ছেলেটির নাম খ্যাঁদা - খ্যাঁদা চক্রবর্তী। বাপ ফড়িং চক্রবর্তী। নামেই প্রকাশ তাদের সামাজিক অবস্থান কেমন হতে পারে।হাড় হাভাতে গরীব। আয় বলতে কয়েকঘর নিত্যপুজো।ইস্কুলে ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাবার সময় মাষ্টার মশাইরা
এমনিই খ্যাঁদার কান দুটো মূলে দিয়ে যেতেন – এমনই গোবেচারা ছিল সে।
প্রায় সাড়ে তিন দশক আগের কথা। অকুস্থল এই বাংলার বঁকুড়া জেলার প্রত্যন্ত ইন্দাস থানা এলাকার এক অনামী গ্রাম। নামটা প্রাসঙ্গিক নয়।
১৯৭৭ এ বাম জমানার আগমন খ্যাঁদার জীবনে আমূল পরিবর্তন এনেছিল। একদিন দেখা গেল ভরা বাজারের মাঝে খ্যাঁদা তাবড় বলশালী কংগ্রেসী দাদাদের চড় থাপ্পড় মারছে। আর তারাও চুপচাপ মার খেয়ে নিচ্ছে – বাদানুবাদ ছাড়াই। পালাবদলের মহিমা। খ্যাঁদার এই রোয়াবের পেছনে ছিল পাশাপাশি তিন টে গ্রামের বাগদি পাড়াগুলোর সি পি এম হয়ে যাওয়া। সেতাবৎ কংগ্রেসী জামানায় দমিত-অত্যাচারিত এই পাড়াগুলোর রাতারাতি সি পি এম হয়ে যাওয়া যেন ছিল ইতিহাসের অতি এক স্বাভাবিক পরিণতি।বাম সরকার জতদিন ছিল, এই শিডিউল পাড়াগুলো ছিল তাদের পাওয়ার হাউস।
পরের ৩৪ বছরের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত। খ্যাঁদার মধ্যপ্রদেশ বেড়েছে। ১৭ লক্ষ টাকা খরচ করে সে ছেলের বিয়ে দিয়েছে। আরও কয়েক লক্ষ টাকা খরচ করে এখন সে একটা বড় পাড়বাঁধানো পুকুরেরও মালিক। অবশ্য নিত্যপূজোটি সে এখনও ধরে রেখেছে। হাজার হোক জাতব্যবসা যে।
২০১১ য় রাজনীতির পটপরিবর্তনের পর খ্যাঁদার ওপর ঝরঝাপটা বা অত্যাচার তেমন কিছু হয় নি। তবে বাগদি পাড়াগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ কমেছে – কারণ পার্টিগত সক্রিয়তা কমেছে।খ্যাঁদা আর কি করে, ওপরতলার নেতারাই যে বলছে আপাতত চুপচাপ থাকতে। অবশ্য ঝামেলা একবার হতেই যাচ্ছিলো – গত পঞ্চায়েত ভোটের প্রাক্কালে খ্যাঁদা তখন তক্কে তক্কে কিছুটা বিজেপি র দিকে কিছুটা ঘেঁষতে শুরু করেছিল। পয়দা কামানোয় আকণ্ঠ ডুবে থাকা টি এম সি নেতারা চেগে উঠে হাজির হয়েছিল খ্যাঁদার বাড়ী। কিছু অর্ধচন্দ্র, কিছুটা বাড়ী ছাড়ার হুমকি – খ্যাঁদা তাতেই ঠাণ্ডা। অবশ্য বিজেপির দিকে ঝুঁকে পড়ার শাস্তি হিসেবে এবার তার জাতব্যবসায় পড়লো কোপ। খ্যাঁদা যে বাড়িগুলোতে পূজো করতো, টি এম সি র ফতোয়ার কারণে তারা বাধ্য হল, অন্য বামুন, কার্তিক চক্রবর্তীকে রাখতে। সেও অবশ্য টি এম সি-র হুকুমেই।এমনই নানা কারণে টি এম সি যখন পঞ্চায়েত ভোটের সময় বিরোধী দের ভোটকেন্দ্রের দিকে ঘেঁষতে দিচ্ছিলো না, তখন তেমন প্রতিবাদ দানা বাঁধতে পারে নি। পাওয়ার হাউসগুলো ছিল নেতার অভাবে স্তিমিত।
ইতোমধ্যে পরিস্থিতিরও পরিবর্তন হয়েছে। এসেছে নতুন প্রজন্ম – যাদের কাছে সি পি এম কোন শোষণ–মুক্তির দল নয়, যা হয়ত বা পূর্বজদের চেতনায় থেকে থাকবে।নব প্রজন্ম সি পি এম কে দেখেছে অন্য যে কোন দলের মতোই দেওয়া-থোয়ার দল হিসেবেই। নতুন শক্তি বিজেপিও হাজির নতুন দেওয়া – থোয়ার কথা নিয়ে। ঐ পাড়াগুলোতে লাগতে শুরু করেছে গেরুয়া পতাকা। এবারের ভোটে ঐ পাড়াগুলো থেকেই গেরুয়া পতাকাবাহী মোটর সাইকেল বাহিনী বেরিয়েছিল ভোট-এর দিন। খ্যাঁদাকে অবশ্য খুব একটা দেখা যায় নি। দেখা গেল ফল বেরোনোর দিন। সারা দেশে জয় শ্রীরাম ধ্বনিতে উদ্দীপ্ত খ্যাঁদা পাল্টা ফতোয়া দিয়েছে কার্তিককে – তাকে খ্যাঁদার নিত্যপূজোর জমি ছেড়ে চলে যেতে হবে।
ওপরতলার কথা কমই জানি। কিন্তু গ্রামবাংলায় বিজেপি - টিএমসি দ্বন্দ্ব সমাসটি নিত্যপূজো কার হাতে থাকবে এমত জরুরি প্রশ্ন ঘিরেই আবর্তিত। সি পি এম এখানে নিতান্তই ছাগলের তিন তৃতীয় সন্তান। কালের কি পরিহাস।
জণগন হতভম্ব, আর খ্যাঁদা দোটানায় – এবার সে কোন দিকে যায় – সম্প্রতি সর্বহারাত্ব-প্রাপ্ত সিপিএমে নাকি মনুবাদী বিজেপির দিকে?
বাগদি পাড়াগুলো তে তেমন দোটানা নেই। তারা আপাততঃ গেরুয়ার দিকেই। সিপিএম বা অন্য কোন বাম যদি এই পাড়াগুলোকে চিরন্তন সিপিএমের পাওয়ার হাউস ভেবে বসে থাকে, যারা নাকি পরিস্থিতি একটু সহায়ক হলে স্বভাবতঃই বামে মোড় নেবে – তাহলে সেটা মুর্খেরই স্বর্গ। কেউ কেউ অবশ্য এমনি কোন আশাতেই তথাকথিত রাজনীতির ঘুটি সাজাতে ব্যস্ত। এঁদেরকে করুণা ছাড়া আর কিই বা করা যায়?
0 Comments
Post Comment