আমার পরিচিত প্রায় সমস্ত বামপন্থী কর্মী বিরোধী জোটের রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী যশবন্ত সিংহ-এর মনোনয়নে অসন্তুষ্ট। পাড়ায়, চায়ের দোকানে, সাইকেল স্ট্যান্ডে, রেল স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের আড্ডায়, এবং ফেসবুকের ব্রিগেডে—সর্বত্র বিরক্তি ও রাগ ঝরে পড়ছে। গত কাল ধনেশ চক্কোত্তি স্ট্রিটের পেয়ারাতলার মোড়ে তারুকাকার চা সিঙ্গারার দোকানের সামনে দাঁড়িয়েও একই কিসসা শুনতে শুনতে ঠিক করেছিলাম, এই ব্যাপারে চটাদার মত কী জানতে হবে।
চটাদা এযুগের একজন লোকাল জিনিয়াস। জানেন না, এমন জিনিস দুনিয়ায় খুব কম। প্রশ্ন থেকে উত্তরে যেতে ওনার সময় এত কম লাগে যে অনেক সময় সন্দেহ হয়, উনি কি আন্দাজে জানতেন কী জিগ্যেস করব। কিন্তু একটা জিনিস আগে থেকে ভেবে রাখতে হয়। চটাদা ভুল প্রশ্ন খুব অপছন্দ করেন। যা হোক কিছু জিগ্যেস করলেই হবে না। জ্ঞাতব্যটা ঠিকঠাক হওয়া চাই। নইলে চা সিঙ্গারা বিনিয়োগ ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে।
সুতরাং পেয়ারাতলার মোড়ে পৌছনোর আগে অন্তত তিনবার মনে মনে রিহার্সাল দিলাম, কী জানতে চাইব। বিজেপি-র প্রার্থীর বিরুদ্ধে কাকে দাঁড় করানো উচিত ছিল? উঁহু, হল না, বামপন্থীদের তরফে বিরোধী জোটে কার নাম প্রস্তাব করা উচিত ছিল? না, এতেও মনে হয় চটাদার রাগ হয়ে যেতে পারে। আচ্ছা, বরং জিগ্যেস করব, অবিজেপি বিরোধী জোট কীভাবে গঠন করলে ভালো হত?
না, ঠিক বুঝতে পারছি না, কীভাবে কথা পাড়ব। থাক, অত ভেবে কাজ নেই। আগে তো যাই।
আমাকে দেখেই চটাদা এক গাল হাসলেন। আয়, আয়। তোর কথাই ভাবছিলাম। এত বড় একটা খবর, আর তোরই কিনা দেখা নেই! কী করছিলি এতক্ষণ?
বড় খবর? কোন খবরের কথা বলছেন চটাদা? মেয়েদের ক্রিকেটের সেই রানের কথা বলছেন?
ছাগল একটা। মেয়েরা বড় রান করলে আমাদের দেশে খবর হয়?
তাহলে? আমি অন্ধকারে খবর হাতড়াতে থাকি। ও, বুঝেছি, অঙ্কিতার টাকা ববিতাকে দেবার খবরটা তো? হ্যাঁ, সে –
না, তোর বালকত্ব ঘুচল না দেখছি।
এবার মরিয়া হয়ে আমি বলতে গেলাম, তাহলে আপনি কি য---
আমার মুখের কথা ছিনতাই করে নিয়ে চটাদা বললেন, এই, এই এতক্ষণে মাথায় ঢুকেছে। তা, তুই খেপে যাস্নি?
যাক্ বাবা, সমাধান হয়ে গেল। আজ খুশি হয়ে নিজের উদ্যোগেই বললাম, দাঁড়ান, আগে সিঙ্গারা বলে আসি।
আয়, আয়। তবে আমার জন্য দুটোর বেশি বলিস না। অলরেডি খান ছয়েক খাওয়া হয়ে গেছে। আর চাও বলে দিয়ে আয়।
বিনিয়োগ করার পরেই জানতে চাইলাম, যশবন্ত ভদ্রলোক কেমন? প্রার্থী হিসাবে সজ্জন মনে হয়?
চটাদা একটা সিঙ্গারার খোল ভেঙে মুখে পুরে জিভকে বোধগম্য শব্দ গঠনের জায়গায় এনে বললেন, বিজেপি ছেড়েছে মানে তো কিঞ্চিত সজ্জনতা আছেই। আজকালকার বাজারে ----
কিন্তু বামপ----
বামেরা? তারা এত দিন কী করছিল? বিজেপি-র বিরুদ্ধে লড়াই করার কোনো স্ট্র্যাটেজি ছকেছিল কিছু? শুনেছিস তুই?
হ্যাঁ, মানে, না, ইয়ে, বলছিলাম কি, মাঝে মাঝেই ----
মাঝে মাঝেই মিটিং হয়। এই বলবি তো? রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের অ্যাজেন্ডা না থাকলে ওদের কী প্ল্যান ছিল বলে মনে হয়? কোন ইস্যুতে প্রচার তুলবে বলে ভাবছিল?
আমি হতাশ হয়ে বলেই ফেললাম, এটা কিন্তু আপনি ভুল লাইনে খেলছেন। প্রশ্ন করার কথা আমার। আপনি উত্তর দেবেন। তা না করে ---
বুঝেছি বুঝেছি। তোর অসুবিধা হচ্ছে। আচ্ছা, সিঙ্গারা যখন খাইয়েছিস, তুইই প্রশ্ন কর।
বলছি কি, বামপন্থীদের কী করণীয় ছিল? আপনার কী মত?
কেন, চুপচাপ বসে বসে অবাম বিরোধীদের জোট পাকানো দেখা, তার পর জোটে যোগ দিয়ে গরিষ্ঠ মতের পেছনে দাঁড়িয়ে পড়া। সেই কাজটা তো ভালোই করেছে।
না, আপনি খুব রেগে আছেন দেখছি। আজ তাহলে থাক। কাল বরং আসব। আমি এবার চাপের কৌশল নিলাম। আমি চটাদার স্বভাব ভালো করেই জানি। উনি একবার একটা কোনো অ্যাজেন্ডায় কথা বলতে শুরু করলে মাঝপথে থামতে ঘোর অপছন্দ করেন। বিশ্বের অধিকাংশ বাক্যবীরদের বোধ হয় এরকমই হয়। বাক্যপথ স্কিম থেকে তাঁরা চট করে সরে যেতে পারেন না, বা, চান না। কায়দাটা কাজে এল।
চটাদা একটু পিছিয়ে গেলেন। বছর ছয়েক। সেই ২০১৬ সালেই সুযোগ এসেছিল। যখন মোদী ভালো নোট বাতিল করে দিয়েছিল। ঠিক মতো ক্যাম্পেন করতে পারলে, বোঝাতে পারলে তখনই সমস্ত বিরোধীদের নিয়ে বামেরা এক কাট্টা হয়ে দেশ জোড়া একটা বিক্ষোভের জন্ম দিতে পারত। দিল না। বোকার মতো একটা বন্ধ ডেকেও শেষে ঘরে বসে রইল। কিছুই করতে পারল না। কেন?
কেন?
কারণ, বামেরা, বিশেষ করে বড় বামেরা তখন ভেতরে ভেতরে আনন্দে হাবুডুবু খাচ্ছিল। তাদের মাথায় তখন ঘুরছিল, এবার টিএমসির সারদা-নারদ কাণ্ডের চোরেরা সব চুরি করা টাকা বালিশের ওয়ার আর পায়খানার সিস্টার্ন থেকে বের করে আনতে বাধ্য হবে, আর জমা দিতে গেলেই ব্যাঙ্ক খপ করে ধরবে। ফলে নোটবাতিল নিয়ে ওরা কিছু করতে আসলে চায়নি।
হ্যাঁ, এটা তুমি ঠিকই বলেছ। আমরা অনেকেই এভাবে ভেবেছি।
কী করে ভাবলি? যারা টাকা চুরি করে থাকে, সেই টাকা তারা নগদে বান্ডিল বেঁধে ঘরে জমিয়ে রাখবে? কেউ রাখে? এখানেই তো বোঝা যায়, তোদের বাম ঘিলুর আয়তন কীভাবে কমে যাচ্ছে! ওরকম কালো টাকা একটাও উদ্ধার হল? কী দেখলি তোরা?
খুবই ভুল হয়েছিল আমাদের সেই চিন্তাটা।
২০১৯ আর ২০২১-এর দুটো বড় নির্বাচন তোদের বৃহৎ বামেরা বিজেপি-র হাতে খেলে গেল। কী বুদ্ধি! না, বিজেপি এসে টিএমসিকে তাড়াক। পরে আমরা বিজেপি-কে তাড়িয়ে দেব। আগে রাম পরে বাম! তোরা ঘাসের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছিস না, পদ্মর সঙ্গে পারবি? মাথায় এল কী করে?
আমি সিধা আত্মসমর্পণ করলাম, ঠিক বলেছ, এটাও কেলেঙ্কারি হতে যাচ্ছিল। ভাগ্যিস ছোট বামেরা বিজেপি-কে ভোট নয় শ্লোগান তুলে প্রচারে নেমেছিল, তাতেই সম্মান বাঁচল।
আর সম্মান। এক পিরজাদাকে খুঁজে বের করলি, তাকে সেকুলার সাজিয়ে ঘাসের মুসলিম ভোট কাটবি বলে। আরে বুদ্ধু, সেকু হলে মুসলিম ভোট হিন্দু ভোট পাওয়া যায়?
না, তা যায় না।
আর যে মুসলিম ভোট কাটবে বলে আশা করিস, সে সেকু হয় কখনও?
মেনেই নিলাম, আমাদের সেই সব অঙ্কই ভুল ছিল। নইলে আর শূন্য হলাম কেন?
প্রশান্ত ভূষণ যখন একা একটা গোটা সিস্টেমকে চ্যালেঞ্জ করে বসলেন, দেশের কাজি-এ-আলা যখন শাস্তি ঘোষণা করতে পর্যন্ত ভয় পাচ্ছে, তখন তোদের বাম নেতাদের সাহস হল না সেই মামলায় নিজেদের যুক্ত করে ওদের আরও বেকায়দায় ফেলতে। তোরা উদ্যোগ নিলে অবাম অবিজেপি দলগুলির নেতারাও অনেকেই সামিল হত, একটা জবরদস্ত চাপ তৈরি হত! করলি তোরা?
কী যে বল, ভাবিইনি এত কথা!
তা ভাববি কেন? ঠান্ডা ঘরে বসে বিবৃতি দিবি আর প্রচার পুস্তিকা বের করবি। আর তোদের বুদ্ধিজীবীরা সেমিনার করবে। কাজের কাজ? নৈব নৈব চ!
তুমি কি এই সব পরামর্শ দিয়েছিলে কাউকে?
দিইনি? অন্তত তিন পার্টির তিন জন মাঝারি নেতাকে বলেছিলাম।
কী বললেন ওনারা?
ফুঃ দিয়ে উড়িয়ে দিলে। এক নেতা বললে, আপনি নিজেই করে দেখান না কর্তা। আমরা না হয় আপনার পেছন ধরব।
ছি! ছি! ওরম বললেন?
হ্যাঁ, মেজ দলের একজন যুব নেতাকে বলেছিলাম। সে বললে কী জানিস? আমাদের নেতারাও মাথা ঘামাচ্ছেন। আপনি অত ব্যস্ত হবেন না। রক্তচাপ বেড়ে যাবে!
হায়। কে বলেছিল, নামটা জানা যাবে?
নাম শুনে কী করবি? ভেরিফাই করবি? নাকি গাল দিতে যাবি?
না, তা নয়, বেকুবটা কে জেনে রাখতাম।
বেকুব তো বেশিরভাগ। আলাদা করে একজনকে জেনে কী করবি?
আর তিন নং নেতা?
সে বরঞ্চ কিঞ্চিত বুদ্ধির পরিচয় দিলে। বললে, দেখ চটাদা, নেতারা আমাদের কথা শুনে লাইন ঠিক করে না। ওসব সাজেশন টাজেশন দেওয়া বেকার। এই লাইনটা যদি কোনো খবরের কাগজ বের করে তখন হয়ত পাত্তা দেবে।
এটা কিন্তু একদম সঠিক বলেছে।
তবেই বোঝ্। একটা একটা সুযোগ এল, আর তোরা সেগুলো হাতছাড়া করলি। বিরোধী জোটের উদ্যোগ বামেরা নিলে যা হতে পারত, হল না। ছোট বামেদের ভটচাজ্জি কিছু ভালো কথা বলায় তোরা তার পেছনে বাচ্চাদের মতো লেগে রইলি। আর যাকে ঠেকাতে তোরা এত প্যাঁচ কষলি, সেই দলটাই বিজেপি-কে রাজ্যের ভোটে হারিয়ে দিয়ে, তোদের শূন্যে নামিয়ে দিয়ে সারা দেশে অবাম অবিজেপি বিরোধীদের কাছে হিরো হয়ে গেল। এখন যদি ওরাই উদ্যোগ নেয়, তোদের পেছন পেছন যাওয়া ছাড়া উপায় কী? আর, অন্য যাকেই ওরা ঠিক করত, তোদের লোক কেউই হত না। শারদ পাওয়ারও নয়, ফারুক আবদুল্লাও নয়। এক যদি তোরা শুরুতে মেধা পটেকার বা জগমোহন সিং-কে রাজি করিয়ে ওনাদের একজনের নাম প্রস্তাব করতে পারতিস, তাহলেও তবু কথা ছিল। তাঁরা খানিকটা হলেও বামপন্থীদের কাছের লোক হতে পারতেন।
উঃ চটাদা, তোমারই নেতা হওয়া দরকার ছিল। এই পেয়ারাবাগানের এক চায়ের দোকানে নিজের জীবন বুদ্ধিসুদ্ধি সব ফিনিশ করে ফেললে। তাহলে বলছ, মন খারাপ করার কিছু নেই? য-কে বিশ্বাস করা যায়? ভালো কিছু করবে?
কাউকে বিশ্বাস করিস না। রাজনীতিটা বুঝতে শেখ। সেই অনুযায়ী খেলতে শেখ।
লোকটার আরএসএস ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে চিন্তা করার কিছু নেই বলছ?
যে আরএসএস ছেড়ে বেরিয়ে এল, তার ব্যাকগ্রাউন্ড ভেবে কী করবি? এখন তাকে দিয়ে সঙ্ঘের বিরুদ্ধে কতটা বলাতে পারিস, তার চেষ্টা দেখ। মানে দেখা উচিত। দলিত নির্যাতন নিয়ে, আদিবাসী উচ্ছেদ নিয়ে, ইউএপিএ সিডিশন-এ গ্রেপ্তারির বিরুদ্ধে সভা করাতে থাক, ভিমা কোরেগাঁও নিয়ে প্রচার করাতে চেষ্টা কর --- তবে যদি কিছু কাজ হয়। নয়ত, এখন থেকে তোরা স্রেফ টিএমসি-র তাস নিয়ে খেলে যাবি।
এটা ভালো বলেছ।
হ্যাঁ, রাষ্ট্রপতি ভোটে তোরা জিতবি না। কিন্তু এই প্রচারের জোয়ারটা যদি পরের লোকসভা ভোট পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে পারিস, তাতে কিছু কাজের কাজ হলে হতেও পারে।
আমি মোটামুটি সব প্রশ্নেরই উত্তর পেয়ে গেলাম। বললাম, দেখি তোমার এই কথাগুলি কোথাও পৌঁছে দেওয়া যায় কিনা!
চেষ্টা করে দেখ। চটাদা বললেন, পারলে জানাস, সেদিন আমিই তোকে একটা আস্ত সিঙ্গারা খাওয়াব।