রসুল(সাঃ) যখন মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় গেলেন তখন দেখলেন যে মদিনাবাসী বছরের দুটি দিনে আনন্দ উৎসব করে থাকেন। দিবস দুটি জাহেলি যুগ থেকে চলে আসছিল। রসুল জিজ্ঞাসা করলেন, এই দিবস দুটি কী কী? মদিনাবাসীগণ জানালেন দিবস দুটি হল ‘নওরোজ’ আর ‘মিহিরজান’। শরতের পূর্ণিমাতে পালিত হয় ‘নওরোজ’ আর বসন্তের পূর্ণিমাতে পালিত হয় ‘মিহিরজান’ উৎসব। তখন নবী মুহাম্মদ(সাঃ) বললেন যে, আল্লাহ তোমাদের এই দিবস দুটির পরিবর্তে খুবই ভালো দুটি দিবস উপহার দিয়েছেন। তা হল ‘ইদ-উল-ফিতর’ আর ‘ইদ-উল-আযহা’।(মুসনাদে আহমদ ১৩০৫৮)। এভাবে মুসলমানদের পৃথক উৎসবের সূচনা হল। এটি ছিল দ্বিতীয় হিজরি অর্থাৎ ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দের ঘটনা। রসুল(সাঃ) বলেছেন, রোজাদারের জন্য দুটি আনন্দক্ষণ রয়েছে, ইফতারের সময় সে আনন্দিত হয়, রবের(আল্লাহ) সঙ্গে দেখা করার সময় আবার সে আনন্দিত হবে।(বুখারি হাদিস নম্বর- ৭৪৯২)। আবার আকাশে ‘ইদ’এর দিনকে বলা হয় ‘পুরস্কারের দিন’। ইদ-উল-ফিতরের একটি ‘ওয়াজিব’ আমল হল ‘সালাতুল ইদ’ বা ‘ইদের নামাজ’। ইদের উৎসব শুরু হয় এই সালাতের মাধ্যমে। ইদের দিন প্রথম প্রহরে ইদগাহে ধনী-দরিদ্র-আমির-ফকির নির্বিশেষে সকল মুসলমান এক কাতারে দাঁড়ান। একসঙ্গে ঈশ্বরের পবিত্রতা ও মহত্ব ঘোষণা করেন। পরস্পরের খোঁজ-খবর নেন ও কুশল বিনিময় করেন। ইসলামে মুসলমানদের এই সম্মিলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইদের নামাজ পড়ার পর একজন ফিরিশতা ঘোষণা দেন, “শোন নামাজ আদায়কারীরা! তোমাদের মহান রাব্বুল আলামিন মাফ করে দিয়েছেন, সকল গুনাহ(পাপ) থেকে মুক্ত অবস্থায় নিজ নিজ আবাসে ফিরে যাও। আজ পুরস্কার প্রদানের দিন।“(আল মুজাবুল কাবির লিত তাবারানি ৬১৭,৬১৮)।
‘ইদ’ শব্দটি এসেছে আরবি ‘আওদ’ শব্দ থেকে। ‘আওদ’ অর্থ ঘুরে আসা বা প্রত্যাবর্তন করা। সুতরাং ইদ কথার আভিধানিক অর্থ হল পুনরাগমন বা বারবার ফিরে আসা। আবার ‘ইদ’এর সামাজিক অর্থ হল উৎসব। ‘ফিতর’ কথাটি এসেছে আরবি ‘ফিতরা’ শব্দ থেকে। ‘ফিতরা’ বা ‘ফেতরা’ ইসলামে ‘যাকাতুল ফিতর’(ফিতরের যাকাত) বা সদকাতুল ফিতর(ফিতরের সদকা) নামে পরিচিত। ‘ফিতর’ শব্দের অর্থ রোজা ভাঙা বা ইফতার করা। আর তাই ইসলামি পরিভাষায় ইদ-উল-ফিতর হল রোজা ভাঙার উৎসব। ‘যাকাতুল ফিতর’ হল ইদ-উল-ফিতর উপলক্ষে গরিব দুঃস্থ ফকির মিসকিনদের মাঝে বিতরণ করা দান। এটি ইদের একটি আবশ্যিক আমল। এটি ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দান কর্ম যা তাদেরকে অনেকখানি ‘সওয়াব’(পুণ্য) পেতে সাহায্য করে। ইদ উদযাপন সার্বজনীন করে তুলতে ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবার মধ্যে ইদের আনন্দ ছড়িয়ে দিতেই ‘সদকাতুল ফিতর’এর বিধান এসেছে। ইসলামে আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করা ‘ফরজ’।
ইদ মানেই খুশির পরব। আনন্দে মেতে ওঠা। এ প্রসঙ্গে একটি হাদিসের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে, আয়েশা(রাঃ) বলেন, এক ইদের দিন হযরত আবু বকর(রাঃ) আমার ঘরে এলেন। সেখানে তখন দু’জন মেয়ে বুআস যুদ্ধের গান গাইছিল। হযরত আবু বকর(রাঃ) ওই মেয়ে দুটোকে শক্ত ধমক দিয়ে বললেন, শয়তানি বাদ্য! তাও রসুলের ঘরে! বন্ধ করো। রসুল(সাঃ) বললেন, আবু বকর, ওদের ছেড়ে দাও। প্রতিটি জাতিরই ইদ ও খুশির দিন থাকে। আজ আমাদের ইদের দিন।“(সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর- ৯৫২)।
পবিত্র রমজান মাসের শেষ সন্ধ্যায় যখন পশ্চিম আকাশে বাঁকা ধানের শিষের মতো ইদের চাঁদ দেখতাম তখন সারা বছরের আনন্দটা এক সন্ধ্যাতেই ধেই করে উঠত। তখন আমাদের ধুলো মাখার বয়স। শখ করে কিম্বা ‘ভোরে ভাত খেয়েছি আর রোজা ভাঙা যাবে না’ ভয়ে একটা দুটো রোজা রাখার সময়। তারপর যখন শরীরে যৌবন এল। হাফ-প্যান্ট ছেড়ে লুঙ্গি পরতে শুরু করলাম, বাবা-মায়েরা বললেন, এবার রোজা রাখতেই হবে। তখন জানতাম না, রোজা রাখার ফজিলত কী, মহান আল্লাহ কী জন্য মানুষের ওপর রোজা নাজিল করেছেন। মা বলেছিলেন, এসব পরকালের ইবাদত বাপ। দোজখ-বেহেস্ত তো পরকালেই? মানুষ সেই অনন্তকালের বিশ্বাস থেকেই টানা একমাস উপবাস করেন।
ইদের আনন্দ শুরু হয়ে যায় সাতাশের রাত অর্থাৎ শবেকদরের রাত থেকেই। শবেকদরের রাতের ইবাদত রোজদারকে আরও পবিত্র করে তোলে। আরও পরিশুদ্ধ হয় মানুষ। পরকালের দোজখ থেকে মুক্তির দোয়া করে। সে বেহেস্ত পেতে চায়। পেতে চায় কবরের আযাব থেকে মুক্তি। এই পবিত্র রাতেই যে মহান আল্লাহ কোরআন অবতীর্ণ করেছিলেন দুনিয়ায়! তবে শাস্ত্রে শবেকদরের রাত সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন, তোমরা রমজানের শেষ দশ রাতের বিজোড় রাতে শবেকদরকে খোঁজো। মানুষ সেই পবিত্র রাত খোঁজার ইবাদত-বন্দেগিতে মত্ত থাকে। ইদের আনন্দ শবেকদরের রাত থেকে শুরু হলেও সে আনন্দ চরম আকার নেয় চাঁদরাতে। এ রাত মেহেদি রাঙানোর রাত। এ কুটুম ও কুটুমের বাড়ি যায় হাতে মেহেদি দিতে। মেহেদি দিতে যাদের হাত পটু তাদের তো চাঁদরাতে বিশাল ডিমান্ড। রাত গড়িয়ে পড়ে তবুও মেহেদি দেওয়া ফুরোয় না! কেউ হাতে চাঁদ আঁকে তো কেউ আঁকে চাঁদ-তারা। কেউ আবার কাবাও আঁকে। কারও হাতে মিনার-গম্বুজ। এই সুযোগে কেউ কেউ তার গোপন প্রেমিকের আদ্যক্ষরও লেখে মেহেদি দিয়ে। আর ফুল-নকশার কারিকুরি তো থাকেই। মেয়েদের সে মেহেদি রাঙা হাত ইদের দিন আত্মীয়ের বাড়ি বাড়ি ঘোরে। নতুন ঝলমলে পোশাক আর মেহেদি রাঙা হাতে তারা কেউ ফুটন্ত ফুল কেউ বেহেস্তের হুর হয়ে ওঠে! বন্ধু বন্ধুর বাড়ি যায় সিমাই-পায়েস খেতে। এখন তো আবার বিরিয়ানির চল এসেছে। সেসব খাবারের সুগন্ধে ম ম করে বাড়ি।
ইদ সামাজিক বন্ধনকে দৃঢ় করে। আমরা যারা নানান ধর্মের মানুষ এক গ্রামে কিম্বা এক এলাকায় থাকি তাদের মধ্যে ইদের আনন্দ ভাগ হয়ে গিয়ে আনন্দ আরও বেড়ে যায়। রামুমুচির বছরের সবচেয়ে বেশি ব্যস্ততা হয় ইদের আগের কটাদিন। হরেন দর্জির তো ক-দিন ঘুম থাকে না চোখে। রাত-দিন এক করে ঘর্ঘর ঘর্ঘর করে নতুন জামা-প্যান্ট বানান। এই হরেনকাকু প্রত্যেক ইদে আমাদের বাড়িতে দাওয়াত পান। দাওয়াত পান রামুমুচি আর শ্যামল ঘোষ। শ্যামল ঘোষ হলেন আমাদের গ্রামের দুধওয়ালা। ইদের আগের দিন আর ইদের দিন তার ব্যস্ততাও হয় চরম। কোন গেরস্তকে দই দিতে হবে কোন গেরস্তকে দুধ দিতে হবে, কার বাড়িতে ছানা পৌঁছে দিতে হবে, একেবারে চরকির মতো ঘোরেন শ্যামল ঘোষ। আর সে কাজের ব্যস্ততার মাঝেই টুক করে কোনও গেরস্তর বাড়ি সিমাই-লাচ্চা খেয়ে নেন। আর যোগমায়া মিস্টান্ন ভান্ডারের সুখেন রানুকে তো তিন দিন তিন রাত ছানায় পড়ে থাকতে হয়। ছানায় খাওয়া ছানায় শোওয়া। কত দই-মিস্টির জোগান দিতে হবে তাকে! পাশের গ্রামের নিখিল মণ্ডল ইদের দিন আমাদের বাড়িতে আসেন মায়ের হাতে বানানো আতপ চালের রুটি খেতে। এই নিখিল কাকু দুর্গাপুজোর সময় আমাদের বাড়িতে এক ধামা খই-মুড়কি আর নারকেলের নাড়ু দিয়ে যান। লক্ষ্মীপুজোয় আমরা তাঁদের বাড়িতে নেমতন্ন খেতে যাই। আর ইদে বাবাকে দেওয়া নিখিলকাকুর লুঙ্গি-পাঞ্জাবি আর দুর্গাপুজোয় নিখিলকাকুকে বাবার ধুতি-পাঞ্জাবি দেওয়াটা তো একটা রেওয়াজে পরিণত হয়ে গেছে। ইদের দিনের সন্ধ্যায় হিন্দু বন্ধুদের সঙ্গে কিম্বা কর্মক্ষেত্রে হিন্দু সহকর্মীদের সঙ্গে যখন ইদের কোলাকুলিটা করি তখনই ‘ইদ’ যথার্থ ‘উৎসব’ হয়ে ওঠে। আমাদের মসজিদের আজান আর নিখিলকাকুর মায়ের মুখের শংখধ্বনি মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। সেই সুরে মেতে ওঠে সুন্দরী বিলে বেড়ে ওঠা ভাঁট-শালুক। শৈশবে আমরা বছরের তিনটে দিনের জন্য মুখিয়ে থাকতাম, রোজার ইদ, কুরবানির ইদ আর দুর্গাপুজো। যে বছর ইদ আর দুর্গাপুজো প্রায় একই সময়ে হয়েছিল, সে বছরের সূর্য আর চাঁদকে মানুষেরা নাকি ঠাট্টা করে বলেছিলেন, এবছর চাঁদ-সূর্যের পিরিত কাঁঠালের আঠার মতো। সে সুন্দর মুহূর্ত অবশ্য এখনও অনেকের জীবনেই আসেনি। আসুক, বেশি বেশি করে মর্তে নেমে আসুক সে পিরিত। আমাদের কাছ থেকে যে পড়শি দূরে চলে গেছেন তারা আবারও কাছে ফিরে আসুন। মননের সে দূর ঘুঁচে যাক। মানুষের মানুষের পিরিত পরব হয়ে উঠুক। প্রেমের চেয়ে বড় পরব আর কী বা আছে দুনিয়ায়?