রবিঠাকুর বলেছেন কী পাইনি তার হিসাব মিলাতে মন মোর নয় রাজি। বেশ, কী পাইনি ভাবব না তা নিয়ে, বরং ভাবি কী পেলাম।
প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া কুড়ি লক্ষ কোটি টাকা পেয়েছি।
কুড়ি লক্ষ কোটি! অর্থাৎ কিনা দুইয়ের পিঠে তেরোখানা শূন্য। মোদীজি তো মঙ্গলবার রাত ঠিক আট ঘটিকায় বলে দিলেন অর্থনীতি বাঁচাতে কুড়ি লক্ষ কোটির ত্রাণ দেওয়া হবে। কোথায় কীভাবে সে টাকা খরচ হবে সে কথা পরদিন বিকেলে জানালেন দেশের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামণ। তা আসুন, দেখা যাক কে কীভাবে পেলাম কুড়ি লক্ষ কোটির কত অংশ।
প্রথমেই জেনে আহ্লাদে আটখানা হয়ে গেলাম, যে বাড়তি আয়কর সরকারের কাছে জমা পড়েছে তা খুব তাড়াতাড়ি রিফান্ড পাওয়া যাবে । যাদের রিফান্ডের পরিমাণ পাঁচ লক্ষের মধ্যে তারা এই পেলেন বলে।
মানে আমার টাকা আমি ভুল করে সরকারকে দিয়ে ফেলেছিলাম, সেটা চলে এসেছে একবারে প্যাঁকপেকে একটা হাঁসের মতো রিলিফ প্যাকেজ হয়ে।
তারপর পেলাম লোন। আপনি যদি মাইক্রো স্মল বা মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজের মালিক হন, তবে আপনি যতটা দরকার ততটাই ব্যাঙ্কঋণ নিতে পারবেন। সেই লোন নিয়েই তার সুদ দিতে শুরু করতে হবে, আর চারবছরের মধ্যে সুদাসল মিটিয়ে দিতে হবে। লে হালুয়া। মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে ব্যবসা বন্ধ, গোটা এপ্রিল মাস এবং মে মাসেরও অনেকটা চলে যাচ্ছে এক পয়সা আয় হয়নি, কিন্তু কর্মচারীদের বেতন, অফিস ভাড়া ইত্যাদি দিতে হয়েছে। এর সঙ্গে এবার দিতে হবে ধারের সুদ। বাজার কিন্তু ঝিমিয়ে পড়ে আছে। মনে করুন , আপনি বাচ্চাদের ঝুমঝুমি বা লাল বলের ব্যবসা করেন, চাঙা বাজারে যে পরিমাণ ঝুমঝুমি বা বল বিকোত, সেই পরিমাণ বিক্রিতে ফিরে যেতে দু-বছরও লেগে যেতে পারে। এদিকে হাতে নগদের টান, ওদিকে তার মধ্যেই এতদিনের খরচের সঙ্গে যোগ হবে লোনের ইন্টারেস্ট। পুরো লোন চার বছরের মধ্যে মিটিয়ে ফেলা কী ভাবে সম্ভব সেটা মাথায় ঢুকছেই না। এদেশে বিরাট বিরাট শিল্পপতিদের লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার ঋণ রাইট অফের নামে মুছে ফেলা যায়, কিন্তু যে ছোট ও মাঝারি সংস্থাগুলি অর্থনীতিকে সচল রাখে , তাদের পরিত্রাণ দেওয়ার সময় সুদহীন ধার দেওয়ার কথাও মনে পড়ে না। তাদের দুর্দশা নিয়েও খানিক বাণিজ্য করে নিতে হয়। অবশ্য যে সরকার গুদামে চাল রাখার জায়গা না থাকলেও নিরন্নকে চাল বিলিয়ে দিতে পারে না, তার থেকে এর চেয়ে বেশি আর কী-ই বা আশা করা যেতে পারে!
এর পর আসি প্রভিডেন্ট ফান্ডের তামাশায়। এতদিন কর্মীর বেতন থেকে বারো শতাংশ কেটে এবং তার সঙ্গে নিয়োজক সংস্থার দেওয়া বারো শতাংশ যোগ করে এমপ্লয়িজ প্রভিডেন্ট ফান্ডে ঢুকত। এবং এই ফান্ডের টাকা কর্মজীবনের শেষে কর্মী পেতেন, যা পুরোটাই ট্যাক্স ফ্রি। এখন বারোর বদলে দুই পক্ষ থেকেই দশ শতাংশ রাখা হবে। এর মানে কী দাঁড়াল ? কর্মীর হাতে টেক হোম বেড়ে গেল আরো দুই শতাংশ, এবং তা করযোগ্য। অর্থাৎ সরকার এই অঙ্কের টাকা থেকে ট্যাক্স পাবে। মনে করি আমি যদি ত্রিশ শতাংশ ট্যাক্সের আওতায় পড়ি, তবে একশো টাকা আয় হলে যে দু টাকা আমার প্রভিডেন্ট ফান্ডে না জমা পড়ে আমার হাতে এল, তার থেকে সরকার ষাট পয়সা কেটে নেবে। এবং নিয়োজক সংস্থার যেটা কর্মীকে দেওয়ার কথা ছিল সেই টাকা থেকেও দুই শতাংশ কাটা হল, এবং এই দু টাকাও করের আওতায়। অর্থাৎ কর্মীর প্রাপ্য কেটে সংস্থাকে দিয়ে তার থেকে ট্যাক্স আদায় করেও বলা হল এটা নাকি পরিত্রাণ প্যাকেজ।
এইবার আসি টিডিএসের কথায়। টিডিএস মানে ট্যাকস ডিডাক্টেড অ্যাট সোর্স। এটা কমেছে ২৫শতাংশ। স্যালারি ছাড়া আর সব পেমেন্টের জন্য এই ছাড় প্রযোজ্য। অর্থাৎ সার্ভিস চার্জ, কমিশন, রেন্ট ইত্যাদি যে সব পেমেন্ট সংস্থা করে, তাতে পেমেন্টের সময়ই সংস্থা যে কর জমা দেয় তা এখন থেকে ২৫ শতাংশ কম দিতে হবে। এটাও পরিত্রাণ ? বা স্টিমুলাস প্যাকেজ ?
এখানে অপ্রাসঙ্গিক হলেও একটা কথা মনে রাখতে হবে।।যার কর গোড়াতেই কাটা হল, তার সামগ্রিক আয় যদি ট্যাক্সের আওতায় না আসে, তাহলে এই টিডিএসটুকুও সরকার ফেরৎ দিতে বাধ্য।
আর এই কুড়ি লক্ষ কোটি স্টিমুলাস প্যাকেজে ঘোষিত হয়েছে নানাবিধ তারিখ। অর্থাৎ এই সামগ্রিক লক ডাউনের জেরে রিটার্ন জমার তারিখ , ট্যাক্স দেবার তারিখ সবই পিছিয়ে দেওয়া হল। আর সেই সব তারিখ পেছানোর ঘোষণার সময় অর্থমন্ত্রীর নাকের পাটা যেমন উত্তেজনায় থরথর কাঁপছিল, তাতে বোঝাই যাচ্ছিল যে এইসব পিছিয়ে যাওয়া তারিখগুলো পেয়ে ভারতের বাজার বিপুল উৎসাহিত হবে।
এই মহাপরিত্রাণ প্যাকেজে আরো একটা ঘোষণা আছে, সেটা হল পনেরো হাজার টাকা বেতনের কর্মীদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের পুরোটাই সরকার দেবে। তবে আগেও এই ঘোষণা হয়েছিল, তাতে খুদি খুদি করে লেখা ছিল, এই সুবিধা শুধু সেই সব সংস্থার জন্য প্রযোজ্য যাদের অধিকাংশ কর্মীর বেতন পনের হাজারের মধ্যে।
তো যা বলছিলুম, কী পেয়েছি তার হিসেব মেলাতে গিয়ে মনে পড়ে গেল, এই যে চারঘন্টার নোটিসে লকডাউন চালু হওয়ার ফলে ভিনরাজ্যের শ্রমিকদের যৎপরোনাস্তি দুরবস্থা, যার ফলে আবালবৃদ্ধবণিতা রাস্তা ধরে হেঁটে চলেছে, আর হাঁটতে হাঁটতে দলে যাচ্ছে, পিষে যাচ্ছে, মরে যাচ্ছে , এই ত্রাণ প্যাকেজে তাদের জন্য এক কণা দানাপানিও জোটেনি।
এই মহাপরিনির্বাণ প্যাকেজ আসলে গোটা দেশের জন্যই একটা প্রকাণ্ড শূন্য।