বিশ্ব হেরিটেজের সম্মান পেল দুর্গাপুজো। সন্দেহ নেই, ইউনেস্কোর 'ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অফ হিউম্যানিটি'-র তালিকায় ওঠার এই খবরে আপামর বাঙালি সমাজই খুশি। কলকাতার দুর্গাপুজো, বাগবাজার-শোভাবাজার-আহিরিটোলা, বিবেকানন্দ রোডের শতাধিক বছরের প্রাচীন বারোয়ারি পুজোগুলো এখনও তাদের সাবেকিয়ানা অনেকটাই ধরে রেখেছে। কলকাতার 'বনেদি বাড়ি'-র পুজোগুলোর মধ্য সবচেয়ে প্রাচীন বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের বাড়ির পুজো, দ্বিতীয় পুজোটি ক্লাইভের মুন্সি থেকে 'রাজা' হয়ে যাওয়া শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজোটি। ছুঁচো শীল, নবো মুনসি, ছিঁড়ি বেনেদের মৌজ-মস্তি-মচ্ছবের আরও অনেক 'বনেদি পুজো' ছিল কলকাতায়। তার অনেকগুলোই নমঃ নমঃ করে হলেও উত্তর পুরুষরা ধরে রেখেছেন। কলকাতার পুজো আর মচ্ছব হাত ধরাধরি করে দীর্ঘকাল ধরেই চলে এসেছে। দুর্গাপুজোর ভাসান নিয়ে বাগবাজার-শোভাবাজারের রেষারেষি থেকে সোর্ড, নেপালা, সোডার বোতলের লড়াই প্রায় ফি-বছরের গল্প ছিল। তেমনি কালীপুজোয় সোমেন মিত্তির ও ফাটা কেস্টের রেষারেষিও আর এক পুজো-কিংবদন্তী।
পাড়ায়-পাড়ায় পুজোয় এই বাড়াবাড়ি রকমের বারো ইয়ারির মচ্ছবের ফোয়ারার পরিবর্তন ঘটতে থাকে আটের দশকের প্রথম দিক থেকে। কলকাতা পুলিশ ও কলকাতা করপোরেশনের হাত ধরে। পুজোয় আইনকানুন, শৃঙ্খলা রক্ষা করা, উৎসবকে রুচিশীল করে তোলা, ডানলপ কোম্পানির সহযোগিতায় পুজো-ম্যাপ তৈরির মধ্য দিয়ে তার শুরুয়াত। সরকার ছিল, পাড়ায় পাড়ায় তৎকালীন বামপন্থী নেতা-কর্মীরাও পুজো সংগঠিত করতে যোগ দিল। তবে, প্রথমদিকে তা ছিল নিচু স্কেলে। এই পরিবর্তনেকে জোর ধাক্কা দিয়ে এক সাংস্কৃতিক উড়ান এল করপোরেটের হাত ধরে। এশিয়ান পেন্টস শারদ সম্মান পুজো কর্তাদের ভাবনাটাকেই বদলে দিল। বদলে যেতে থাকল পুজোর আঙিনা। এশিয়ান পেন্টস-এর একটি চমৎকার শ্লোগান ছিল 'শুদ্ধ শুচি ও সুস্থ রুচি'। সালটি ১৯৮৫। পুজো মণ্ডপে ফিরে এল বাংলা গান, বিশেষ বিশেষ পল্লিতে বাজল সানাই, সরোদ। উৎকট জগঝম্প ও লারেলাপ্পা ছেড়ে বাংলার পুজো বাংলা সংস্কৃতির দিকে মুখ ফেরাল। এর পিছনে বাম ও ভিন্নমতের সাংস্কৃতিক কর্মীদের প্রত্যক্ষ যোগ ছিল।
একটি পুরস্কারও এ সময় চালু হয়েছিল। সেটি হল 'শিরোমণি পুরস্কার'। স্ব স্ব ক্ষেত্রে পণ্ডিত, উস্তাদদের সম্মান জানানো শুরু হয়। প্রথম এই পুরস্কারে সম্মানিত হন উস্তাদ বিসমিল্লা খান। এর পর একে একে সম্মান জানান হল, বিকাশ ভট্টাচার্য, গনেশ হালুইদের মতো শিল্পীদের। আবার এঁরাই চললেন বিভিন্ন পুজোয় 'শারদ সম্মান'-এর বিচারক হয়ে। পাড়ায় পাড়ায় সারা পড়ল। পুজোর উদ্যোক্তারা ভাল কিছু, শৈল্পিক, অভিনব কিছু করার জন্য উৎসাহিত হলেন। তাঁরা যুক্ত করতে থাকলেন আর্ট কলেজগুলির ।
পুজো আঙিনায় তৈরি হল পুকুর-মরাই-সব্জি বাগান মাখা গ্রাম। মুক্তেশ্বর মন্দির কিংবা সাঁচী স্তূপের প্রায় নিঁখুত রেপ্লিকা গড়ে চমকে দিলেন দীপক ঘোষ। অমর সরকার, ভবতোষ সুতাররা গ্রাম ছেনে তুলে আনলেন পট, গালা, নাগা শিল্প। যোগ দিলেন কারিগররাও। সুবোধ রায় ছত্তিশগড়ের বস্তারের ধাতু শিল্প ডোকরা হাজির করলেন নাগরিক পল্লির অন্দরে। বিহারের মধুবনী আসছে। কোচবিহার, আসামের শীতলপাটি, মেদিনীপুরের মাদুর, বাঁকুরার টেরাকোটা, শান্তিপুর, ধনেখালির তাঁতের কাপড় আসছে। লোকশিল্প দিয়ে সেজে উঠছে পুজা প্রাঙ্গন। বিস্মিত হচ্ছে কলকাতা, বহির্কলকাতা। শুরু হল বছরভর গবেষণা। পৃথিবীর যে প্রান্তের যত মণিমাণিক্য আছে—আমেরিকার কিংবা আফ্রিকা মহাদেশে, সিন্ধু সভ্যতায়—তার ছোঁয়া লাগল বাংলার পুজোয়। ভীমবেটকার গুহাচিত্র থেকে চৌষট্টি যোগিনী—দুর্গাপুজোয় সাজসজ্জায়, শিল্পীর পাশাপাশি কারিগরদের হাতযশে, পুজো উদ্যোক্তাদের উৎসাহদানে সেদিন জন্ম নিচ্ছিল 'ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ'-এর ভ্রুণ। এরও আগে, অবশ্যই আমাদের মনে রাখতে হবে, বকুলবাগান সর্বজনীন দুর্গাপুজোয় দুর্গা গড়ছেন নীরদ মজুমদার, বিকাশ ভট্টাচার্য, পরিতোষ সেনদের মতো চিত্রশিল্পী; মীরা মুখোপাধ্যায়, উমা সিদ্ধান্তদের মতো ভাস্কররা। এই প্রথিতযশা কিংবদন্তী শিল্পীদের হাত ধরে আদি বারোয়ারি দুর্গা, কুমোরটুলির দুর্গা 'আর্টের জগতে স্থান পেল'। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর ভাষায় : "পুঁথিকার দেবতা—সমস্তের ধ্যান দিল শিল্পে, সেই ধ্যান মতো গড়ে চলল—এই ঘটাই যদি পুরোপুরি ঘটতো তবে আমাদের আর্ট কেবলমাত্র ধ্যানমালার ইলাস্ট্রেশন হয়ে যেত। কিন্তু এর চেয়ে বড় জিনিস হয়ে উঠল বুদ্ধ নটরাজ প্রভৃতি নানা দেবমূর্তি সেটা ধ্যানমালার লিখিত ধ্যানের অতিরিক্ত...শুধু শিল্পের শিল্পক্রিয়া তাদের অমরত্ব দিল বলে এবং শুধু সেইটুকুর জন্য আর্টের জগতে এই সব দেবতার স্থান হল।" —অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাগেশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলী।
কুমোরটুলি ও ডেকরেটর সংস্কৃতিকে বদলে দিয়ে কলকাতার পুজো হয়ে উঠল, খোলা আকাশের নীচে পুজো আঙিনায় স্থাপনশিল্প বা ইনস্টলেশন আর্টের এক শহর জোড়া আর্ট গ্যালারি। এমনটা, ধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষ শিল্পের উৎসব সারা পৃথিবীতে কোথাও নেই। এই 'মিথস্ক্রিয় স্থান-নির্দিষ্ট স্থাপনা শিল্প', বাঁশ-বাটাম-দড়ি-কাপড়ের একবগগা ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসার এই প্রচেষ্টা; যেখানে পুজো কর্তারা শিল্পীর হাতে আর্থিক রসদ তুলে দিয়ে বলছেন, 'কিছু একটা গড়ো'। আর শিল্পী তাঁর সমস্ত মেধা, মনন, হাড়ভাঙা খাটুনি দিয়ে গড়ে তুলছেন এক শিল্পকীর্তি। মিলানবাসী শিল্পী সফিকুল কবির চন্দনের ভাষায়, "এ হল স্থাপনাশিল্পের গণতন্ত্রীকরণ। সর্বজনীন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নন্দনতত্ত্ব। ইতিহাসবেত্তা, আর্ট হিস্টরিয়ান অধ্যাপক তপতী গুহঠাকুরতার মতে, " নিজস্ব অধিকারেই এ পাবলিক আর্ট।" শিল্পী সমাজ আর সাধারণ দর্শক সমাজের সঙ্গে একটা ভাবের আদান-প্রদান ঘটছে পুজোর আঙিনায়। তাঁদের কেউ শিল্প দীক্ষিত, কেউ বা সীমিত শিক্ষার অধিকারী, কারও তেমন করে চোখ ফোটেনি। তবু, এই জানা না-জানা প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াচ্ছে না উপভোগের। দুর্গাপুজোর এই হেরিটেজ সম্মান পাওয়ার পিছনে তপতীদেবীর এক বড় ভূমিকা রয়েছে। কেন হেরিটেজ স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য কলকাতার দুর্গাপুজো তা তিনি এবং শিল্পীগোষ্ঠী ইউনেস্কোকে বোঝাতে পেরেছেন। এবং এও এক আধ-বছরের প্রচেষ্টা নয়।
হেরিটেজ স্বীকৃতির পর কলকাতার পথে ইউনেস্কোকে ধন্যবাদ জানানোর সাংস্কৃতিক মিছিলে মুখ্যমন্ত্রীর মুখ শোভিত ব্যানার দেখে কিংবা কর্তাদের বক্তব্য শুনে মনে হয় , কলকাতার দুর্গাপুজোর বয়স যেন এই দশ বছর। আর এই স্বীকৃতি প্রাপ্তির জন্য যাবতীয় প্রশংসা একমাত্র মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-এরই প্রাপ্য। ইতিহাসকে বিকৃত করা শাসকের ধর্ম। ইউনেস্কোকে ধন্যবাদ জানানোর বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক মিছিল তাই ভরে ওঠে স্তাবকবৃন্দে কিংবা ভাড়াটে বাজনাদারে। এক একক ব্যক্তির স্তুতিগাথায় শুরু ও শেষ হয় মিছিল। নামকাওয়াস্তে এক ব্যানার উড়তে দেখা যায় কলকাতার এক অন্যতম বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্রে। যেখানে রোমান হরফে ইংরেজি ভাষায় লেখা ''Thank You"! বাংলাভাষা যে রাষ্ট্রপুঞ্জে এক স্বীকৃত আন্তর্জাতিক ভাষা; এই দুর্গাপুজো যে এপার-ওপার, ঈশান বাংলার পুজো, এই স্বীকৃতি যে আপামর বাংলার স্বীকৃতি, আত্মগৌরব প্রচারের ঢক্কানিনাদে তা হারিয়ে গেল। যে ভাষায়, ভাষার দুর্গাপুজো তা ভুলেই মেরে দিলেন কর্তারা। 'স্বৈরতান্ত্রিক রাজতন্ত্র'-এ এমনই হয়। সর্বজনীন উৎসবরের আঙিনা ভরে ওঠে আমিত্বের পুজোর আয়োজনে।