে আমি সাহায্য সমর্থন পাব। কিন্তু আজ যখন আইআইটি কর্তৃপক্ষ আমার ন্যায়বিচার পাওয়ার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে, একটা প্রশ্ন প্রতিটি মুহূর্তে আমাকে তাড়া করে ফিরছে- ওরা কাদের বাঁচাচ্ছে?"
উদ্গত অশ্রু নিয়ে তিনি আরও বলেছেন, "আমি মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির কাছে চিঠি লিখেছিলাম, সংবাদমাধ্যমে অনেকবার তাঁর কাছে আবেদন জানিয়েছি। পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু কমিশনের চেয়ারম্যান-এর কাছেও চিঠি লিখেছিলাম। কিন্তু প্রত্যুত্তরে একটি শব্দও তাঁদের থেকে শুনতে পাই নি।"
"ফয়জানের হত্যা শুধু আমাদেরই ক্ষতি নয়, দেশেরও। যেমন মেধাবী তেমনই ভালো মনের মানুষ ছিল। সে সমাজ ও দেশের সম্পদ ছিল।" বলেছেন ফয়জানের বাবা সালিম আহমেদ।
ফয়জান ছিল ভারতের অন্যতম মেধাবী সন্তান। খড়্গপুর আইআইটি-তে রোবোটিক্স সংক্রান্ত দুটি গবেষণা টিমের অন্যতম সদস্য ছিল সে। অন লাইনে সে গণিতের শিক্ষকতা করতো যার পেমেন্ট হত ডলারে। অসম সরকারের মেধাবৃত্তি পেয়েছিল কৃতী ছাত্র হিসাবে। অনেক সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেল তার মৃত্যুতে।
কে বা কারা তাকে হত্যা করেছিল? কেন করেছিল? তারা কি আদৌ ধরা পড়বে? ফয়জানের বাবা-মা ছেলের হত্যার বিরুদ্ধে ন্যায় বিচার পাওয়ার যে লড়াই করে চলেছেন গুঁড়িয়ে যাওয়া অস্তিত্ব নিয়ে, আদৌ কি তা পাবেন কোনদিন?
আপাতত নিরুত্তর সময়ের কাছে উত্তর দাবি করার দায় এবার আমাদের, নাগরিকদের ওপর এসে পড়েছে। আমরা কি শুধুই 'পাশে আছি' বলে পাশ কাটাবো না রাস্তায় জোরালো আওয়াজ তুলব আমাদের হতভাগ্য দুই সহনাগরিকের পাশে থেকে? যে আওয়াজ প্রাতিষ্ঠানিক বধিরতা, ঔদাসীন্যকে ফালা ফালা করে দেবে? কবে? কখন?
মূল লেখার সূত্র।
Unsolved Mystery: The Tragic Murder of IIT KGP’s Faizan Ahmed