পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

ধনীতম এক শতাংশের সম্পত্তির আংশিক পুনর্বন্টন কীভাবে সম্ভব (১)

  • 30 April, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 494 view(s)
  • লিখেছেন : শমীক সরকার
দেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র এক শতাংশ যে অতিধনী আছেন, তাঁদের সম্পত্তির অল্প কিছু অংশ সরকার কর বা অন্যান্য উপায়ে নিয়ে তা কি সাধারণ মানুষের কাজে লাগানো সম্ভব? প্রশ্ন তুলেছেন শমীক সরকার।

সম্প্রতি ভোটের আবহে ভারতে অতিধনীদের সম্পত্তির একাংশের পুনর্বন্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। অনেকদিন ধরেই অনেক অর্থনীতিবিদ এবং গণনাসংস্থা যে কথা বলে চলেছেন— দেশে সম্পদ ক্রমশ আরো বেশি বেশি করে কুক্ষিগত হচ্ছে ধনী এবং অতিধনীদের হাতে। তারা যেমন আরো বড়োলোক হচ্ছে, তেমনি আরো গরীব হচ্ছে বাকি জনতা। যেমন, এই মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে অসমতার তাত্ত্বিক অর্থনীতিবিদ থমাস পিকেটি এবং অন্যান্যরা একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে— অর্থনৈতিকভাবে ধনীতর এক শতাংশ মানুষের হাতে কুক্ষিগত হয়ে আছে দেশের চল্লিশ শতাংশ সম্পদ। এবং এক শতাংশের হাতে প্রতি বছর জমা হচ্ছে দেশের মোট বার্ষিক আয়ের বাইশ শতাংশ।

এপ্রিল মাসের শুরুর দিকে ভোটের প্রচারে গিয়ে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী একটি জনসভায় বলেন, কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে দেশের সম্পদের সমীক্ষা করবে, এবং সম্পদের পুনর্বন্টন করবে তপশিলি জাতি ও উপজাতি, অন্যান্য পিছিয়ে থাকা বর্গ এবং গরীবদের মধ্যে। যদিও কংগ্রেসের নির্বাচনী ইস্তাহারে এর কোনও উল্লেখ নেই। এই কথা বিকৃত করে ২১ এপ্রিল তীব্র সাম্প্রদায়িক আক্রমণ শানান মোদি, রাজস্থানের বংশওয়াড়া-র একটি জনসভায়। দর্শকাসনে উপস্থিত মহিলাদের উদ্দেশ্যে মোদি বলেন, কংগ্রেস আপনাদের মঙ্গলসূত্র, গলার হার খুলে নিয়ে ঘুসপেটিয়া (অনুপ্রবেশকারী) এবং বহু কাচ্চা বাচ্চা হয় যাদের, সেই মুসলমানদের দিয়ে দেবে। এই কথা এরপর উত্তরপ্রদেশের জনসভাতেও পুনরায় বলেন মোদি, কিন্তু তখন মুসলমান শব্দটি শুধু বাদ রাখেন।

আমরা এই প্রবন্ধে মোদির সাম্প্রদায়িকতা বা মিথ্যে ভাষণ নিয়ে কিছু বলতে চাইছি না। সেসব নিয়ে অন্যত্র অনেক কথা বলা হয়েছে, নিন্দার স্রোত বয়ে গেছে। নীরব দর্শক নির্বাচন কমিশনের ভূমিকার সমালোচনা করা হয়েছে। পিটিশন করা হয়েছে। আপাতত আমরা আমাদের দেশে অতিধনীদের বিপুল সম্পত্তির আংশিক পুনর্বন্টন নিয়ে আলোচনা করতে চাইছি, যে ইস্যুটা ভোটের আবহে বিকৃতভাবে হলেও উঁকি দিতে শুরু করেছে।

আমাদের দেশে ধনীদের সম্পত্তির পরিমাণ কত?

পিকেটিদের সমীক্ষা অনুয়ায়ী, ২০২৩ সালের মার্চ মাস অব্দি আমাদের দেশে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ৯২ কোটি ২৩ লক্ষ ৪৪ হাজার ৮৩২। তার মধ্যে সবচেয়ে ধনী ০.০০১ শতাংশ হল অতিধনী। অর্থাৎ, আমাদের দেশে অতিধনী ৯ হাজার ২২৩ জন। কমপক্ষে কত টাকার তুল্য মোট সম্পদের মালিক হলে এই অতিধনীদের মধ্যে আসতে পারা যায়? কমপক্ষে প্রায় ২৭৫ কোটি ৬৭ লক্ষ টাকার তুল্য সম্পত্তির মালিক হলে। ঊর্ধসীমা নেই। এদের মধ্যেও সম্পত্তির পরিমাণের কম বেশী আছে, এই অতিধনীদের গড় সম্পত্তির পরিমাণ ২২৬১ কোটি ৩৪ লক্ষ টাকার মতো। তাহলে এই অতিধনীদের মোট সম্পত্তির পরিমাণ কত? গুণ করলেই পাওয়া যাবে। ২০৮ লক্ষ কোটি টাকার চেয়েও বেশি। [বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে? আচ্ছা, একজনের উদাহরন দিই। আম্বানি আদানিরা তো আছেনই। উদাহরন হচ্ছেন অমিতাভ বচ্চন। নিজের ৩১৬০ কোটি টাকার সম্পত্তি। সম্প্রতি উইল করেছেন, মারা গেলে ছেলে মেয়ে অভিষেক বচ্চন আর শ্বেতা বচ্চন সমানভাবে পাবেন এই সম্পত্তি। প্রায় ১৬০০ কোটি করে একেকজন। অতএব, ওঁরা যদি কপর্দকহীনও থাকেন এখন, বাবা মারা যাবার পর তাঁরা অতিধনী হয়ে যাবেন।]

তর্কের খাতিরে ধরে নিই, বছর বছর এদের আয় কেবল দীর্ঘমেয়াদী আমানতের সুদ (৭%) থেকে। এবং ধরা যাক, আমানতি সুদে আয়ের ওপর এই ট্যাক্স চাপানো হচ্ছে না আপাতত, যেহেতু এটা সম্পদ-কর। তাহলে এদের কাছ থেকে প্রতি বছর যদি এদের সম্পদের অর্ধেক (৫০% বা ০.৫) সরকার নিয়ে নেয় তাহলে কী দাঁড়াবে? এদের মধ্যে সবচেয়ে কম ধনী যে, অর্থাৎ যার সম্পদের পরিমাণ প্রায় ২৭৫ কোটি ৬৭ লক্ষ টাকা, তার সম্পত্তির পরিমাণ পাঁচ বছর পরে দাঁড়াবে ২৭ কোটি ৩১ লক্ষ টাকার মতো। অর্থাৎ, সে তখনও বেশ ধনী। আর শুধু তার কাছ থেকেই সরকার পাঁচ বছরে এভাবে আদায় করবে ২৬৭ কোটি টাকা।

তাহলে এই ৯ হাজার ২২৩ জন অতিধনীদের সবার কাছ থেকে মোট কত আয় করবে? ২০১.৫ লক্ষ কোটি টাকার মতো। প্রথম বছরে ১০৪ লক্ষ কোটি, তার পরের বছরে ৫২ লক্ষ কোটি, তার পরের বছরে ২৬ লক্ষ কোটি, তার পরের বছরে ১৩ লক্ষ কোটি, তার পরের বছরে সাড়ে ৬ লক্ষ কোটি টাকা। মোট সুদ যোগ করলে অতিধনীদের (অর্থাৎ, প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার ধনীতর ০.০০১%) কাছ থেকে পাঁচ বছরে আদায় হওয়া টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ২২০ লক্ষ কোটি টাকার মতো। পাঁচ বছরে ২০১.৫ লক্ষ কোটি আদায়, ১৮.৫ লক্ষ কোটি তার সুদ। অর্থাৎ, পাঁচ বছরে মোটমাট ৯% সুদ।

এরপর আসছে যারা ভীষণ-ধনী (অর্থাৎ, প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার ধনীতর ০.০১%) কিন্তু অতিধনী নয়। ধরা যাক, তাদের সম্পত্তির সিকিভাগ (২৫% বা ০.২৫) করে বছরে সম্পদ-কর হিসেবে নেওয়া হল; এবং, যারা বেশ-ধনী (অর্থাৎ, প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার ধনীতর ০.১ শতাংশ) কিন্তু ভীষণ-ধনী কিংবা অতিধনী নয়, তাদের সম্পত্তির দশ ভাগের এক ভাগ (১০% বা ০.১) করে বছরে আদায় করল সরকার। তাহলে সরকারের হাতে পাঁচ বছরে কত ফান্ড জমা হয়?

পিকেটিদের রিপোর্ট অনুসারে, আমাদের দেশে ভীষণ-ধনীর সংখ্যা ৯২, ২৩৪ – ৯, ২২৩ = ৮৩, ০১১ জন। এবং কমপক্ষে ৩৬ কোটি ৮৭ লক্ষ টাকার তুল্য পরিমাণ সম্পত্তি থাকলে, কিন্তু তা আবার ২৭৫ কোটি ৬৭ লক্ষ টাকার কম হতে হবে, তবে সে ভীষণ-ধনীর তালিকায় ঢুকবে। [উদাহরন, ভারতীয় ক্রিকেট দলের বর্তমান অধিনায়ক রোহিত শর্মা, যার সম্পত্তির পরিমাণ ২১৬ কোটি টাকা]। পিকেটিদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে হিসেব করলে পাওয়া যায়, এদের সম্পত্তির মোট পরিমাণ ৯২,২৩৪৩০০ কোটি – ৯,২২৩২,২৬১ কোটি = ৬৮ লক্ষ কোটি টাকার মতো। এদের থেকে যদি বছরে পঁচিশ শতাংশ মতো সম্পত্তি-কর সরকার আদায় করে, তাহলে পাঁচ বছরে মোট আদায় হবে ৫২ লক্ষ কোটি টাকার মতো। পাঁচ বছরে এর সুদের পরিমাণ দাঁড়াবে (আগের হিসেব মতো পাঁচ বছরে মোটমাট সুদ ৯% ধরলে) ৪.৭ লক্ষ কোটি টাকা। অর্থাৎ ভীষণ-ধনীদের থেকে সরকারের পাঁচ বছরে মোট আয় হবে ৫৬.৭ লক্ষ কোটি টাকা।

একইভাবে বেশ-ধনীদের থেকে প্রতি বছর সম্পত্তির দশ শতাংশ করে আদায় করলে সরকারের পাঁচ বছরে কত আয় হবে? পিকেটির রিপোর্ট অনুসারে, আমাদের দেশে বেশ-ধনীর সংখ্যা ৯,২২,৩৪৫–৯২,২৩৪=৮ লক্ষ ৩০ হাজার ১১১ জন। এবং, এদের সম্পত্তি সওয়া পাঁচ কোটি টাকার ওপরে কিন্তু ৩৬ কোটি ৮৭ লক্ষ টাকার নিচে। [উদাহরন, প্রায় সওয়া ন’ কোটি টাকার সম্পত্তি থাকা প্রাক্তন ক্রিকেটার অশোক দিন্দা]। পিকেটিদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে হিসেব করলে দেখা যায়, এই বেশ-ধনীদের মোট সম্পত্তির পরিমাণ ৯,২২,৩৪৫৪০ কোটি–৯২,২৩৪৩০০ কোটি=৯৩ লক্ষ কোটি টাকার মতো। এদের থেকে যদি বছরে দশ শতাংশ মতো সম্পত্তি সরকার আদায় করতে থাকে, তাহলে পাঁচ বছরে মোট আদায় হবে ৩৮ লক্ষ কোটি টাকার মতো। পাঁচ বছরে এর সুদের পরিমাণ দাঁড়াবে (আগের হিসেব মতো পাঁচ বছরে মোটমাট সুদ ৯% ধরলে) ৩.৪ লক্ষ কোটি টাকার মতো। অর্থাৎ, বেশ-ধনীদের থেকে সরকারের মোট আয় হবে পাঁচ বছরে ৪১.৪ লক্ষ কোটি টাকার মতো।

অর্থাৎ, অতিধনী (দেশের প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার ধনীতম ০.০০১ শতাংশ ব্যক্তি), ভীষণ-ধনী (দেশের প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার ধনীতর ০.০১ শতাংশ ব্যক্তি কিন্তু যারা আবার অতিধনী নয়), এবং বেশ-ধনী (দেশের প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার ধনীতর ০.১ শতাংশ ব্যক্তি কিন্তু যারা আবার ভীষণ-ধনী বা অতিধনী নয়) — এদের কাছ থেকে যথাক্রমে সম্পত্তির অর্ধেক, সিকিভাগ এবং দশভাগের এক ভাগ প্রতি বছর আদায় করলে পাঁচ বছরে সরকারের হাতে আসে খরচযোগ্য ২২০ ৫৬.৭ ৪১.৪ = ৩১৮ লক্ষ কোটি টাকার মতো।

প্রসঙ্গত, আমাদের দেশের বার্ষিক বাজেট প্রায় ৪৫ লক্ষ কোটি টাকার মতো। পাঁচ বছরের বাজেট ২২৫ লক্ষ কোটি টাকা।

 

 

 

0 Comments

Post Comment