এখন দেশাত্মবোধ না দেখালেই সে দেশদ্রোহী।এখন প্রতিবাদ করার নাম ‘দেশদ্রোহিতা’।
এবার আসা যাক কিভাবে এই দেশাত্মবোধ ঢোকানো হচ্ছে? আর কিভাবে স্মার্ট ফোনের মধ্যে দিয়ে সমস্ত নাগরিকদের মধ্যে সঞ্চারিত করা হচ্ছে এই জাতীয়তাবোধ? দেশের প্রথমবার ভোটদাতার সংখ্যা কত? তাঁরা কি নিয়ে ব্যস্ত? অন্য রাজ্যের কথা ছেড়েই দেওয়া যাক শুধুমাত্র বাংলাতেই প্রথমবার যারা ভোট দেবেন সেই সংখ্যাটা ৭৯ লাখ। এর মধ্যে অনেকের কাছেই দামী দামী স্মার্ট ফোন আছে, এবং এর বেশীরভাগটাই হোয়াটসআপ ব্যবহার করেন। এঁদের কেউ কেউ হয়তো ‘পাবজি’ খেলে নিয়মিত। আপনি নিশ্চিত ভাবছেন এটা আবার কি খেলা এটার সঙ্গে জাতীয়তাবাদ, বা রাজনৈতিক প্রচারের কি সম্পর্ক? এটা একটা দলগত খেলা, একদল অন্যদলকে ডেকে এনে মারবে। এটার পুরো নামটাও হয়তো অনেকে জানেন না “ প্লেয়ার আননোন ব্যাটেল গ্রাউন্ড”। এছাড়াও আরও বেশ কিছু খেলা এসেছে আমাদের অগোচরে যেমন ‘ কাউন্টার স্ট্রাইক’‘ফোরটনাইট’ইত্যাদি। এই খেলাগুলো মূলত খেলা হয় স্মার্ট ফোনে এবং এগুলোর মধ্যে এমন এমন চরিত্রকে ঢোকানো হয় যাতে মনে হয় খেলাটি যেন সত্যি ঘটনার অবলম্বনে তৈরি। ধরা যাক কোথাও হয়তো দেখা যায় জঙ্গিরা আক্রমণ করেছে, সেই আক্রমণের হাত থেকে বাঁচাতে একজন শক্তিশালী নেতা এসে বলছেন, উৎসাহিত করছেন কিভাবে জঙ্গি নিকেশ করা যায়, দেশকে রক্ষা করা যায়। সুতরাং অজান্তেই তাঁর মধ্যে একটা দেশাত্মবোধ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। তাঁর কাছে তখন চাকরির দাবি, শিক্ষার দাবি গৌণ হয়ে যায়। এর পাশাপাশি চলে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে হোয়াটসআপগ্রুপ ধরে প্রচার। মুসলমানেরা সন্ত্রাসবাদী, মুসলমানেরা ক্রমশ সংখ্যায় বেড়ে চলেছে। মুসলমানদের জন্যই অন্যান্য মানুষদের সবচেয়ে বেশী অসুবিধা হচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি। একজন ১৮ বছরের কিশোর/ কিশোরীকে যদি রোজ এই রকমের বিভিন্ন মেসেজ পাঠানো হয় সে বিশ্বাস করতে শুরু করে ঐ কথাগুলো। এবং এর বিপরীত যেকোনো রকমের কথাকেই তাঁর মনে হয় দেশদ্রোহীবা অদেশপ্রেমিক।
এবার আসা যাক ফেসবুক বা ট্যুইটারে। যেখান থেকে শুরু হয় আর একরকমের প্রচার। আমাদের প্রধানমন্ত্রী গত নির্বাচনের আগে বলেছিলেন তিনি নাকি চৌকিদার। তারপর ৫ বছর কেটে গেছে, এরপর রাফাল, আধার সহ বিভিন্ন দুর্নীতির সঙ্গে তাঁর নাম জড়িয়ে নানান অভিযোগ উঠেছে। বেশ কিছু নামকরা ব্যবসায়ী ব্যাঙ্ক থেকে কোটি কোটি টাকা নিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। এই সমস্ত অভিযোগকে জড়িয়ে বিরোধীরা বলতে শুরু করে ‘চৌকিদার নিজেই চোর’তাহলে আর সে কি করে দুর্নীতির বিপক্ষে লড়বে? অস্বস্তিতে পড়ে তিনি একদিন সকালবেলা দেশের সমস্ত মানুষের উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে জানালেন, তিনি একা চৌকিদার নন দেশের সব মানুষই চৌকিদার। এবং শ্লোগানটা ঘুরিয়ে দিলেন ‘আমিও চৌকিদার’। পরদিন থেকে তাঁর মন্ত্রীসভার সব মন্ত্রী, সমস্ত বিজেপি তথ্যপ্রযুক্তি সেলের মানুষ অথবা রোবটেরা নিজেদের নামের আগে চৌকিদার শব্দটা বসিয়ে ফেললো। এর দুটো মানে দাঁড়ালো— প্রতিটি মানুষ যদি তাঁরকথার প্রতিধ্বনি করে তাহলে আর কেউ চোর থাকে না। অন্যদিকে একে অন্যকে সন্দেহ করা যায়। এটাও সেই বিভাজনের খেলা, যা শুরু হয়েছিল নোটবন্দীর সময়ে। একজন মানুষ ভাবতে শুরু করে যে তাঁর পাশের বাড়ির মানুষটি চোর, কারণ সে তো নিজেকে চৌকিদার বলছে না। আর যদি না বলে তাহলে সে মোদীর বিপক্ষে অতএব সে ‘দেশদ্রোহী’। পাশাপাশি অনলাইনে বিক্রি শুরু হলো টুপি, চায়ের কাপ, টিশার্ট, পেন, জলের বোতল ইত্যাদি যার প্রতিটিতে লেখা একটাই কথা ‘আমিও চৌকিদার’। অনলাইনে যারা কেনা কাটা করেন তাঁরা জানেন যে প্রতিটি কেনাকাটার সময়ে ক্রেতাকে তাঁর ঠিকানা, ফোন নম্বর দিতে হয়। সুতরাং দুদিক দিয়ে লাভ হলো শাসক দলের। এক, জিনিস বিক্রি করে টাকা এলো। পাশাপাশি অসংখ্য ক্রেতার তথ্য হস্তগত হল। যে তথ্য দিয়ে পরে আবার নতুন হোয়াটসঅ্যাপগ্রুপ বানানো যায় এবং আবার সেই পুরনো প্রচার বা ঘৃণা-বিদ্বেষ নতুন করে ছড়ানো যায়। সুতরাং এটা একটা গোলাকার খেলা, না চাইলেও এতে আপনাকে অংশীদার হতেই হবে।যেন এটা মানুষের আন্দোলন। জানা গেছে দেশের শাসক দলের সর্বোচ্চ ব্যাক্তির একটি বেসরকারি কোম্পানি এই গোটা প্রক্রিয়াটার সঙ্গে যুক্ত। বেশ কিছু ফেসবুকের পেজ চলে যেখান থেকে এই প্রচার চালানো হয়। শাসক দল এই অভিযোগ অস্বীকার করলেও সম্পূর্ণভাবে ফেলে দিতে পারেনি। কিন্তু ঘৃণা-বিদ্বেষের প্রচার নির্বাচন কমিশনের চোখের সামনেই চলছে। নির্বাচন কমিশন এখনওআদি অনন্ত কাল ধরে যে পদ্ধতিতে চলতো এখনও যদি সেই একইরকমের পদ্ধতিতে শাসকদলকে বোঝার চেষ্টা করে তাহলে নির্বাচন কমিশন নিয়েই প্রশ্ন উঠে যায়। পাশাপাশি বিরোধী দলেরাও যদি তাঁদের প্রচারকে সেই পুরনো দেওয়াল দখলের রাজনীতির ঘেরাটোপে রেখে দেয় তাহলে এই রকম একটি শক্তি ক্রমশ আরও শক্তিমান হয়ে উঠবে এবং আমাদের শিরায় উপশিরায় ঢুকে যাবে যেখান থেকে বেরিয়ে আসা এই দশক কেন এই শতকেও সম্ভব হবে না।
আসলে এটা একটা ধারণা যা সমাজে ঢুকিয়ে দেওয়া গেলে একটা সন্দেহের বাতাবরণ এমনিই তৈরি হয়ে যায়। এ এমন এক সন্দেহ যে মানুষকে কি খাচ্ছে, কি পরছে সেটার ওপর চৌকিদারী করাটা সামাজিক মান্যতা পেয়ে যায়। যে সন্দেহের বশে ইখলাখদের মারতে পিছপা হয়না আর একজন সহনাগরিক। যে সন্দেহ একজন নাগরিককে ভাবতে দেয় না, কিসের জন্য অন্য অনেক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে একজনকে বাধ্য হয়ে, বাস্তব জীবনে চৌকিদার হতে হয়। যে সন্দেহ নিজেকে হীনমন্য হতে শেখায়, প্রশ্ন করতে বারণ করে। আসলে স্যালুট পাওয়া এবং স্যালুট করার মধ্যে যে তফাৎ আছে সেটাকেই আরও গভীরে প্রবেশ করানোর জন্যই এই প্রচার। অনেকের প্রিয় ছবি ‘ হীরক রাজার দেশে’র সেই বিখ্যাত যন্তর মন্তর ঘরে ভারতের নাগরিকদের প্রবেশ করানো হয়েছে।এখান থেকে বেরিয়েই সবাই বলবে “আমিও চৌকিদার” যা আজকের সময়ে মগজ ধোলাইয়ের নতুন মন্ত্র।